somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ আমি ফিরে এসেছি

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এখানে একটা পুকুর ছিল। কারও মনে আছে কিনা জানি না। তবে আমার মনে আছে। মনে থাকবে নাই বা কেন?? এই পুকুর পাড়ে যে কত অলস সন্ধ্যা কাটিয়েছি তা ভাবলেই এই কড়া রোদেলা দুপুরটাও ভালো লাগে। সামনেই একটা নারকেল গাছ আছে। আমাদের জ্বালায় বেচারার মাথায় নারকেল রাখতে পারতো না। আমরা, আমি রনি আর সিফাত। আমরা তিনজন এই মহল্লা চষে বেরিয়েছিলাম। সেই রাস্তাটা আর আগের মতো নেই। কেমন যেন অনেক পরিবর্তন এসেছে। সামনেই একটা খেজুর গাছ দেখা যাচ্ছে, ওটার পাশেই একটা রাস্তা গিয়েছে। খেজুর গাছের গলি। কিছুদূর গিয়ে হাতের ডানে গেলেই আমার বাড়িটা। আমার বাড়ি ছিল আরকি, এখন ওখানে কেও থাকে কিনা জানি না।

আমি মিথ্যা বলছি না। আমি আসলেই আজকে বাড়ি যাচ্ছি। বিশ্বাস করুন। এই যে এইখানে একটা মৃত প্রায় কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল। আর গাছটার নিচেই কাশেম ভাইয়ের চায়ের দোকান ছিল। এখানে বেশ ভালো আড্ডা হতো। কিন্তু এখন তো দোকান টা দেখা যাচ্ছে না। এই জায়গায়।১২ তলা একটা ভবন দেখা যাচ্ছে। কে জানে এটার মালিক কাশেম ভাই কিনা!!

এই যে ভেঙ্গেচুড়ে যাওয়া বাড়িটা দেখছেন, এটাতে সীমা রা থাকতো। সেসময় এই বাড়িটাই ছিল মহল্লার সবচেয়ে সুন্দর বাড়ি। কিন্তু এখন এটার অবস্থা দেখে তো এখন ভয় লাগছে। কি ছিল আর কি হল। নকশা করা বাড়িটার প্লাস্টার উঠে গেছে, ইট গুলো দেখা যাচ্ছে। গা ছমছম করে। সীমার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। এক বিকেল ওর বাড়ির বড় উঠোনে খেলতে পারলে পরের এক সপ্তাহ পাড়ায় বুক উচিয়ে থাকা যেত। আমরা তিনজনই সীমার প্রতি দূর্বল ছিলাম। কিশোর বয়সে কিশোরী হাওয়া। সীমা যদি রনি বা সিফাতের সাথে ইকটুখানি কথা বলতো তবে কিশোর বুকে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করতাম। পরে অবশ্য সীমার বিয়ে হয়ে যায় কোন এক ব্যাবসায়ীর সাথে। আমরা সবাই অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। তিনজনই একা নির্জন পথে হেটে গিয়েছিলাম। কত যে সিগারেট পুড়লো আমাদের হাতে ঠোঁটে।

সীমার বিয়ের কিছু মাস পরে সিফাত এলাকা ছেড়ে চলে যায়। না না, মনের কষ্টে না। ওর বাবার পোস্টিং হয় চট্রগ্রামে। ওখানে চলে যাবার পরে ওর আর কোন খবর নেয়া হয় নি। এই রাস্তা দিয়ে সোজা হাঁটলেই একটা একটা মুদির দোকান পাবেন, তার পাশেই সিফাতের বাসা ছিল। এখন কি অবস্থা কে জানে। আর রনি?? কোন মেয়ের প্রেমের পাল্লায় জানি পড়েছিল, বছর ঘুরতেই মেয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বন্ধু আমার একবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করে। ওর এমন আহাম্মকি দেখে ওর মা ওকে বিয়ে দিয়ে দেন সুমির সাথে। সুমি বেশ লক্ষ্মী মেয়ে ছিল। মাত্র কয়েকদিনে আমার বেয়াড়া বন্ধুটাকে ঘড়কুনো করে দিয়েছিল। রনি নিজ ব্যাবসায় মনোযোগ দিল। আর বছর না ঘুড়তেই ফুটফুটে এক ছেলের বাবা হয়ে গেল। এই যে আমগাছটা, তার নিচে যে টিনশেড বাড়িটা দেখছেন ওটা ছিল রনির উঠান। এই আমগাছের আম দিয়েই রনির মা আমসত্ত্ব বানাতেন, আমরা ছিলাম এর রাক্ষস।

