... এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা...
... সব ক'টা জানালা খুলে দাও না, ওরা আসবে, চুপি চুপি, যারা এদেশটাকে ভালবেসে...
... সালাম সালাম হাজার সালাম...
... মোরা একটি ফুলে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করেছি আজ...
... আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী...
... পূর্ব দিগন্তে সূর্য্য উঠেছে...
... একতারা তুই দেশের কথা বল রে বার বার, আমাকে তুই বাউল করে সঙ্গে নিয়ে যা...
গানগুলো শুনলেই গায়ে কাটা দিতো, ভালো লাগারা স্নায়ুতে স্নায়ুতে ছুটাছুটি করতো।
আমার আর আমার ভাইয়ার সবচেয়ে প্রিয় ছিল 'সব ক'টা জানালা খুলে দাও না'। গানটা শুনলেই কেমন বিজয়ের অনুভূতির সাথে বিষন্নতা আর আশারা মিলে মিশে এক হয়ে যায়। গানটার প্রতি ভাইয়ার খুব ভালো লাগা শুরু হয় একটা ক্যাম্পে গিয়ে। একটা অন্ধ ছেলে গেয়েছিল গানটা। ছেলেটা যেন চোখের আলো হারিয়ে মনের আলোতে সত্যিই 'ওদের' দেখতে পাচ্ছিল। গান শেষ হওয়ার পরে সবার চোখে পানি। তিন দিন পরে বাসায় এসে গুট গুট করে সব গল্প বলতো আমাকে, এই ঘটনা বলেছিল যখন তখনও ওর চোখে পানি টল মল করছে, আমার মনে আছে।
তারও আগে গানগুলো শুনেছি মায়ের মুখে। কাজ করতে করতে হঠাৎ গুণ গুণ করে ওঠা। মা যেই গান গাইতো, তখন তাই আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। মা গান গাইলে মায়ের গলায় লতা ভর করতো যে! নজরুলের কিছু হামদ নাতের পাশাপাশি লতা-হেমন্ত, আর এই সব গান মায়ের সীল মারা হয়ে গেল।
এরপর গানগুলো যতবার শুনেছি, স্কুলের ফাংশনে, এখানে সেখানে, ততবার মায়ের উষ্ণ স্পর্শ লাগতো মনে, গায়ে। আশ্চর্য, খুব বেশি কিছু করলে, সেটা 'ক্লীশে' হয়ে যায়। এই গানগুলো শুনলে এখনও ভালো লাগে, বিরক্তিরা আসে না।
দেশের গান নিয়ে আমি গবেষনা করি নি, কিন্তু গত 35 বছর ধরে গানের ধারা যে বদলে গিয়েছে তা বুঝতে পারি। প্রথম দিকে গানগুলোতে সংগ্রামী চেতনা অনেক বেশি ছিল। আমাদের প্রজন্ম উদ্্বেলিত হয় 'আমি বাংলার গান গাই শুনলে'। গত 35 বছরে গানগুলো যতই বদলে যাক, গানগুলো ঠিক আমাদের অদৃশ্য সূতোয় বেঁধে ফেলে এক সাথে।
এক সূঁতোয় বেঁধে ফেলে আমাদের। যদিও, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে বিভক্ত জাতি। রাজনীতিবিদরা মুক্তিযুদ্ধের অনুভূতি নিয়ে রাজনীতি করে তাই আমাদের দেশের মৌলিক রাজনীতি আজও একেই ঘিরে।
মুক্তিযুদ্ধের পরে ঠিক এই প্রসঙ্গে এত তীব্র পর্যায়ে শিং ঠেঁকানো মল্লযুদ্ধ আগে কখনও হয়েছে বলে মনে হয় না!
স্বাধীনতা প্রসঙ্গ আসতেই অনেক অভিমান, অনেক ক্ষোভ, অনেক কষ্ট, অনেক অতৃপ্তি, অনেক অস্বস্তি, অনেক অশ্রুর অনুভূতিগুলোর দরজা খুলে যায় হাট হয়ে। গানগুলো তাই আশা হতাশার জটিল বিক্রিয়ার সুইচ টিপে দিয়ে যায় মনে। কারো মনের হতাশার আগুন, কারো আশার আলো, কারো স্মৃতির বেদনারা অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসে দু'চোখ দিয়ে।
সে যত যাই হোক, 36 বছরে যত বদলে যাক দেশ, দেশের মানুষেরা, এই গানগুলো শুনে বুকে উথাল পাথাল হয় না, তেমন মানুষ আমাদের প্রজন্মে নেই, আমাদের আগের প্রজন্মে নেই। কেন, তবে আমরা, এই ভালো লাগার অনুভূতিটাকে পূঁজি করে বাংলাদেশকে সাজাতে পারবো না সুন্দর করে? মতভেদ থাকবেই, না থাকলে আমরা মানুষ হতাম না যে! বড় বেশি রোবটিক হয়ে যেতাম! আমরা ইউটোপিয়ায় নেই, এই মতভেদের সাথেই বিচক্ষনতা আর বুদ্ধিমত্তার সাথে থাকতে হবে আমাদের। দেশের ধুঁকতে থাকা অবস্থায় আমরা প্রত্যেকে নিজে কি করতে পারি, তাই জিজ্ঞাসা করতে হবে যে নিজেদের! আর যাই হোক, আমরা নিশ্চয়ই চাই না, ইরাকের মত বাইরের হস্তক্ষেপে সারা দেশের ঝাঁঝড়া হয়ে যাওয়া? আমরা খাদের কিনারায় চলে এসেছি, এখান থেকে কোনদিকে যাবো, তা আমাদেরই ঠিক করে নিতে হবে।
আজ, বিজয়ের দিনে, দুর্নীতি, জঘন্য রাজনৈতিক মনোপলি, দারিদ্রতা, অনৈতিকতা, অসহিষ্ণুতা, সন্ত্রাসবাদ, এই সব নব্য হানাদারদের থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য নিজেরা কি করতে পারি ভাবি, চলুন। নিজের পক্ষ থেকে এই হানাদারদের সাথে যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা নেই। যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, তারা আর কিছু না পারেন, অক্ষমতার কান্নাটুকু ঈশ্বরের সামনে করে চেয়ে নিন দেশের স্বাধীনতা। দেশের মানুষের মুক্তি।
'... একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়ে,
যেথায় কোকিল ডাকে কুহু দোয়েল ডাকে মুহূর্মুহূ,
নদী যেথা ছুটে চলে, আপন ঠিকানায়... '

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


