somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফেসিজম কি ?

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ভূমিকা _

গত কয়েক বছর যাবত রাজনীতির জগতে যে শব্দটিকে আমি সবচে বেশি তাৎপর্যের সাথে উচ্চারিত হতে শুনেছি সেটি হচ্ছে ' ফেসিজম ' । অল্প বয়সে মুসোলিনির কল্যাণে ফেসিজমের প্রতি আমার এক প্রকার ফেসিনেসন জন্মে । মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মানোর কারনে জেনেটিকেল্লি হিটলার , ফেসিজম , নাজিজম এর প্রতি আলাদা মোহ ছিল । কোন সংশয় নেই সেই মোহ ছিল সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও অজ্ঞানতা প্রসূত । ফেসবুক - ব্লগে গত কয়েকবছর যাবত ফেসিজম শব্দটি প্রচুর ব্যাবহার করা হচ্ছে । তেমন কিছু ব্যাবহারকারীদের আমি ' ফেসিজম ' বিষয়টি কি তা ব্যাখ্যা করতে বলেছিলাম । তারা দুই ধরনের উত্তর দিত । ১। আওয়ামীলীগ ফেসিস্ত সরকার , কারন তারা অত্যাচারী ২। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেকারনে হয়েছে তার নাম ফেসিজম ।

সত্যি কথা হল এসব কিন্তু ফেসিজমের কোন সংজ্ঞার পর্যায়েই পড়েনা । যে যার মতো করে সংজ্ঞা তৈরি করে নিচ্ছে ।

সংজ্ঞা যে যার মতো করে যে তৈরি করে নিচ্ছে তার একটা মজার উদাহরণ দেয়া যাক । আমি যে বাসায় থাকি তার ঠিক উপরের তালায় বিএনপিপন্থী একজন রাজনীতিবিদ থাকেন । তার ছয় সাত বছরের একটা মিষ্টি মেয়ে আছে । একদিন ওদের বাসায় যেয়ে দেখি মেয়েটা মন খারাপ করে চুপচাপ বসে আছে । আমি পাশে বসে বললাম , মন খারাপ কেন আপু ? পিচ্চি বলল , আব্বু একটা ফেসিস্ত । আমি কোনোক্রমে আমার মনস্তাত্ত্বিক পতন ঠেকালাম । বললাম , ফেসিস্ত মানে কি ? পিচ্চির উত্তর _ যে খেলনা কিনে দেয় না !



@ ' ফেসিজম ' শব্দের উৎপত্তি ইটালিয়ান শব্দ ' Fascio ' থেকে । যার আভিধানিক অর্থ 'bundle' , 'sheaf' .পরবর্তীতে নানান পরিবর্তন , পরিবর্ধন এর মধ্যে দিয়ে এই শব্দ থেকে জন্ম নেয় ' ফেসিজম ' । ফেসিজমের জন্ম সাল ধরা হয় ১৯১৯ কে । ১৯১৯ সালের ২৩ মার্চ ইতালির মিলান শহরে এক সহিংস কম্যুনিস্ট হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে আবির্ভাব ঘটে ফেসিজমের ।

ফেসিজম নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে পুজিবাদ (capitalism ) নিয়ে কিছু বলে রাখা জরুরি ।

