somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একাকিত্বের একাঙ্কিকা ও সমাজচ্যুতের জীবনবোধ

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

’নাক উঁচা’ নামে বরিশালীয় বাংলায় একটি শব্দবন্ধ রয়েছে। না, উন্নত বা উচ্চ নাসারন্ধ্রধারীদের সাথে এঁদের গুলিয়ে ফেলবেন না।
এই ‘উঁচা’দের নাসিকাখানা সিনাই পর্বতের চুড়ার মতো খাড়া মোটেই নয়। আসলে, ইহাদের টেস্ট বা অহংবোধখানা বড্ড উচ্চমার্গীয়। যেমন ধরুন, ইহারা পারলে প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদকেও লেখক হিসেবে গোণায় ধরেন না। বিশুদ্ধ রাগ সঙ্গীত অথবা ওস্তাদ বল্লাল সেনের সঙ্গীত ব্যতিত ওনারা শ্রবণ করেন না। ওনারা অনেকটা হলেন, ওই যাকে আপনারা ক্লাসিক, ভাবিস্ট বা ‘সেই’ বলে অভিহিত করে থাকেন।

এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপে যেমন করে ‘আঁতেল’ নামক শব্দটি ভুলভাবে নেতিবাচকতায় পর্যবসিত হয়েছে, তেমন করে, নানা কারণেই ’নাক উঁচা’ও বঙ্গল্যান্ডের আমজনতার কাছে নেগেটিভ ইমেজেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তবে আমার কাছে নাক উঁচা’র আরেকটি positive মানে আছে, সেটির নাম ডেলিকেসি।

হ্যা, সূক্ষ্ণপন্থী মানুষরাও নাক উঁচা হন-মনে রাখবেন। আশা করি, ডেলিকেসি বিষয়টা আপনাদের বুঝিয়ে বলতে হবে না। যদিও জানি, বাঙালীরা আবার ডেলিকেসিরও একই তরিকায় ভুল অর্থ করে। ডেলিকেট বা সূক্ষ্ণতাপন্থী মানুষদের এরা বলে-’বিটিষ’। অধুনা একদল আবার তাদের নাম দিয়েছে ‘সুশীল’।

নাকখানা উঁচু হবার মতো ক্লাসি হতে হলে অনেক কিছু দরকার হয়। এমনি এমনি তো আর একদিনেই নাক বা টেস্ট এমন উঁচু হয়ে পড়ে না। তবে সবচেয়ে বেশি যেটি দরকার, সেটি হল ম্যাচিওরিটি।
মানুষ যত ম্যাচিওরড হয়, ডেলিকেসি তত বাড়ে। যত বয়স হয়, যত বেশি অভিজ্ঞতা বাড়ে, ডেলিকেসি তত বাড়ে, নাকখানা ততই উঁচু হয়।
এই নাক উঁচা মানুষেরা নিরব হন, স্বল্পভাষী হন, উচ্ছাসের বাড়াবাড়ি মুক্ত হন, হাইপ মুক্ত হন। তারা ভাইরালে মাতেন না, ট্রেন্ডে চ্যাতেন না। রুচী, পছন্দ, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গী, সিদ্ধান্ত-কোনো কিছুতেই এঁরা সহজে ও দ্রুত আপ্লুত হন না, গলে যান না, ঢলে পড়েন না। এঁরা সময় নেন।

এই নাক উঁচারা স্বাভাবিকভাবেই অমিশুক হন, অসামাজিক তকমা পান। এঁরা খুব স্বাভাবিকভাবেই সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে থাকেন। এঁদের বন্ধুমহল হয় থাকেই না, থাকলেও অতি সীমিত; সমাজে, পরিবারে, রাষ্ট্রে এনারা খুব একটা আদৃত হন না।

