পোর্ট স্ট্রীট, ম্যানচেস্টার, ইংল্যান্ড। ১৮১৭ সাল।
হালকা ধূসর ধুলোতে ঢাকা পোর্ট স্ট্রীটের রাস্তা। গলির দু’ধার দিয়ে প্রসস্ত বিল্ডিং। রাস্তার ঠিক মাথায় দাঁড়ানো রয়েছে একটি ঘোড়ার গাড়ী। গাড়োয়ানের মাথায় লম্বা বাঁকানো টুপি। চোখে কালো চমশা। গলিতে ঢুকতে হাতের বাম দিকের প্রথম দালানের নীচে দাঁড়িয়ে ৩ ভদ্রলোক কোনো বিষয়ে শলা পরামর্শ করছেন। তার ঠিক পাশেই লাল ইটের দালানের দেয়ালে গা ঘেঁষে ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন একজন মহিলা ভিক্ষুক। ঘড়িতে ঠিক দুপুর দুটো। মিসেস হান্টার এই রাস্তা ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন ৩৫ নম্বর পোর্ট স্ট্রীটের বাড়িতে। ভদ্র মহিলার বয়স আন্দাজ ২৫ কি ৩০ হবে। গায়ের গড়ন মাঝারি গোচের। চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। চেহারা দেখলে সহজেই বোঝা যায় গত কয়েকদিন ভালো ঘুম হয়নি। সুউচ্চ নাকের ডগা বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। স্বাভাবিকের তুলনায় একটু দ্রুত হেটে চলছেন মিসেস হান্টার। যে কারও দেখলে মনে হবে ভদ্র মহিলার খুবই তাড়া আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিসেস হান্টার এসে দাড়ালেন পোর্ট স্ট্রীটের ৩৫নং বাড়ীর গেইটে। গেইটের সামনে বড়ো বড়ো গাঢ় সোনালী অক্ষরে লেখা ৩৫। বাড়ীর সামনের প্রশস্ত কাঠের দরজায় কয়েকবার কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে বেড়িয়ে এলেন একজন ভদ্রলোক। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মাথার চুল হালকা বাদামি রঙের। চোখেমুখে পূর্ণ গাম্ভীর্যের ছাপ। পোশাক-আশাকে একজন পেশাদারীত্বের ছাপ সহজেই ফুটে উঠছে। ভদ্রলোকের বয়স বোধ করি ৪২-৪৫-এর মধ্যে হবে। ভদ্রলোক চশমার কাঁচ দিয়ে তীক্ষè দৃষ্টে তাকালেন মিসেস হান্টারের দিকে। গম্ভীর গলায় বললেন-
- কাকে চাই?
- আমি যদি ভুল না করে থাকি। আপনি নিশ্চই মিস্টার হেরি উইলসন।
- হ্যা, ঠিক ধরেছেন। আপনি?
- আমি মিসেস হান্টার।
- ও মিসেস হান্টার। আপনি এসে গেছেন। আপনার সাথেতো দুপুর দুটোর সময় লেডি লুইস কার্টারের সাথে সাক্ষাত ছিল।
- হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আমি কী ভিতরে আসতে পারি?
