(1)
সূর্যের আলো যখন হেলে পড়লো তখন
কাধে ব্যাগ নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলাম।
অনেকবার কলিংবেল দেওয়ার পরও
মিলির কোন সাড়াশব্দ নেই।প্রচন্ড
মেজাজ খারাপ হচ্ছে।পাশের
সিড়িতে বসে পড়লাম।পকেটে হাত
দিলাম মিলিকে ফোন দেওয়ার জন্য
কিন্তু পকেটে হাত দিতেই
সিগেরেটের প্যাকেট হাতে
ঠেকলো।বের করলাম একটা বেনসন।
অল্প বয়স থেকে পোড় খাওয়া কালো
ঠাট দিয়ে বেনসনের মধু গ্রহন করতে শুরু
করলাম।এমন সময় সিড়ির শেষ মাথায়
মিলিকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে
উঠতে দেখলাম। মাথার সব মেজাজ
মুখে এনে দিলাম ঝারি। ঝারি
খেওয়েও মুখের হাসিটা মিলির
মিলিয়ে গেল না।
চাবি দিয়ে দরজা খুলতে খুলতে
বললো বাজারে গিয়েছিলো।
বাসায় ঢুকে রুমে এলাম। শাওয়ারের
ঠান্ঠা পানি দেহ স্পর্শ করলেও তা
মন স্পর্শ করতে পারলোনা। মাথা
মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলাম। গিয়ে
বসলাম নাস্তার টেবিলে। মিলি
রান্নাঘরে কাজ করছে।আবার একটা
বেনসন খুব আয়েশ করে খেতে শুরু
করলাম
এমন সময় মিলি এসে শুরু
করলো প্যানপ্যান।আজকাল খুবই বিরক্ত
লাগে মিলিকে।বিরক্ত লাগে তার
ভালোবাসা।
এমন সময় মেসেজ আসলো মোবাইলে
বহু প্রতিক্ষিত মেসেজ সিথীর
মেসেজ।
(2)
সিথী ভার্সিটি সেকেন্ড
ইয়ারে পড়ে। লেখেপড়ায় যেমন
ভালো তেমনি তার আচরন। প্রতিদিন
সে ভার্সিটি যেতে বাস স্ট্যান্ড
দাড়াতো এবং খেয়াল
করতো পাশেই এক দোকানে যুবক
বাইক থামিয়ে সিগারেট কিনতো।
সিথী ভাবতো রোজ এক প্যাকেট
সিগারেট লাগে!!
তবে যুবকটাকে তার ভালই লাগতো
মুখে খোচা খোচা দাড়ি,গায়ের
রং শ্যামলা,উচ্চতা মাঝারি,স্বাস্থ্য
ভালই।এভাবে কোন একদিন ঝিরি
ঝিরি বৃষ্টিতে রাস্তায় কাদা
জমেছিল।যুবকটি যখনই বাইক থামালো
কাদার ছিটা গিয়ে পড়ল সিথীর
গায়ে।যা মুখে আসে তাই
বেরোলো সিথীর মুখ দিয়ে।যুবক যতই
সরি বলে
সিথীর মুখ যেন আর থামেনা।বাধ্য
হয়ে যুবক বাইক নিয়া পগারপার।পরে
সিথীর অনুতাপ হয় এবং সেই
অনুতাপের বোঝা লাঘব করতে
গিয়েই পরিচয় যুবকের সাথে।সেই
থেকে আজ যুবক তার হৃদয়ের মাঝে
প্রবল ভালোবাসার ঢেউ তুলে।
আজ
সকাল থেকেই সিথীর উপর
দিয়ে যথেষ্ট চাপ গেছে।
২টা পরীক্ষা ছিলো।বাসায় ফিরেই
জানতে পারে মা
নানি বাড়ি গেছে কাল আসবে।
সিথি তাই দ্রুত ফ্রেশ হয়ে
গাধাটাকে মেসেজ দিলো যে
ঘুরতে বের হবে।
(3)
সিথীর মেসেজ
পেয়েই আমি দ্রুত
একটা টিশার্ট পড়লাম মানিব্যাগটা
নিয়েই স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে বের
হওয়ার
সময় মিলিকে বললাম রাতে
খাবোনা। বলে বেরোতে যাব এমন
সময় পিছন থেকে দিহান ডাকলো।
দিহান আমার ছেলে ৭ বছরের।
যাকে আমি আমার জীবন থেকেও
বেশি ভালোবাসি। আমাকে বললো
