somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অকৃতজ্ঞতার সাতকাহন

২৯ শে মে, ২০২৩ সকাল ৮:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিস্তি-১: অকৃতজ্ঞ মহাপ্রাণ:

পৃথিবীটা নেতিবাচকতায় ভরপূর। পৃথিবীর পুরো ব্যবস্থাপনা সচল থাকে যেই অণু ও পরমাণুর বদৌলতে, সেই পরমাণুর অস্তিত্বের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হল ঋনাত্বক বা নেতিবাচক গুনের ইলেকট্রন। তবু কী এক অদ্ভূত কারনে, ইদানিং সামাজিক মাধ্যমে সামান্য নেতিবাচক কোনো কথা বললেই কাতারে কাতারে সুশীল সমাজ আপনাকে ঘিরে ধরবে। আপনাকে সুশীল বাণী শোনাবে। “ছিঃ ছিঃ ভাই, এভাবে আপনি বলতে পারলেন?”, “এভাবে নেতিবাচক কথা বলতে নেই”, ”ইতিবাচক হোন”, “আপনি কি ফ্রাস্ট্রেটেড?” ইত্যাদি ইত্যাদি মন্তব্য। এই বাস্তবতা মাথায় নিয়েই একটা নেতিবাচক লেখা লিখছি। আজ আমার এই বছরের একমাত্র স্বেচ্ছাছুটি। মানে নিজের জন্য নেয়া একমাত্র ছুটি। ছুটির দিনটাতে বসে বসে লিখছি।

লেখার বিষয় “অকৃতজ্ঞতা”। লোকে বলে, সম্রাট শাহজাহান নাকি শ্বেত তাজমহলের বিপরীতে একটি কৃষ্ণ তাজমহলও বানানো শুরু করেছিলেন। আমি কিছুদিন আগে কিছু মহাজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। অনেক মানুষ তাতে আমায় সাবাশ দেন। যদিও আমার সাবাশের কিছু হয়নি। কিছু ভাল ও যোগ্য মানুষের কথা আমি শুধু বলেছি। আর সৌভাগ্য যে, আমি তাদের সান্যিধ্যে এসেছি। তার বিপরীতে আজ লিখছি অকৃতজ্ঞতার কাহিনী।

চার দশকের জীবনে কত মানুষের সান্যিধ্যে এলাম। কত লোকের সাথে হল আলাপ। কাউকে জানলাম, কাউকে শুধু বাহির হতে দেখলাম। কেউ কাছে এসে দূরে গেলেন। কেউ বা দূরেই থাকলেন। কত রকমের মানুষ। এরই মধ্যে কেউ কেউ এসেছেন উল্কার মতো। ছুটে আসেন, সর্বব্যাপী আগ্রাসীর মতো বাঁধনে বাঁধতে চান। কিছুটা সজ্জন চিন্তায়, বাকিটা স্বার্থে। আজকের লেখা তাদের নিয়ে।

আমার একজন রুস্তম চাচা ছিলেন। তিনি একটা চুটকি বলতেন।

”কাকে বিশ্বাস করি? বিশ্বাস করে মওলানা সাবের কাছে মেয়ে বিয়ে দিলাম। দশ মাস পরে সে-ও দেখি নাতি কোলে নিয়ে হাজির।”

এই জোক আপনি ধরতে পেরেছেন কিনা জানি না। আমিও ঠিক তেমনি পারিনি, অনেক মানুষকে চিনতে। সেইসব মানুষ, যাদের নিয়ে ভাবতে হয়েছে, ”এর পক্ষেও এমন হওয়া, এমন পাল্টি খাওয়া সম্ভব!” হয়েছেও তাই, যাকে বেশি বিশ্বাস করেছি, যাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি কনফিডেন্স ছিল, সেই চমক দেখিয়েছে সবচেয়ে বেশি। আমার অনুজ হুমায়ুন বলেছিলেন, “এটা কি Me too টাইপের কিছু হবে?” নাহ, বরং এটাকে বলতে পারেন, “To Me”। অকৃতজ্ঞতা টূ মী।

অন্যের দোষগুন বললে, নিজের গায়ে পড়ে। তাই আগাম ক্ষমা চেয়ে নিই। আমার তরফে কারো সাথে অকৃতজ্ঞতা হয়ে থাকলে। অকৃতজ্ঞতার এই শাহনামায় ব্যক্তিগত, সামাজিক, পেশাগত অকৃতজ্ঞতার কত রঙীন কাহিনীই আছে।

একটা কথা আছে, "I Forgive but I do not Forget”।

তেমনি, মহামানবদের মতো করে আমি ভুলতে পারি না। মনে রয়। হঠাৎ হঠাৎ কোনো খারাপ দিনে তা মনকে ভারাক্রান্ত করে। আমরা আসলে অতিমানব তো নই। যতই মুখে বলি, প্রতিদান চাই না, কিন্তু মন ঠিকই ছোট্ট করে একটা আশার জন্ম দেয়। হয়তো তিনি প্রতিদান দেবেন না। কিন্তু প্রতিউত্তরটুকু তো দেবেন। নিদেনপক্ষে উপকার পেয়ে, সাহায্য পেয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করুন, প্রতিদানে একখানা বৃহৎ বংশদন্ড তো দেবেন না নিশ্চই। সেই আশা তো করাই যায়।