- হ্যাঁ, অবশ্যই। আসুন। আপনার জন্যইতো ম্যাডাম অপেক্ষায় রয়েছেন।
মিসেস হান্টার দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন।
- আপনি বসুন। আমি ম্যাডামকে ডেকে দিচ্ছি।
মি. হেরি উইলসন একজন তীক্ষè প্রখর বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। ছোটবেলা থেকে রহস্য অনুসন্ধানের দিকে তার প্রবল আগ্রহ। সেই আগ্রহের সুবাদেই দীর্ঘদিন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর হিসেবে কাজ করেছেন। দেশে সম্মানও কুড়িয়েছেন যথেষ্ট কিন্তু তাতে তিনি খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার আগ্রহ বিশ্বখ্যাত কোনো ডিকেটটিভের সহযোগী হয়ে ইতিহাসের পাতায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকা। পাশাপাশি এ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞানার্জন। মি. হেরি উইলসন একজন খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ কিন্তু অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে তিনি প্রচন্ড রকম চঞ্চল ও উদগ্রীব। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নিতে পারেন। সত্যান্বেশনের ক্ষেত্রে তার মতো আগ্রহীর জুরি মেলা ভার। ডিটেকটিভ হিসেবে দেশে-বিদেশে বিভিন্নভাবে মিসেস লুইস কার্টারের অসীম কৃতিত্বের কথা শুনেছিলেন তিনি। তাই একরকম উদগ্রীব হয়েই তার সহযোগী হিসেবে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন। সেই ইন্টারভিউও ছিল তার জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সে কথা মি. হেরি কখনোই ভুলতে পারবেন না। দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় শ’খানেই প্রার্থী এসেছিল ইন্টারভিউ দিতে। তার মধ্য থেকে লেডি লুইস কার্টার মি. হেরিকেই বেছে নিয়েছিলেন। লেডি কার্টারের ব্যক্তিগত অনুসন্ধানকৃত ২টি ছায়া কেইস মাস খানিকের মধ্যে হাতে কলমে সলব করার কথা ছিল প্রার্থীদের। ঘটনার সকল তথ্য, উপাত্ত ও প্রয়োজনীয় আনুসাঙ্গিক সকল বিষয়ই প্রার্থীদেরকে অভিহিত করা হয়েছিল। শ’খানেক প্রার্থীর মধ্যে মি. হ্যারি উইলসন ব্যতিত কেউই এই দু’টি কেইসের একটিরও সঠিক সমাধান করতে সক্ষম হননি। মি. হ্যারি উইলসন কেইস দুটিকে খুব ভালোভাবেই সমাধান করতে পেরেছিলেন। এর জন্য তার উপর মাস খানেক প্রচন্ড ধকল গিয়েছিল। দিন-রাত, নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েই অনুসন্ধান চালিয়ে গিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে লেডি কার্টারের মতো একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভের সহযোগী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। সত্যিইতো এই রকম সৌভাগ্য কয়জনের ভাগ্যেই বা জুটে। ইচ্ছা আর সঠিক শ্রম মানুষের জীবনকে নিয়ে যায় প্রাপ্তির সব্বোর্চ শিখরে। তাই লক্ষ অর্জনের জন্য মেধার সাথে সাথে নিরলস শ্রমটাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
মিসেস হান্টার সোফায় বসে প্রথমে ঘরের চারপাশে একটু তাকালেন। কাঠের মেঝেতে মোটা পুরু দামি নকশি করা কার্পেট। সামনে বড়ো বড়ো প্রশস্ত তিনটে জানালা। জানালায় বেশ দামি পর্দা ঝুলানো রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ঘর থেকে বাহিরের দৃশ্য সহেজই দেখা যাচ্ছে। ঘরের দেয়ালগুলো হালাকা সাদা ও কালচে বর্ণের। দেয়ালে কিছু পোর্টরেইট লাগানো রয়েছে। সম্ভবত বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড ও সার্টিফিকেটের পোর্টরেইট। অন্য সময় হলে হয়তো মিসেস হান্টার সেগুলোকে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখতে যেতেন কিন্তু এখন সেগুলো দেখার প্রতি তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। মিনিট খানেকের মধ্যে উপরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন লেডি লুইস কার্টার সাথে তার সহযোগী মি. হেরি উইলসন।