বাবা কই যাও।বললাম ফাইয়াজ
আঙ্কেলের বাসায় যাবো। ওখানে
আমার সব বন্ধুরা আসবে। আড্ডা
দিবো।ছেলে আমার বলে সেও
আমার সাথে যাবে।এমন সময় মিলি
আসলো। মিলি বললো বাবা তোমার
বাবা যাবে আর আসবে।আমার
দিকে তাকিয়ে মিলি বললো রাত
করোনা বেশি।ইচ্ছা না থাকলেও
ছেলেকে মিথ্যা বলায় বিবেক
আমাকে প্রতি মুহূর্তে পুড়য়ে খেতে
থাকলো। রিক্সা নিলাম।
(4)
রিক্সা থেকে নামতে নামতে
দেখি সিথী নীল শাড়িতে
দাড়িয়ে।যেন এক মেঘবালিকা।
অন্যকোনদিন হলে হাটুগেড়ে দেরি
হওয়ার জন্য সরি বলতাম।চাঁদের
মিষ্টি আলো দিতাম তার খোপায়।
চেহারায় হয়তো আমার অনুতাপের
ছায়া ছিলো।তা দেখে সিথী
বললো কিসু হইসে এত লেট
কেন?আমি বললাম না কিসু না
দিহান আসতে চাচ্ছিলো।ফাকি
দিয়ে এলাম। সিথী বললো ওকে
নিয়ে আসতে। শুনে হাসলাম।শুকনো
হাসি।বললাম চলো খেতে বসি।
খাওদাওয়ার ফাকে সিথী যা
বললো তাতে অনুতাপের বোঝার
সাথে যোগ হলো চিন্তার বোঝা।
সিথীকে নাকি আগামী সপ্তাহে
দেখতে আসবে। খাওয়া শেষ করে
নিষ্প্রান ভাবে তাকে বাসায়
পৌছে দিলাম।এরপর রিক্সা নিলাম।
গন্তব্যস্থল বাসা। ধরালাম
প্যাকেটের শেষ বেনসন।এই
সিগারেটের ধোয়ার ঘুর্ণিঝড়েও
ক্ষমতা নেই যে আমার এই চাপের
বোঝা উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
বাসায় ঢুকলাম। মিলি দরজা খুলে
দিলো।
(5)
ঘরে ঢুকেই রুমে গিয়ে বিছানায় গা
এলিয়ে দিলাম।ঘুমের ভান করে শুয়ে
থাকলাম।
মিলি এসে দেখলো আমি ঘুমাচ্ছি।
আমার মাথায় হাত
বুলিয়ে দিতে দিতে সে ঘুমিয়ে
পড়ল। শুরু হল আমার
বিবেকের পুড়িয়ে খাওয়া আর
চিন্তার বোঝার বুকে চেপে বসা।
ভাবতে শুরু করলাম আমার ছেলের
কথা।তার একটা সুন্দর ভবিষ্যত দেয়া
আমার দ্বায়িত্ব। মনে পড়ল মিলির
কথা।কি দোষ মেয়েটার।ও তো
আমাকে পাগলের মত ভালোবাসে।
অনেক বিশ্বাসও করে।আজ যখন বললাম
ফাইয়াযের বাসায় যাবো চাইলেই
খোজ নিতে পারতো তা সে
নেয়নি। মনে পড়লো সিথীর কথা
মেয়েটার বয়স অল্প। ভালোবাসে
আমাকে।৮ মাস ৩ দিনের সম্পর্ক।আমি
তার কাছে কিছুই লুকাই নি।
বলেছিলাম আমি বিবাহিত। আমার
ছেলে দিহানকে আমি অনেক
ভালোবাসি।তাও নাকি সে
আমাকে চায়। ভালই চলছিলো সব।
প্রায় বিকেলে আমি সিথীর
কোলে মাথা রাখতাম।দেখতাম
কিভাবে পাখির ডানায় আলো
ঝলকানি দেয়।সারাদিন অফিস
শেষে ক্লান্ত পিঠ যখন এলিয়ে
দিতাম তার পিঠে শুষে নিত আমার
ক্লান্তি সে।ভালই লাগে তার সঙ্গ।
তবে তা কি ভালোবাসা??মিলির
সাথে আমার বিয়ের ৯ বছর।দিহান ৭
বছরের। তবে এদের ভালোবাসা
থেকে কি আমার সিথীর আট মাসের
সম্পর্ক বেশী মুল্যবান?সিথী এখনও
বিয়ে করেনি তার একটা সুন্দর
ভবিষ্যত আছে।
সে হয়তো আমাকে ভালোবাসে
তবে বয়স কম হওয়ায় বাস্তবতার উত্তাপ
সে টের পাচ্ছে না।তাকে এই ভুল