হয়েছেও তাই। এই কথাটি আমি প্রায়ই বলতে চাই। ভয়ে আর সংকোচে বলি না। আজকে একটি বিশেষ কারনে কোথাও লিখে ফেলেছিলাম। সেটাই copy করলাম।

কথাটি হল, ভালোবাসা, ভাল লাগা, আনুগত্য, শ্রদ্ধা, মুগ্ধতা ও কৃতজ্ঞতা-এগুলোকে কি convert করা যায়? মানে, এগুলোকে কি আমল হিসেবে convert করা যায়? Convert করা বা হওয়ার দাবী কি যৌক্তিক? নাকি এগুলো স্রেফ বায়বীয় বিষয় ও বলার জন্য বলা বিষয়?আপনি আমাকে ভালোবাসেন। সেটাকে কি আপনার আমলে প্রভাব ফেলার কথা না?

ধরুন, আপনি আমাকে ভালোবাসেন, আমার লেখা পড়ে স্বপ্নদোষের মতো আনন্দ হয়, আমাতে মুগ্ধ থাকেন, আমাকে mentor মানেন, আমার প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হতে হতে ঘাড় ভেঙে মরেও যান, নিজের career'র চিন্তায় যেকোনো পরামর্শ বা জ্ঞান আপনি খোঁজেন-এই যে এত এত এত মিথ্যা কথা ও মিথ্যা প্রবোধ আমরা মনকে দিই, সেই বোধ ও প্রবোধগুলোকে কাজে রূপান্তর করার একটা চাপ কি আমরা আদৌ অনুভব করি? বা, করা কি উচিত?

আমরা প্রায়ই অনেককে বলি, আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। তাহলে, সেই ‘আপনি’টা যদি কখনো ঠেকায় পড়ে বাদাম বেঁচে, তখন দরকার না থাকলেও দু’টাকার বাদাম কিনে সেই ’আপনি’টার উপকার করা কি দায় হয়ে যায় না? যার লেখা বা কাজে আপনি মুগ্ধ, ধরুন তিনি একজন হুমায়ুন বা হিমু, তিনি যদি একটা চটি বই বইমেলায় প্রকাশ করেন, তাহলে তার একখানা চটি দশ টাকায় কেনাটা কি আপনার ওপর জরুরী হয় না?

নাকি, ‘কৃতজ্ঞতা’, ‘মুগ্ধ’, ’Fan’, ’ধন্য’, ‘সহমত ভাই রহমত বোন’-এইসব কথাগুলো কেবলই ফাঁকা বুলি? ছেলেভোলানো গপ্প?নাকি আপনি হেমন্ত দাদা’র ভক্ত হিসেবে কেবলই গাইবেন, ”আমি দূর হতে তোমারে দেখেছিইইইইইই,আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছিইইই।” আমাদের অকৃতজ্ঞতায় হাতেখড়ি প্রাগৈতিহাসিক কাল হতেই। ল্যাংটো কাল হতে একটা কথা শুনতাম, “যেই পাতে খায়, সেই পাতে হাগে।” কৃতঘ্নতার এর চেয়ে ভাল উপমা আর হয় না।

অকৃতজ্ঞতার সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলো আপনাদের বলতে পারব না। মানহানী মামলায় ফেঁসে যাব। তবে অকৃতজ্ঞতার সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে চাকরী দেয়া নেয়া নিয়ে। অন্তত দেড় ডজন ঘটনাতে আমি দেখেছি, কীভাবে চাকরী বা ডিলপ্রার্থীরা ডিগবাজি খেয়েছেন। আমি দেখেছি, জব হওয়ামাত্রই কীভাবে মানুষ নিজের ভূবনে ব্যস্ত হয়ে যান আর তাদের বেকার সতীর্থদের জন্য কাজ করার দায়টা বেমালুম ভুলে যান। আর অবশ্যই খুব দ্রুত সব ভুলে টীনের চশমা পড়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি যেন কে?”

বহু আগে, হয়তো ৫ বছর। একটি ছেলে ফেসবুকে মেসেজ (এর ভাল বাংলা পাইনি, বার্তা হয়তো।) দিল। বাড়িতে খারাপ অবস্থা। বাবা বিছানায়। চাকরী চাই। আমি কোনোকালেই চাকরী দেবার মতো বড় মানুষ হইনি। আজও না। মানুষ তা বোঝে না।

আমার দৌড় বড়জোর বুদ্ধি ও দক্ষতা শেখানো পর্যন্ত। তবু চেষ্টা করি। তাকে একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরীতে ঢুকালাম। আনুষ্ঠানিকভাবে “ধন্যবাদ, স্যরি, মাফ করবেন” এই কথাগুলো বাঙালী বলতে পারে না। তাই ওই রাস্তায় হাঁটিও না। কিন্তু নিদেনপক্ষে “ভাই জয়েন করেছি”-এই সংবাদটাও হযতো কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হতে পারত। সেটাও পেলাম না।

তারপর কাটল ৬ মাস। হঠাৎ একদিন তিনি লাপাত্তা। নিয়োগকর্তাকে কোনো নোটিশ না দিয়ে। তিনি আমাকে জানালেন। ফোন করলাম। বন্ধ। আবার করি। রিং হয়, ধরেন না। মাস দুয়েক পরে একটা গায়েবানা নম্বর হতে কল করা হল এইচআর হতে। তিনি এইচআরকে জানালেন, তিনি অন্যত্র জয়েন করেছেন। এখানে তার ভবিষ্যত ছিল না, ইত্যাদি।.............

