ডুমেলা বতসোয়ানা-১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
মিস বতসোয়ানা
আগের গুলো পড়তে চাইলে-ডুমেলা বতসোয়ানা-১০
আমি আমার জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি। আমার রুমের পূর্বদিকের জানালা দিয়ে ইউনিভার্সিটির বারটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাদের হইচই-এর আওয়াজ, মাঝে মধ্যে মদ কিংবা বিয়ারের বোতল আছড়ে ভেঙে ফেলার শব্দ এগুলো স্পষ্ট কানে ভেসে আসছে। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। এরা মদ-বিয়ার খেয়ে আছড়ে ভেঙে রাখে। চারদিকে ভাঙা কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। বিশেষ করে বারগুলোর সামনে ভাঙা কাঁচের টুকরা দেখলে মনে হয় যেন একদল উন্মত্ত মাতাল গাড়ি ভাঙার মতো কাঁচ ভেঙে মহোৎসবে মেতেছিল। যাই হোক জানালা দিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম বেশ কিছু মেয়েও বারে ছেলেদের পাশাপাশি মদ-বিয়ারের বোতল হাতে পান করে চলেছে। এ দেশে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু যে ব্যাপারটা আমার মাথায় আসে না সেটা হলো, এরা মদ-বিয়ার পান করার জন্য এতো টাকা পায় কোথায়?
এদেশি একজন ছাত্রের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানলাম সরকার এদের প্রচুর টাকা দেয় পড়াশোনার ভর্তুকি হিসেবে। এ টাকা দিয়ে ওরা পড়াশোনার যাবতীয় ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়ারও খরচ চালিয়ে থাকে। আমি যে হোস্টেলে থাকি এর কিচেন ক্যাবিনেটে একদিন কি একটা খুঁজতে গিয়ে দেখি পুরো ক্যাবিনেট ভর্তি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ এবং বিয়ারের বোতল। পরে জানলাম পিএইচডি অধ্যয়নরত ছাত্র মোরাফি এগুলোর মালিক। ওর সঙ্গে আলাপ করে জানলাম উইকএন্ডে সে এগুলো সাবাড় করবে। শুনে তো আমার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। এতোগুলো মদ-বিয়ারের বোতল সে এই দুই তিন দিনেই সাবাড় করবে, তাও একা একা!
শুধু ইউনিভার্সিটি কেন, বতসোয়ানার সর্বত্রই মদ-বিয়ার পান রীতিমতো ওপেন। শহরের বিভিন্ন সুপার মার্কেটে মদ-বিয়ার বেচা হচ্ছে। এখানে লিকুয়ারাম নামে শুধু মদ-বিয়ার বিক্রির জন্য আলাদা বার আছে। কিছু কিছু বারের বাইরে কয়টি টেবিল-চেয়ার রাখা আছে। মদ খেয়ে তারা নাচে, গলা ছেড়ে ইংরেজি গানের সুর বাজে, কেউ আবার উদ্দাম নৃত্য আরম্ভ করে দেয়।
এদেশে এইডসের হার অত্যন্ত বেশি। অবশ্য পুরো আফ্রিকা মহাদেশ জুড়েই এইডস ভয়াবহ আকার ধারণ করে আছে। এ রকম একটি প্রাণঘাতী ভয়াবহ রোগের প্রকোপ সত্ত্বেও দেশটির নাগরিকদের মধ্যে সেক্স বিষয়ে তেমন কোনো সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে অশিক্ষিত নাগরিকদের মধ্যে। দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা মাত্র ১৫ লাখ। এইডস-এর কারণে ২০৫০ সালে নাকি দেশটির জনসংখ্যা কমে দাঁড়াবে ১১ লাখে। বিষয়টি খুবই ভাবনার বটে।