পুজিবাদ __

পুজিবাদ হল এমন একটি কাঠামো যেখানে উৎপাদনের সকল যন্ত্রগুলো কতিপয় ব্যক্তির হাতে থাকে এবং এই পুজিবাদকে কেন্দ্র করে যে সমাজ কাঠামো গড়ে উঠে তাকে পুঁজিবাদী সমাজ বলে । মূলত পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদনের মূল উদ্দেশ্য হল _ মুনাফা । অর্থনীতির একটি সাধারণ সূত্র হল _ পুজি বিনিয়োগ করলে মুনাফা হয় , সেই মুনাফার একটি অংশ যুক্ত হয় মূল পুজির সাথে এভাবে বিনিয়োগের পরিমান বাড়ে , আর বিনিয়োগ বাড়লে মুনাফা আরও বেড়ে যায় । এভাবে মুনাফা ক্রমাগত বাড়তে থাকে । ফলে সমাজের একটি অংশ ফুলে ফেঁপে ধনী হয়ে যায় আর বড় অংশটি ক্রমেই দরিদ্র হতে থাকে । এই দরিদ্র জনগুষ্ঠির অর্থনৈতিক অবস্থা এতোটা খারাপ হয় যে এরা বাজার থেকে খাদ্য , বস্র ও প্রয়োজনীয় উপকরন কিনতে পারেনা । ফলে বাজার অবিক্রিত পণ্যে বোঝাই হয়ে যায় । পণ্য বিক্রি হয়না বলে এরুপ অবস্থায় কলকারখানা গুলোতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় । মালিকদের একাংশ দেউলিয়া হয় আর শ্রমিকরা হয় চাকুরি ছাড়া । পুঁজিবাদী কাঠামোর এরুপ সঙ্কটকে বলে ' ব্যবসা সঙ্কট ' বা ' অর্থনৈতিক মন্দা ' । বছর পাঁচেক আগেও এরকম একটি অর্থনৈতিক মন্দায় বিশ্ব আক্রান্ত হয়েছিল । এরকম অবস্থায় শ্রমিক অসন্তোষ ব্যাপক আকার ধারন করে । শ্রমিকরা পুজিপতিদের হাত থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে শ্রমিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় । (( এই শ্রমিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার বৈজ্ঞানিক পদ্দতির (?) নাম - কম্যুনিজম । )) কিন্তু রাষ্ট্রের পুজিপতিরা তোঁ আর সেটা হতে দিতে পারেনা । তারা তখন শ্রমিকদের শান্ত করার জন্য নানান টেকনিক খুঁজে বের করে ।

যুদ্ধ করে স্বল্পউন্নত , অনুন্নত , অপুজিবাদি দেশ গুলো দখল করে সেখানকার বাজার হাত করা । যেমনটা হয়েছিল ভারতবর্ষে । ব্রিটিশরা ভারতকে তাদের উপনিবেশে পরিনত করেছিল । তাদের বাজার দখল করেছিল এবং নিজেদের পণ্যে উপমহাদেশের বাজার ভর্তি করে ব্রিটিশ শ্রমিকশ্রেণীকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের হাত থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল । কাজেই দেখা যাচ্ছে _ যুদ্ধ এবং উপনিবেশবাদ মূলত পুজিবাদের ফল ।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পৃথিবীর সবচে শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশ ছিল ব্রিটেন , ফ্রান্স । পৃথিবীর তাবত দেশগুলো ছিল তাদের উপনিবেশ । বেশ ভালো ভাবেই তারা বিশ্ব শাসন করে চলছিল । কিন্তু বিপত্তি বাধে গত শতকের শুরুতে জার্মানি ও ইতালির অর্থনৈতিক সম্প্রসারনবাদ এর ফলে । ইতালি এবং জার্মানি পুঁজিবাদী দেশ । আর পুজিবাদের বৈশিষ্ট্য মতে কয়েকবছর পর পরই দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা । ফলে পুনরায় উৎপাদন বন্ধ , শ্রমিক ছাঁটাই । ফলশ্রুতিতে শ্রমিক বিপ্লবের আশংকা । তাই জার্মানি ও ইতালির দরকার । অপুজিবাদি উপনিবেশ । কিন্তু উপনিবেশ তোঁ আর বললেই পাওয়া যায়না । ব্রিটিশ বা ফরাসিরা তাদের দিবে কেন ? কাজেই যুদ্ধ । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ । সৌভাগ্যক্রমে সেই যুদ্ধে ব্রিটিশ ফরাসিরা জয়লাভ করে আর ইতালি - জার্মানি হেরে যায় । এর জের ধরে ১৯১৮ সালে ইতালির শ্রমিকরা দখল করে নেয় ইতালির রাষ্ট্র যন্ত্র । কিন্তু নানা কারনে রাষ্ট্র ক্ষমতায় তারা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনা । ইতালির এই শ্রমিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়েই মূলত ফেসিজমের আত্মপ্রকাশ ।

