আসলে স্বাধীনতার সময়টুকু ইতিহাসে থাকলে, না থাকলেও খুব বেশি পার্থক্য সৃষ্টি হতো না। কারণটা বুঝা যায় তুর্কীদের সাথে কথা বললে। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, কামাল আতাতুর্ক প্রভাবিত মানুষদের সাথে কিছু কিছু ব্লগারের মারাত্মক মিল... 'রিলিজন এন্ড পলিটিকস? নো গুড, নো গুড।' যা বলেছিলাম, আমরা পোস্ট কলোনিয়াল মুসলিমরা এখন পৃথিবী দেখছি পশ্চিমা চোখ দিয়ে, তাই একবারও ভাবার চেষ্টা করি না, আসলে রিলিজন এন্ড পলিটিকস বলতে ইসলাম ঠিক কি কি ব্যপারের সমন্বয় চাইছি? ইসলামিক রাষ্ট্র আসলে কি বস্তু? এ খায় না পড়ে? সেদিন কে যেন একটা সুপার ডুপার প্রশ্ন করেছিলো, আচ্ছা, ইসলামিক রাষ্ট্রের সবাই কি বেহেস্তে যাবে ডাইরেক্ট?
প্রথমত, একটা কথা বলি। ইসলামে প্রতিটা ক্ষেত্রে একজন মানুষ ভীষণ রকমের দায়বদ্ধ। প্রথমে ব্যক্তিগত, তারপরে পারিবারিক, তারপরে সামাজিক এবং তারপরে অবশ্যই রাজনৈতিক ক্ষেত্র, রাজনৈতিক ক্ষেত্র কখনই এর বাইরে নয়। নবী রাসুলদের ইতিহাস পড়ুন, আমি এমন কোন নবী রাসুলের ইতিহাস পাই নি, যারা সমাজের অথোরিটির সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন নি। তাই করতে গিয়ে অনেক বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু দেখবেন, মূসা (আ), ইবরাহীম (আ), জাকারিয়া (আ) কারও জীবন এই সংঘাত মুক্ত দেখবেন না। রাজনীতি সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, আর প্রতিটা ক্ষেত্র আল্লাহ ভীতি থাকলে, আর এই ক্ষেত্রে না থাকলে কোন কাজ হবে না!
এখনকার রঙিন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সাথে আসলে ইসলামের সংঘাতটা কোথায়। মানে শুনতে তো দারুণ লাগে। ধর্ম নিরপেক্ষ। মানে কোন ধর্মকে অসম্মান করা হবে না? সব ধর্মের সমান অধিকার?
কখখনো না। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা। এবং প্রতিটা ধর্মকে হেয় করার পূর্ণ অধিকার। ধর্ম সংক্রান্ত মানুষের হৃদয়ের কোমল জায়গাটায় আঘাত দেয়ার ব্যপারে রুথলেস হয়ে যাওয়া। ফ্রান্সে হিজাব ব্যান না হলে সেটা বুঝতাম না। তুর্কী মেয়েগুলো, যারা নিজের দেশে হিজাব পড়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারে না দেশীয় আইনে আটকায় বলে, তাদের সাথে কথা বলার আগে বুঝতে পারতাম না। বুঝতে পারতাম না 'পিস ক্রাইস্ট' স্কাল্পচারটা না দেখলে। এটা নাকি একটা শিল্পকর্ম, যেখানে আমেরিকান শিল্পী নিজের পেশাব বোতলে ভরে তাতে ডুবিয়ে রেখেছেন জিসাস ক্রাইস্টের মূর্তি। জিজাস আমাদের নবী। যারা ঈশ্বরপুত্র ভাবেন, তাদের হৃদয়ের অনেকটুকু জুড়ে আছেন। এমন নিদারুন অসভ্য কাজকে আমরা শিল্প হিসেবে ভাবতে পারি না, কষ্ট দেয় খুব প্রিয় কাউকে নিয়ে মিথ্যাচারিতা আমাদের যেমন কষ্ট দিত তেমন। চিন্তা করুন একজন জীবন্ত মানুষের কথা, তাকে পথে ধরে থাপ্পড় দিলে তার অধিকার লংঘন হবে, তাই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে তার বিচার আছে। কিন্তু মৃত মানুষেরা, বা স্রষ্টার মত অদৃশ্য সত্ত্বাকে যা ইচ্ছা তাই বলা যাবে। ধর্ম সংক্রান্ত যে কোন অপমানকে 'বাক স্বাধীনতা' বলে ছেড়ে দেয়া হয়। আসলে, যারা নিয়মের প্রবর্তক, তারা বুঝতে পারেন না, স্রষ্টা মানুষের হৃদয়ের ঠিক কতটা জুড়ে থাকতে পারে, এই ধরণের ব্যপারে মানুষ ঠিক কতটা রক্তাক্ত হয়। তাই বলার সাহস রাখেন, এটা নাকি 'ফর দ্যা পিপল'।