লেডি লুইস কার্টার দেখতে দশজন নারীর চেয়ে একটু আলাদা। তার চোখেমুখে ব্যক্তিত্বের স্পষ্ট ছাপ। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ;è মনে হয় যেন ঈগলের দৃষ্টি। ঈগল যেমন শতফুট ওপর থেকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যকে দেখ পায়। ঠিক তেমনি লেডি লুইস কার্টারও একজন ঈগল দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ। এক দৃষ্টিতে মনে হয় আপাদমস্তক পর্যবেক্ষন করে নেন। মানুষের চোখ দেখে তার মনের ভাষা পড়ে ফেলার এক অদ্ভূত ক্ষমতা রয়েছে তার মধ্যে। মানুষ ও প্রাণীদের মনোজগত নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছেন। তাই সাইকোলজীতেও তার যথেষ্ট দখল রয়েছে। দূরদষ্টি ও পর্যবেক্ষন ক্ষমতায় তিনি অনন্য।
ছোট বেলা থেকেই একজন প্রখর মেধাসম্পন্ন মানুষ মিস লুইস কার্টার। প্রাইভেট ডিকেটটিভ হিসেবে সারা দেশে তার জুড়ি মেলা ভার। প্রখর মেধা ও আনসলব মিষ্ট্রি কেইসের রহস্য উন্মোচনের জন্য তার খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে গিয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড থেকে ল’তে সব্বোর্চ ডিগ্রি লাভ করেছেন। তথাপি ম্যাথাম্যাটিকসে তার দখল অগাধ। সময় পেলেই খাতা কলম নিয়ে বসে যান ম্যাথ সলব করতে। ফিবোনাচ্চি রাশি মালা ও সংখ্যাতত্ত্বে তার বিশেষ দখল রয়েছে। কেইসের সঠিক তথ্য অনুসন্ধান ও তার সমাধান খুঁজে পেতে প্রায়ই তিনি এই বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োগ করে থাকেন। সন্দেহ তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। তবে সন্দেহ দূরা করা তার চেয়েও বড়ো বাতিক। পেশার সাথে নিবিড় সম্পর্ক ও এহেন বাতিকের ফলে পেশার বাইরে অন্য কিছুর চিন্তার সুযোগ হয়নি মিসেস লুইস কার্টারের। কেইস যত জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে তার মস্তিঙ্ক ততই জেগে উঠে। তিনি ততই উন্মাদের মতো তার মস্তিঙ্ককে জাগিয়ে তোলেন। মস্তিঙ্কের কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য তিনি এক বিশেষ ধরনের ড্রাগ সেবন করে থাকেন। অর্থের চেয়ে পেশাদারিত্ব তার কাছে বড়ো।
প্রতিটা মূহূর্তে তিনি তার বুদ্ধিমত্তার সাথে যুদ্ধ করে যান। প্রতিটি জটিল কেইসে তিনি তার পূর্ববর্তী বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যেতে চান।
মিসেস হান্টারকে দেখে প্রথমে অভিবাদন জানালেন লেডি লুইট কার্টার। তারপর মিসেস হান্টারের মুখোমুখি সোফায় বসে পড়লেন।
- কী বলব মিসেস হান্টার। আপনাকে দেখে প্রচন্ড উদগ্রীব, হতাশ আর দুর্বিসহ লাগছে। কীভাবে হলো এসব?
- গতকাল আপনাকে ফোনেতো সব কিছু বিস্তারিত বলতে পারিনি। আজ সকল কিছু বিস্তারিত জানাবো।
- হ্যাঁ, আপনি আমাকে সব কিছু খুলে বলুন। যা আছে সব। দয়া করে কোনো কিছু বাদ রাখবেন না বা লুকোবেন না। আপাত দৃষ্টিতে যেটিকে আপনার কাছে খুব সামান্য বলে মনে হচ্ছে সেটিও আমাকে জানাবেন।
- জ্বী, অবশ্যই জানাব। এই বিপদে আপনিই আমার একমাত্র সঙ্গী।
