ডুমেলা বতসোয়ানা-১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আগেরগুলো পড়তে চাইলেডুমেলা বতসোয়ানা-৯
বতসোয়ানা ভার্সিটির দিনগুলো
আমি আমার মতো করে থাকি তাই আমার প্রতিবেশী ছাত্রদের সঙ্গে তেমন একটা দেখা হয় না। মাঝে মধ্যে রুম থেকে বের হওয়ার সময় কাউকে সামনে দেখলে হাই-হ্যালো টাইপের সৌজন্য বিনিময় হয়। আমি সহজভাবে তাদের সঙ্গে মিশতেও পারি না। কারণ আমার মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে গেছে ল্যাপটপটি চুরি যাওয়ার পর থেকে। মনে হয় তাদের সঙ্গে মিশলে বন্ধুত্বের ছলে আবার এটি চুরি করে নিয়ে যাবে। এখানে আসার ঠিক দ্বিতীয় মাসের মাথায় বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা আমার একমাত্র বন্ধু ল্যাপটপটি চুরি যায়। এটি ছিল ২০০৬ সালের অক্টোবরের তিন তারিখ। গ্যাবরন শহরে গিয়েছিলাম। আমি যখন বাইরে যাই ল্যাপটপটি কেবিনেটে ঢুকিয়ে দরজায় তালা মেরে গিয়েছি। যেতে যেতে দেখলাম ক্লিনিং লেডি ক্লাস্টারের মেঝে মুছছে। প্রতিদিনই সকাল ১০ টায় নিয়মিত সে আসে। তার কাছে প্রতিটি রুমের Master key থাকে। শিক্ষার্থী কেউ না থাকলেও সে সবার রুমে যেতে পারে। প্রতিদিন ধুয়ে মুছে পুরো ক্লাস্টারটাকে সে ঝকঝকে করে রাখে।
ডুমেলা মা।
ক্লাস্টারের মূল দরজা দিয়ে বেরুতে বেরুতে ক্লিনিং লেডিকে আমি বতসোয়ানার কালচার অনুযায়ী সৌজন্য জানাই।
ডুমেলা রা...বলে মধ্যবয়সী লেডি হাসিমুখে প্রত্যুত্তর দেয়। লেডিকে আমি সংক্ষেপে বলি যে বাইরে বেরুচ্ছি। আমার রুম আজ পরিস্কার করার দরকার নেই। কাল করলেই চলবে। লেডি কি বুঝেছে কে জানে। দুর্বোধ্য সেটসোয়ানা ভাষায় (বতসোয়ানার ভাষা সেটসোয়ানা) কি কি যেন বলে ওঠে। আমি আর কথা বাড়াই না। তাড়া আছে। ক্লাস্টারের মূল দরজাটা বাইরে থেকে লক করে আমি নিশ্চিন্তমনে বেরুলাম। এখন যাবো গ্যাবরন। অনেকদিন পর মোলেপোলেলে থেকে আমার বন্ধু ফজলু গ্যাবরন এসেছে। ওর মনটা ভীষণ খারাপ। মোবাইলে সংক্ষেপে এইটুকুই জানিয়েছে। আজ সকাল থেকে আমার মনটাও ভীষণ খারাপ। কী কারণে তা জানি না। মন খারাপ দুই বাল্যবন্ধু একসাথে হলে কিছুটা মন ভালো হবে নিশ্চিত। এই ভেবেই আমি গ্যাবরন শহরে শামীমের বাসায় যাচ্ছি। ওখানেই ফজলু আসবে।
বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ার পর ওর কাছ থেকে যা শুনলাম তাতে বজ্রপাত হলেও আশ্চর্য হতাম না। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে ও এককথায় ওর ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে একেবারে চলে এসেছে। চোখে অপার স্বপ্ন নিয়ে সে বতসোয়ানা এসেছিল। ওর ছোট ভাই মুজিবের একটি টেক অ্যাওয়ে পরিচালনা করবে নিজের নামে। আস্তে আস্তে ভাইয়ের টাকা পরিশোধ করে দেবে। এই ছিল শর্ত। কিন্তু দীর্ঘ এক বৎসরেও এই ফয়সালা হয়নি। তাই আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য ভাইয়ের কাছ থেকে চলে আসা। গ্যাবরনে কোথায় থাকবে, কোথায় খাবে তা জানা নেই। তবে যেহেতু অনেকদিন ধরে বতসোয়ানা আছে ব্যবস্থা একটা না একটা হয়ে যাবেই। ওর সাথে বসে বসে দীর্ঘক্ষণ ভবিষ্যত পরিকল্পনা করলাম। আমরা একটি বিজনেস প্ল্যান চুড়ান্ত করলাম। এদেশে ব্যবসা করা সহজ। শুধু পুঁজি দরকার। এই পুঁজি কোত্থেকে আসবে তা নিয়ে ভাবার সময় নিয়ে বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। হোস্টেলে ফিরতে রাত আটটা। ফিরতে ফিরতে আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল আজ আমার জন্যও কোন দু:সংবাদ অপেক্ষা করছে। চাবি দিয়ে মূল ক্লাস্টারের দরজা খুললাম। তারপর আমার রুমের দরজা খুললাম। লাইট জ্বালিয়ে কেবিনেটের দিকে তাকিয়ে দেখি কেবিনেটের দরজার তালা ভাঙ্গা। আমার বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লেগেছিল যে আমার ল্যাপটপ চুরি গিয়েছে।
