পাঁচই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পড়ায় এক ধরনের অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল, বলা যায় তিন তিনবার যারা ক্ষমতায় বসেছে, তারা এখন না আছে ক্ষমতায় আর না আছে সংসদের বিরোধী দলের অবস্থানে। বিষয়টা এমন নয় যে জনগণের মধ্যে তাদের সমর্থন নেই। বিগত সিটি কর্পোরেশন এবং উপজেলা নির্বাচনে তাদের ব্যাপক সাফল্য প্রমাণ করে তারা একেবারে জনসমর্থনহীন হয়ে পড়েনি। বৃহৎ এই দলটির নেতৃবৃন্দের দাবি একটি ‘ফেয়ার ইলেকশন’ হলে তারাই ক্ষমতায় আসবে। অথচ এখন দলটির কার্যক্রম সীমাবদ্ধ হয়ে আছে সভা-সেমিনার আর প্রতিবাদ সমাবেশের মধ্যে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন সরকার অধিকাংশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন বিজয়ী বিশাল সংখ্যার এমপি-মন্ত্রী নিয়ে দেশ চালিয়ে যাচ্ছে দাপটের সাথে। রাজনীতির এই যখন অবস্থা তখন দেশে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে খুন-খারাবি, অপহরণ ও গুমের ঘটনা।
এতে পেশাদার ও ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা যেমন জড়িয়ে পড়েছে তেমনি জড়িয়ে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই ছিলো জনগণের ভরসা ও আস্থার প্রতীক। আর এই উভয়কেই কৌশলে ব্যবহার করছেন রাজনীতিবিদরা। এমনটা করা হচ্ছে নিজেদের পথকে নিষ্কণ্টক করার জন্যই। কেউ কাউকে আজ বিশ্বাস করতে পারছে না। এমনকি নিজেদের দলের সদস্যদেরকেও নয়। আর এর শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই। প্রায় প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্ত থেকে খবর আসছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী খুন হওয়ার। তাই তাদের মধ্যে বিরাজ করছে অজানা আশঙ্কা। রাজনৈতিকভাবে এসবের পেছনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে দোষারোপ করা হলেও দেখা গেছে অধিকাংশ আওয়ামী নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন নিজেদের অন্তর্কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। পাঁচই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নির্বাচন বানচাল করতে বিএনপি এবং তাদের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামি সহিংস আন্দোলন পরিচালনা করলেও জনগণের পক্ষ থেকে নেতিবাচক সাড়া পাওয়ার কারণে নির্বাচনের পরে তারা আর সেদিকে পা বাড়াতে সাহস করেনি। এদিকে খালেদা জিয়াসহ বিএনপির অন্যান্য নেতারা আওয়ামী লীগের গতিবিধি গভীরভাবে লক্ষ্য রাখছেন। তারা মনে করছেন জনসমর্থনহীন এবং তাদের দৃষ্টিতে এ ‘অবৈধ সরকার’ বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না। এমনিতেই তাদের নিজেদের মধ্যে অন্তর্কলহ সৃষ্টি হয়েছে। এই রোগে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ নিজেরাই পঁচে যাবে। তারা কালক্ষেপণ করছেন আওয়ামী লীগের আরো একটু পঁচার জন্য। আরেকটু পঁচলেই তারা এ সরকারের পতনে আন্দোলন শুরু করবেন।
এদিকে রাজনৈতিক বাক-বিতণ্ডায় যুক্ত হয়েছে একটি স্পর্শকাতর ও ঘৃণ্য বিষয় নিয়ে কথা চালা-চালি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র বছর চারেকের মাথায়, অর্থাৎ ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতি ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের সবাই নির্মমভাবে নিহত হন। বাদ যান শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বর্তমান আওয়ামী শাসনকে দুঃশাসন আখ্যা দিয়ে তাদের পরিণতিও ৭৫ এর ন্যায় হতে পারে বলে বিভিন্ন পক্ষ থেকে বার বার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হচ্ছে। এটা যে একেবারেই অমূলক ও উড়িয়ে দেওয়ার বিষয় নয় তা প্রমাণিত হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সৈয়দ আশরাফ এর বক্তব্যে। তিনি আশঙ্কা করে বলেছেন, দেশে আবার ৭৫ এর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। একই সাথে তিনি বলেছেন, বৈধভাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না।
গত শনিবার বিকেলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ মিলনায়তনে ছয়দফা দিবসের আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগই নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও কৌশলে ইদানীং বার বার ৭৫ এর ১৫ই আগস্টের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করলেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া কৌশলে সে কথাকেই সমর্থন করেছেন। তিনি বলেছেন, দেশে আর কখনো ১৯৭৫ এর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না। আর যদি হয় তবে তার দায় আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ গণবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বলে তারা এ আশঙ্কা করছে। দেশে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না দেওয়ার কারণে যদি আবারও ‘৭৫ এর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তবে তার দায়ভার আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। রোববার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে জিয়াউর রহমানের ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্বাধীনতা ফোরাম আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
এদিকে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ডক্টর তুহিন মালিকও বাংলা ভিশনের ফ্রন্টলাইন নামক এক অনুষ্ঠানে রাজনীতিতে বর্তমান সুনশান নিরবতাকে অতি ভয়ঙ্কর আখ্যা দিয়ে বলেছেন, বাঘ যখন শিকার ধরতে যার তখন লাফ দেওয়ার আগে সে সামান্য একটু পেছনে সরে আসে। জাতীয় জীবনে এখন চলছে সেই সময়। কি হবে তা হয়তো আমরা অনুমান করতে পারছি না, কিন্তু সবাই আশঙ্কা করছি।
এদিকে আওয়ামী লীগকে ভালোবাসেন, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন এমন সমর্থক ও শুভাকাঙ্খীরাও দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগামহীন আইন লঙ্ঘন করে বিচার বহির্ভূত হত্যা, অপরহণ, খুন ও গুমের ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন। সেই সাথে তাদের উদ্বিগ্নতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে নিজেদের মধ্যে দলীয় কোন্দল ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো। একই সাথে রয়েছে ছাত্রলীগের নানাবিধ বিতর্কিত কর্মকাণ্ড। তাদের বদ্ধমূল ধারণা আওয়ামী লীগে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং দলের জন্য প্রকৃত ত্যাগী ও নিবেদিত প্রাণ কর্মীর অভাব দেখা দিয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত নেতাদের আওয়ামী লীগে যোগদান, আবার প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়াকে মোটেই ভাল চোখে দেখছেন না। তারা মনে করেন দলের বেশিরভাগ নেতা-কর্মীরাই বর্তমানে অবৈধ পথে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। দল কোন ধরনের সমস্যায় পতিত হলে এদেরকে দলের পাশে পাওয়া যাবে না বলেও মনে করেন তারা। তাদের ধারণা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার চারদিকে যারা ঘিরে রয়েছে আসলে তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক প্রকৃত আওয়ামী লীগার। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণেই দলও আজও এই অবস্থানে টিকে আছে। দল কোন দুর্যোগে পতিত হলে তাদেরকে পাশে না পাওয়ারই আশঙ্কা বেশি। তাদের বেশিরভাগেরই মনোভাব দলের ভেতর শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করে দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের স্থান করে দিয়ে স্বার্থবাদীদেরকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হোক।
এ বিষয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা আশা করেন। একই সাথে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ বিবেচনা করে পুরো বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতার এ পক্ষের এ দলটিকেই নেতৃত্ব দিতে হবে বলে তারা মনে করেন।