- না বাবু, তুমি একটুও বের হবে না।
- বাবু, তুমি অযথা চিন্তা করছো। আমি যাবো আর আসব।
- না এই হরতালের মধ্যে কোথাও যাবে না তুমি।
- বাবু, প্লিজ ! বন্ধুরা সবাই বেরিয়েছে। আমি না গেলে খুব করে পচাবে।
-না বলেছি একবার। তোমার কিছু একটা যদি হয়ে যায় আমার কি হবে?
- কিচ্ছু হবে না । যাই না প্লিজ?
- তুমি আমার কথা না শুনে বের হলে আগামী সাত দিন কথা বন্ধ।
- আচ্ছা যাবো না
- এই তো আমার লক্ষী সোনাটা।
ত্রিশ মিনিট পর
- বাবা, বাইরে যাচ্ছ? আসার পথে টেইলারের কাছ থেকে আমার জামাগুলো একটু এনে দিও তো।
- আচ্ছা মা দিবো। আর কিছু লাগবে?
- আর... শ্যাম্পু নিয়ে আসবে। শেষ হয়ে গেছে।
এসব শুনে মেয়েটির মা উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
- তোর বাবাকে কি এসব আনতে বলছিলো? আজ হরতাল খেয়াল আছে? পথে বের হলেই ককটেল, কাদানি গ্যাস কর রকমের বিপদ।
- হ্যা তাই তো ! কিন্তু মা নতুন ড্রেস টা আমার যে আজই লাগবে । কাল যুথিকার জন্মদিন। আমাকে সকালে যেতে বলেছে।
মা মেয়ের মৃদু বিবাদ শুনে বাবা বললো,
-তুমি থামো তো। কি এমন চাদ পাহাড় নিয়ে আসতে বলছে। আর এমন হরতাল রোজ হচ্ছে। কেউ মানছে নাকি। তুই চিন্তা করিস না মা আমি সব নিয়ে আসবো। কেমন?
-আচ্ছা বাবা। ড্রেস টা ভাল করে দেখো নিয়ে আসবে।
-আচ্ছা ।
আট ঘন্টা পর
মেয়েটির বাবা ফিরে এলে মা ভয়ে চিৎকার করে বললো,
-কি হয়েছে তোমার? মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে কেন?
-ও কিছু হয়নি।
-কিছু হয়নি মানে? স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মাথায় খানিক টা কেটে গেছে।
-আরে টেইলারের দোকানের সামনে থেকে ফেরার সময় মিছিলের এসে গিয়েছিলো আর পিছন থেকে পুলিশের কাদানি গ্যাস তাই ছুটে বের হতে গিয়ে হোচট খেয়ে পরে গেছিলাম। তাই সামান্য একটু ছিলে গেছে।
-আমি তখনই মানা করেছিলাম। এই মেয়েকে নিয়ে আর পারা গেল না। তুমিও লাই দিয়ে দিয়ে শেষ করলে ।
-খবরদার ! এই নিয়ে আমার মেয়েকে কোন কথা বলবে না। ও কি জানতো এমন টা হবে? কি করছো ও এখন?
-ঘুমাচ্ছে। ডেকে দেই।
-না না আমার এমন কিছু হয়নি যে ওকে কাচা ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হবে। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।
এই ঘটনার ছয় মাস না যেতেই মেয়েটির তার আদরের বাবুর সাথে সম্পর্কের ইতি ঘটলো। অবশ্য নতুন বাবু জুটতেও বেশি সময় লাগলো না। কিন্তু দিন, মাস, বছর, সময়ের পরিক্রমা যতই দীর্ঘ হোক না কেন, বাবা টা আর বদলালো না। আজও বাবা টা পৃথিবীর সব ঝড় উপেক্ষা করে মেয়েটির মন পাহারা দেয়। সব বিপদ মুখে হেসে বেড়িয়ে যেতে বলে, "তুই চিন্তা করিস না মা, আমি ঠিক নিয়ে আসবো।" নিয়েও আসে বাবাটা। কিন্তু মেয়েটার বিশাল মনে যেখানে অপরিচিত মানুষদের জন্য বড় বড় জাহাজ ভিড় করে থাকে অথচ বাবা টার জন্য ছোট্ট একটা তরীও নোঙর করা নেই। যে তরীতে ভেসে হয়তো কোন দিন মেয়েটি বাবার বুকের ভেতরে ভালোবাসার যে বিশাল সমুদ্রে আদরের ঢেউ হি ল্লোল তোলে সেই বিশাল স্নেহরাশির সন্ধান পেতো। কিন্তু সেই আবেগে সেই মহা জলরাশি অযত্নে, অবহেলায় একদিন শুকিয়ে গেলো। কেউ খবর রাখলো না।
গল্পটি কোন হতভাগ্য মেয়ের নয়, গল্পটি আমাদের। আমার বাবার, আপনার বাবার। ছোট বেলা থেকে বাইরে তো অনেক দূরের ব্যাপার, পাড়ার কিংবা গলিতে ছোট খাটো কোন গোলযোগ হলে বাবা-মা আমদের বাইরে যাবার প্রতি নিধেষাজ্ঞা জারি করে দিতো। কিন্তু অবরোধ, হরতাল, মারামারি যত যা ঘটে যাক না কেন, কখনো দেখেছেন বাবাকে ঘরে বসে থাকতে। আমি দেখিনি । কিন্তু সবকিছু অগ্রাহ্য করে বাবাদের প্রতিদিন জীবন সংগ্রামে ঝাপিয়ে পরতে দেখেছি। শুধু আমাদের একটা সুন্দর আগামী দেবে বলে। আচ্ছা বাবাগুলো যখন সব উপেক্ষা করে ঘোর বিপদেও স্বাভাবিক চিত্তে ঘর থেকে জীবনের তাগিদে বের হয়ে গেছে, আমরা কতদিন তাদের বাধা দিয়েছি? বের হয়ে গেলে বাবাটা যেন ভাল ভাবে ফেরে সেইজন্য কতদিন দুঃচিন্তা করেছি? বাবাদের এই অনিশ্চতার মধ্যে চলাফেরা খুব যেন স্বাভাবিক ব্যাপার। তারা যেন এলিয়েন। তাদের কিছু হতেই পারে না। অথচ যাকে দুইদিন আগেও চিনতাম না, তাদের জন্য অন্ধ আবেগ, বেহায়া যত্নের শেষ নেই আমাদের। আমরা কি সত্যি যোগ্য সন্তান হয়ে গড়ে উঠতে পারছি? যেদিন আমরা বাবা কিংবা মা হবো সেদিন কোন মুখে আমরা আশা করবো যে আমাদের সন্তান আমাদের ভালবাসবে, হয়ে উঠবে ভাল একজন মানুষ?
পৃথিবীতে সব ভালোবাসার বাবুগুলো খারাপ হয় বলছিনা । কিন্তু এই বাবুগুলোই একদিন বাবা হবে। তাই পৃথিবীর কোন সম্পর্কের পুরুষের কাছে বাবা হলেন অপ্রতিদ্বন্দী, ঠিক যেমনটি মায়ের উপস্থিতি যেকোন নারীর কাছে।
--- বাবা দ্যা এলিয়েন/ আর্য্য