ভূমিকা _
গত কয়েক বছর যাবত রাজনীতির জগতে যে শব্দটিকে আমি সবচে বেশি তাৎপর্যের সাথে উচ্চারিত হতে শুনেছি সেটি হচ্ছে ' ফেসিজম ' । অল্প বয়সে মুসোলিনির কল্যাণে ফেসিজমের প্রতি আমার এক প্রকার ফেসিনেসন জন্মে । মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মানোর কারনে জেনেটিকেল্লি হিটলার , ফেসিজম , নাজিজম এর প্রতি আলাদা মোহ ছিল । কোন সংশয় নেই সেই মোহ ছিল সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও অজ্ঞানতা প্রসূত । ফেসবুক - ব্লগে গত কয়েকবছর যাবত ফেসিজম শব্দটি প্রচুর ব্যাবহার করা হচ্ছে । তেমন কিছু ব্যাবহারকারীদের আমি ' ফেসিজম ' বিষয়টি কি তা ব্যাখ্যা করতে বলেছিলাম । তারা দুই ধরনের উত্তর দিত । ১। আওয়ামীলীগ ফেসিস্ত সরকার , কারন তারা অত্যাচারী ২। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেকারনে হয়েছে তার নাম ফেসিজম ।
সত্যি কথা হল এসব কিন্তু ফেসিজমের কোন সংজ্ঞার পর্যায়েই পড়েনা । যে যার মতো করে সংজ্ঞা তৈরি করে নিচ্ছে ।
সংজ্ঞা যে যার মতো করে যে তৈরি করে নিচ্ছে তার একটা মজার উদাহরণ দেয়া যাক । আমি যে বাসায় থাকি তার ঠিক উপরের তালায় বিএনপিপন্থী একজন রাজনীতিবিদ থাকেন । তার ছয় সাত বছরের একটা মিষ্টি মেয়ে আছে । একদিন ওদের বাসায় যেয়ে দেখি মেয়েটা মন খারাপ করে চুপচাপ বসে আছে । আমি পাশে বসে বললাম , মন খারাপ কেন আপু ? পিচ্চি বলল , আব্বু একটা ফেসিস্ত । আমি কোনোক্রমে আমার মনস্তাত্ত্বিক পতন ঠেকালাম । বললাম , ফেসিস্ত মানে কি ? পিচ্চির উত্তর _ যে খেলনা কিনে দেয় না !
@ ' ফেসিজম ' শব্দের উৎপত্তি ইটালিয়ান শব্দ ' Fascio ' থেকে । যার আভিধানিক অর্থ 'bundle' , 'sheaf' .পরবর্তীতে নানান পরিবর্তন , পরিবর্ধন এর মধ্যে দিয়ে এই শব্দ থেকে জন্ম নেয় ' ফেসিজম ' । ফেসিজমের জন্ম সাল ধরা হয় ১৯১৯ কে । ১৯১৯ সালের ২৩ মার্চ ইতালির মিলান শহরে এক সহিংস কম্যুনিস্ট হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে আবির্ভাব ঘটে ফেসিজমের ।
ফেসিজম নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে পুজিবাদ (capitalism ) নিয়ে কিছু বলে রাখা জরুরি ।
পুজিবাদ __
পুজিবাদ হল এমন একটি কাঠামো যেখানে উৎপাদনের সকল যন্ত্রগুলো কতিপয় ব্যক্তির হাতে থাকে এবং এই পুজিবাদকে কেন্দ্র করে যে সমাজ কাঠামো গড়ে উঠে তাকে পুঁজিবাদী সমাজ বলে । মূলত পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদনের মূল উদ্দেশ্য হল _ মুনাফা । অর্থনীতির একটি সাধারণ সূত্র হল _ পুজি বিনিয়োগ করলে মুনাফা হয় , সেই মুনাফার একটি অংশ যুক্ত হয় মূল পুজির সাথে এভাবে বিনিয়োগের পরিমান বাড়ে , আর বিনিয়োগ বাড়লে মুনাফা আরও বেড়ে যায় । এভাবে মুনাফা ক্রমাগত বাড়তে থাকে । ফলে সমাজের একটি অংশ ফুলে ফেঁপে ধনী হয়ে যায় আর বড় অংশটি ক্রমেই