somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অভিজিৎ থেকে কয়েক গজ দূরে... By Arif Jebtik

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাত সোয়া ৯টা। শাহবাগের জাদুঘরের সামনের অংশটা ফাঁকা ফাঁকা। বইমেলা ফিরতি আমি, জয়ন্ত দা আর মাসুম ভাই শেষবারের মতো চায়ের কাপে চুমুক দেই। এই সময়ে এখানে ওখানে বইফেরা আরো কিছু তরুনের জটলা। একজন বলে, 'একটু আগে সোহরাওয়ার্দীর গেটে কুপিয়েছে।'
আমরা কান খাড়া করি। ভার্সিটি এলাকা, অনেক রাজনৈতিক সমীকরন। আমি জিজ্ঞেস করি, "উদ্যানের ভেতরে না বাইরে?" ছেলেটি জবাব দেয়, "বাইরে, টিএসসির সামনে। সঙ্গে একটা মেয়েও ছিল। দুজনকেই কুপিয়েছে।" তাহলে রাজনীতির কিছু নয়, হয়তো প্রেম সংক্রান্ত ব্যাপার। আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এর মাঝে আরেকজন বলে, 'মনে হয় বইমেলা থেকে ফিরছিল।'
এইবার কেন যেন আমার চায়ের কাপ ছলকে উঠে। অকারন। কেউ কিছু বলেনি। আমি দ্রুত টুটুল ভাইকে ফোন দেই, "অভিজিৎ-বন্যা কি মেলায়?" তিনি বলেন, "না, বেরিয়ে গেল একটু আগে। আমরাও বেরিয়ে গেছি।" আমি বলি "ফোন করেন তো। এক্ষুনি ফোন করেন। টিএসসির সামনে একটু আগে হামলা হয়েছে, ওরা কোথায় আছে দেখেন।" আমার কণ্ঠের উত্তেজনা বেরিয়ে আসে। টুটুল ভাইকে ফোন করার পর আমি মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করি। তারপর আবার ফোন করি তাঁকে, ফোন ব্যস্ত। এই ফাঁকে সচলায়তনের গ্রুপে তাঁদের নাম্বার কারো জানা আছে কি না জানতে চাই।
সময়কালে মোবাইলে নম্বর খুঁজে পাওয়া যায় না, হাত কাঁপে।

টুটুল ভাই আরো কিছু সঙ্গী নিয়ে ততক্ষনে শাহবাগে। অভিজিৎ এর ফোন বন্ধ। জল্পনা কল্পনা হয়, আমরা কি খামোখাই প্যানিক হয়ে গেছি, নাকি সত্যিই ঘটে গেছে কিছু? মাসুম ভাই-জয়ন্ত দা দ্রুতই ঢাকা মেডিকেলে আমাদের বন্ধুদের ফোন করতে থাকেন। আহতদের নামটা জানলে নিশ্চিত হওয়া যেত। নয়তো এখুনি হাসপাতালে যাওয়া দরকার।

ততক্ষন থেকে ঢাকা মেডিকেল থেকে ফোনের জবাব আসে, 'আহত লোকটি প্রফেসর অজয় রায়ের ছেলে। অবস্থা খুব খারাপ। এবি পজেটিভ রক্ত লাগবে।' টুটুল ভাইরা লাফ দিয়ে রিক্সায় উঠেন। আমরা ডানে বামে তাকাই। ততক্ষনে আমাদের আশেপাশে আরো কয়েকজন। এবি পজেটিভ রক্ত কার আছে? কী শুনলাম, এবি পজেটিভ নাকি বি পজেটিভ? রক্ত কোথায় পাই, কার কাছে আছে এই সহজলভ্য রক্ত?'

এমন নয় যে অভিজিৎ এর সঙ্গে আমার অনেক ঘনিষ্টতা। অনলাইনে ভার্চুয়াল পরিচয় অনেক বছর, মিথস্ক্রিয়া হয়তো দুয়েকবারের। এই তো মাত্র কয়েকদিন আগে মেলায় কয়েকমিনিটের দেখা, খুব ব্যস্ততায় ছিলেন দুজনেই, স্টলের সামনে একদঙ্গল ব্লগার, কে একজন একটা ছবিও তুলেছিল আমাদের সকলের। প্রথম দেখায় দুজনকেই ভালো লেগেছিল কিন্তু দাঁড়িয়ে শান্তিতে দুদণ্ড কথা বলার সুযোগ হলো না আমাদের। আজ তার জন্য আমরা সবাই অস্থির হই কেন?