পড়াশুনা শেষ করে নতুন চাকরি পেয়েছিলাম, কবে জানি??!! মনে নাই। তবে চাকরির দুই মাসের মাথায় বাবা মা জোড় করে বিয়ে দিয়ে দেয় নিপার সাথে। নিপার সাথে আমার পরিচয় হয় বিয়ের ঠিক দু সপ্তাহ আগে। মুরুব্বীরা সবকিছু ঠিকঠাক করার পরে পাত্র পাত্রীর প্রথম সাক্ষাৎ আর কি। তো যাই হোক, ওকে দেখে শীতকালেও যে আমার মনে বসন্তের বাতাস বইবে এবং আমার মনে যে বসন্তের বাতাস আদৌ বয়ে যাওয়া সম্ভব তা আমার জানা ছিল না। যাই হোক, অবশেষে আমাদের বিয়েটা হয়েই যায়। ভেবেছিলাম বিয়ের দিন কি কি হয়েছিল তা রাতের বেলা লিখে রাখবো, যাতে স্মৃতি থাকে। কিন্তু সেইরাতেই বউ আমাকে নিরস বলে খোঁচা দিয়েছিল। সেই থেকেই শুরু হল আমাদের খোঁচাখুচি সংসার। নিপা আমার পিতামাতার সন্তানের মতো ছিল, অন্য পরিবারের মেয়ে কি আমাদের পরিবারকে এতো দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে? তাই সন্তানের মতোই বললাম। পিতামাতার আদরের মেয়ে হয়ে গিয়েছিল নিপা। ওর সাথে আমার কখনো মনোমালিন্য হয় নি এমনটা বললে ভুল হবে। ভীষণ রাগ করতাম ওর সাথে কিন্তু ঘন্টার কাটা পেরুনোর আগেই রোগগুলো সব ধূলিসাৎ হয়ে যেত মনের অজান্তেই। খুব ভালবাসতাম বলে হয়তো। এতদিন পর ওর সাথে দেখা করবো, রাগ নিশ্চয়ই করবে। কিন্তু দেখবেন, রাগটা মোটেও ও রাখতে পারবে না।

বিয়ের দুই বছরের মাথায় আমাদের ঘড় আলো করে একটা ছোট্ট পরী আসে। পরীটা যখন কান্না করে নিজের জন্মের জানান দিচ্ছিল তখন ইচ্ছে হচ্ছিল ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ দেই। কিন্তু ডাক্তার মহিলা ছিল বিধায় বেচেঁ গিয়েছিল। মেয়ের নাম কি রাখব এই নিয়ে আমাদের ভেতর তুমুল লড়াই, আমি যেটা ঠিক করি সেটা নিপার কাছে ভালো লাগে না। নিপা যেটা করে সেটা আমার না। অতঃপর আমরা ফারিহা নাম রাখি। কে জানে ফারিহা এখন কেমন আছে। অনেক বড় হয়ে গিয়েছে নিশ্চই।

এই যে দোকানটা দেখছেন, এখানে আগে একটা সেলুন ছিল। রাতুল দাদার সেলুন। দাদা বা ভাই আসলে আমার বাবা ডাকতেন, ছোট থেকেই রাতুল দা শুনতে শুনতে আমিও রাতুল দা ডাকি। বাবা আমার চুল রাতুল দাদার কাছ থেকেই কাটাতেন। উনি আমাদের একরকম ঘনিষ্ঠ আত্নীয় হয়ে গিয়েছিলেন। প্রত্যেক পূজায় তার বাসায় যে কত লাড্ডু মোয়া খেয়েছি তার হিসেব নেই। আমাদের ছোট্ট ফারিহার চুলও কাটিয়েছিলাম রাতুল দা কে দিয়েই। রাতুল দা কে ধরে নিয়ে এসেছিলাম। অনেক চিন্তায় ছিলাম, ধারালো খুড়টা আমাদের ফারিহার নরম চামড়ার কিছু করবে না তো?? না, রাতুল দা সব ঠিকমতো করেছিল। কত কথাই না মনে পড়ছে। অনেকদিন পরে বাসায় যাচ্ছি, জানিনা মেয়ে টা কেমন আছে। ওর চুল কি অনেক বড় রেখেছে?