৮ মাস পরে ভদ্রলোক আবার মেসেঞ্জারে বার্তা দিলেন, “স্যার, ওই সময় টাইফয়েড হয়েছিল। তাই চলে গিয়েছিলাম। ভাল হতে হতে অনেকদিন লাগায় ভাবলাম, তারা আর নেবেন না। তাই নতুন চাকরী নিই। (ডাহা মিথ্যা। কোথায় গিয়েছিল, সেটাও জানতাম।)

আমি নারাজি দেয়ায় অতঃপর জানালেন, নতুন কর্মস্থলে অসুবিধা। বেতন হয় না সময়মতো। কিছু করুন।”

ন্যাড়া নাকি বেলতলায় একবার যায়। তবে বোকা ন্যাড়ারা যায় অনেকবার।

আমি ওই প্রতিষ্ঠানে আবার কথা বলে ব্যবস্থা করে দিলাম। তারাও লোক দরকার থাকায় নিয়ে নেন। জয়েনের পরে একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। অতঃপর ১ বছর পরে আবার তার পলায়ন। এইচআর হতে আমাকে ফোন। আমার শরমে মরে যাওয়া। তিনি আর ফিরলেন না। ............

ঘটনা শেষ? নাহ! ন্যাড়া আছে না? ২ বছর পরে আবার একদিন..................স্যার!.......হায় ন্যাড়া!

এক ভদ্রলোক বেকার। একদিন বার্তা দিলেন। দোকানপাটে সেলসম্যান চাকরী হলেও চাই। লেখাপড়া অচল হয়ে যাবার যোগাড়। আমি ন্যাড়া আমার মতো আরো কয়েকজন ন্যাড়াকে ধরলাম। কয়েকটা স্থানে চেষ্টাও হল। সফল হল না। মধ্যের সময়টাতে আমার ইদ, কোরবানি, জন্মদিন, আগাম মৃত্যুদিন সবকিছুতে তার শুভেচ্ছাবাণী পেতে পেতে আমি দিশেহারা।

অতঃপর একটি প্রতিষ্ঠানে ফ্লেক্সিবল টাইমে তার একটা পার্টটাইম কাজের ব্যবস্থা হল। যিনি আমার অনুরোধে ব্যবস্থা করেছেন, তিনি আমাকে জয়েনের ৭ দিন পরে জানালেন, ভদ্রলোক লাপাত্তা। আমি জানি কিনা। অথচ ওই ছেলে জয়েন করার খবরও আমাকে দেয়নি। আমি ক্ষমা চাইলাম। ভদ্রলোক নেহাত ভদ্র বলে চেপে গেলেন।

১.৫ মাস পরে সেই ছেলে আবার বার্তা দিল, “ভাইয়া, বিদেশে একটা সেমিনারে যাবার দাওয়াত পেয়েছি। আমার স্বপ্ন। একজন স্পন্সর যোগাড় করে দিন না?”

ন্যাড়া, তুই আসলেই ন্যাড়া।

একজন সজ্জন মানুষ। তার প্রচন্ড ডিসোলেশন ও ফ্রাস্ট্রেশনের দিনগুলোতে আমার সাহায্য নিতেন। ভবঘুরে আমি আর্থিক সাহায্য না করলেও সাইকোলজিক্যাল এইড আর মেন্টাল সাপোর্টসহ অগুনতি সময় তাকে দিলাম। মানুষটি আমাকে পীর টীর কিছু একটা ভাবতেন (বলছি কারন সেটা প্রায়ই প্রকাশ করতেন তিনি।)।

একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “বিদ্যুত ভাই, আমার কি কখনো একটা ভাল বাসা হবে?” আমি তাকে বলি, “আপনার ভাল বাসাও হবে, ভালোবাসাও হবে।”

সত্যিই তিনি ভাল বাসা আর ভালোবাসা-দুটিই কিছুদিনের মধ্যে পেয়ে যান। তারপর তিনি সমাজের দশজনের একজন হয়ে গেলেন। একসময় আমার একটা খুব প্রয়োজন পড়ল। টাকার না। কয়েকজন মানুষের সশরীরে কোনো একটা কাজে হাজিরার। তাকে অনুরোধ করলাম। “স্যরি বিদ্যুৎ ভাই, আমাকে ‘ওঁ’ নিষেধ করেছে।..............................আসলে.................” আমি আর অনুরোধ করিনি।

হায় রে বিদ্যুৎ নামের ছ্যাড়া (ছোকরা)।

একজন সজ্জন কাছের মানুষের সন্তান হারিয়ে গিয়েছিল। আসলে হারায়নি। ইচ্ছে করে হারিয়েছে। তো অনুরোধ পেয়ে গেলাম। বৃত্তান্ত শুনলাম। তারপর দেড়দিন লেগে থেকে নেটওয়ার্ক তোলপাড় করে সন্তানকে খুঁজে বের করলাম। তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে ফেরত নিয়ে এলাম।

কী ভাবলেন? আমাকে গাঁদা ফুলের মালা পড়িয়ে বরণ করেছেন? ফুহ!

