১লা জানুয়ারী, ২০১৪। হঠাৎই শেষ দুপুরে ফোন এলো ভোলা যেতে হবে। কি আর করা বাসায় গিয়ে কোনরকম ব্যাগ গুছিয়ে সোজা সদরঘাট। অনেক কষ্টে লঞ্চের একটা ডাবল কেবিনের একটা ছিট প্ওায়া গেল। মানুষের কোলাহল, ঠান্ডা বাতাস আর বুড়িগঙ্গা নদীর পঁচা দুর্গন্ধ - লঞ্চটা যত তারাতারি ঢাকা ছেড়ে যায় ততই মঙ্গল। নদীতে ভ্রমন আমার সবচেয়ে প্রিয়, আর লঞ্চে রাতের খাবার মানে, মনে রাখারমত সুস্বাদু। এবার অনেকদনি বাদে লঞ্চে চড়ছি। আগে সুযোগ পেলেই লঞ্চ জার্নি করতাম। জোস্না রাত হলেতও কথাই নেই। বারান্দায় বসে হেডফোন কানে দিয়ে গান শুনতে শুনতে রাত কভার । সবশেষ মনেহয় ২০১০ এ বরিশাল গিয়েছিলাম। লঞ্চটা সদরঘাট ছাড়ল রাত আটটায়। বেয়ারা খাবার দিয়ে গেল নয়টার দিকে। ডাল চর্চরি, ইলিশ মাছ, সব্জি আর সাদাভাত। দেখতে বেশ লাগল, কিন্তু মুখে দিতেই মনে হল এক ঢাইকিলোকা থাবরা খেলাম। পুরা রান্নায় কেরোসিনের ফ্লেবার, না এরচেয়ে বাসা থেকে ম্যাডামের হাতের রান্না করা খাবার সাথে না নিয়ে যে ভুল করেছি তা হারে হারে টের পেলাম।
শার্ট চেঞ্চ করে একটা টিশার্ট পরে নিলাম। এসময় আমার নিত্য সঙ্গি রবি ঠাকুরের গান অথবা জগজিৎ সিং এর গজল আর একটা বই। হেডফোন কানে লাগিয়ে ম্ওালানা আবুল কালাম আজাদের ”ইন্ডিয়া উইনস্ ফ্রিডম” খুলে আধশোয়া হয়ে পড়তে শুরু করলাম। বইয়ের অর্ধেকটা আগেই পড়া, আজ বাকিটুকু শেষ করতে হবে। এই বইটা পরতে গিয়ে আমি প্রতিটা পৃষ্টায় ম্ওালানার আজাদের তীব্র অভিমান আর পরাজয়ের বেদনা খুজে পেয়েছি। তিনি পাঠককে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, দেশ বিভাগের পূর্বের কয়েকটা বছরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যদি একটু অন্যরকম ভাবে ঘটতো, তাহলে হয়তো ভারতবর্ষের ইতিহাস আজ ভিন্ন কলমে লিখতে হতো। তিনি যা আশা করেছিলেন তার কিছুই বাস্তবরূপ লাভ করেনি। কানে বেজে চলেছে - নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধু সুন্দরী রুপসী হে নন্দনবাসিনী উর্বসী। হয়তো মানুষের মাঝে এরকম একজন বসবাস করে যাকে কোন সম্পর্কের সজ্ঞায় সীমাবদ্ধ করা যায় না। অথচ সম্পর্কহীন সম্পর্কটা অনন্তকালের। হঠাৎই গানটা থেমে গেল মোবাইলের রিংটোনে, ম্যাডামের ফোন। রাত তখন দশটা। এতক্ষন খেয়ালই ছিল না, আরো আগেই একটা ফোন করা প্রয়োজন ছিল। বাসায় তিনটা শিশু রেখে চলে এসেছি। একটা প্রাপ্ত বয়স্ক শিশু আর দুইটা অপ্রাপ্ত বয়স্ক, যাদের কাছে পৃথিবী মানেই আমি। আর গত শতাব্দির একজন আমি এখন আর একা নই, চারজন আমি। আর এই চারজন আমির সামনে একা আমি ভীষন সংকীর্ন, অনেক প্রশ্ন নিজের কাছে। জানি এসবের উত্তর কোনদিন্ও মিলবে না। কারো সাথে কোনদিন শেয়ারও করা হবে না। আমার এইসব শিশুরা ভীষণ লক্ষী শিশু। একটা সহজ সরল অতি সাধারণ মানুষযে কতটা অসাধারণ হতে পারে তা আমি আমার নিজের জীবনে উপলব্ধি করতে পারছি। যে মানুষটা সাথে না থাকলে হয়তো কোনদিন বুঝতেই পারতাম না। কিভাবে যেন এই মানুষটা হয়ে গেল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ নারী, যে ভালবাসায় ভোলায় মোরে মিছে আশায় ভোলায় না, দু:খ সুখে দোলায় মোরে কল্পনাতে দোলায় না, সেই তো আমার প্রিয়। যে সকল ঝড়ের আঘাৎ থেকে বাঁচায় মোরে আগলে রেখে, প্রদীপ হয়ে নিজেই জ্বলে, আগুন হয়ে জ্বালায় না, সেই তো আমার প্রিয়। হঠাৎই মনে পরলো আজ ১লা জানুয়ারী, ২০১৪। সিট! এই মানুষটার সাথে একটি চুক্তিপত্র সই করেছিলাম ১লা জানুয়ারী, ২০০১ তারিখে একসাথে থাকবো বলে। সারাটা দিন কেটে গেল, একবারও মনে পরল না।