যখন বুঝতে পারলাম প্রথমেই মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখলাম। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে বসলাম এই মুহূর্তে আমার করণীয় কি। ছুটে গেলাম ইউনিভার্সিটির সিকিউরিটি অফিসে। ওখান থেকে একজন অফিসার আমাকে নিয়ে বতসোয়ানা পুলিশ স্টেশনে আসল। পুলিশ স্টেশনটি গ্যাবরনে মেইন মলের পাশেই। নানান কিসিমের মানুষে গিজ গিজ করছে অফিসারের রুমটি। এখানেও কিউ। আমার সামনে ৩/৪ জন লোক। আমি ভাবছি কিভাবে সংক্ষেপে আমার ল্যাপটপ হারানোর বিষয় বুঝাবো। আমার পালা এলে সংক্ষেপে ঘটনাটা বলি। অফিসার আমার হাতে কয়েকটি ফরম ধরিয়ে দিয়ে তা পূরণ করে আবার এখানে আসতে বলে। ফরমটি নিয়ে আরেকটি টেবিলে বসে আমি তা পূরণ করি। কখন চুরি হয়েছে, কিভাবে চুরি হয়েছে, জিনিসটির মূল্য কত, সন্দেহভাজন কারও নাম বলতে পারবো কিনা ইত্যাদি তথ্যে ফরমটি ঠাসা। আমি যথাসম্ভব সংক্ষেপে লিখলাম। এছাড়া আলাদাভাবে পুলিশ কমিশনার বরাবর একটি আবেদনও লিখলাম। সেই অফিসার আরও কয়েকজন পুলিশ নিয়ে আমাকেসহ রওনা হলো। রাত প্রায় ১১ টা বাজে। অফিসার হোস্টেলে আমার রুমে এসে বিস্তারিত দেখে এবং জেনে নোট করে নিল। বিদায় বেলায় আমাকে আশ্বস্ত করে বলল যে, খুব শীঘ্রই আমার ল্যাপটপ উদ্ধার করে দেবে।
ল্যাপটপ ছাড়া সত্যিকার অর্থেই যে এখানে আমি অসহায় ল্যাপটপ হারানোর পর তা বুঝতে পেরেছি। যাহোক শেষমেশ অনেক কষ্টে ধার করে (আশরাফ নামে এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে চার মাস পর অর্থ পরিশোধের শর্তসাপেক্ষে) আরেকটি ল্যাপটপ জোগাড় করেছি ঠিকই কিন্তু রুম ছেড়ে বের হলেই মনে সব সময় একটা ভয় লেগেই থাকে, পাছে এটি আবার চুরি যায়। এবার চুরি গেলে আমি নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবো। কারণ ল্যাপটপ ছাড়া এখানে এই ইউনিভার্সিটিতে আমি এক মুহূর্তও টিকতে পারবো না। ইন্টারনেট অ্যাকসেসসহ আমার এই ক্ষুদ্র কক্ষটিই আমার স্বদেশ, আমার বিশ্ব। বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করার একমাত্র যোগসূত্র আমার এই ল্যাপটপটি। অক্টোবরের তিন তারিখ বিদেশে আমার একমাত্র বন্ধু বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা এই ল্যাপটপটি চুরি যাওয়াতে আর যাই হোক এই কিছু দিন আগেও যে জাতিটি অসভ্য, বর্বর ছিল তাদের মধ্যে আমি সত্যিই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে লাগলাম।
বতসোয়ানা ইউনিভার্সিটির হলে থাকি। মাঝে মধ্যে আমার নিজের ভাষায় কথা বলতে প্রচন্ড ইচ্ছা করে। এমনই ইচ্ছা যে, কথা বলতে না পারলে মনে হয় আমি মারা যাবো। মাঝে মধ্যে আমার এ রকম হয়। কিন্তু এখানে আমার গণ্ডিটা এতোটাই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে যে, সারা দিনেও প্রায় কারো সঙ্গেই কথা বলা হয় না। একা রুমে পড়ে থাকি। কোথায় যাবো, কার সঙ্গে গিয়ে গল্প করবো এই বিদেশে? এখানকার আমার সহপাঠী যারা তাদের সঙ্গে কথা বলে আমি আরামবোধ করি না। একে তো ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত ভিন্নতা তার ওপর আবার ল্যাপটপটি চুরি যাওয়ার পর থেকে ভয়, কেউ না আবার বন্ধু সেজে এসে এটিও সুযোগ বুঝে চুরি করে নিয়ে যায়। দেশি ভাষায় প্রাণখুলে কথা বলতে না পারলে যে আমার সুখ হয় না। এখানে বাঙালি কিছু পরিবার এবং ব্যাচেলর বাঙালি আছে। বিদেশের মাটিতে সবাই সবার কর্মব্যস্ততা নিয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি উপলক্ষ্যে বাঙালিদের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটে।