ভিতরের বিস্তারিত বাদ দিলে শুধু বলি, ওই উদ্ধার কান্ডের ১ দিন পর হতে তিনি আমার মুখ দেখা বন্ধ করেছেন। কেন? ওই যে, আমি ছ্যাড়া।

একজন সজ্জনকে একবার কিছু দুষ্টু মানুষ হামলা করল। তার জান ও মালের বিরাট আজাব। আমার কী যেন হল। ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বুদ্ধি খাটালাম, ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘ কূটনৈতিক টকশো করে তার জানমাল ওই দুষ্টুদের হাত থেকে বাঁচালাম। অতঃপর....................

আমার ভাগে যেটা জুটল, সেটা হল, “আপনাকে এত কথা বলতে কে বলেছিল?”

গতমাসে এক অপরিচীত ভদ্রলোক বার্তা পাঠালেন, তিনি বিশেষ একটি বিষয়ে এমবিএ। তাকে ন্যুনতম একটি সুযোগ যেন দিই ইন্টারভিউ দেবার। শুরুটা খুব বিনয়ী ও যৌক্তিক পথে। তাকে সময় দিলাম কথা বলার, যুক্তি দেবার। যুক্তি দিলাম, বোঝালাম, বাস্তবতা বোঝালাম, কী করতে হবে, কেন হচ্ছে না-এসব। তিনি যেই বুঝলেন, কাজ হবে না, বাঁকা কথা শুরু করলেন। একসময় শুরু করলেন, গোটা এইচআর সেক্টরের সিনিয়রদের তুলোধুনো। তাকে বারবার বোঝালাম। তিনি যখন দেখেন, ন্যুনতম সম্ভাবনা নেই, ব্যক্তিগত অপমান শুরু করলেন।

আমি খুব মজা পাই এমন মানুষদের সংস্পর্শে এসে। স্বার্থ না মিটলে এমন ১৮০ ডিগ্রীর ডিগবাজি জীবনে খুব কম দেখিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সময়ে হ্যান্ড নোট খুব কাঙ্খিত বস্তু ছিল। বড় ভাইদের পুরোনো নোটের কপি উদ্ধার করতে পারাটা খুব লোভনীয় জিনিস ছিল।

তো পড়াশোনায় লবডঙ্কা আমার সেকেন্ড ইয়ারে কিছু ভাল নোটস হাতে এলো। আমাকে এক বড় ভাই আমার পড়াশোনায় তীব্র অনীহা দেখে নোটগুলো দিয়েছিলেন। কীভাবে যেন সেই খবর কিছু সৃহৃদের কাছে গেল।

তো এক ভদ্রলোক স্বেচ্ছায় আমার রুম খুঁজে আমার খোঁজ নিতে এলেন। খোঁজ নিতে এলেন, কারন ক্লাস করতাম হাতে গোনা। তো তিনি খোঁজ ও নোট দু্টোই নিলেন। তার অনেকদিন পরে আমি পরীক্ষা দিতে কেন্দ্রে গেলাম।

ভদ্রলোকের সাথে দেখা। তিনি তার স্বজাতী বন্ধুদের নিয়ে মেতে রইলেন। আমাকে তিনি চিনতে ব্যর্থ হলেন। পরের ইয়ারে আবার এলেন খোঁজ ও নোটস নিতে। আমি আবারও ন্যাড়া। পরীক্ষার সময়ে আবার আমি ছ্যাড়া।

তবে সবচেয়ে ছ্যাড়াব্যাড়া হয়েছিল, একবার, যখন এক ভদ্রলোক নোটস নিয়ে আর ফেরতই দেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে যারা থেকেছেন, তারা বুঝবেন একটা সীট সেখানে কী জিনিস। তো শেষের দিকে এক ভদ্রলোককে নেতারা জোর করে রুমমেট করে দিয়ে গেলেন। তিনি ভালমানুষ বড্ড।

আমাকে বললেন, “বিদ্যুত, আমরা তো সহযাত্রী। আমাদের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নিয়ে থাকতে হবে।” আমি আশায় বুক বাঁধলাম।

তিনি আমার লুঙ্গী তোয়ালে হতে শুরু করে টুথপেস্টেও সমব্যথী হতে থাকলেন। রাতে আমাকে মশারী খাটাতে না করেন। কারন তার মশারী নেই আর তার তাতে অসুবিধা হয়। তাও কিছুকাল করতে বাধ্য করলেন।