প্রত্যেকে তাঁদের আশেপাশে তাকায়। কয়েকজনের নাম স্মরণে আসে আমাদের সকলের। নিজেদের মতো করে ফোন করতে থাকি। আমার হাত কাঁপে। কেউ একজন বলে ফেসবুকে আপীল দেন।
আমাদের এক সতীর্থ মেয়ে এগিয়ে আসে, এবি পজেটিভ রক্ত আছে তাঁর। তাঁকে রওনা করিয়ে দেই। অপেক্ষায় থাকি আরো ২ জনের, একজন বাসে আছে শাহবাগে নেমে পড়বে। এই ২জন নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে।

মাসুম ভাই ছুটোছুটি করতে থাকেন। একটা প্রতিবাদী মিছিল হওয়া দরকার। আমি বোকার মতো বলি, 'মিছিল করে কী করবেন?' তিনি অবিশ্বাসের চোখে তাকান। আমি বলি, প্রোগ্রাম দিলে কালকে দেন, আজকে দরকার নেই। মাসুম ভাইয়ের পাশ থেকে কেউ একজন বলে, "হুমায়ূন আজাদ আহত হওয়ার পরেও প্রথম মিছিল করেছিল মাসুম ভাই।" আমি ভাবি তাতে কী লাভ হলো, দশবছর পরেও কি হামলা কমেছে? মাসুম ভাই ক্ষনে ক্ষনে দৌঁড়ায়। স্বর্ণযুগের জাসদী আকরাম ভাইকে দেখি তার পুরোনো মূর্তিতে, দুই হাত মুঠো করে শরীর শক্ত করে গর্জায়। সাংবাদিকরা দুয়েকজন ফোন করা শুরু করেছে ততক্ষনে। 'অভিজিৎ এর নামের বানান কী? ত নাকি খন্ড ত?'

আরো কিছু মেলা ফেরতা লোক ততক্ষনে শাহবাগে। একটা ছেলের শার্টে রক্তের দাগ। অভিজিৎকে ধরাধরি করে তুলে দিয়ে আসা গুটিকয় লোকের একজন। আমি তখন কাকে যেন রক্তের জন্য ফোন করছি। একপাশে টেনে নেয় আমাকে। তারপর ফিসফিস করে বলে, "এত রক্ত লাগবে না ভাই। মাথায় কোপ মেরেছে, মগজ বেরিয়ে গেছে।' আমি তার দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থাকি। সে ক্লান্ত গলায় বলে, "জানেন আরিফ ভাই। একটা লোকও এগিয়ে আসেনি। সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ছবি তুলছিল।"

আমি ধপ করে ফুটপাতে বসে পড়ি। ল্যাম্পপোস্টে গা এলিয়ে দেই। আমার সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসে। ঐ দূরে তখনও মাসুম ভাই, জয়ন্ত দা, আকরাম ভাই মিছিলের জন্য লোক জড় করছে।
আমরা কাছে এর সবকিছুই অকারন মনে হয়।

আমরা এমন এক জনপদে বাস করছি যেখানে দুয়েকজন ঘাতক নয়, সবাই ঘাতক হয়ে উঠেছি।
এখানে প্রতিবাদ প্রতিরোধের কোনো মূল্য নেই। ঘাতকের কথা ভাবি না, তারা আর কয়জন?
কিন্তু আমার জনপদে ঘিরে ধরা একদঙ্গল পশু। মোবাইলে খিচখিচ করে ছবি তুলছে।
এই জঙ্গলে আমি তাদের ভাষা আর তারা আমার ভাষা বুঝবে না কোনোদিন।

আমার বসে থাকা আর অভিজিৎ এর আহত হওয়ার মাঝখানে কয়েক গজ দূরত্ব মাত্র। সেই দূরত্বটুকুতেও গিজগিজ করছে বোধহীন, চিন্তাশক্তিহীন স্থবির পশুর পাল। এই গহন গহীন আঁধারে এসব ঝাঁকঝাঁক মোবাইল ফোনের আলো এড়িয়ে অন্য কোনো আলো জ্বেলে আমি কোনদিনই কোনো গন্তব্যে পৌঁছাব না।
এই চিন্তাশক্তিহীন পশুদের জঙ্গলে এই অন্ধকারে আমাকে এভাবেই বসে থাকতে হবে..
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৩


মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×