পারতপক্ষে মানুষ এঁদের হতে দূরে থাকতেই পছন্দ করে। সময় নিয়ে মিশলে, একসাথে উঠলে-বসলে, সময় নিয়ে ইনটারেকট করলে এঁদের মনের থই পাওয়া হতে শুরু করে এদের হতে প্রজ্ঞা ও বোধের রস আস্বাদন করা সম্ভব হলেও, সেটা পেতে গিয়ে সারাক্ষণই ‘কখন কী ভুল হয়ে যায়, পান হতে চুন খসে কখন যে ভ্যাজাল লাগে’-সেই আশংকায় সাধারনরা এই অসাধারনদের হতে দূরে থাকেন।
তাছাড়া বাঙালরা অন্য বাঙালের ”ভাব নেই তার কুলোপণা চক্কর” হজম করতে অভ্যস্ত না।

আপনি যদি নিজেকে ক্লাসি বা নাক উঁচা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন, তাহলে একা থাকবার জন্য প্রস্তুত হোন। কারন নাক উঁচারা নিজেরাও যেমন বন্ধু নির্বাচনে বা করণীয় নির্ধারণে বড্ড বেশি খুঁতখুতে, তেমনি করে, ক্লাসিক ও ডেলিকেট আপনাকেও মানুষ দূর হতে ঘৃনা করবে, হিংসা করবে, দূর হতেই বিদ্বেষ ছুড়বে; কেউ বা আবার আপনাকে ভক্তিও করবে-তবে সেটিও, ওই দূর হতেই।

কী অদ্ভুৎ না শুনতে, আপনাকে মানুষ আপনার ডেলিকেসির জন্য শ্রদ্ধাও করছে, আবার সেই ডেলিকেসিই তাদের আপনার কাছে আসতে দিচ্ছে না? আপনার ডেলিকেসি আপনাকে অন্যদের হতে বিচ্ছিন্ন রাখবে। দূর হতে সবাই শ্রদ্ধার অঞ্জলী দিলেও কাছে আসবে না নানা কারনেই। ডেলিকেট মানুষদের সাথে চলতে, উঠতে, বসতে মানুষ অস্বস্তিতে ভোগে, কার্যত হয়তো ভয়ই পায়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে গড়পড়তা জীবনবোধে গড়ে ওঠা গড়পড়তা মানুষেরা ডেলিকেট বা নাক উঁচা আঁতেলদের সঙ্গ দিতে বা নিতে পছন্দ করে না। আমাদের সমাজ সিংহভাগ গড়পড়তা ‘তেঁল’দের নিয়েই গড়া।

সিংহভাগের জীবনবোধই “দুনিয়াটা মস্ত বড়, খাও, দাও, ফূর্তি করো”-টাইপের সরল। নিজেদের সাথে অমিলের কারণে, চিন্তার গভীরতার অভাবে ভোগা মানুষেরা তাই ‘আঁতেল’দের হিংসা করুক, ভালো বাসুক-সবটাই দূর হতে।

সমস্যাটা ঠিক নাক উঁচাদের, নাকি নাক নিচাদের-সেই ভেদ আমি করতে পারব না। তবে এটা জানি, এটি একটি কমপারেটিভ চয়েজ। আপনি যদি নাক নিচা বা গড়পড়তা হয়ে গড়পড়তা একটি জীবনবোধের মালিক হয়ে মরতে চান, সেক্ষেত্রে আপনি একটি গড়পড়তা জীবন পাবেন, বন্ধুবান্ধব পরিবেষ্টিত হয়ে, ব্যপক আদৃত হয়ে মরবেন।

সেক্ষেত্রে জীবনটা নেহাতই কামানা-পাকানা-খানা-পাখানার নামান্তর হবে। আর যদি নাক উঁচা’দের দলে যোগ দেন, তাহলে বর্জন, উপেক্ষা, নিঃসঙ্গতায় ভুগবেন-সেটাও যেমন মানতে হবে, আবার আপনি কিছু বিরল সম্মান, সমীহ, ভালোবাসা পেলেও পেতে পারেন।
দিন শেষে, বেলা শেষে আপনি সুশীল, আঁতেল ও বিরক্তির মূর্ত প্রকাশ, অথচ সমীহ মিশ্রিত একটি ‘ভাবিস্ট’ ক্যারেক্টার হয়ে মরবেন।

চয়েজ আপনার।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:৫৯
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×