অতঃপর শেষটা এমন, তিনি কতিপয় নেতাকে ধরলেন। একদিন আমাকে বললেন, তোমাকে নিয়ে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে। একটা রুম দেখে চলে যাও। আফটার অল আমাদেরতো একের অসুবিধা অন্যকে দেখতে হবে.................।

আপনি যদি বাস্তব জগতে কারো কোনো রকম উপকার করেন, কাউকে বিপদ হতে উদ্ধার করেন, তবে আপনার মনে কী কাজ করে? আমি বাজে লোক তো, তাই বাজে চিন্তাই সবার আগে মনে আসে।

আমার ধারনা, মাত্র ১% লোকের মধ্যে নিঃস্বার্থতা কাজ করে। যিনি উপকারের বিনিময়ে একদমই কিছু প্রত্যাশা করেন না। বাকি ৯৯% মানুষ উপকারের বিনিময়ে ফিরতি প্রতিদান, কেউ কেউ বিশেষ কোনো সুবিধা, কেউ কেউ অন্তত বিপদে পড়লে ফিরতি উপকার পাবার আশা করেন। একদম কিছু না হলেও, উপকারভোগী মানুষটি উপকারীর প্রতি মানসিকভাবে কৃতার্থবোধটুকু বজায় রাখুন আর মুখে একটি শুকনো ধন্যবাদ অন্তত দিন-সেটাও প্রত্যাশা করেন না-এমন মহামানবের দেখা পেলে আমি তার পায়ের ধুলা মাদুলীতে ভরে গলায় ঝোলাব।

মুশকীল হল, “Thank you", "So kind of you", "I am so grateful" ইত্যকার বাক্যসমষ্টি বা তার চোস্ত বাংলা প্রচলিত থাকলেও বাংলাদেশের মানুষ কেন যেন, ফরমালিটি করে হলেও ওই শব্দগুলো বলতে গেলে জিহবা জড়িয়ে যায়। আর সত্যি সত্যি উপকারের প্রতিদান দেবার ক্ষেত্রে তো “কাজের বেলায় কাজি, কাজ ফুরোলে পাজি।”

তবু মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদের ”মানব’ পরিচয়কে তো আর ভুলে যেতে পারি না। তাই শত অনাচারের পরেও কবি জসীমউদ্দীনের সুরে বলতে হয়-
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই, যে মোরে করেছে পর।

ভেবেছিলাম এই লেখাটা সর্বস্ব উজাড় করে লিখব। রেয়াত দেব না কিছুই। কোনো পিছুটান দেখব না। কিন্তু লেখা এতটা এগোনোর পরে ভাবি, কী হবে, এসব প্রকাশ করে?

তাতে কি জগতে কোনো পরিবর্তন আসবে? বুড়িগঙ্গায় কি তাতে স্বচ্ছ সলীল প্রবাহিত হবে? সেন্ট্রাল জেলের পরিত্যাক্ত প্রাসাদ কি তাতে কয়েদীতে আবার ভরে উঠবে? নাকি শহরে মধ্যকেন্দ্রে আমার নামে একটা আবক্ষ মূর্তী স্থাপিত হবে?

কিছুই না। তাই ভাবি, কী দরকার অযথাই কিছু মানুষকে লজ্জায় ফেলে? তাছাড়া, এই ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারন নিজেকেই নেতিবাচক অনুভূতিতে নিমজ্জিত করে।

বঙ্কিমচন্দ্র এসে বলেন, “তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?”

কিস্তি-২: তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব কেন?

আমাদের অকৃতজ্ঞতার ইতিহাস খুব পুরোনো নয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল হতেই তার জন্ম।

ল্যাংটো কাল হতে একটা কথা শুনতাম, “যেই পাতে খায়, সেই পাতে হাগে।” কৃতঘ্নতার এর চেয়ে ভাল উপমা আর হয় না।

একটু শুরুতে পিছিয়ে দেখি। মুসা (আঃ) একদিন খিজির (আঃ) এর সাথে ভ্রমন করছিলেন। পথে একটা নদী পড়ল। দুজন এতিম ছেলে তাদের নৌকায় করে নদী পাড় করে দিলেন। তারা পাড়ে উঠতেই খিজির আঃ তার লাঠি দিয়ে নৌকার তলায় একটা ফুটো করে ডুবিয়ে দিলেন।

মূসা আঃ খুব অবাক হয়ে এই অকৃতজ্ঞতার কারন জানতে চাইলেন। [উত্তরটা পরে বলছি]

মহামতি রাম তার স্ত্রী সীতাকে নিয়ে ১৪ বছর বনবাস করেন। স্ত্রী সীতা তাকে ১৪ বছর বনে সঙ্গ দেন। সবরকম কষ্ট, বেদনা, দুর্বিসহ দিন মেনে নেন হাসিমুখে। লোকালয়ে ফেরার পর রাবণ কান্ড। তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রাবণের হাত হতে সীতাকে উদ্ধার। মাঝে লঙ্কাপুরী ধ্বংস।