আমি চাই প্রতিটা ধর্মের জন্য পূর্ণ সম্মান, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মত প্রতিটা ধর্মের প্রতি পূর্ণ অসম্মান নয়।
ইসলামিক রাষ্ট্র হচ্ছে, বাই গড, ফর দ্যা পিপল, উইথ দ্যা পিপল। স্রষ্টা কর্তৃক দিয়ে দেয়া কিছু অলংঘনীয় নিয়মরাশি।
স্রষ্টা অলংঘনীয়--এই কনসেপ্টটা ইসলামিক রাষ্ট্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ফিচার। স্রষ্টার কাছে চরম দায়বদ্ধতা।
এখনকার প্রক্ষিতে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক রাষ্ট্র? ইসলামের বেশ কিছু ব্যপার আছে, যেগুলো পরিপূর্ণ ভাবে আমরা করতে পারবো না রাষ্ট্রকে পাশে না পেলে। সুদ কোরআনের আয়াতে স্পষ্ট হারাম। এখন যদিও কিছু চেষ্টা চলছে সুদহীন ব্যাংকিং চালানোর কিন্তু সত্যি বলতে কি, ওই ব্যাংকগুলো কিন্তু সুদমুক্ত ব্যবসা চালাতে পারছে না অন্যান্য ব্যাংকের সাথে ডিলিংসের কারণে। রাষ্ট্রীয় সাহায্য ছাড়া আধুনিক অর্থনীতিতে কুরআনের সেই নির্দেশ মানার উপায় কি? যাকাত সিস্টেম হচ্ছে ওয়েল ফেয়ার সিস্টেম, যাতে সমাজে একজন মানুষও অভুক্ত না থাকে। খলীফারা যাকাত নিজেরা আদায় করতেন ট্যাক্স হিসেবে এবং সেটা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন যার যতটা প্রয়োজন সেভাবে। আমরা মুসলিম দেশে আছি, কিন্তু আসলেও কি জাকাতটাকে সাস্টেইনেবল ভাবে ব্যবহার করতে পারছি? উল্টো ভিড়ের চাপে পড়ে কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে? আমি এখানে বা বাংলাদেশে বাইরে গেলে একটা জিনিস ভীষণ রকমের মিস করি সেটা হলো নামাযের জায়গা এবং পরিবেশ। আমার সিডনীতে অভিজ্ঞতা আছে ছাত্রীর কিচেন টাইলসে মাথা ঠেকিয়ে নামায পড়ার, ট্রেইনের সিটে বসে মানুষের কৌতুহলী চোখ এড়ানোর প্রানপণে চেষ্টা করার সাথে সাথে নামায পড়ার। বাংলাদেশ, একটা মুসলিম দেশ। আশা করা হয় অবস্থা আরেকটু উন্নত হবে। অথচ দেখুন, কোচিং থেকে ফিরতাম যখন, তখন উল্টো দিকে মসজিদে ভাইয়া নামায পড়তো। আমি বিব্রত হয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। সবাই বেরিয়ে গেলে পিছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়তাম।
ভীষণ রকমের ইচ্ছা হতো কোন এক অদ্ভূত উপায়ে রাসুল (সা) এসে যদি দেখতেন... তাঁর সময়ে যখন একটা মসজিদও ছিল না যেখানে শুধু পুরুষেরা নামায পড়তো, এখন আমাদের মুসলিম দেশগুলোতে বেশির ভাগ মসজিদই শুধু পুরুষদের জন্য। ট্রাই ওয়ারিং হিজাব, অমুসলিম এবং নাস্তিক আত্মীয়দের মাঝে। আমি তাই করে এসেছি, স্কুলেও কখনও পজেটিভ পরিবেশ পাই নি, নামাযও পড়তাম একেবারেই একা, ৮০% মুসলিমের দেশে! অথচ নামায নাকি মুসলিম আর কাফেরের মাঝে পার্থক্য করে। আসল ব্যপার হলো, আমাদের দেশে এবং সমাজে পরিপূর্ণ ইসলামের মধ্যে থাকতে হলে রীতিমত যুদ্ধ করে থাকতে হয়। আমি তাই চাই এমন একটা পরিবেশ যেখানে আমাকে যুদ্ধ করতে হবে না। আমার সমাজ আমাকে সাহায্য করবে, দূরে ঠেলবে না। সে জন্যই অনুভব করি, রাষ্ট্র আর মিডিয়ার সাপোর্ট কত জরুরি, সেখানেই সত্যি ইসলামিক রাষ্ট্রের কথা আসছে। আমি রাস্তার পাশের অট্টালিকা আর তারই পাশের অভুক্ত মানুষগুলোকে দেখে তীব্র যন্ত্রনার সাথে একজন আবু বকর (রা) কে মিস করি, যিনি ঘোষনা দিয়েছিলেন, একটা ছাগলের দড়ির সমান সম্পদের জন্যও কেউ গরীবের অর্থ (অর্থ্যাত যাকাত) মারার চিন্তা করলে, তিনি তার সাথে জিহাদ করবেন...
