- আমার পূর্বনিবাস হচ্ছে দক্ষিণ অ্যায়ারল্যান্ডের ওয়াটারফোর্ডে। এখনও সেখানে আমার পূর্বপুরুষদের ঘর-বাড়ি রয়েছে। আমার শৈশব, কৈশর পুরোটাই কেটেছে সেখানে। আমাদের পূর্বপুরুষরা এসেছে আয়ারল্যান্ডের বিখ্যাত কুইন্স বংশ থেকে। রেফাডল ওফ্রেলস বংশের সাথে বরাবরই আমাদের বংশের শত্রæতা ছিল। আমি যখন ট্রিনিটি কলেজে প্রত্বতত্ত¡ ফ্যাকাল্টিতে লেখাপড়া করছিলাম তখন আমার সাথে পরিচয় হয় এ্যালেক্সের। ও ছিল কম্পিউটার সাইন্স ফ্যাকাল্ট্রির একজন ছাত্র। বন্ধুত্ব দিয়ে পরিচয়টা শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত সেটা গড়ায় প্রেমে। আমাদের জীবনের সেই মূহুর্তগুলো ছিল সত্যিই অসাধারণ। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সারাদিন কাটিয়েছি আরকেওলজী মিউজিয়ামে, ডাবলিন ক্যাসেলের সামনে, ব্রাইট স্ট্রীট সহ শহরের প্রায় সবগুলো পার্কে। একদিন আমাকে আর অ্যালেক্সকে পার্কে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলে আমাদের বাড়ীর চাকর প্যাটরিক ওলফি । সে আমাদের বাড়িত গিয়ে বিষয়টি বাবা-মাকে জানায়। পরবর্তীতে বাবা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে আমার বয়ফ্রেন্ড রেফাডল ওফ্রেলস বংশের ছেলে। বিষয়টি আমিও জানতাম না। বাবা একদিন রাত্রিবেলায় অফিস থেকে ফিরে আমাকে বিষয়টি জানায়। আমার মাথায় তখন বাজ পড়ে। মনে হচ্ছিল বাড়ীর ছাদ খুলে আমার মাথার উপর পড়ছে। কিন্তু কি করার ততদিনে আমার আর এ্যালেক্সের সম্পর্ক বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে।
বাবাকে বললাম
- আমার আর এ্যালেক্সের সম্পর্ক বহুদূর গড়িয়েছে। এখন আমার পক্ষে ওকে ছাড়া বাকী জীবনটা কাটানো সম্ভবপর নয়।
বাবা গম্ভীর আর কড়া গলায় বললেন-
- হান্টার। তুমি কী জাননা রেফাডল ওফ্রেলস বংশের সাথে আমার শত্রুতা শত শত বছরের? ওরা হচ্ছে আমাদের চিরশত্রু। আমার বাবা, দাদা, তার বাবা, তার বাদা বলতে গেলে প্রায় চৌদ্দ পুরুষ ধরে চলছে ওদের সাথে আমাদের শত্রুতা চলছে। এত কিছু জানার পরও তুমি ওর সাথে সম্পর্ক রাখতে চাচ্ছ?
- শত শত বছর ধরে চলে আসা শত্রুতা আমরা কী এখন মিটিয়ে নিতে পারি না, বাবা? পূর্বপুরুষদের শত্রুতা কেন এখনও আমারা চালিয়ে যাবো? বাবা তুমি একজন শিক্ষিত লোক হয়ে কেন এসবে এখনও প্রশয় দিচ্ছ?