কথা বলতে বলতে ভদ্র মহিলা কেঁদে দিচ্ছিলেন। আবেগজড়িত কণ্ঠে মিস লুইস কার্টারের হাত জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন।
- আপনিই পারেন আমাকে সাহায্য করতে। পুলিশকে আমি আর বিশ্বাস করতে পারছি না। গত ক’মাস ধরে কী দুর্বিসহ যন্ত্রণায় যে আমি দিনাতিপাত করছি তা আমিই জানি। আমার এ কষ্ট বুঝবার মতো কেউ নেই। আমি পত্র-পত্রিকায়, টেলিভিশনে আপনার ভূয়সী প্রশংসা শুনেছি। আপনার মতো ডিটেকটিভের সাক্ষাৎ পাবো আশা করিনি। আমার এ দুঃসময়ে আপনার সাহায্য পেয়ে আমার সত্যিই ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে একমাত্র আপনিই আমাকে এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারবেন- বলে রুমালে চোখের জল মুছছিলেন মিসেস হান্টার।
-আচ্ছা, আপনি এতো কান্না করবেন না। আমিতো আছি। দেখি আপনার জন্য কতটুকু করতে পারি। তবে আপনার কেসটা মনে হচ্ছে যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং হবে। গতকাল ফোনে যতটুকু বলেছিলেন তাতেই আমার কিছুটা আন্দাজ করা হয়ে গেছে। ফোনেতো আর সব বলা যায় না। আপনি কান্না বন্ধ করে চোখ মুছে পুরো ঘটনাটি খুলে বলুন।
চলবে..।
পোর্ট স্ট্রীট, ম্যানচেস্টার, ইংল্যান্ড। ১৮১৭ সাল।
হালকা ধূসর ধুলোতে ঢাকা পোর্ট স্ট্রীটের রাস্তা। গলির দু’ধার দিয়ে প্রসস্ত বিল্ডিং। রাস্তার ঠিক মাথায় দাঁড়ানো রয়েছে একটি ঘোড়ার গাড়ী। গাড়োয়ানের মাথায় লম্বা বাঁকানো টুপি। চোখে কালো চমশা। গলিতে ঢুকতে হাতের বাম দিকের প্রথম দালানের নীচে দাঁড়িয়ে ৩ ভদ্রলোক কোনো বিষয়ে শলা পরামর্শ করছেন। তার ঠিক পাশেই লাল ইটের দালানের দেয়ালে গা ঘেঁষে ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন একজন মহিলা ভিক্ষুক। ঘড়িতে ঠিক দুপুর দুটো। মিসেস হান্টার এই রাস্তা ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন ৩৫ নম্বর পোর্ট স্ট্রীটের বাড়িতে। ভদ্র মহিলার বয়স আন্দাজ ২৫ কি ৩০ হবে। গায়ের গড়ন মাঝারি গোচের। চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। চেহারা দেখলে সহজেই বোঝা যায় গত কয়েকদিন ভালো ঘুম হয়নি। সুউচ্চ নাকের ডগা বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। স্বাভাবিকের তুলনায় একটু দ্রুত হেটে চলছেন মিসেস হান্টার। যে কারও দেখলে মনে হবে ভদ্র মহিলার খুবই তাড়া আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিসেস হান্টার এসে দাড়ালেন পোর্ট স্ট্রীটের ৩৫নং বাড়ীর গেইটে। গেইটের সামনে বড়ো বড়ো গাঢ় সোনালী অক্ষরে লেখা ৩৫। বাড়ীর সামনের প্রশস্ত কাঠের দরজায় কয়েকবার কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে বেড়িয়ে এলেন একজন ভদ্রলোক। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মাথার চুল হালকা বাদামি রঙের। চোখেমুখে পূর্ণ গাম্ভীর্যের ছাপ। পোশাক-আশাকে একজন পেশাদারীত্বের ছাপ সহজেই ফুটে উঠছে। ভদ্রলোকের বয়স বোধ করি ৪২-৪৫-এর মধ্যে হবে। ভদ্রলোক চশমার কাঁচ দিয়ে তীক্ষè দৃষ্টে তাকালেন মিসেস হান্টারের দিকে। গম্ভীর গলায় বললেন-
- কাকে চাই?
- আমি যদি ভুল না করে থাকি। আপনি নিশ্চই মিস্টার হেরি উইলসন।
- হ্যা, ঠিক ধরেছেন। আপনি?
- আমি মিসেস হান্টার।
- ও মিসেস হান্টার। আপনি এসে গেছেন। আপনার সাথেতো দুপুর দুটোর সময় লেডি লুইস কার্টারের সাথে সাক্ষাত ছিল।
- হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আমি কী ভিতরে আসতে পারি?
