বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম যাচ্ছি। চট্রগ্রাম মেইল। নাইট ট্রেন। সেবার অদ্ভুত যাত্রী উঠেছিলো। ইয়ং ছেলে। আনুমানিক বাইশ তেইশ বছর বয়স। দুধে আলতা রঙ। হৃষ্টপুষ্ট গঠন। টানা টানা ভীষণ মায়া ভরা চোখ। একেবারে সিনেমার হিরোদের মতো দেখতে। চেহারাসুরত দিয়ে দিব্যি আমেরিকান ইউরোপিয়ান বলে চালানো যাবে। শুধুমাত্র নোংরা টিশার্ট লুঙ্গি আর লক্করঝক্কর পুরাতন ট্রেন সে যাত্রায় নিশ্চিত করেছিলো বিদেশি নয় ভূমিপুত্র খাটি। হা হা হা।
বিভিন্ন স্টেশনে যাত্রী নেমে গেলে এক পর্যায়ে হালকা হয়ে এলো কামরা। ছেলেটার পাশের যাত্রী ওয়াশরুম থেকে এসে দেখলো, তিন সিট জুড়ে আরাম করে শুয়ে আছে। ভদ্রলোক কাঁধে আলতো স্পর্শ করে সিটে বসার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। এ সময় বিপত্তি। ছেলেটি বললো, ‘ভাই আপনি কিছুক্ষণ পরে আসেন।’ সিট ছেড়ে দিতে অপারগতা প্রকাশ করলো সে। মুখোমুখি দেখছিলাম। কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো যাত্রী। মুহূর্তকাল লাগলো ধাতস্থ হতে। তারপর বিরক্তির সাথে বললো, ‘এইডা কেমুন কথা কইতাছেন! আপনে ইয়ং পোলা। আমার থেইকা পনেরো বিশ বছরের ছোটো। হুইয়া থাকনের লাইগা আমারে কইতাছেন খাঁড়ায় যাইতে!’ রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে অনিচ্ছার সাথে উঠে বসলো ছেলেটি। বুঝতে পেরেছে, যাত্রী মহোদয় এ সুবিধা দিবে না তাকে।
ঘটনা আরও আছে। কামরার সিটগুলো তিন সিটের। কিন্তু ভিড় বেশি আর স্বাস্থ্যবান যাত্রী না হলে চার জনও বসে। ভোরের দিকে এক পিতাপুত্র এলো। ষাটের কাছাকাছি বয়স পিতার। এসে ছেলেটিকে অনুরোধ করলো, সামান্য চেপে বসে জায়গা করে দিতে। তৎক্ষনাৎ বিরক্তিভরে অস্বীকৃতি জানালো সে। চেপে বসতে পারবে না। লোকটার ছেলে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলো। বললো, ‘বয়ষ্ক লোক বসতে চাচ্ছে। কেন পারবেন না! আর লোকজন বসছে না।’ কিন্তু সে সিদ্ধান্তে অটল। তপ্ত বাক্য বিনিময় হলো। প্রায় মারামারিতে জড়ানোর মতো পরিস্থিতি। প্রবীণ ভদ্রলোক এ সময় ছেলেকে শান্ত করলো। বললো, ‘এর সাথে কথা বলে লাভ নেই। এ মানুষই না। বাদ দাও।’
ছেলেটি খুব সম্ভবত ফেনীতে নেমে গিয়েছিলো। ঠিক তখনই পরিষ্কারভাবে লক্ষ্য করলাম, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী সে। পা দুটোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়নি বা কোনও কারণে কাটা পড়েছিলো। ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। (লুঙ্গি পরায় কামরার ভিতর সেভাবে বুঝতে পারিনি।) অল্প উচ্চতার শরীর কেমন ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো প্লাটফর্মে। খুব মায়া হলো দেখে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ১২:১৪