একথা শুনে বাবা প্রচন্ড রেগে গেলেন। তার চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করল। মুখের মাংস যেন রাগে কিলবিল করছিল। হঠাৎ সপাট করে আমার গালে চড় বসিয়ে দিল।
-বেয়াদব মেয়ে মুখে মুখে তর্ক করতে শিখেছিস। ফের যদি ওই ছেলের সাথে দেখি। তোকে টুকরো টুকরো করে হাঙ্গরকে দিয়ে খাওয়াবো।
- আমি তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম। ইতিপূর্বে বাবা কোনোদিন আমার গায়ের হাত তোলেনি। আমার কথার প্রেক্ষিতে বাবা যে এতটা রেগে যাবেন তা আমি ভাবতে পারিনি। দৌঁড়ে বেড রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে লাগলাম। এই ঘটনার পর কিছু দিন আমার বাইরে যাওয়া বন্ধ ছিল। কলেজেও যেতে পারতাম না। এদিকে বারবার শুধু এ্যালেক্সের কথাই মনে পড়ছিল। মায়ের অনুরোধে পরবর্তীতে বাবা আমায় কলেজে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। তবে আমাকে চোখে চোখে রাখার জন্য আমাদের বাড়ীর বহুদিনের বিশ্বস্থ চাকর প্যাটরিক ওলফিকে দিলেন আমার সাথে। এইভাবে কয়েকদিন কাটল। প্যাটরিকের অগোচরে আমি কলেজে এ্যালেক্সের সাথে দেখা করে সমস্ত ঘটনা খুলে বলি। প্রথমে একটু অবাক হলেও পরবর্তীতে এ্যালেক্স বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিল। ও জানতো না যে আমি ওদের চিরশত্রæ কুইন্স বংশেরই একজন। সবকিছু জেনেও ও আমাকে মেনে নিল। কারণ আমরা দুজন দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসতাম। একেবারে পাগলের মতো ভালোবাসতাম। আমাদের ভালোবাসার কাছে বংশ মর্যদা ছিল অতি তুচ্ছ বিষয়।
কথা বলতে বলতে মিসেস হান্টারের দু’চোখ জলে ভিজে গেল। কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে উঠল। হান্টার রুমালে দ’ুচোখ মুছে আবার কথা বলতে লাগলেন।
- একদিন প্যাটরিক আমাদের দুজনকে একসাথে দেখে ফেলে কিন্তু আমাকে কিছু বলে না। পরে বাসায় এসে বাবাকে সব কিছু বলে দেয়। কথা শুনে বাবা ভয়ংকরভাবে ক্ষেপে ওঠেন।
বাবা বললেন
- এত বড়ো সাহস এইটুকু মেয়ের আমার আদেশ অমান্য করে। আজ থেকে ওর ঘর থেকে বের হওয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ। কেউ যদি ভুলেও ওকে ঘর থেকে বের করে তো আমি তাকে এই বাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য বের করে দেবো।
বাবার এই কথা শুনে ভয়ে আমার পা দু’টো ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। মনে হচ্ছিল আমি মাথা ঘুরে সেখানেই পড়ে যাবে।
কথা শেষ না হতেই বাবা এক হ্যাঁচকা টানে আমার হাত ধরে টেনে সিঁড়ি দিয়ে দোতলার বেডরুমে নিয়ে গেল। তারপর বাইরে থেকে দরজাটা সপাট লক করে দিল। এইভাবে দীর্ঘদিন বন্ধী অবস্থায় ছিলাম। শুধুমাত্র খাবারের সময় চাকর-বাকররা খাবার দিয়ে যেত। তারপর বাইরে থেকে আবার দরজা বন্ধ করে দিত। একদিন রাতের বেলা ঘুমিয়ে আছি হঠাৎ কানের কাছে এ্যালেক্সের মৃদ্যু কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।
-হান্টার। হান্টার।
শব্দ শুনে ধড়মড়িয়ে উঠলাম।
-এ্যালেক্স তুমি? এতরাতে তুমি আমার ঘরে কীভাবে ঢুকলে?
আমি কী স্বপ্ন দেখছি না সব কিছু বাস্তবে ঘটে চলছে বুঝতে পারছিলাম না।
- এ্যালেক্স। তুমি কী আমার স্বপ্নে এসেছ? নাকি বাস্তবে?