এমন যে পতিপ্রাণা রমনী সীতা, তাকে দুষ্টলোকের দাবীর মুখে ও কুপরামর্শে মহামতি রাম চরিত্রহীনতা (আড়ালে সতীত্বহীনতার) দোষ দিয়ে বসলেন। আগুনে ঝাপ দিয়ে সীতাকে নিজেকে নিঃষ্কলুশ প্রমান করতে হয়েছে। রাম কৃতজ্ঞতার ধার দিয়ে হাঁটেননি। ভাবেন নি, অসতী হলে তিনি ১৪ বছর রামের সাথে বনে যেতেন? আর অসতী হলেও তিনি যে ১৪ বছর স্বামীর সাথে বনে থেকেছেন, সেই কৃতজ্ঞতাতেই তো তাকে মেনে নেয়া উচিৎ।

স্কুলের বইয়ে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের গল্প মনে পড়ে? তার প্রিয় বন্ধু ব্রূটাস আর পম্পেই মিলে তার খুনে নেতৃত্ব দেয়। হন্তারকের ছুরির আঘাতে ঢলে পড়ার মুহূর্তে সিজারের সেই বিখ্যাত উক্তি, “এল ব্রূটে?” মানে ব্রূটাস, তুমিও?” যেই বন্ধুদের তিনি সম্রাট হয়ে উঁচু পদে তুলে এনেছিলেন, তারাই তাকে হত্যা করে। আহ কৃতজ্ঞতা।

আমার একজন রুস্তম চাচা ছিলেন। তিনি একটা চুটকি বলতেন। ”কাকে বিশ্বাস করি? বিশ্বাস করে মওলানা সাবের কাছে মেয়ে বিয়ে দিলাম। দশ মাস পরে সে-ও দেখি নাতি কোলে নিয়ে হাজির।” এই জোক আপনি ধরতে পেরেছেন কিনা জানি না। আমিও ঠিক তেমনি পারিনি, অনেক মানুষকে চিনতে। সেইসব মানুষ, যাদের নিয়ে ভাবতে হয়েছে, ”এর পক্ষেও এমন হওয়া, এমন পাল্টি খাওয়া সম্ভব!” হয়েছেও তাই, যাকে বেশি বিশ্বাস করেছি, যাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি কনফিডেন্স ছিল, সেই চমক দেখিয়েছে সবচেয়ে বেশি।

হালের সুলতান সুলেমান দেখেন? (অবশ্য আমাদের প্রকৃত পুরুষ মানুষেরা সিরিয়াল দেখেন না। ওতে নাকি নিজেদের নারীদের কাতারে নিয়ে যাওয়া হয়। অামি বুঝি না, ’মেয়েদের মতো লাগবে’ এমন ভয় যদি পুরুষকে সারাক্ষন চালিতই করে, তবে এমন ঘৃন্য ‘মেয়ে’ মানুষকে সে বিয়ে কেন করে?) অকৃতজ্ঞতার চুড়ান্ত প্রদর্শন দেখতে পাবেন বিভিন্ন চরিত্রে। সাফিয়ে সুলতান-অসংখ্যবার ক্ষমা পাওয়া স্বত্ত্বেও আবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন (যদিও পরিচালকের ইচ্ছায়।)

বুলবুল আগা-প্রাণভিক্ষা পেয়েও আবার কোসেমের পেছনে লাগে। কোসেমকে সুলতানা হতে যে কাজ করে, সেই মুরাদ পাশাকে মুহূর্তের অবাধ্যতায় খুন করায় কোসেম। প্রাণ বাঁচাতে, মান বাঁচাতে কোসেম সুলতান হানদান সুলতানকে সাহায্য করলেও হানদান প্রাণ পেয়েই কোসেমকে ল্যাঙ মারতে নেমে পড়ে। সব চরম কৃতজ্ঞ লোকজনের সমাহার।

আমি এই শিক্ষাগুলোর জন্যই সুলতান সুলেমান দেখি। কৃতজ্ঞতার রয়েছে জটিল অঙ্ক। রয়েছে জটিল মারপ্যাঁচ।

জাতীয় পর্যায়ে অকৃতজ্ঞতার ভুড়ি ভুড়ি উদাহরন পাবেন।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বৃটিষরা বাঙালী তথা ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের সহায়তা নেয়। প্রচুর ভারতীয় তাদের হয়ে লড়ে। যুদ্ধ শেষ হলে ভারতের স্বাধীনতা দেবে-এমন একটা বিশ্বাস বা ধারনা দেয়া হয় তাদের। যুদ্ধ শেষ হলে সেই আশায় ছাই ঢেলে দেয় অকৃতজ্ঞ ও চতুর বৃটেন।

উপমহাদেশে হাটু গেড়ে বসতে, মসনদ দখলে এদেশীয় ক্ষমতালোভী আমলাদের সাহায্য নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। সেই মীরজাফর, মীরকাশিমের কী পরিণতি করেছিল লর্ড ক্লাইভ তা কি জানেন? কৃতজ্ঞতার ধার দিয়েও যায়নি কখনো কোনো কালে, ক্ষমতা যারাই বগলদাবা করেছেন।

