somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আর্কাইভ থেকে: মারিয়ার জন্য ভালবাসা

২৬ শে মে, ২০২৩ রাত ১০:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



চিত্রগ্রাহকঃ এলেনা কজলোভা। আমি যখন মারিয়াকে দেখি তখন ও ঠিক এই মেয়েটির বয়সী ছিলো। শারীরিক গঠন ও চেহারাতেও মিল আছে। ওর ভাইদের সাথে তোলা দুয়েকটি গ্রুপ ফটো আছে আমার কাছে। কিন্তু সেগুলো শেয়ার করা কিছুতেই শোভন হবে না। হাজার হোক অন্যের পারিবারিক ছবি।


আমার বয়স তখন ছাব্বিশ। ওর বারো। সুতরাং শিরোনাম দেখে কোনওরকম বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। এ ভালবাসা একজন ছোটো বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালবাসা। কিংবা বলা যেতে পারে যে, আমার থেকে বয়সে অনেক ছোটো একজন বন্ধুর প্রতি ভালবাসা। খুব মিষ্টি একটি মেয়ে মারিয়া। ওর বয়সের এতো বিনয়ী লক্ষ্মী মেয়ে আমি আমার এ যাবতকালের জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। বেশ বুঝতে পারছিলাম, আমার সেখানে থাকাতে ওর খানিকটা হলেও অসুবিধা হচ্ছিলো। যতোটা শান্তশিষ্ট নিরীহ শাকের পোকা দেখেছিলাম, ওর বয়সের ছেলেমেয়েদের সাধারণত ওরকম থাকার কথা নয়। নেহায়েত বাইরের একজন লোক থাকাতে অমন সুবোধ বালিকাটি হয়ে থাকতে হয়েছিলো। এছাড়াও ওর বড়ো ভাই বন্ধু ফয়সালও একবার জানিয়েছিলো যে, মারিয়া ভয়ঙ্কর দুষ্টু।

মারিয়া তখন ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ে। হঠাৎ কোনও উপলক্ষ্য ছাড়াই সেবার ওদের বাড়ি বগুড়া থেকে বেড়িয়ে আসি। সে সময় এখানে প্রকাশিত বগুড়ার ডায়েরি শিরোনামের ছোটো লেখাটি ওদের বাড়ি থেকে পোস্ট করা। প্রথম পোস্ট। মনে পড়ছে, দ্বিতীয় দিন ওর নানির চল্লিশার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অটোতে করে প্রায় দু'ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে সাড়িয়াকান্দিতে ওর নানা বাড়ি গিয়েছিলাম। মারিয়া সারা পথ আমার পাশে বসে ছিলো। অটোর সময়টা প্রায় ঘুমিয়েই কাটাই। সবমিলিয়ে আনন্দ হাসি গানে ভরা দারুণ দু’টো দিন কাটিয়েছিলাম ওদের সঙ্গে। মহাস্থানগড়, বেহুলা লক্ষিন্দরের বাসরঘর, প্রেম যমুনার ঘাট, শাহ আলির মাজার ইত্যাদি বগুড়ার দর্শনীয় স্থানগুলো মনের সুখে ঘুড়ে বেড়িয়েছিলাম। প্রেম যমুনার ঘাট ভ্রমণ নিয়েও পৃথক একটি লেখা আছে এখানে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাস। দারুণ শীত পড়েছিলো সেবার বগুড়ায়। আরে সে বছর বিজয় দিবসটাই তো উদযাপন করেছিলাম সেখানে! হা হা হা। ভুলে গিয়েছিলাম।

ঠিক যেদিন ওদের বাড়ি থেকে চলে আসবো সেদিনকার কথা। আমি কাপড়চোপড় মালপত্র গুছিয়ে একেবারে প্রস্তুত বেরোনোর জন্য। ওর বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি। ওর আরেক ভাই খুব সম্ভবত স্কুলে ছিলো, নাহলে খেলতে গিয়েছিলো। ১৮ ই ডিসেম্বর ২০১৪। জানি না বিশেষ কোনও ছুটি ছিলো কিনা সেদিন। মারিয়া বাড়িতেই ছিলো, স্কুল যায়নি। হয়তো কোনও কারণ ছাড়াই স্কুল কামাই। হে হে হে। ওর বড়ো ভাই বন্ধু ফয়সাল ঠিক সে সময়টা বাড়ির বাইরে ছিলো, নাহলে বাথরুমে। অতো পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে নেই। ভিতরের ঘরে ওর মা ছিলো। আমি মারিয়াকে রুমের বাইরে দেখতে পেয়ে ডাকলাম। গেলো রাতে দুষ্টুমি করে বন্ধু ফয়সালের নাক ডাকার ছোটো একটি ভিডিও ধারণ করেছিলাম সেল ফোনে। সেটা দেখানো উদ্দেশ্য।