দরিদ্র হতে থাকে । এই দরিদ্র জনগুষ্ঠির অর্থনৈতিক অবস্থা এতোটা খারাপ হয় যে এরা বাজার থেকে খাদ্য , বস্র ও প্রয়োজনীয় উপকরন কিনতে পারেনা । ফলে বাজার অবিক্রিত পণ্যে বোঝাই হয়ে যায় । পণ্য বিক্রি হয়না বলে এরুপ অবস্থায় কলকারখানা গুলোতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় । মালিকদের একাংশ দেউলিয়া হয় আর শ্রমিকরা হয় চাকুরি ছাড়া । পুঁজিবাদী কাঠামোর এরুপ সঙ্কটকে বলে ' ব্যবসা সঙ্কট ' বা ' অর্থনৈতিক মন্দা ' । বছর পাঁচেক আগেও এরকম একটি অর্থনৈতিক মন্দায় বিশ্ব আক্রান্ত হয়েছিল । এরকম অবস্থায় শ্রমিক অসন্তোষ ব্যাপক আকার ধারন করে । শ্রমিকরা পুজিপতিদের হাত থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে শ্রমিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় । (( এই শ্রমিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার বৈজ্ঞানিক পদ্দতির (?) নাম - কম্যুনিজম । )) কিন্তু রাষ্ট্রের পুজিপতিরা তোঁ আর সেটা হতে দিতে পারেনা । তারা তখন শ্রমিকদের শান্ত করার জন্য নানান টেকনিক খুঁজে বের করে ।
যুদ্ধ করে স্বল্পউন্নত , অনুন্নত , অপুজিবাদি দেশ গুলো দখল করে সেখানকার বাজার হাত করা । যেমনটা হয়েছিল ভারতবর্ষে । ব্রিটিশরা ভারতকে তাদের উপনিবেশে পরিনত করেছিল । তাদের বাজার দখল করেছিল এবং নিজেদের পণ্যে উপমহাদেশের বাজার ভর্তি করে ব্রিটিশ শ্রমিকশ্রেণীকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের হাত থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল । কাজেই দেখা যাচ্ছে _ যুদ্ধ এবং উপনিবেশবাদ মূলত পুজিবাদের ফল ।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পৃথিবীর সবচে শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশ ছিল ব্রিটেন , ফ্রান্স । পৃথিবীর তাবত দেশগুলো ছিল তাদের উপনিবেশ । বেশ ভালো ভাবেই তারা বিশ্ব শাসন করে চলছিল । কিন্তু বিপত্তি বাধে গত শতকের শুরুতে জার্মানি ও ইতালির অর্থনৈতিক সম্প্রসারনবাদ এর ফলে । ইতালি এবং জার্মানি পুঁজিবাদী দেশ । আর পুজিবাদের বৈশিষ্ট্য মতে কয়েকবছর পর পরই দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা । ফলে পুনরায় উৎপাদন বন্ধ , শ্রমিক ছাঁটাই । ফলশ্রুতিতে শ্রমিক বিপ্লবের আশংকা । তাই জার্মানি ও ইতালির দরকার । অপুজিবাদি উপনিবেশ । কিন্তু উপনিবেশ তোঁ আর বললেই পাওয়া যায়না । ব্রিটিশ বা ফরাসিরা তাদের দিবে কেন ? কাজেই যুদ্ধ । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ । সৌভাগ্যক্রমে সেই যুদ্ধে ব্রিটিশ ফরাসিরা জয়লাভ করে আর ইতালি - জার্মানি হেরে যায় । এর জের ধরে ১৯১৮ সালে ইতালির শ্রমিকরা দখল করে নেয় ইতালির রাষ্ট্র যন্ত্র । কিন্তু নানা কারনে রাষ্ট্র ক্ষমতায় তারা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনা । ইতালির এই শ্রমিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়েই মূলত ফেসিজমের আত্মপ্রকাশ ।