হালে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েনকে আপনি মুক্তিযুদ্ধের কৃতজ্ঞতার মাপকাঠিতে মাপতে গেলে নিজেই বিব্রত হবেন। দায় কার-সেটা অনেক বিশ্লেষনের দাবী রাখে। আমি শুধু কৃতজ্ঞতার জটিল গ্যাড়াকলের কথা বলছি এখানে। একটা অদ্ভূত অকৃতজ্ঞতার কথা বলি। মানুষ নাকি তার সৃষ্টিলগ্নে আদিম যুগে পাহাড়ে, জঙ্গলে, বনে, গাছের ওপরে বাস করতে।

ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সেই মানব জাতি একসময় নিজের সুরক্ষা, সুন্দর থাকা, সভ্য হবার তাগিদ হতে প্রথমে পরিবার, তারপর দল, তারপর সমাজ, তারপর দেশ, তারও পরে মহাদেশ, জাতিসংঘ গঠন করে।

তো কথাটা হল, ব্যক্তিমানুষ বা একক মানুষ তার নিজের দরকারে রাষ্ট্র পয়দা করেছিল। রাষ্ট্র’র নিজের অস্তিত্বের জন্য ব্যক্তিমানুষের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। কিন্তু আজকে রাষ্ট্র নিজেই একটি দানবীয় প্রতিষ্ঠান। দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে লক্ষ্য করে দেখুন। দুনিয়ার প্রায় সর্বত্রই রাষ্ট্রযন্ত্র নামক দানব ব্যক্তিমানুষের গলাটা টিপে ধরে তার যাবতীয় ইচ্ছা, অনিচ্ছা, চাওয়া, পাওয়া, ভাল-মন্দ লাগা, তার মতামত, স্বাতন্ত্র সবকিছুকে নির্মমভাবে পিষে মারছে।

ব্যক্তির মতামত, ব্যক্তিসাধারন তথা জনগনের মনের কথাটা রাষ্ট্র কোন দেশে কান পেতে শোনে? বরং রাষ্ট্রের ইচ্ছা অনিচ্ছা চাপিয়ে দেয়া হয় জনগনের উপর। রাষ্ট্র যেটা বিশ্বাস করে, সেটা তার নাগরিকদের মানতে বাধ্য করা হয়। এই মানুষের জন্যই নাকি রাষ্ট্র আর বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। রাষ্ট্র কোথায় আজ মানুষের স্বার্থ দেখছে? কোথায় সে তার সন্তানদের কাছে টানছে? সে ব্যস্ত কতিপয় ধান্দাবাজ ও পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষায়। সাধারনের মুখ সেলোটেপ দিয়ে বন্ধ করে দেয়ায়। ইহাকে আমরা কৃতজ্ঞতার সেন্সরশীপ ও পুলিশী প্রতিদান হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।

আপনাদের মনে পড়ে কিনা? এই বঙ্গদেশেই জনৈক সন্তানেরা তাদের মাকে ঘরে স্থান না দিয়ে গরুর গোয়ালে নিয়ে রেখে এসেছিল? সেই মাকে শিয়ালে কুকুরে কামড়ে আধমরা করে ফেলে যায়? সেকি? ভুলে গেলেন? আমাদের তথাকথিত ’সামাজিক মাধ্যমে” [আসলে অসামাজিক মাধ্যম] কত ভাইরাল হয়েছিল ঘটনাটা! আমরা কত কত স্ট্যাটাস দিলাম সেটা নিয়ে। ওহো, আপনাদের তো বলিইনি।

পৃথিবীতে অকৃতজ্ঞতা বা কৃতঘ্নতার সবচেয়ে বৃহত্তম ও বর্বরতম উদাহরন হল বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যা।

একটা গোটা জাতিকে যিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা এনে দিলেন, যেই বাঙালী জাতি স্বাধীনতা পাবার পরে তাকে বরণ করে নিয়েছিল বীরের মতো, বাবার সত্যিকারের আসন দিয়েছিল, যেই মুজিব এদেশের ৩ লক্ষ অত্যাচারিত মায়ের পিতৃত্বের দায় নিয়েছিলেন, সেই জাতির পিতাকে বাঙালী জাতি রীতিমতো পরিকল্পনা করে, আয়োজন করে, ঘটা করে হত্যা করে ফেলে। এতটুকু হাত কাঁপে না। আড়ম্বর করে তার খুনিদের সিংহাসনে বসায়। এতবড় জঘন্য কৃতঘ্নতা স্বাধীনতার মাত্র ৪ বছরের মধ্যে। একটি গোটা জাতির কৃতঘ্ন হতে সময় নেয় মাত্র ৪ বছর!!

[কেউ কেউ এতক্ষন লেখাটা পড়ে মজা পেলেও এই অনুচ্ছেদটি পড়েই আমাকে আওয়ামিলীগার বানিয়ে তুলোধোনা শুরু করবেন। কেউ কেউ মন্তব্যে লজিক দেখাবেন, ’কেন বঙ্গবন্ধুর খুন জায়েয ছিল’। মিয়ারা, নিজের পিতাকে হত্যা করার কোনো লজিকই আদতে লজিক নয়, ওটা অযুহাত মাত্র।]

উপকারীকে নাকি বাঘে খায়? কপালকুন্ডলার নবকুমারকে মনে পড়ে? যে নবকুমার তার নৌকার লোকদের খাবার সংস্থান করতে বনে নেমেছিলেন আর তার সাথের লোকেরা তাকে বনে ফেলে রেখেই চলে যায়? বাঘের গলা হতে কাঁটা বের করে বিপদে পড়া বকের গল্পও নিশ্চই মনে পড়ে?