বতসোয়ানার অধিকাংশ তরুণ মাথার চুল কামিয়ে ফেলে। অনেক মেয়েও মাথা ন্যাড়া করে ফেলে। ওদের মাথার চুলগুলো এমনই কোঁকড়ানো যে, আমাদের মতো লম্বা হওয়ার সুযোগ পায় না। চুল কামিয়ে ফেলে জট পাকানো পরচুলা পরে। বিনুনি করা জটের মতো চুলগুলো মাথার চারধারে সাপের মতো ঝুলতে থাকে। আর যারা একটু ফ্যাশন সচেতন তারা বিচিত্র ফ্যাশনভারে মাথা সাজায়। ছেলে-মেয়েদের মাথায় পরচুলা দেখতে পাওয়া যায় খুব। এরা হেয়ার-ড্রেসারে গিয়ে চুলের খুব পরিচর্যা করে। এ ধরনের হেয়ার ড্রেসারে চুল পরিচর্যার খুব ডিমান্ড এবং খুব খরচও বটে। দুই থেকে আড়াইশ পুলা খরচ হয় একবারের চুল পরিচর্যায় যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় দুই আড়াই হাজার টাকা। বিচিত্র ধরনের চুলের পরিচর্যা সেসব। মেয়েদের মাথার ছোট ছোট চুলগুলোতে কৃত্রিম চুল দিয়ে চিকন সাপের মতো বিনুনি গাঁথা হয়। পুরা মাথাটার মধ্যে এমনভাবে বিনুনিগুলো বিন্যস্ত থাকে যে, দেখলে আমাদের দেশের ধানের জমিতে সারিবদ্ধভাবে চারা লাগানো জমির কথা মনে হয়।
ছেলেরাও এ রকম চুলের সাজে সজ্জিত হয়। মেয়েরা তাদের চুলগুলোকে আরো অনেক রকমভাবে সাজায়। সাপের ফনার মতো করে চুলগুলোকে যখন সাজায় আমার কাছে মেয়েগুলোকে বিষধর নাগিনীর মতোই মনে হয়। অনেক সময় আবার আনারসের উপরের পাতাগুলো যেভাবে চারধারে ছড়িয়ে থাকে সেভাবে করেও সাজায়। মনে হয় আস্ত একটি কালো আনারস যেন মাথায় বহন করে চলছে। আরো বিচিত্র সে সাজ-সজ্জা চুলের। বিউটি পার্লার থেকে একবার চুল পরিচর্যা করে আসার পর অনেক দিন পর্যন্ত তা এভাবে রেখে দেয়া হয়। ছেলেমেয়েরা যে চুল ভিজায় না তা তো স্পষ্ট বোঝা যায় একই সাজ অনেক দিন দেখলে। পাছে আবার এতো দামি চুল পরিচর্যা না আবার নষ্ট হয়ে যায় এই কারণেই বোধহয় চুল ভিজায় না। এখানকার কালো নেটিভদের চুল পরিচর্যার বেশ কিছু সেলুন আছে। এগুলোতে বাঙালি বা ইনডিয়ানরা যায় না। ছুরি, কাঁচির আঘাত খেয়ে এইডসের জীবাণু দেহে ঢুকে পড়ে সেই ভয়ে। পুরো গ্যাবরন জুড়ে দু’একটি ইনডিয়ান সেলুন আছে। এগুলোতে চুল কাটাতে বিশ পুলা চার্জ করা হয়। সেলুনের ব্যবসা এখানে খুব লাভজনক। কিন্তু বর্তমানে বতসোয়ানা সরকার বিদেশিদের জন্য এই ব্যবসার পারমিট দিচ্ছে না।
বতসোয়ানা দেশটিকে ঘুরে দেখেছি। বিশেষ করে রাজধানী গ্যাবরন শহরটিকে দেখেছি ভালো করে। বটসোয়ানার মূল টাউন দুটি। একটি গ্যাবরন এবং অপরটি ফ্রান্সিস টাউন। আরো কয়েকটি ভিলেজেও গিয়েছিলাম। এ কয় দিনে বতসোয়ানা দেশটিকে আমি যতোটুকু সম্ভব দেখার চেষ্টা করেছি। আমার দেখার মূল বিষয় ছিল দেশটির মধ্যে সম্ভাবনাময় কি কি আছে যা আমাদের দেশে নেই। বতসোয়ানা দেশটির উল্লেখযোগ্য যে কয়টি বিষয় আমার সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে বতসোয়ানার বাণিজ্যনীতি এবং অপরটি বতসোয়ানার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা।
উদার বাণিজ্য নীতির কারণে সত্যিকার অর্থেই বতসোয়ানা একটি বিনিয়োগবান্ধব দেশ। বিদেশি বিনিয়োগকারীকে সহজেই বতসোয়ানায় প্রবেশাধিকার দেয়া হয়। এ সুবিধাটুকু অপব্যবহৃত হচ্ছে এখানকার কতিপয় বাঙালি এবং পাকিস্তানি আদম ব্যবসায়ী দ্বারা। বতসোয়ানায় এসে শুনলাম এখানে ঘুষ কালচারটি চালু হয়েছে এক রকম অসাধু আদম ব্যবসায়ীদের দ্বারাই। সাউথ আফ্রিকা পাচারের জন্য সহজ ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে কোনো আদমকে প্রথমে বতসোয়ানা আনার প্রয়োজন হয়। এজন্য ওই ব্যক্তির নামে
কোম্পানি খুলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ওয়ার্ক পারমিট, ভিসা ইত্যাদি তৈরির জন্য একটি চক্র গড়ে উঠেছে।