অনুভব করি এসবই, কিন্তু কখনই ভাবি না, ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মুসলিমদের প্রধান দায়িত্ব। কখখনও না। রাসুল (স) নবুয়াতের ২৩ বছর পরে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, এবং তার কিছুদিনের মাঝেই তিনি মারা গিয়েছেন। ২৩ টা বছর তিনি মানুষের পাশে কাটিয়েছেন, মানুষের কষ্ট দূর করেছেন। তারপরে যখন অবস্থা এমন হয়েছে, যখন মানুষের একমাত্র বাধা সরকার, তখন তিনি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। শেষ কাঁটাটুকু তুলেছেন। সমাজের শেষ অনাচারটুকু দূর করেছেন সেভাবে। ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা শুধু মাত্র সরকার বদলের মাধ্যমে কখনও হতে পারে না। তাতে কেবল পচন কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখার মত অবস্থা হবে, কাপড়ের নিচে পচন অব্যাহত থাকবে। ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে সমাজের ক্ষতগুলো দূর করতে হবে, তারপরে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা আসতে পারে, যেটা মুসলমিদের প্রধান দায়িত্ব না, বরং সর্বশেষ দায়িত্ব। এর আগে অনেক কাজ। আমাদের মুসলিম দেশগুলোতে ড্রাগ এডিক্টদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, পর্ণোগ্রাফী বাড়ছে, হতাশা বাড়ছে, খুন বাড়ছে, ধষর্ণ বাড়ছে, এসিড বাড়ছে, বাবা মায়ের প্রতি অসম্মান বাড়ছে, মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা বাড়ছে, অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, অর্থ বাড়ছে কিন্তু অনাহারে মারা যাওয়া মানুষ বাড়ছে, নারীরা নির্যাতিত হচ্ছেন। এগুলো দূর করা এখন প্রধান কাজ। মানুষকে শিক্ষিত করা এখন প্রধান কাজ। ইসলামিক রাষ্ট্র অনেক দূরের স্বপ্ন। যেহেতু আমার জীবদ্দশায় আমি তেমন কোন সম্ভবনা দেখি না, আর মানুষের মনের গভীরে প্রত্থিত পশ্চিমা ইতিহাস মানুষকে 'ধর্ম আর রাজনীতি'র আইডিয়া সাদরে গ্রহন করতে দেয় না একদম, তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই তর্ক কখনও শেষ হবার নয়। অনন্ত কালের জন্য চলতেই থাকবে। কখনও প্রসংগ উঠলে হয়তো দু'একটা কথা বলতে পারি এখন থেকে, কিন্তু অনেক দূরের, অনেক পরের, ধরা ছোঁয়ার বাইরে সেই ভবিষ্যতকে নিয়ে এখন অর্থহীন তর্ক করার চেয়ে ভালো কাজ আছে, তাই করবো।
আর একটা ওয়ার্নিং: এই পোস্টে আমি কোন অপ্রাসংগিক মন্তব্য দেখলে আমার নিতান্ত অপ্রিয় কাজটা করবো, সোজা ডিলিট। ডোন্ট বি শকড!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০০৬ বিকাল ৪:৫৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