আপনি কারো উপকার করবেন, আর তিনি সেটা মনে রাখবেন, আপনার দরকারেও তিনি ঝাপিয়ে পড়বেন-এমনটা যদি আপনি ভেবে থাকেন, তবে ভাই আপনি কলি যুগে অচল। বরং এখন যুগটা হল এমন, আপনি কারো উপকার করতে আপনার কলিজাটা বের করে দারুন করে ফ্রাই করে প্লেটে করি খেতে দিবেন, সে আপনাকে বলবে, “লবনটা কম হয়ে গেছে।”

আপনার সন্তান, যারা আপনার কলিজা, যাদের মানুষ করা নিয়ে আপনি গর্বিত, আপনি কেবল একটা ব্লাফ ঘোষনা দিন, যে, আপনার সব এসেট আপনি আপনার সবচেয়ে ছোট সন্তানকে দিয়ে যাবেন, তারপর দেখুন, তারা কতটা মানুষ, কতটা দানুষ!

ভার্চুয়াল সাইবার জগতেও অকৃতজ্ঞতার ছড়াছড়ি। আপনি আপনার স্মার্ট ফোনের ব্লুটুথ ব্যবহার করে এক ফোন হতে অন্য ফোনে শেয়ারইট এ্যাপ নিয়ে নেন। তারপর শেয়ারইট ইন্সষ্টল করে জীবনের তরে ব্লুটুথকে ভুলে যান।

আপনি যদি বাস্তব জগতে কারো কোনো রকম উপকার করেন, কাউকে বিপদ হতে উদ্ধার করেন, তবে আপনার মনে কী কাজ করে? আমি বাজে লোক তো, তাই বাজে চিন্তাই সবার আগে মনে আসে।

আমার ধারনা, মাত্র ১% লোকের মধ্যে নিঃস্বার্থতা কাজ করে। যিনি উপকারের বিনিময়ে একদমই কিছু প্রত্যাশা করেন না। বাকি ৯৯% মানুষ উপকারের বিনিময়ে ফিরতি প্রতিদান, কেউ কেউ বিশেষ কোনো সুবিধা, কেউ কেউ অন্তত বিপদে পড়লে ফিরতি উপকার পাবার আশা করেন। একদম কিছু না হলেও, উপকারভোগী মানুষটি উপকারীর প্রতি মানসিকভাবে কৃতার্থবোধটুকু বজায় রাখুন আর মুখে একটি শুকনো ধন্যবাদ অন্তত দিন-সেটাও প্রত্যাশা করেন না-এমন মহামানবের দেখা পেলে আমি তার পায়ের ধুলা মাদুলীতে ভরে গলায় ঝোলাব।

”নিঃস্বার্থতম কাজটির পেছনেও একটি সূক্ষ্ণ স্বার্থ কাজ করে। সেটার হল “নিঃস্বার্থ’র স্বীকৃতি।”

মুশকীল হল, “Thank you", "So kind of you", "I am so grateful" ইত্যকার চটুল বাক্যসমষ্টি বা তার চোস্ত বাংলা প্রচলিত থাকলেও বাংলাদেশের মানুষ কেন যেন, ফরমালিটি করে হলেও ওই শব্দগুলো বলতে গেলে জিহবা জড়িয়ে যায়।

আর সত্যি সত্যি উপকারের প্রতিদান দেবার ক্ষেত্রে তো “কাজের বেলায় কাজি, কাজ ফুরোলে পাজি।” তবু মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদের ”মানব’ পরিচয়কে তো আর ভুলে যেতে পারি না। তাই শত অনাচারের পরেও কবি জসীমউদ্দীনের সুরে বলতে হয়-
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই, যে মোরে করেছে পর।

কেউ যদি বলেন, আমাদের কৃতজ্ঞতার কোনো উদাহরনই কি নেই? হ্যা হ্যা, আলবত আছে। স্রোতের একদম বিপরীতে বাংলাদেশের জন্মানো রাজাকারকূলের পাকিস্তান নামক ব্যর্থ ও নোংরা রাষ্ট্রটির প্রতি কৃতজ্ঞতার লালা নিঃস্বরন দেখলে আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় জাতি হিসেবে আমরা অকৃতজ্ঞ।

কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, ১৯৭১ সালে পাকি কুত্তাদের সঙ্গ দেয়া তাদের পক্ষে? সেটা সময় হলে আরেকদিন বলব।

[কপাল কুন্ডলার যে উক্তিটাকে আমি হেডিং করেছি-সেটিকে আসলে ইচ্ছা করে একটু বাঁকিয়ে দিয়েছি। সত্যিটা হল, তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম না হই কেন?। আর মূসা আঃ এর ঘটনাটিতে ওই নