আমার একটা প্রায় আত্মজীবনীমূলক লেখা রঙবেরঙ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
পঞ্চাননের লেখালিখি
-----------------------------------
ছোট বেলার থেকে লেখালিখির সখ ছিল পঞ্চানন মিত্রর। গল্প কবিতা নাটক, মানে যা' হোক কিছু। ওই নামী লেখকেরা যেমন লেখেনটেখেন। কিন্তু স্কুল ম্যাগাজিনে খান দু'এক লেখা বেরিয়েছিল বটে। তারপর নিজের আলস্যে, সংসারের চাপে আর কল্পনা শক্তি, ভাষার দখল এ'রকমের সাতসতেরো প্যাঁচ পয়জারে সেই লেখক হওয়া তাঁর আর হয়ে উঠল না। সরকারি চাকরি শেষ হল ষাট বছর বয়সে। ভাবলেন এতদিনে অবকাশ মিলেছে।
কলম কামড়ে খাতার পাতা প্রায় ছিঁড়ে ফেলার জোগাড় হল। কিন্তু ঠিকঠাক লেখা আর বেরোয় না।
মাঝ থেকে ঝামেলা বাড়ল তাঁর গিন্নি অনুপমার। তিনি আবার গল্পের বইএর পোকা। কাউকে না পেয়ে পঞ্চানন নিজের সেই ব্যর্থ লেখাগুলো, মানে যখন যা' বেরোয় কবিতা গল্প শেষ করেই ডাক দেন তাঁকে।
অনু, এইটে একটু পড়ো তো।
বলেই বায়না,
উঁহু, অমন মনে মনে নয়, কবিতাটা জোরে জোরে বেশ আবৃত্তির মত করে পড়ো।
অনুপমা বিরক্ত হন। কিন্তু লোকটার ওপর তাঁর বড় মায়া হয় বলে,পড়েনও।
লেখাটা গল্প যদি হয়, দাবীর বহর বাড়ে। সংলাপের জায়গাগুলো নাটকের মত করে আবেগ মিশিয়ে নাকি পড়তে হবে। এ'দিকে সংসারের পাঁজা কাজ পড়ে রয়েছে।
পড়তে পড়তেই অনুপমা বুঝতে পারেন কোনও লেখাই কিচ্ছু হচ্ছে না।
বোঝেন পঞ্চাননও। কাউকে না বলে ক্যুরিয়ার দিয়ে কয়েকখানা লেখা নানান পত্রপত্রিকায় পাঠিয়েছেন। অন্য কাজের নাম করে বেরিয়ে পত্রিকা অফিসে দিয়েও এসেছেন। লাভ হয়নি। কেউ ছাপেনি সেই সমস্ত লেখা।
সকালে মর্নিংওয়াকের বন্ধু জগবন্ধুকে বলতে, সে বিচ্ছিরি খ্যা খ্যা করে হেসে উঠেছে,
আরে পঞ্চা, লিখবার সখ হয়েছে লিখে যা। ছাপাবার ঘোড়া রোগটা আবার তোকে ধরল কেন? যাই লিখিস, এট্টু চেনাজানা না থাকলে ওই সব ছাইপাঁশ কেউ ছাপে নাকি?
পঞ্চাননের মাঝে মাঝে ওই রকমের চেনাজানা না থাকার জন্য আপশোষ হয় বটে, কিন্তু নিজের লেখা যে তাঁর নিজেরই পড়তে ইচ্ছে করে না। অনুপমার পড়ার সময়ও বুঝতে পারেন লেখাগুলো ওই ছাইপাঁশই হচ্ছে।
ঠিক বাষট্টি বছরের জন্মদিনের পর তাঁর মনে হল, সময় ফুরিয়ে আসছে।
জগবন্ধুকে সমস্যাটা বললেন
হ্যাঁ রে জগু, গতমাসে বলরামদা' মরে গেল। তার দু'মাস আগে নবা'র ছোট কাকা।
তা' বয়েস হলে মানুষ তো চলে যাবেই। তোকে কি মৃত্যুভয় ধরল নাকি?
পঞ্চানন অপ্রস্তুত হাসির সাথে যৎকিঞ্চিত হাহাকার মিশিয়ে বললেন
না, ইয়ে বয়েস হলে মরতে তো হবেই। কিন্তু কিছুই যে লিখে উঠতে পারলাম না।
জগবন্ধু মিটিমিটি বিষাক্ত এক ধরণের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললেন
হ্যাঁ রে, অ্যাদ্দিন যে লিখছিস,গুরু ধরেছিস?
গুরু, মানে?
আরে সব বিদ্যেই গুরুমুখী বিদ্যে। সে তুই যাই হতে চাস না কেন! ভালো কিছু হতে গেলে গুরু ধরতেই হবে। ছুতোর মিস্ত্রি কলমিস্ত্রি থেকে বিজ্ঞানী ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার যাই হোস না কেন।
গুরু, সে আমি এই বয়সে পাই কোথায়?
দাঁড়া দাঁড়া, আমায় বলেছিস যখন কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই।
তা' গুরুর ব্যবস্থা সেই জগবন্ধুই করলেন। বিখ্যাত সাহিত্যিক চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়কে বাংলা সাহিত্যজগতে কে না চেনে। সেই চন্দ্রশেখরকেই পাকড়ানোর ব্যবস্থা করে ফেললেন জগবন্ধু। ছোটশালার জামাই মস্ত ডাক্তার, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট। তার কাছে চিকিৎসা করান এই চন্দ্রশেখর। পুরোনো পেটের অসুখ। বাঙালির জাতীয় অসুখ। অসুখের কথা যাক গে। সেই ডাক্তার জামাই বাবাজীবন কে বলে কয়ে চন্দ্রশেখরকে রাজি করানো গেছে।
তিনি পঞ্চাননকে লেখা শেখাতে ঠিক রাজি হয়েছেন বলা যাবে না। কিন্তু দু'একটা টিপস দেবেন বলে দেখা করবার অনুমতি দিয়েছেন।
তাই বা কম কী? পঞ্চানন এক পায়ে খাড়া।
ঘড়ির সময় মিলিয়ে, আধঘণ্টা আগে হাজির হয়ে ফুটপাথে হাঁটাহাঁটি। তারপর ভয়ে ভয়ে কলিংবেল টিপতেই স্বয়ং তাঁর দেখা মিলল। পরিচয় দিতে ড্রয়িং রুমে বসা গেল। রাশভারী লেখক। ব্যবহারটি তত মোলায়েম হবে না আন্দাজেই ছিল।
জগবন্ধু পইপই করে বলে দিয়েছিল
ডিসপেপসিয়ার রুগী, মেজাজ একটু চড়া হবে। ঘাবড়াবি না।
কিন্তু সামনাসামনি দেখা গেল ব্যাপার তেমন না।
বেশ আন্তরিক ভাবেই বললেন
তা বয়েস কত হল বাপু তোমার?
প্রথম দর্শনেই তুমি সম্বোধনে রাগ করলেন না পঞ্চানন। অত বড় লেখক, কিছু না হোক দশ পনেরো বছরের বড়ই হবেন বয়সে। তা ছাড়া গুরু শিষ্যের সম্বন্ধ হতে চলেছে। এই সময়ে সম্বোধনের শিষ্টতা নিয়ে ভাবলে চলে না।
আজ্ঞে, বাষট্টি
যাঃ, এত পরে এলে।
একটু হতাশ গলায় বললেন চন্দ্রশেখর।
এই এত বয়সে কী শিখবে বলো তো। ময়না, জানো তো, বয়েস হয়ে গেলে আর কথা বলা শেখানো যায় না।
কিছুই কি উপায় নেই?
একে তো তোমার নামটা মানে আধুনিক লেখক হবার পক্ষে একটু ইয়ে। পঞ্চানন পালটে ছদ্মনাম নিতে হবে। মানে ধরো সেই শিবই রইলে। নাম নিলে নটরাজ। নটরাজ মিত্র। আর বাকিটা…অ্যাঁ, দেখছি দাঁড়াও… বলে মুখ কুঁচকে চোখ বুজে বসে রইলেন লেখক।
সে এক বেদম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।
আন্দাজ, টানা পাঁচ মিনিট পর চোখ খুললেন তিনি। যেন দৈববাণী পেয়েছেন, এই রকমের গোপন ভঙ্গীতে বললেন
শোনো হে, উপায় আছে। তুমি টুকে লেখো।
অ্যাঁ,
নিজের কানকে নিজে বিশ্বাস করতে পারছেন না পঞ্চানন।
হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। এই এতখানি বয়সে নতুন করে মকশো করে তুমি আর কিছুই দাঁড় করাতে পারবে না ঠিকঠাক। তার চেয়ে তুমি টুকে লেখো। অবশ্য হুবহু টুকো না। সামান্য এ'দিক ও'দিক করে নিজের মত করে কিছু পালটে দিও।
কিন্তু টুকব কোত্থেকে স্যার?