তাছাড়া সবার সঙ্গে সবার দেখা হওয়ার তেমন উপায় নেই। এখানে যে ক'জন বাঙালি পরিবার নিয়ে থাকেন তাদের মধ্যে সাজ্জাদ ভাই বতসোয়ানা সরকারের একজন আইটি কর্মকর্তা। আরেকজন সবুর ভাই বতসোয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগের শিক্ষক। ডা. আরুস্তু বতসোয়ানা হসপিটালের ডাক্তার। সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন এবং অনেক দূরে দূরে থাকেন। আরেকটি সমস্যা হলো কোথাও যেতে হলে স্থানের দূরত্বের কারণে গাড়ি লাগবে। গ্যাবরন শহরে সব রুটে কুম্বি চলাচল করে না। যাতায়াতের অসুবিধার কারণে বাঙালি কারো সঙ্গে দেখা করা আমার পক্ষে অনেকটা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তাই কথা বলতে না পেরে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো ধার করে নতুন কেনা ল্যাপটপটি নিয়েই আমি আমার জগৎ রচনা করি।
বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূর সুদূর বতসোয়ানা ইউনিভার্সিটির আমার নিজস্ব জগতে বসে আছি। বতসোয়ানা ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স হোস্টেলে আমার জন্য বরাদ্দকৃত সিঙ্গেল রুমে। এখন বাজে বিকাল পৌনে চারটা। বাইরে ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের হই-হল্লার আওয়াজ পাচ্ছি। শনি এবং রবিবার এদেশে সাপ্তাহিক ছুটি। ওরা বলে উইকএন্ড। উইকএন্ড মূলত শুরু হয় শুক্রবার বিকাল থেকেই। এ সময় থেকেই ওদের আনন্দোৎসব শুরু হয়ে যায়। আনন্দোৎসব নয় যেন রীতিমতো পানোৎসব। ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের জন্য একটি পানশালা আছে। নাম স্টুডেন্ট বার। শুক্রবার সন্ধ্যায় সেই বারটি থাকে সরগরম। ফার্স্ট ফ্লোরে আমার রুমের পূর্বদিকের জানালা দিয়ে সেই বারটি স্পষ্ট দেখা যায়। এদেশে মদ-বিয়ার খুবই সহজলভ্য। পানির দরে মদ বিকোয়। প্রকাশ্যে মদ-বিয়ার পান এখানে স্বাভাবিক ব্যাপার। ছেলে-বুড়ো সবার হাতেই মদের বোতল, বিয়ারের বোতল দেখি। প্রকাশ্যে মদ-বিয়ার খেয়ে বাজনার তালে তালে ছেলে-বুড়ো সবাই নাচতে থাকে। অবশ্য এই জাতি এমনিতেই নাচে। নাচতে নাচতে কথা বলে, নেচে নেচে পথ চলে। আর সর্বত্রই মিউজিক। মার্কেট, সুপার মার্কেট, স্টেশনারি দোকান, রেস্টুরেন্ট (এরা বলে টেক অ্যাওয়ে) সারাক্ষণ মিউজিক বাজতেই থাকে আর যেখানেই বাজনার আওয়াজ সেখানেই এদের নাচ। এ দেশে শহরের ভেতরে চলাচলের জন্য আমাদের দেশের টেম্পো জাতীয় এক প্রকার বাহন আছে এগুলোকে বলা হয় কুম্বি। কুম্বির মধ্যে যখন পুরো ভলিউমে গান বাজিয়ে ড্রাইভারসহ যাত্রীরাও বসে বসে কোমর দোলাতে থাকে আমার মনে হয় একটি নাচুনে জাতির দেশে এসে পড়লাম। জাহাঙ্গীর নামে এখানকার এক ছোট ভাইয়ের মন্তব্য ‘কেয়ামতের আগে দজ্জাল পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়ার সময় নাকি ঢোল-নাকাড়া বাজাতে বাজাতে আসবে। ওর ধারণা, দজ্জাল নির্ঘাত এই কুম্বিতে চড়েই আসবে।’
চলবে...
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন্যায়ের বিচার হবে একদিন।

ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন
J K and Our liberation war১৯৭১


জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।