বতসোয়ানায় আইটি সেক্টরে, মেডিকাল সেক্টরে, টেকনিকাল সেক্টরে দক্ষ জনশক্তির প্রচুর অভাব। সরকার এদিকে নজর দিলে বিশ্বে আমাদের দক্ষ জনশক্তি রফতানির একটি নতুন দেশ হিসেবে বতসোয়ানা পরিচিতি পেতে পারে। শিল্প ইন্ডাষ্ট্রি স্থাপনের জন্য বড় বিনিয়োগের পাশাপাশি ক্যাটেল পোস্ট, ভেজিটেবল ফার্ম, পোল্টি ফার্ম, বেকারি, বিস্কিট কারখানা, মোম কারখানা, প্লাস্টিক কারখানা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ছোট বিনিয়োগের জন্যও বতসোয়ানা একটি আদর্শ স্থান হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
বতসোয়ানার বাণিজ্য নীতির পাশাপাশি এ নীতিকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা কাজ করে যাচ্ছে। এটিই হচ্ছে ওপরে আলোচিত আমার মনোযোগ আকর্ষণকারী সেই সাপ্তাহিক পত্রিকা। এ বিষয়ে বলার আগে বতসোয়ানার পাবলিকেশন্স-এর ওপরে একটু আলোকপাত করা যাক। এই দেশে আমাদের দেশের মতো দৈনিক পত্রিকা নেই। অর্থাৎ সপ্তাহের সাতদিনই পত্রিকা বেরোয় না। শনি, রবি উইকএন্ড বাদ দিয়ে বাকি পাঁচদিন বেরোয় এ রকম সেমি-দৈনিক পত্রিকা তিনটি। দি ডেইলি নিউজ নামে এ রকম একটি সরকারি পত্রিকা আছে যেটি পাঠকদের মাঝে ফ্রি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এটির জনপ্রিয়তা তেমন নেই এবং এর গ্রাহক সংখ্যাও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। দি গেজেট এবং ইকো নামে আরো দুটি পত্রিকা আছে। সাপ্তাহিক কয়েকটি পত্রিকা আছে। এদের মধ্যে দি ভয়েস, দি মনিটর, সানডে টাইমস উল্লেখযোগ্য।
বতসোয়ানায় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেও বেশ কয়েকটি দৈনিক এবং সাপ্তাহিক আসে। মাঝে মধ্যে এ পত্রিকাগুলোতে বতসোয়ানার কিছু উল্লেখযোগ্য কিংবা চাঞ্চল্যকর খবর লিড নিউজ হিসেবে থাকে। এখানকার পত্রিকাগুলো ট্যাবলয়েড টাইপের। অবশ্য ব্রডশিটেও কিছু পত্রিকা পাওয়া যায়। তবে 'দি বতসোয়ানা অ্যাডভার্টাইজর' পত্রিকাটি আমার কাছে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী মনে হয় এর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে। এতোগুলো পত্রিকার ভিড়ে কেন এটি আমার মনোযোগ বেশি আকর্ষণ করেছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি যা জেনেছি তাতে মনে হলো বতসোয়ানার বাণিজ্যনীতিকে কেন্দ্র করেই পত্রিকাটি বাণিজ্য করে যাচ্ছে। পাঠকরা, গ্রাহকরা বিনামূল্যেই তা পাচ্ছেন। আমি ভাবি আমাদের দেশেও যদি এ রকম একটি পত্রিকা থাকতো যেটি বিনামূল্যে পাঠকরা হাতে পাবেন। প্রচলিত পত্রিকাগুলোর পাশাপাশি এটি একটি তথ্য ব্যাংক হিসেবে মানুষের কাছে থাকবে। আমাদের বাংলাদেশেও এ রকম একটি পত্রিকা করা সম্ভব। বতসোয়ানার ১৫ লাখ জনগোষ্ঠীর বাজারকে টার্গেট করে যদি শুধু বিজ্ঞাপননির্ভর একটি পত্রিকা চলতে পারে ১৫ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে কি বিশাল সম্ভাবনাময় হতে পারে এ রকম একটি পত্রিকা।
চলবে...
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন্যায়ের বিচার হবে একদিন।

ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন
J K and Our liberation war১৯৭১


জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।