থেকে সরিয়ে নেয়ার দ্বায়ভারো
তো আমার। ভাবতে ভাবতে উঠে
বসলাম।টেবিল থেকে এক গ্লাস
পানি খেলাম। ছেলের ঘরে
গিয়ে দেখি গুটিশুটি মেরে শুয়ে
আছে। অপরাধের বোঝা আর বইতে
পারলাম না। তা চোখ দিয়ে ঝরে
পড়লো।এগিয়ে গিয়ে আমার চাঁদের
কপালে চুম্বন একে দিলেম।ভাবলাম
আমি দিহান আর মিলির সাথে যে
প্রতারনা করছি তার প্রায়শ্চিত্ত
করতে হবে।সিথীর কাছে ক্ষমা
চাইতে হবে।ওকে ভুল থেকে বের
করে আনতে হবে। গিয়ে রুমে শুয়ে
পরলাম।শীত শীত লাগছিলো।কাথা
আর
না খুজে শুয়ে পড়লাম।
(6)
ঘুম যখন
ভাঙ্গলো গায়ে কাথা আবিষ্কার
করলাম।যাতে মিলির ভালোবাসার
ছোয়া পাওয়া যায়। নাস্তা করতে
করতে সিথীকে মেসেজ দিলাম
জরুরী দেখা করার জন্য।মিলিকে
বললাম দিহানকে স্কুল দিয়ে এসো।
যাওয়ার আগে অনেকদিন পর
মিলিকে বুকে টেনে নিলাম।বুকে
সেই আগের মত সমুদ্রের পানি আছড়ে
পড়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম।
অনেকদিন পর বেশ ভালো লাগছে।
বাইক স্টার্ট দিলাম। গন্তব্য সেই বাস
স্ট্যান্ড যেখেনে সিথীর সাথে
প্রথম দেখা। গিয়ে দেখি আজ
প্রথমবারের মত সিথী লেট।একটা
বেনসন ধরালাম। সিথীকে আসতে
দেখে আধা খাওয়া সিগারেটটি
ফেলে দিলাম।অর্ধ শেষ
হওয়া সিগারেটটি যেন আমার আর
সিথীর প্রেমের প্রতীক আজ।সিথী
এসেই বললো হঠাৎ
জরুরি তলব??কি আজই বিয়ে করবে
নাকি। আমি হেসে বললাম বাইকে
উঠো। গিয়ে থামলাম লেকে।
কিভাবে বলবো বুজতে পারছিলাম
না। বললাম তুমি বসো।আমি
আসতেসি।একটু আড়ালে গিয়ে পুরা
ব্যাপারটা আমি মেসেজে লিখে
ওকে সেন্ড করলাম।ও
ভাবলো যে এটা হয়তো আমার নতুন
কোন পাগলামি।মেসেজ খুলে যখন
পড়তে শুরু করল সে যে শক্তি হারাতে
শুরু করলো তা বুজতে পারলাম।কিছুখন
পর তার সামনে আসলাম।
ভেবেছিলাম সে ডুকরে কেদে
উঠবে।কিন্তু না সে শীতল গলায়
বললো কোন অভিযোগ নেই আমার।শুধু
শেষ অনুরোধ আমাকে বাসায় পৌছে
দাও।বাসায় পৌছানোর পথে সিথী
একটাও কথা বললোনা।যাওয়ার
বেলায় খালি বললো ভালো
থেকো।
(7)
বাসায় এসে সিথী দেখলো
মা বাসায়। অসময়ে মেয়েকে ঘরে
দেখে মা জিগ্গেস করল কিরে অসুস্থ
নাকি।সিথীর যে কথা বলার শক্তি
নেই।শুধু
সে মাথা নাড়লো।
রুমে গিয়ে মেসেজটা সে বারবার
পড়তে লাগলো।পড়তে পড়তে কখন যে
ঘুমিয়ে পড়লো।মেসেজের কথাগুলা
অধো ঘুম আধো জাগরন অবস্থায় কানে
বাজতে থাকলো।এই ঘুম ভাঙ্গলো
বিকালে।
উঠেই সে গোসল করেই মায়ের
মুখামুখি হলো।লজ্জা শরমের মাথা
খেয়ে মাকে তার বিয়ে এক
সপ্তাহের মধ্যে
দেয়ার জন্য অনুনয় করতে থাকলো।
(8)
সিথীকে নামিয়ে দিয়ে মনটা একটু
খারাপ লাগছে ঠিক করলাম আজ
অফিস যাবোনা। ফোন দিলাম সাইফ
ভাইকে বললাম ভাই শরীর খারাপ আজ
আসবো না।বসকে বুঝায়ে বইলেন।
বাইক ঘুরালাম রিয়াদের অফিসের
দিকে।সব ব্যাপার
রিয়াদকে খুলে বললাম।মন বেশ
হালকা লাগছিলো। দুপুরে এক
সাথে লান্ঞ্চ করলাম। বিকালে
পার্কটাউন গিয়ে বসলাম সব বন্ধু এক
সাথে।দুটা খাবার পার্সেল নিলাম।
দিহান আর মিলির জন্য। বাইক
চালাতে চালাতে ভাবছি
কিভাবে মিলিকে সব খুলে বলবো।
যখন সিড়ি দিয়ে উঠছি পকেটের
মোবাইল তিনবার ভাইব্রেট হলো।
মানে মেসেজ আসছে।পকেট থেকে
মোবাইল বের করে দেখি সিথীর
মেসেজ।প্রচন্ড ভয় পাচ্ছি । তবে কি
সিথী কোন দাবি নিয়ে দাড়াবে
আজ?? মেসেজটা খুলে অবাক হলাম
সিথী লিখেছে আগামী সপ্তাহে
আমার বিয়ে।অনুরোধ থাকলো
স্বপরিবারে এসো। প্রচন্ড ভারী
কোন
বোঝা নেমে গেল বুক থেকে।
কলিং বেল দিতেই মিলি দরজা
খুললো পাশেই দিহান। দিহান
জিগ্গেস করলো বাবা কি এনেছো।
আমি বললাম খুলেই দেখো।
মিলি অভিযোগের সুরে বললো আজও
খেয়ে এসেছো।
আমি একটা হ্যাসূচক হাসি দিলাম।
রুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে হতে ভাবলাম
অপরাধের বোঝা শেষ করতে সিথীর
বিয়ের দিন মিলিকে সব বলবো।
দরকার হলে সব উজাড় করে মিলিকে
জড়িয়ে ধরে কাঁদবো। ভাবতে
ভাবতে অপরাধের
বোঝের ভার সামিয়িক লাঘব করার
দ্বায়িত্ব বেনসনের উপর ছেড়ে
দিলাম। বহুদিন পর আমি মিলি আর
দিহান এক সাথে টিভি দেখলাম।
ঘুমটাও বেশ ভালই হয়েছে।
(9)
আজ সেই কাঙ্খিত দিন।সিথীর
বিয়ে। আমি অফিস থেকে ছুটি
নিয়েছি। প্রীয়সির কাছে সব খুলে
বলব। ছুটির কথা মিলিকে জানালাম
না। মিলিকে বললাম অফিসের পথে
যাবার সময় দিহানকে স্কুল নামিয়ে
দিবো।ছেলে আমার মহা খুশি
বাইকে চড়বে।বাবার সাথে যাবে।
দিহানকে নামিয়ে দিয়ে
ফ্ল্যাটের সামনে আসতেই দেখি
অনেক মানুষের ভিড়।
বিল্ডং থেকে কালো ধোয়া যেন
নীল আকশকে ঢেকে ফেলতে
চাইছে।লোক মুখে শুনলাম গ্যাস লাইন
থেকে আগুনের উৎপত্তি। দাড়িয়ে
থাকার সকল
শক্তি হারিয়ে ফেললাম।
(10)
এখন মিলি
রাতের আকাশের নক্ষত্র হয়ে মিটি
মিটি হাসে। আমি আর দিহান
রাস্তায় একা হাটি।
বিকালে আমি হাজারো
ছায়ার ভিড়ে আমার আর দিহানের
ছায়ার পাশে মিলির ছায়া খুজে
বেরাই। সেই না বলা কথাগুলো বলার
প্রতীক্ষা শুধুই বাড়ে।আর বাড়ে
নিজের উপর ঘৃনা। এই বুকে আর
কোনদিন হয়তো সমুদ্রের পানি আছড়ে
পরার আওয়াজ আর শুনতে পাবো না।
শুনেছি সিথী বিয়ে করেছে।সুখী
আছে সে।তবে অপরাধের
বোঝা থেকে আমার
মুক্তি পাওয়া আর হলো না।ক্ষমা করে
দিও আমায়
মিলি। থাকতে মূল্য বুঝিনি তোমার।
কষ্ট দিয়েছি তোমায় প্রতারনা
করেছি তোমার সাথে।তার
বিনিময়েও
তুমি আমায় দিয়েছো নির্ভেজাল
ভালোবাসা। আকাশের আলো
ছায়ার মাঝে আজো তোমাকে
খুজি অপরাধের বোঝা থেকে মুক্ত
হতে।
বসে থাকি তোমাকে ফিরে
পাওয়ার মিথ্যা আশায়।
জোছনার
আলো মুঠো করে দিহানকে দিয়ে
বলি নে তোর মায়ের ভালোবাসা।
ভালোবাসি তোমায় মিলি