মারিয়া এলো আমার কাছে। দাঁড়ালো মুখোমুখি। ভীষণ শীর্ণ, দুঃখী চেহারা। বিষাদের মলিন কালো ছায়া সেখানে।

'মারিয়া, দেখো, তোমার ভাইয়া কীভাবে নাক ডাকে, দেখো।' বললাম আমি। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ফোনের ভিডিওটা অন করে দিলাম। রাতের টিভি নিউজের সাথে শুরু হলো ফয়সালের নাক ডাকা। মিনিট খানিক দেখেই হি হি হি করে হেসে উঠলো মারিয়া। মিনিট খানিকই হবে বা সামান্য কিছু বেশি। তারপর দেখলাম যেতে উদ্যত হলো। চোখ দুটো টকটকে লাল। অশ্রু টলমল করছে। আমার দিকে কিছুতেই তাকাতে পারছে না। মাথা নামিয়ে রেখেছে তো রেখেছেই। হঠাৎ ভিডিওটা অসমাপ্ত রেখেই আমাকে ছাড়িয়ে এক পা দু’পা করে যেতে লাগলো। আমি আবার ডাকলাম মারিয়াকে। ‘মারিয়া, দাঁড়াও, আরেকটু বাকি আছে। একটু পর দেখবে, আরও জোরে একদম ব্যাঙের মতো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করে নাক ডাকছে তোমার ভাইয়া। হা হা হা। দেখে যাও।’

কিন্তু মারিয়া দাঁড়ালো না। আসলে ও কিছুতেই চাইছিলো না যে, আমি ওকে কাঁদতে দেখে ফেলি। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, আমার পাশে আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই কেঁদে ফেলতো। ঘটনার আকস্মিকতায় হত বিহ্বল হয়ে পড়ি। এরকম কিছুর জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না। নিছক মজা করার জন্য এসব করা। শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে আমার ভালো লাগে। মারিয়া ঋজু হয়ে শ্লথ পা'য়ে যেতে লাগলো ঘরের দিকে, ওর মা'র কাছে।

না, কিছুই কিছু নয়। দু’দিন ওদের সঙ্গে থাকাতে আমার প্রতি একধরণের ছেলেমানুষি মায়া জন্মেছিলো মারিয়ার অবুঝ শিশু মনে। ও বুঝতে পারছিলো যে, ওদের বাড়ি থেকে চলে গেলে আর কোনওদিন আমাদের দেখা হবে না। মারিয়াই শুধু মেনে নিতে পারছিলো না ব্যাপারটা। আহা, অবুঝ শিশু মন!

তারপর দীর্ঘ সময় কেটে গেছে। মারিয়া নিশ্চয়ই আজ আর সেদিনের সেই ছোট্ট শিশুটি নেই। ও এখন পনেরো ষোলো বছরের কিশোরী। হয়তো আমার কথা, সেদিনের কথা আজ আর মনে নেই ওর। না থাকাই স্বাভাবিক। যা হোক আজ এ সামান্য লেখার মাধ্যমে মারিয়ার প্রতি, আমার সেই ছোট্ট বন্ধুর প্রতি, হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে গভীর ভালবাসা জানাচ্ছি। দারুণ রোমাঞ্চকর উপভোগ্য সে উজ্জ্বল ভ্রমণের কথা আজ যখনই কোনও অবসরে ভাবি, তখন সবার আগে আমার মনে পড়ে যায় মারিয়াকেই। সেই ফেরার দিন ওর সঙ্গে কাটানো তীব্র মুহূর্তেগুলোর স্মৃতি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০২৩ রাত ৮:৩৭
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

পঁচে যাওয়া বাংলাদেশ আর্মি

লিখেছেন রিয়াজ হান্নান, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:২৫


একটা দেশের আর্মিদের বলা হয় দেশ রক্ষা কবজ,গোটা দেশের অব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে বহিরাগত দুশমনদের আতংকের নাম। ছোটবেলা থেকে এই ধারণা নিয়ে কয়েকটা জেনারেশন বড় হয়ে উঠলেও সেই জেনারেশনের কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×