ফারিহার জন্মের কয়েকমাস পরেই বাবা মারা গেলেন। পুরো বাড়ি থমথমে অবস্থা। মা একা একা থাকতেন। কোন কিছুতেই মন বসত না। এমনকি ফারিহার সাথে ও না। বাবা চলে যাওয়ার দুই মাস পর মাও বাবার স্মরনাপন্ন হলেন। সেদিন নিপা অনেক কেদেছিলো। স্বান্তনা দেয়ার মতো কোন ভাষাই আমি পাইনি। অনেক বছরের ছায়া মাথার উপর থেকে সরে যাওয়ায় এলোমেলো ছিলাম কিছুদিন। তারপর সবকিছু সামলে নিতে হয়েছিল। এই তো খেজুর গাছটা। আরেকটু সামনে গেলেই আমার বাড়িটা। কতদিন ফারিহা কে দেখি না, নিপাকেও না। নিপার চুলে নিশ্চয়ই পাক ধরেছে। আচ্ছা ওরা কি আমাকে দেখে চিনবে?? যে হারে দাড়ি মোছ গজিয়েছে । কিন্তু আমি ঠিকই চিনবো আমার স্পন্দন কে।

ফারিহা আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে। ওর বয়স যখন তিন তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ফারিহা কে নিয়ে একটু ঘুরে আসা যাক। পাহাড় সমুদ্র দেখাবো। মেয়েকে চেনাতে হবে তো। আমাদের বেরানো নিয়ে মা মেয়ের মাঝে উৎসাহের কোন কমতি ছিল না। এটা কিনতে হবে ওটা কিনতে হবে আরও কত কি। মা মেয়ে গিয়েছিল মার্কেটে, আর আমি ব্যাস্ত ছিলাম অফিসে। ছুটির আগে সবকিছু ঠিকঠাক করে আসবো বাসায়। কাজ প্রায় শেষ, উঠবো উঠবো করছি ঠিক তখনই একটা ফোন আসে, তারপরই আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলে যাই। ফোনটা কি ছিল মনে নাই। কেনই বা ছুটে গেলাম কিছুই মনে নাই। বয়স হয়েছে বলেই হয়তো। এইতো আমার বাড়ি। কিন্তু বাড়ির দরজার সামনে এতো ধুলো কেন?? গাছের পাতা পরে আছে?! জানালার কাচ গুলোও ভাঙ্গা। আচ্ছা, ওরা কি আমার সাথে রাগ করে আছে আঠারো বছর ধরে যোগাযোগ রাখি নি বলে??

কষ্ট হচ্ছে, ভুলে যাওয়া কথাগুলো মনে পড়লে এতো কষ্ট লাগে কেন? সারা বছরই তো ভুলে থাকি কিন্তু মেয়েটার জন্মদিন আসলেই সবকিছু মনে পরে কেন?
আমার নিপা, আমার ফারিহা বাসায় ফিরছিল মার্কেট থেকে নতুন জায়গায় যাবে মেয়ের ত নতুন জামাকাপড় লাগবে। পথে ওদের রিকশাটাকে ধাক্কা দেয় একটা কার। মেয়েকে কোলে করে নিপা ছিটকে পরে রাস্তায়। আর একটা বাস চলে গিয়েছিল ওদের কোমল শরীরকে পিষে দিয়ে। সারা বছর পথে পথে ঘুরি আমি। ওই বাস আর কারটাকে খুজিঁ আমি। আমার কোন কিছু মনে থাকে না, শুধু ফারিহার জন্মদিনের আগে মনে পরে ওদের পাহাড় আর সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাব বলেছিলাম
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×