এক কথায় , ফেসিজম হল পুজিবাদের সর্বচ্চ রূপ । যেখানে পুজিপতিরা ( বুর্জুয়া ) উৎপাদনযন্ত্রের ( কারখানা , জমি , খনি ) উপর নিজেদের ক্ষমতা তিকিয়ে রাখার জন্য শ্রমিকদের বিভক্ত করে এবং শ্রমিকনেতাদের হত্যা করে আন্দোলন দমন করে । এই দমন পীড়ন নীতি চালানোর জন্য বুর্জুয়া গণতান্ত্রিক দেশে পুজিপতিরা এই অত্যাচারী নিপীড়ক গুষ্ঠিকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসায় । ১৯২২ সালে এমন একটি পরিস্থিতে ইতালির ক্ষমতা গ্রহণ করেন বেনিতোঁ মুসলিনি এবং তার ফেসিস্ত পার্টি । যাদের মূল কাজ ছিল শ্রমিক শ্রেণীর উপর নিপীড়ন চালানো এবং উৎপাদন জন্ত্রে বুর্জুয়াদের অধিকার টিকিয়ে রাখা ।
এবার ইতালিতে ফেসিজমের বিস্তারের ঐতিহাসিক কারন সম্পর্কে আলোচনা করা যাক ।
ক্রমাগত ' ব্যবসা সঙ্কটের ' ফলে ইতালির সাধারণ জনগন , শ্রমিক , কৃষক শ্রেণী তখন গভীর হতাশায় নিমজ্জিত ।এর মধ্যে ১৯১৮ , ১৯২৩-২৪ , ১৯২৯ , সালে বার বার শ্রমিক বিপ্লব করেও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে অসফল হয় ইতালিয়ান প্রলেতারিয়াতরা ( সর্বহারা _ সমাজের নিন্ম শ্রেণী , মূলত - শিল্পশ্রমিক ) । ক্রমবর্ধমান শ্রমিক বিপ্লব এবং অন্যদিকে শ্রমিকদের উপর কম্যুনিস্ট রাশিয়ার প্রভাব ইতালিয়ান বুর্জুয়া ( শিল্প মালিক ) দের চিন্তার কারন হয়ে দাড়ায় । ফলে তারা ফেসিস্ত পার্টিকে প্রমট করে ক্ষমতায় বসায় । এই ফেসিস্ত পার্টি মুলত সমাজের পেটিবুর্জুয়া ( মূলত কৃষক , ছোট ব্যবসায়ী ) শ্রেণীর দল । সাধারণ জনগনের হতাসাকে কাজে লাগায় এরা । উগ্র জাতীয়তাবাদ , মৌলবাদ কে প্রমট করে এই পাতি বুর্জুয়া শ্রেণীকে শ্রমিক বিপ্লব হতে পৃথক করে ফেলা হয় । এদের দ্বারাই শায়েস্তা করা হয় শ্রমিক শ্রেণী তথা কম্যুনিস্ট পার্টিকে । এছাড়াও ফেসিজমের বিস্তারে স্তালিন এর ভুল সিদ্ধান্ত এবং ইতালিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টির ' পপুলার ফ্রন্ট ' নীতি বুমেরাঙ্গের মতো কাজ করেছে ।
এর ধারাবাহিকতায় ১৯৩৩ সালে জার্মানির ক্ষমতায় আসে হিটলারের নাৎসি পার্টি । ফেসিজম এবং নাৎসিজমের মধ্যে মূলত মূলগত কোন বেবধান নেই । নাৎসিজম হল ফেসিজমের চরমতম রূপ !
পাদটীকা _
যুদ্ধ , উপনিবেশবাদ , সাম্রাজ্যবাদ , নয়া - উপনিবেশবাদ , ফেসিজম , নাজিজম এসব কিছুই পুজিবাদের ফল । আমরা একটা শক্ত পুজিবাদী বিশ্বতে বাস করি । গত শতক থেকে বর্তমান শতক পর্যন্ত যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে তার প্রধান কারন ছিল পুজিবাদ । এখন আমাদের ভেবে দেখার সময় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা কেমন সমাজ দিয়ে যাব । ভেবে দেখার সময় আমরা কোন পথে হাঁটবো । সংস্কার নাকি যুদ্ধ ?