- হ্যাঁ, অবশ্যই। আসুন। আপনার জন্যইতো ম্যাডাম অপেক্ষায় রয়েছেন।
মিসেস হান্টার দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন।
- আপনি বসুন। আমি ম্যাডামকে ডেকে দিচ্ছি।
মি. হেরি উইলসন একজন তীক্ষè প্রখর বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। ছোটবেলা থেকে রহস্য অনুসন্ধানের দিকে তার প্রবল আগ্রহ। সেই আগ্রহের সুবাদেই দীর্ঘদিন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর হিসেবে কাজ করেছেন। দেশে সম্মানও কুড়িয়েছেন যথেষ্ট কিন্তু তাতে তিনি খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার আগ্রহ বিশ্বখ্যাত কোনো ডিকেটটিভের সহযোগী হয়ে ইতিহাসের পাতায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকা। পাশাপাশি এ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞানার্জন। মি. হেরি উইলসন একজন খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ কিন্তু অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে তিনি প্রচন্ড রকম চঞ্চল ও উদগ্রীব। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে নিতে পারেন। সত্যান্বেশনের ক্ষেত্রে তার মতো আগ্রহীর জুরি মেলা ভার। ডিটেকটিভ হিসেবে দেশে-বিদেশে বিভিন্নভাবে মিসেস লুইস কার্টারের অসীম কৃতিত্বের কথা শুনেছিলেন তিনি। তাই একরকম উদগ্রীব হয়েই তার সহযোগী হিসেবে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন। সেই ইন্টারভিউও ছিল তার জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সে কথা মি. হেরি কখনোই ভুলতে পারবেন না। দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় শ’খানেই প্রার্থী এসেছিল ইন্টারভিউ দিতে। তার মধ্য থেকে লেডি লুইস কার্টার মি. হেরিকেই বেছে নিয়েছিলেন। লেডি কার্টারের ব্যক্তিগত অনুসন্ধানকৃত ২টি ছায়া কেইস মাস খানিকের মধ্যে হাতে কলমে সলব করার কথা ছিল প্রার্থীদের। ঘটনার সকল তথ্য, উপাত্ত ও প্রয়োজনীয় আনুসাঙ্গিক সকল বিষয়ই প্রার্থীদেরকে অভিহিত করা হয়েছিল। শ’খানেক প্রার্থীর মধ্যে মি. হ্যারি উইলসন ব্যতিত কেউই এই দু’টি কেইসের একটিরও সঠিক সমাধান করতে সক্ষম হননি। মি. হ্যারি উইলসন কেইস দুটিকে খুব ভালোভাবেই সমাধান করতে পেরেছিলেন। এর জন্য তার উপর মাস খানেক প্রচন্ড ধকল গিয়েছিল। দিন-রাত, নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েই অনুসন্ধান চালিয়ে গিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে লেডি কার্টারের মতো একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভের সহযোগী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। সত্যিইতো এই রকম সৌভাগ্য কয়জনের ভাগ্যেই বা জুটে। ইচ্ছা আর সঠিক শ্রম মানুষের জীবনকে নিয়ে যায় প্রাপ্তির সব্বোর্চ শিখরে। তাই লক্ষ অর্জনের জন্য মেধার সাথে সাথে নিরলস শ্রমটাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
মিসেস হান্টার সোফায় বসে প্রথমে ঘরের চারপাশে একটু তাকালেন। কাঠের মেঝেতে মোটা পুরু দামি নকশি করা কার্পেট। সামনে বড়ো বড়ো প্রশস্ত তিনটে জানালা। জানালায় বেশ দামি পর্দা ঝুলানো রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ঘর থেকে বাহিরের দৃশ্য সহেজই দেখা যাচ্ছে। ঘরের দেয়ালগুলো হালাকা সাদা ও কালচে বর্ণের। দেয়ালে কিছু পোর্টরেইট লাগানো রয়েছে। সম্ভবত বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড ও সার্টিফিকেটের পোর্টরেইট। অন্য সময় হলে হয়তো মিসেস হান্টার সেগুলোকে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখতে যেতেন কিন্তু এখন সেগুলো দেখার প্রতি তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। মিনিট খানেকের মধ্যে উপরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন লেডি লুইস কার্টার সাথে তার সহযোগী মি. হেরি উইলসন।