এ্যালেক্স আমার গায়ে চিমটি কেটে বলল
-সত্যিই এসেছি। এবার বিশ্বাস হচ্ছে? ঐ যে দেখ তোমাদের বাড়ির ছাাদের স্কাই লাইট ভেেেঙ্গ তোমার ঘরে ঢুকেছি।
তাকিয়ে দেখলাম স্কাইলাটের জায়গায় স্কাইলাইট নেই। ছাদের ঐ অংশটা পুরোপুরি ফাঁকা।
-হ্যা, এবার বিশ্বাস হচ্ছে।
- শোন হান্টার। আমাদের হাতে সময় খুবই কম। আমরা যদি বাকী জীবনটা একসাথে কাটাতে চাই তাহলে আজই আমাদের পালাতে হবে। আমার বাবাও আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গেছে। আজ রাতে যদি পালাতে না পারি তাহলে কালই বাবা আমার চাচাতো বোন এ্যালগেছটা এ্যাঞ্জেলার সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবেন। আমার সবকিছু ঠিকঠাক করা আছে। আমরা এখান থেকে আপাতত আমার বন্ধু মিসেলের বাসায় গিয়ে উঠব। পরে আমরা আমার ক্লাসমেটের বাড়ি ইংল্যান্ডে ম্যানচেস্টারে গিয়ে উঠব। ঐখানে ও সব কিছু জানিয়ে রেখেছে।
আমি কিছুই চিন্তা করতে পারছিলাম না। এতদিন পর এ্যালেক্সকে কাছে পেয়ে আমি আন্দনে প্রায় আত্মহারা। সুতরাং রাতের বেলা ঐ অবস্থাতেই এলেক্সের সাথে বাড়ী থেকে পালালাম। কিছুদিন মিসেলের বাসায় আত্মগোপন করে ছিলাম। পরে এ্যালেক্সের সাথে ওর বন্ধু জনের বাসা ম্যানচেস্টারে এসে আশ্রয় নিলাম। ম্যানচেস্টারে পৌঁছানোর কিছুদিনের মধ্যেই এ্যালেক্স একটা কাজ জুটিয়ে নিল। কয়েক বছরের মধ্যেই ছোট-খাটো একটা বাড়ী কিনে ফেললাম। আমাদের দাম্পত্য জীবন খুবই ভালো কাটছিল। দীর্ঘদিন আমার পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না। এ্যালেক্স আমাকে বারণ করেছিল ওদের সাথে যোগাযোগ করতে।
হঠাৎ আমাকে প্রায় অবাক করে দিয়েই একদিন বাবা-মা আমার বাড়িতে এসে উপস্থিত। এ্যালেক্স সবেমাত্র অফিসের জন্য বের হয়েছে কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলতেই হকচকিয়ে গেলাম। দেখি মা-বাবা দুজনেই দরজায় দাঁড়িয়ে। কয়েক মুহূর্ত যেন স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইলাম। পরক্ষণের মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
- মা। তুমি আমাদের ঠিকানা পেলে কোথায়?
- কেন তোরা কী ভেবেছিলি ইংল্যান্ডে চলে আসলি বলে আমরা কোনোদিন তোদের হদিস পাবো না?
- না, তা নয়। আমরাতো কাউকে জানিয়ে আসিনি। তাই ভাবলাম তোমরা কীভাবে আমাদের ঠিকানা পেলে?
- এ্যালেক্সের বন্ধু মিসেলের কাছ থেকে।
- ও তাই বল।
এসো ভিতরে এসো।
বাবা আমাকে দেখে বুকে টেনে নিল।
- শোন্ হান্টার। আমি পূর্বের সব কিছু ভুলে গেছি। দেখছিস না তোদের দেখতে একেবারে ইংল্যান্ডে চলে এলাম। তা তোর স্বামী কী বাসায় আছে, না অফিসে গেছে?
- ও কিছুক্ষণ আগেই অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়েছে।
- ওহ। তাহলে তো এখন আর দেখা হলো। অফিস শেষে নিশ্চয়ই বাসায় ফিরবে?