চারিদিকে আবার কোলাহল আর বৈদ্যুতিক আলো, মোবাইলে দেখি রাত সোয়া বারোটা। বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম চাঁদপুর এসে গেছি। একটু বের হবার জন্য দরজাটা সামান্য খুলতেই আবার এক ঢাইকিলোকা থাবরা খেলাম, ভয়াবহ ঠান্ডা থাবরা। সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে বিছানায়। আমার সহযাত্রী ভদ্রলোক হুইসেল বাজিয়ে ঘুমে বেঘোর প্রায় ঘন্টা দু’য়েক যাবৎ। লঞ্চটা চাঁদপুর ছাড়ল, থেমে গেল কোলাহল। চারদিকে আবার অন্ধকার। আজ হয়তো শুক্লপক্ষ।
১৯৪৬ সালের ভয়াবহ দাঙ্গা। হিন্দু মারছে মুসলমান, মুসলমান মারছে হিন্দু। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দ্দী সাহেব কোনভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছেন না। দিনের পর দিন না খেয়ে না ঘুমিয়ে ছুটে চলেছেন কোলকাতা শহরের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। কেন্দ্রীয় সরকারে কাছে মিলিটারী চেয়ে বার বার আবেদন করেও কোন সাড়া পাচ্ছেন না। হঠাৎই কেবিনটা ভয়ংকর রকম আলোতে ভরে উঠলো। এত আলো কিসের? কোথা থেকে এলো? এতটাই আলো যে, আলোর উৎস ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না। আলোটা তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে, মনে হচ্ছে আলোর উৎস তীব্র গতিতে লঞ্চের দিকে ধেয়ে আসেছ। হতবিহ্বল হয়ে অনুমান করার চেষ্টা করছি। হঠাৎ করেই আলোটা ডানদিকে ঘুরে গেল, তীব্রতাও কমে গেল। অস্পষ্ট আলোয় যা দেখলাম, তা অবাস্তব। একটা দানব আকৃতির হোভারক্রাফট। বাংলাদেশে মেঘনা নদীতে হোভারক্রাফট ? কিভাবে সম্ভব ? কবে এলো এই জিনিস ? স্বপ্ন দেখছি নাতো ? আমিতো ঘুমাইনি, স্বপ্ন দেখবো কিভাবে ? সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। হোভারক্রাফটটা আছড়ে পরল আমাদের লঞ্চের উপর। আর প্রচন্ড শব্দে লঞ্চটা আছরে পরল নদীতে। আমি ছিটকে পরলাম, লঞ্চের দেয়ালের সাথে মাথায় ভীষন আঘাৎ পেলাম। লঞ্চটা তলিয়ে যাচ্ছে, আমি তলিয়ে যাচ্ছি, চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আমি জ্ঞান হারালাম।
যখন জ্ঞান ফিরল দেখি শুয়ে আছি নদীর পারে বালুর উপর। সমস্ত শরীর ভেজা, ভীষন ভারী মনে হচ্ছে নিজেকে। নরাচরা করতে পারছি না। চারিদিকে অসংখ্য লোকজন। আরো বেশ কয়েকজন শুয়ে আছে আমার আশেপাশে। পুলিশ ঘুরে বেরাচ্ছে এদিক সেদিক। দু’জন পুলিশ এলো আমার কাছে। আমার সাথে কোন কথা না বলেই আমার পকেট হাতরাতে শুরু করে দিল। আমি বার বার বললাম, আপনারা কি করছেন? আমার পকেটে হাত দিচ্ছেন কেন? আমার কথা কানেই নিল না। হিপ পকেট থেকে মানি ব্যাগটা তুলে খোজাখুজি শুরু করল একজন। সবতো ভিজে ছয়লাব। মানিব্যাগের মধ্যে আছেই মাত্র হাজার দুয়েক টাকা, এটিএম কার্ড, কিছু ভিজিটিং কার্ড আর ভোটার আইডি কার্ডের একটা ডুপ্লিকেট। পুলিশ সবসময় আনরোম্যান্টিক, ভোটার আইডি কার্ডটাই তার পছন্দ হলো। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে আর আমার দিকে তাকাচ্ছে বার বার। আর একজনতো আমার পানিতে ভেজা মোবাইল অন করতে না পেরে, মোবাইল থেকে সিমটা খুলে ইতিমধ্যে নিজের সেটে ঢুকিয়ে নিয়েছে। আমি তখন ভাবছি, দেকিনা কি করে ? আমার সিম থেকে কারো সাথে ফাও কথা বলবে, বলুক। হাতে মোবাইল টিপতে টিপতে একসময় কানের কাছে ধরল। এক সময় বলা শুরু করল - হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। আমি চাঁদপুর থানার সাব ইন্সপেক্টর বলছি। আমি যার নম্বর থেকে আপনাকে কল দিয়েছি, তিনি কি আপনার পরিচিত বা আত্মীয় ? একটু চুপ, তারপর- গতরাতে চাঁদপুরের কাছে যে লঞ্চটা ডুবে গেছে, উনি সেই লঞ্চে ছিলেন। Sorry, he is no more.
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:৫৬