প্রসঙ্গ: সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ এবং অবাস্তব অশ্বডিম্ব প্রাপ্তি!
-আবছার তৈয়বী
সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ পালন করা যাবে কি-না- এটা নিয়ে বছর দশেক যাবত বিভিন্ন লেখালেখি হচ্ছে। বাংলাদেশে ৪০ টিরও বেশি গ্রামে সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে একদিন বা দুইদিন আগে রোযা রাখা হয় এবং সেই হিসেবে মিল রেখে ঈদও উদযাপন করা হয়। মাত্র কয়েক যুগ ধরে এটি হয়ে আসছে। চট্টগ্রামে এই নতুন নিয়ম চালু করেছে- মির্জাখীল দরবার। সেই দরবারের অনুসারীরা যেখানে আছেন, তারাও সেখানে সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে রোযা পালন ও ঈদ উদযাপন করেন। মূলতঃ তারাই বাংলাদেশে এটি ছড়িয়ে দিয়েছে। আর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে- সৌদি চিন্তা-সাম্রাজ্যবাদীরা। কিন্তু মির্জাখীল দরবারের সাথে সৌদি চিন্তা-সাম্রাজ্যবাদীদের কোনই মিল নেই। দুনিয়ায় হাজারও জীবন-মরণ সমস্যা থাকতে এই একটি বিষয় নিয়ে কেন এতো হৈ চৈ হচ্ছে- বুঝি না। ১৪০০ বছর ধরে চলে আসা একটি মীমাংসিত ও আচরিত ব্যাপার নিয়ে মাতামাতি করার কোন দরকার আছে বলে আমি অন্ততঃ মনে করি না। কিন্তু আমি বা আপনি মনে না করলেও প্রশ্ন যখন ওঠেছে- উত্তর অবশ্যই দিতে হবে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে- যদি আপনি 'সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ' পালন করার পক্ষে মত দেন- তো '১৪০০ বছর ধরে কারোই রোযা ও ঈদ শরীয়ত সম্মতভাবে হয়নি'- বলেই ধরে নিতে হবে। এ এক অসম্ভব ব্যাপার! এই মত ধরে নিলে যে সব দিনে রোযা রাখা হারাম, সে সব দিনেও রোযা রাখা হয়ে যায় এবং যে সব দিনে রোযা রাখা ফরজ সাব্যস্থ হয়, সে সব দিনে রোযা রাখা হয় না। এর অর্থ দাঁড়াল- ওই মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া ১৪০০ বছর ধরে আর কারো রোযাও পূর্ণ হয়নি এবং কারো ঈদও হয়নি। প্রত্যেকে গুনাহে কবিরা এবং হারাম কাজ করেছেন। ব্যাপারটি কতোটা ভয়াবহ চিন্তা করেছেন?! শুধু তাই নয়, তেমনিভাবে চাঁদের সাথে সম্পর্কিত কোন তারিখের কোন ফজিলত মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া পৃথিবীর সব মুসলমানরাই বঞ্চিত ছিলেন বলে ধরে নিতে হয়! তার মানে আপনার মিলাদুন্নবী (দরুদ) হয়নি! আপনার ফাতেহায়ে ইয়াজদাহুম হয়নি! আপনার শবে মি'রাজ হয়নি! আপনার ঈদুল আযহা হয়নি! হায়, হায়... আপনার কি খুব বেশি আফসোস হচ্ছে- ভাই?
আরে ভাই, অাফসোস করার কোনই দরকারই নেই। কারণ, তাদের মত মানলে এই উম্মতের কারোরই রোযা, ঈদ এবং চাঁদের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য কোন ইবাদাতই হয়নি। কোন আউলিয়া, কোন ইমাম, কোন তাবয়ে তাবেঈন, কোন তাবেঈন, এমনকি অনেক সাহাবী (রিদ্বওয়ানুল্লাহি তায়ালা আলাইহিম আজমাঈন)- কারোরই রোযা ও ঈদ হয়নি! যা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। চিন্তা-সাম্রাজ্যবাদী সৌদিয়া এই বিষয়টি বিশ্ব মুসলিমের 'মরা ঘোড়া' ওআইসির কাঁধেও সওয়ার করেছিল। সৌদি সমর্থিত 'রাবেতায়ে আলমে ইসলামী'র ওলামা কাউন্সিলেও তুলেছিল। সৌদিয়ার খরচেই দল-মত নির্বিশেষে মুসলিম বিশ্বের বাঘা বাঘা উলামারা এতে অংশগ্রহণ করেছেন এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছাড়াই তাদের কনফারেন্স সমাপ্ত হয়েছিল। তার মানে তারাও বোঝাটি ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন। এর পর সৌদির ও সৌদি মদদপুষ্ট প্রস্তাবকরা চুপসে যায়। কারণ, এতে সৌদি উলামারাও একমত না। এর আড়ালে তাদের উদ্দেশ্যটা হলো- চিন্তা-সাম্রাজ্যবাদকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া। আর সৌদির চিন্তা-সাম্রাজ্যবাদ বুঝেন তো? সেটা হলো- ওহাবীবাদ আর সালাফীবাদ। মানে- মাযহাব বিরোধী মতবাদ, ওলী- আউলিয়া বিরোধী মতবাদ, ইমাম-আয়িম্মা বিরোধী মতবাদ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বিরোধী মতবাদ, সর্বোপরি আল্লাহ-রাসূল (দরুদ) বিরোধী এক ঈমান বিধ্বংসী মতবাদ। কিন্তু কেউ কেউ এই বিষয়টি বর্তমান সরকারের মাননীয় ধর্মমন্ত্রী এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ডিসি মহোদয়েরও মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। তাঁরা বিষয়টির ব্যাপকতা বুঝে বাংলাদেশের সকল মতের উলামাদের এক টেবিলে বসিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেন। কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা! চিল্লাচিল্লি,যাতায়াত খরচে আর ভুরিভোজনে কতগুলো টাকার শ্রাদ্ধ ছাড়া আর কিছুই হয়নি! সবখানেই আলোচনার ফলাফল দাঁড়ায়- 'একটা বড় ধরণের অশ্বডিম্ব'। সেই 'অশ্বডিম্ব'কে ভাগাভাগি করে উলামারা যার যার গন্তব্যে ফিরে গেছেন। বলুন- আলহামদু লিল্লাহ!
জেনে রাখুন- মূলতঃ 'রূইয়তে হিলাল' বা চাঁদ দেখা বিষয়টি দীনের মূল ইবাদাতের মধ্যে পড়ে না। এটি দীনের 'ওয়াসায়েল' বা অনুষঙ্গের মধ্যে পড়ে। এটি মূল ইবাদাত নয়, কিন্তু ইবাদাত শুদ্ধ হওয়ার প্রধান অনুষঙ্গগুলির একটি। এই ইস্যুটির পক্ষের এবং বিপক্ষের প্রধান দলীল হলো- একটি হাদীসে রাসূল (দরুদ)। আল্লাহর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামা ইরশাদ করেছেন-صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته فإن غم عليكم فاقدروا له ثلاثين অর্থাৎ "তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখো এবং চাঁদ দেখে রোযা ছাড়ো। যদি তোমাদের কাছে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন বলে অনুমিত হয় ( যেখানে চাঁদ দেখার সম্ভাবনা না থাকে) তাহলে তোমরা শা'বানের ত্রিশ দিন পূর্ণ করো"। মজার ব্যাপার হলো- সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা পালন ও ঈদ উদযাপনকারীরাও এই হাদীসটিকেই দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
'সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ' হলে صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته فإن غم عليكم فاقدروا له ثلاثين হাদীসে রাসূলের (দরুদ) ওপর আমল হয় না। ইসলামী শরীয়তে আমর (নির্দেশসূচক শব্দ) সাধারণ অর্থে ওয়াজিব হয়। আর বিশেষ ক্ষেত্রে 'নুদুব' বা মুস্তাহাব হিসেবেও পরিগণিত হয়। কিন্তু কোন অবস্থাতেই মুস্তাহাব থেকে নীচে নামে না। এটি উসুলে ফিকাহর একটি নীতিমালা। রোযা রাখার ক্ষেত্রে صوموا ও ছাড়ার ক্ষেত্রেও وأفطروا সাধারণভাবে প্রত্যেকের ওপরই ওয়াজিব হয়। 'উলিল আমর' (আইনি দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ) চাঁদ দেখে থাকলে বা 'উলিল আমর' কোন বালিগ, আক্বিল এবং আদিল দুই মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষীর প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে, সেক্ষেত্রে চাঁদ দেখাটা সাধারণ মুসলমানের জন্য জন্য সুন্নাত, মুস্তাহাব বা মুস্তাহসান হয়ে যায়। কিন্তু 'উলিল আমর' এর সিদ্ধান্ত মানাটা সকলের ওপরই ওয়াজিব হয়। 