এক কথায় , ফেসিজম হল পুজিবাদের সর্বচ্চ রূপ । যেখানে পুজিপতিরা ( বুর্জুয়া ) উৎপাদনযন্ত্রের ( কারখানা , জমি , খনি ) উপর নিজেদের ক্ষমতা তিকিয়ে রাখার জন্য শ্রমিকদের বিভক্ত করে এবং শ্রমিকনেতাদের হত্যা করে আন্দোলন দমন করে । এই দমন পীড়ন নীতি চালানোর জন্য বুর্জুয়া গণতান্ত্রিক দেশে পুজিপতিরা এই অত্যাচারী নিপীড়ক গুষ্ঠিকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসায় । ১৯২২ সালে এমন একটি পরিস্থিতে ইতালির ক্ষমতা গ্রহণ করেন বেনিতোঁ মুসলিনি এবং তার ফেসিস্ত পার্টি । যাদের মূল কাজ ছিল শ্রমিক শ্রেণীর উপর নিপীড়ন চালানো এবং উৎপাদন জন্ত্রে বুর্জুয়াদের অধিকার টিকিয়ে রাখা ।

এবার ইতালিতে ফেসিজমের বিস্তারের ঐতিহাসিক কারন সম্পর্কে আলোচনা করা যাক ।

ক্রমাগত ' ব্যবসা সঙ্কটের ' ফলে ইতালির সাধারণ জনগন , শ্রমিক , কৃষক শ্রেণী তখন গভীর হতাশায় নিমজ্জিত ।এর মধ্যে ১৯১৮ , ১৯২৩-২৪ , ১৯২৯ , সালে বার বার শ্রমিক বিপ্লব করেও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে অসফল হয় ইতালিয়ান প্রলেতারিয়াতরা ( সর্বহারা _ সমাজের নিন্ম শ্রেণী , মূলত - শিল্পশ্রমিক ) । ক্রমবর্ধমান শ্রমিক বিপ্লব এবং অন্যদিকে শ্রমিকদের উপর কম্যুনিস্ট রাশিয়ার প্রভাব ইতালিয়ান বুর্জুয়া ( শিল্প মালিক ) দের চিন্তার কারন হয়ে দাড়ায় । ফলে তারা ফেসিস্ত পার্টিকে প্রমট করে ক্ষমতায় বসায় । এই ফেসিস্ত পার্টি মুলত সমাজের পেটিবুর্জুয়া ( মূলত কৃষক , ছোট ব্যবসায়ী ) শ্রেণীর দল । সাধারণ জনগনের হতাসাকে কাজে লাগায় এরা । উগ্র জাতীয়তাবাদ , মৌলবাদ কে প্রমট করে এই পাতি বুর্জুয়া শ্রেণীকে শ্রমিক বিপ্লব হতে পৃথক করে ফেলা হয় । এদের দ্বারাই শায়েস্তা করা হয় শ্রমিক শ্রেণী তথা কম্যুনিস্ট পার্টিকে । এছাড়াও ফেসিজমের বিস্তারে স্তালিন এর ভুল সিদ্ধান্ত এবং ইতালিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টির ' পপুলার ফ্রন্ট ' নীতি বুমেরাঙ্গের মতো কাজ করেছে ।

এর ধারাবাহিকতায় ১৯৩৩ সালে জার্মানির ক্ষমতায় আসে হিটলারের নাৎসি পার্টি । ফেসিজম এবং নাৎসিজমের মধ্যে মূলত মূলগত কোন বেবধান নেই । নাৎসিজম হল ফেসিজমের চরমতম রূপ !

পাদটীকা _

যুদ্ধ , উপনিবেশবাদ , সাম্রাজ্যবাদ , নয়া - উপনিবেশবাদ , ফেসিজম , নাজিজম এসব কিছুই পুজিবাদের ফল । আমরা একটা শক্ত পুজিবাদী বিশ্বতে বাস করি । গত শতক থেকে বর্তমান শতক পর্যন্ত যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে তার প্রধান কারন ছিল পুজিবাদ । এখন আমাদের ভেবে দেখার সময় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা কেমন সমাজ দিয়ে যাব । ভেবে দেখার সময় আমরা কোন পথে হাঁটবো । সংস্কার নাকি যুদ্ধ ?
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×