- হ্যাঁ, ও বিকেলের মধ্যে আশা করি চলে আসবে। তোমরা আর কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে? ভিতরে এসো।
বাবা-মাকে সিঁড়ি দিয়ে সোজা দোতলায় গেস্ট রুমে নিয়ে গেলাম। দোতলায় আমাদের তিনটে রুম। একটি আমাদের স্বামী-স্ত্রীর বেড রুম। আরেকটি আমাদের ভবিষ্যত সন্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল আর বাকী একটি গেস্ট রুম। বললাম
-আচ্ছা তোমরা ফ্রেশ হয়ে নিচে নাস্তার টেবিলে আসো। আমি তোমাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।
এই বলে আমি কিচেনে যেয়ে চট-জলদি কিছু নাস্তা তৈরি করে নিয়ে এলাম। আমি নাস্তা নিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচে খাবার টেবিলে এসে বসল। মা বলল
- কিরে তোদের তো বিয়ের অনেক বছর হয়ে গেল। সন্তান-সন্তুদি আর কবে নিবি?
- এইতো মা আগামী বছরে প্ল্যান আছে। এ্যালেক্সের কিছুদিনের মধ্যেই প্রমোশন হওয়ার কথা। যদি সেটা হয়ে যায় তো আগামী বছরেই তোমরা তোমাদের নাতী বা নাতনীর মুখ দেখবে।
বাবা বললেল
- তাহলেতো খুবই ভালো।
- আচ্ছা মা, ম্যারি কেমন আছে? মেরির কি বিয়ে হয়েছে?
বাবা একটু ইস্ততত হয়ে উত্তর দিল
- হ্যাঁ, ভালো আছে।
- ওকে কী বিয়ে দিয়েছ?
- না, দেইনি। ভাবছি...।
এইটুকু বলেই বাবা থেমে গেল। বাবা-মা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ।
- আমাদের বাড়ীর পুরোনো চাকর প্যাটরিক ও কী এখনও আমাদের বাড়িত কাজ করে?
- হ্যাঁ, এখনও কাজ করে।
খাবার টেবিলে আর তেমন কোনো আলাপ হয়নি। সন্ধ্যায় এ্যালেক্স বাসায় এলে আমি ওকে বাবা-মার কাছে নিয়ে গেলাম।
বাবা বলল-
- তুমিই তাহলে এ্যালেক্স।
- জ্বি। আপনারা ভালো আছেন?
- হ্যাঁ, আমারা ভালো আছি। তুমি কেমন আছে?
- জ্বি, ভালো।
আমরা হান্টারকে এক মাসের জন্য আমাদের বড়িতে নিয়ে যেতে চাই। এতে কী তোমার কোনো আপত্তি আছে?
- না, আপত্তি থাকবে কেন। এটাতো খুবই আনন্দের বিষয় এতদিন পরে আপনাদের অভিমান ভেঙ্গেছে। আপনারা আপনাদের মেয়েকে বেড়াতে নিজ বাড়িতে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। এতে আমার কোনোই আপত্তি নেই।
- তোমাকেও সাথে নিয়ে যেতাম কিন্তু শুনলাম সামনে তোমার প্রমোশন। এই সময়ে তুমি ছুটিতে গেলে তোমার প্রমোশনের কোনো সমস্যা হয় কিনা তাই তোমাকে যেতে বললাম না। তুমি কিছু মনে কর না।
- না, বাবা আপনি ঠিকই বলেছেন। এখন প্রচুর কাজের চাপ রয়েছে। এই সময়ে বেড়াতে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।
- আমিও তাই ভাবছিলাম।
- কী হান্টার তোমারতো আমাদের সাথে যেতে কোনো আপত্তি নেই?
- না, বাবা। আপত্তি থাকবে কেন। এ্যালেক্স যেহেতু যেতে অনুমতি দিয়েছে তাই আমার আর কোনো আপত্তি নেই।
সেদিন রাতে আর কোনো কথা হলো না। পরের দিন জিনিসপত্র গোছাগাছ করতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। বাবা-মা আমার ঘরে এসেছিল বিকেলে আমাকে জিনিসপত্র গোছাতে সাহায্য করতে। সন্ধের মধ্যে এলেক্স অফিস থেকে বাসায় ফিরল। এলেক্স আমাদেরকে স্টেশন অবধি পৌঁছে বাড়ী ফিরে গেল।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১১:৩৯