'উলিল আমর' এর সিদ্ধান্ত মানার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের ওয়াজিবের ওপর আমল আদায় হয়ে যায়। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই সরকারি বা বেসরকারিভাবে 'রূ'ইয়তে হিলাল কমিটি' বা 'চাঁদ দেখা কমিটি' আছে। তারা শরীয়ত প্রস্তাবিত কোয়ালিটির আদিল, আকিল ও বালিগ সাক্ষীদের চাক্ষুস সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন এবং তা আইনি কর্তৃপক্ষ বা সরকারে সিদ্ধান্ত হিসেবে দেশব্যাপী নির্দেশনা হিসেবে ছড়িয়ে দেন। যারা 'সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ' উদযাপন করেন- তারা যেমন হাদীসে রাসূলের (দরুদ) ওপর আমল করেন না, ঠিক তেমনি এই বিষয়ে 'উলিল আমর'ও মানেন না। এমনকি সেই সম্প্রদায়ের কেউই চাঁদ দেখার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন না। তারা আন্ধা লোকের মতো নিজেদের শোহরতের জন্য অন্যের অনুসরণ করেন মাত্র। আর হাদীস অস্বীকার করে অন্যের অনুসরণ করা সম্পূর্ণই হারাম।
আপনি দেখবেন- 'সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ পালন' করার পক্ষের লোকেরা বিভিন্ন কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। বিভিন্ন মাযহাববের ইমামের সিদ্ধান্তসমূহ দিয়ে থাকেন। কিতাবের উদ্ধৃতি ও সিদ্ধান্তগুলো ঠিকই আছে। কিন্তু তাদের নিয়ত বা উদ্দেশ্যটি ঠিক নেই। তাদের উদযাপনের পদ্ধতিটা ঠিক নেই। তারা যতই দলিল দিক বা হাদিসটিকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন- মূল ব্যাপারটি আসে শাহাদাতের (সাক্ষীর) বেলায়। দীনের সকল ক্ষেত্রেই সাক্ষীর বেলায় 'চাক্ষুষ সাক্ষী' অতি অবশ্যই জরুরি। 'চাক্ষুষ সাক্ষী ছাড়া ইসলামী শরীয়তে অন্য কোন সাক্ষী গ্রহণযোগ্য নয়'। মনে রাখবেন, "শরীয়তের দৃষ্টিতে কোন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন 'চাক্ষুষ সাক্ষী'র স্থলাভিষিক্ত হয় না"। তাই আরবে বা অন্য কোন স্থানে চাঁদ উদয় হলে তা ফ্যাক্স, টেলেক্স, টেলিগ্রাম, টেলিফোন, অডিও বা ভিডিও কল, রেডিও এবং টিভির সংবাদ, ইন্টারেন্ট বা ওয়েব ফ্রিকোয়েন্সি, এপস এবং অন্যান্য ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করে দূরবর্তী কোন দেশে যেখানে উদয়স্থলের হুকুমত চলে না, বা 'উলিল আমর' (আইনি দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ) তথা সরকার বা রুইয়তে হিলাল কমিটির কাছে দুইজন চাক্ষুস সাক্ষী স্বশরীরে এসে সাক্ষ্য দেয় না সেখানে চন্দ্রোদয়ের সংবাদ গ্রহণযোগ্য হবে না। এটাই হচ্ছে- লাস্ট এন্ড ফাইনাল কথা। মজার ব্যাপার হচ্ছে- যারা এই হাদীসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে বিশ্বের কোথাও চাদ দেখলে সকলের ওপরই তার হুকুম বর্তানোর ঝুটা দাবী করেন বা হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা করেন বা ইসলামী অাইনজ্ঞ ও ফিকাহবিদদের উদ্ধৃতিগুলো নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন- তারা জানেনই না যে, খোদ মধ্যপ্রাচ্যেই সব দেশে একই দিনে রোযা পালন এবং ঈদ উদযাপন করা হয় না! তাহলে তারা কিসের ভিত্তিতে উম্মতের মাঝে ফিতনা করছেন? সবচেয়ে বড়ো কথা- রমজানের রোযা পালন এবং ঈদ উদযাপনের তারিখ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইসলামে কোন ধরণের ফিরকাবাজিও নেই, ইখতিলাফও নেই। এই 'ইখতিলাফহীন' একটি বিষয়কে যারা ইখতিলাফের ডোরে বেঁধে ফিতনা ছড়াচ্ছেন- তারা ভালো কাজটি করছেন না। ইত্তিহাদে উম্মাহর স্বার্থে তাদেরকে চিহৃিত করুন এবং বয়কট করুন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার- মুহতারাম Mohammad Ali দাদা! যাঁর অনুরোধে আমি এই লেখাটি লেখার সৌভাগ্য সৌভাগ্য অর্জন করলাম।
বি.দ্র: ফিতনা নির্মূলে এবং মানুষকে আসল সত্যটি জানানোর লক্ষে সওয়াবের নিয়তে লেখাটি বেশি বেশি শেয়ার করুন। আর কপি করে অবিকৃতভাবে লেখাটি সর্বত্র ছড়িয়ে দিন।
তারিখ: ০৫ জুন, ২০১৭ খৃ.
আবুধাবি, ইউ.এ.ই।