কেন হে, কঠিনটা কী। আমার রচনাবলী থেকেই শুরু কর না। যে কোনও একটা উপন্যাস ধরো। একটা একটা প্যারাগ্রাফ টুকলে অণুগল্প হয়ে যাবে দিব্যি। একটা চ্যাপ্টার টুকে দিলে ছোট গল্প। আর সাহস করে পুরোটা টুকতে পারলে ধরো উপন্যাসই হয়ে গেল। আমি এখন ওষুধ খাব বাপু। যাও, এ'বার এসো এখন।
এই অবধি বলেই একরকম জোর করেই পঞ্চাননকে বেরোবার দরজা অবধি এগিয়ে দিলেন চন্দ্রশেখর।
পঞ্চানন আনাড়ি মানুষ। বুঝতেই পারলেন না ওই চোখ মুখ কুঁচকানোর সময় থেকেই পেট ব্যথা শুরু হয়েছিল বড় লেখকের। আর ডিসপেপসিয়া রুগীর যা হয়, ওই ব্যথার সময় প্রচণ্ড রাগ হতাশা আরও সব নানারকম হয়ে, কথাবার্তা ঠিক থাকে না।
পঞ্চানন তাঁর সদ্যলব্ধ গুরুবাক্য কে বেদবাক্যতুল্য মনে করে বাড়ি ফিরলেন।
শুরু হল সাধনা। কিন্তু শুরু করেই বুঝলেন গাড্ডায় পড়েছেন। অনুপমা অবধি ধরে ফেলতে পারছেন টোকার ব্যাপারটা। কার লেখা কোত্থেকে ঝেঁপেছেন... সব! এই ব্যাপার ঝানু সম্পাদকরা তো ধরে ফেলবে বটেই।
তবে? গুরুবাক্য কি মিথ্যে হয়ে যাবে?
পঞ্চানন অনেক ভাবলেন।
ভাবতে ভাবতে বুঝলেন, গুরু ঠিকই বলেছিলেন।
তাঁর সারা জীবনে কত কত ঘটনা ঘটেছে। কোনওটা সুখের, কোনওটা কান্নার, কোনওটা বা ভয়ের রোমাঞ্চের। তিনি প্রত্যেক বার কিছু লেখার আগে চোখ বুজে ডুব দিতে লাগলেন সেই স্মৃতির পাতাগুলোয়।
সেই যে ছোটবেলায়, ময়ূরাক্ষীর বন্যা এসেছিল, ডুবে গেছিল পাঁচথুপির বাসা। হু হু করে জল ঢুকছে তখন, উঁচু বড়রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে।
দাদু বন্যার জলকেই যেন বললেন, একটু দাঁড়া, জুতোটা পরে নিই। আর পরমুহূর্তে জুতো ভেসে গেল। জুতোর মায়া ছেড়ে শিশু পঞ্চাননের হাত ধরে কোমরজল টপকে বড়রাস্তায় উঠে এলেন দাদু। সাত'দিন পরে বাবা কলকাতা থেকে এল মস্ত গুড় জ্বাল দেওয়ার কড়াইয়ে চেপে। অবিশ্বাস্য সেই বন্যার গল্প।
স্কুলে ডানপিটে দুষ্টু ছেলে হিসেবে নামডাক ছিল। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় রশিদ স্যারের অঙ্ক ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে বসে লাট্টু ছাড়বার পর স্যার লেত্তিটা দেখে ফেলায় কী বিষম হেনস্থা।
আস্তে আস্তে বড় হলেন। স্কুল পালাটালো। স্কুল শেষে কলেজে। বেকার অবস্থার যন্ত্রণা সয়ে চাকরি যোগাড়ের অভিযান। চাকরি পেলেন। । বিয়ে করে সংসারী হলেন। কত বন্ধুর সাথে নতুন করে আলাপ হল।
তারপর ছড়িয়ে থাকা অফিস আর সাংসারিক জীবনের কত রকম ঘটনা, পঞ্চানন দেখলেন সব রয়েছে তাঁর মাথার কোটি কোটি নিউরনের লুকোনো ভল্টে।
একে একে সেই গোপন সিন্দুক থেকে কাহিনীগুলো বার করে টুকতে শুরু করলেন পঞ্চানন। হুবহু,সেই সব স্মৃতির পাতায় যা যা লেখা। আর সামান্য কল্পনা মিশিয়েও দিতে থাকলেন সে'গুলোর ভাঁজে ভাঁজে।
কী আশ্চর্য, এ'বার সেই লেখাগুলো একটা দু'টো করে ছাপাও হতে লাগল। হ্যাঁ, বড় বড় নামকরা পত্রিকাতেও।
পঞ্চানন একটু অবাধ্য হয়েছেন। গুরুর কথামত ছদ্মনাম নেননি। নিজের নামেই লিখে গেছেন তিনি।
অনেক দিন পরে, সাহিত্যের একটা বড় পুরস্কার পাবার পর, সাংবাদিকরা তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে এসেছে।
যখন জিজ্ঞেস করা হল, তাঁর এত ভালো কাহিনীকার হবার রহস্য কী,
তিনি সত্যি কথাই বললেন তাদের
আমার সব লেখাই আমি টুকে লিখি।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১৯ রাত ৯:০৬