হারুন ভাইকে আমি চিনি আজ প্রায় ১৪ বছর হলো। কালো, বড় বড় মায়াভরা চোখ আর মুখে লাজুক হাসি, হারুন ভাইয়ের চিরায়িত রুপ! চৌদ্দ বছর ধরে তিনি আমাদের পারিবারিক টেইলর। পারিবারিক বলছি একারণে যে, আমাদের পরিবারের সকলের জামা কাপড় তাঁর কাছেই বানাতাম। বানাতাম বলছি কেন? কেন এখন আর বানাই না? আসলে জামা বানানোর ১৪ বছরের পথটি আজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিভাবে? বলছি ....................
রাঁধুনী আসেনি আজকে, মধ্যাহ্ন বিরতিতে তাই বাসা্য় অনেক কাজ, রান্না, গোসল, খাওয়া......... দেরী করলে আবার অফিসে ঝারি! ধুপধাপ কাজের ফাঁকে দেখলাম ছোটবোনের তিনটা মিসকল, ভাবলাম নিশ্চয় কোনো ভালো খবর আছে, তাই আমাকে জানানোর জন্য এত ব্যস্ত .................
কোনোরকমে বাসা থেকে বের হয়েই ছোটবোনকে ফোন দিলাম। ভাবলাম হ্য়ত ওর অফিসের কোনো এক্সাইটিং কিছু শুনবো, কিন্তু শুনতে হলো, "একটা খারাপ খবর আছে !" দ্রুত চিন্তা করছি কি ধরনের খারাপ খবর হতে পারে? অফিসে গন্ডগোল? মামুনির শরীর কি হঠাৎ বেশী খারাপ হয়ে গেলো? নাকি নতুন কোনো বিপদ এসে ভর করেছে আমাদের উপর? আমার সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে আমার বোন কাঁদতে কাঁদতে বললো, "হারুন ভাই আজকে সকাল দশটায় মারা গেছেন।" আমি দাড়িয়ে পড়লাম। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
হারুন ভাই না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আর কোনোদিন তাঁর হাসিমাখা মুখটা দেখবো না, আপা ডাকটা শুনবো না ভাবতেই আমার দুচোখ ছাপিয়ে শুধু কান্না আসছে......... অনেক মানুষ দেখেছি জীবনে, উনার মত মানুষ দেখি নাই। এক রাগহীন অমায়িক মানুষ ছিলেন তিনি। কত সময় কত রাগ করতাম, কোনদিন উনি আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি, মুখের উপর পাল্টা উত্তর দেননি। সব অভিযোগ মাথা নত করে হাসিমুখে শুনতেন। আমার ছোট বোনের বর সব সময় বলত, "হারুন ভাই সব সময় আপনাদের জামা বানাতে ভুল করে, তারপরও আপনারা উনার কাছেই জামা বানাবেন! আর হারুন ভাই এত বছর ধরে জামা বানায়, তারপরও ভুল করে! আপনারাও আজব, আর হারুন ভাই ও আজব!" আসলেই হারুন ভাইয়ের কাছে জামা বানাতে দিলে কোথাও না কোথাও তিনি একটু ভুল করতেনই, আমরা অল্টার করাতাম, রাগ করতাম, কিন্তু ওনার কাছেই ড্রেস বানাতাম। কারণ ছিলো ওনার আন্তরিকতা! দোকানে গেলেই ব্যস্ত হয়ে টুলটা বের করে দিতেন বসার জন্য, কয়েকদিন না গেলেই ফোন করতেন, আপা রাগ করেছেন, জামা বানাবেন না? আর ভুল হবে না আপা। ঈদ কিংবা যেকোনো অনুস্ঠানের আগের দিনও আমরা নিশ্চিন্ত মনে কাপড় নিয়ে উপস্থিত হতাম, জানতাম হারুন ভাই একটা ব্যবস্থা করে ফেলবেন।এমনও হয়েছে, ঈদের আগেরদিন ড্রেস বাসায় পৌঁছে দিয়ে গিয়েছেন। মানুষের প্রশংসা কুড়ানো আমাদের সুন্দর সুন্দর জামাগুলোতো তাঁরই মমতার ফসল। আমি দেশের বাইরে থাকার সময়ও তাঁর কাছ থেকেই ড্রেস বানিয়েছি। আমাদের বন্ধুবান্ধব, আত্মী্য়স্বজন সবাই হারুন ভাইকে চিনত, উনার কাছে ড্রেস বানাতে চাইত। শুধু আমাদের সাথেই না, অন্যদের সাথেও তিনি এমনি আন্তরিক ব্যবহার করতেন। ওনার মত মানুষ আজকালকার দিনে পাওয়া ভার!
হারুন ভাইয়ের মৃত্যুতে একটা বড় ধাক্কা খেলাম আজকে। উনিতো আমাদের কোনো আত্মী্য় না , কিন্তু মনে হচ্ছে যেন আমার খুব ঘনিস্ঠ আত্মী্য়ই মারা গেছেন। আমার বোন জরুরী একটা মিটিং ক্যানসেল করেছে, বলেছে, "আমার আত্মীয় মারা গিয়েছে!" বুঝলাম, মানুষের মনে দাগ কাটার জন্য অনেক লেখাপড়া করতে হয় না, বড় অফিসার হতে হয়না । সাধারণ হয়েও অসাধারণ হওয়া যায়! এই যে, আজকে আমি কাঁদছি উনার আন্তরিকতা আর বিনম্রতার জন্য! আমি কালকে মারা গেলে আমার জন্য কেউ কাঁদবে না, আমার অনেক দোষ, সবচেয়ে বড় দোষ হলো আমার অনিয়ন্ত্রিত রাগ! আজকে খুব আপনার মত হতে ইচ্ছে করছে হারুন ভাই, রাগহীন। অনেক সময় অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি আপনার সাথে, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন কেনো হারুন ভাই? ক্ষনস্থায়ী এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থায়ী না, আর যা কিছু ভালো, তাও যেনো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়.....ভালো মানুষগুলোও হারিয়ে যায় সময়ের আগে......কত মানুষ কতবছর বেঁচে থাকে, আপনার এত তাড়া কিসের? এখন আমাদের কে জামা বানিয়ে দিবে? কে আপনার মত আপা বলে দৌড়ে আসবে, বলেন তো? আমি আপনার জন্য আল্লাহর কাছে নামাজ পড়ে দোয়া করেছি, আল্লাহ যেনো আপনাকে ক্ষমা করেন এবং বেহেশত নসীব করেন, আর আমাকে যেনো আপনার একটা গুন দেন, রাগ না করে যেন আপনার মত হাসিমুখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারি।
আর একটা কথা, আমার এই ভাইটা আজকে দুনিয়া থেকে চলে গিয়েছেন, কবরে তাঁর প্রথম রাত, আপনারাও দোয়া করবেন, যেন তাঁর কবরের আজাব মাফ হয়। তাঁর পরিবার যেনো এই ক্ষতি কাটিয়ে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:১৫