লেডি লুইস কার্টার দেখতে দশজন নারীর চেয়ে একটু আলাদা। তার চোখেমুখে ব্যক্তিত্বের স্পষ্ট ছাপ। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ;è মনে হয় যেন ঈগলের দৃষ্টি। ঈগল যেমন শতফুট ওপর থেকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যকে দেখ পায়। ঠিক তেমনি লেডি লুইস কার্টারও একজন ঈগল দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ। এক দৃষ্টিতে মনে হয় আপাদমস্তক পর্যবেক্ষন করে নেন। মানুষের চোখ দেখে তার মনের ভাষা পড়ে ফেলার এক অদ্ভূত ক্ষমতা রয়েছে তার মধ্যে। মানুষ ও প্রাণীদের মনোজগত নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছেন। তাই সাইকোলজীতেও তার যথেষ্ট দখল রয়েছে। দূরদষ্টি ও পর্যবেক্ষন ক্ষমতায় তিনি অনন্য।
ছোট বেলা থেকেই একজন প্রখর মেধাসম্পন্ন মানুষ মিস লুইস কার্টার। প্রাইভেট ডিকেটটিভ হিসেবে সারা দেশে তার জুড়ি মেলা ভার। প্রখর মেধা ও আনসলব মিষ্ট্রি কেইসের রহস্য উন্মোচনের জন্য তার খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে গিয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড থেকে ল’তে সব্বোর্চ ডিগ্রি লাভ করেছেন। তথাপি ম্যাথাম্যাটিকসে তার দখল অগাধ। সময় পেলেই খাতা কলম নিয়ে বসে যান ম্যাথ সলব করতে। ফিবোনাচ্চি রাশি মালা ও সংখ্যাতত্ত্বে তার বিশেষ দখল রয়েছে। কেইসের সঠিক তথ্য অনুসন্ধান ও তার সমাধান খুঁজে পেতে প্রায়ই তিনি এই বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োগ করে থাকেন। সন্দেহ তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। তবে সন্দেহ দূরা করা তার চেয়েও বড়ো বাতিক। পেশার সাথে নিবিড় সম্পর্ক ও এহেন বাতিকের ফলে পেশার বাইরে অন্য কিছুর চিন্তার সুযোগ হয়নি মিসেস লুইস কার্টারের। কেইস যত জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে তার মস্তিঙ্ক ততই জেগে উঠে। তিনি ততই উন্মাদের মতো তার মস্তিঙ্ককে জাগিয়ে তোলেন। মস্তিঙ্কের কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য তিনি এক বিশেষ ধরনের ড্রাগ সেবন করে থাকেন। অর্থের চেয়ে পেশাদারিত্ব তার কাছে বড়ো।
প্রতিটা মূহূর্তে তিনি তার বুদ্ধিমত্তার সাথে যুদ্ধ করে যান। প্রতিটি জটিল কেইসে তিনি তার পূর্ববর্তী বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যেতে চান।
মিসেস হান্টারকে দেখে প্রথমে অভিবাদন জানালেন লেডি লুইট কার্টার। তারপর মিসেস হান্টারের মুখোমুখি সোফায় বসে পড়লেন।
- কী বলব মিসেস হান্টার। আপনাকে দেখে প্রচন্ড উদগ্রীব, হতাশ আর দুর্বিসহ লাগছে। কীভাবে হলো এসব?
- গতকাল আপনাকে ফোনেতো সব কিছু বিস্তারিত বলতে পারিনি। আজ সকল কিছু বিস্তারিত জানাবো।
- হ্যাঁ, আপনি আমাকে সব কিছু খুলে বলুন। যা আছে সব। দয়া করে কোনো কিছু বাদ রাখবেন না বা লুকোবেন না। আপাত দৃষ্টিতে যেটিকে আপনার কাছে খুব সামান্য বলে মনে হচ্ছে সেটিও আমাকে জানাবেন।
- জ্বী, অবশ্যই জানাব। এই বিপদে আপনিই আমার একমাত্র সঙ্গী।
কথা বলতে বলতে ভদ্র মহিলা কেঁদে দিচ্ছিলেন। আবেগজড়িত কণ্ঠে মিস লুইস কার্টারের হাত জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন।
- আপনিই পারেন আমাকে সাহায্য করতে। পুলিশকে আমি আর বিশ্বাস করতে পারছি না। গত ক’মাস ধরে কী দুর্বিসহ যন্ত্রণায় যে আমি দিনাতিপাত করছি তা আমিই জানি। আমার এ কষ্ট বুঝবার মতো কেউ নেই। আমি পত্র-পত্রিকায়, টেলিভিশনে আপনার ভূয়সী প্রশংসা শুনেছি। আপনার মতো ডিটেকটিভের সাক্ষাৎ পাবো আশা করিনি। আমার এ দুঃসময়ে আপনার সাহায্য পেয়ে আমার সত্যিই ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে একমাত্র আপনিই আমাকে এই বিষয়ে সাহায্য করতে পারবেন- বলে রুমালে চোখের জল মুছছিলেন মিসেস হান্টার।
-আচ্ছা, আপনি এতো কান্না করবেন না। আমিতো আছি। দেখি আপনার জন্য কতটুকু করতে পারি। তবে আপনার কেসটা মনে হচ্ছে যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং হবে। গতকাল ফোনে যতটুকু বলেছিলেন তাতেই আমার কিছুটা আন্দাজ করা হয়ে গেছে। ফোনেতো আর সব বলা যায় না। আপনি কান্না বন্ধ করে চোখ মুছে পুরো ঘটনাটি খুলে বলুন।
চলবে..।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১১:৪২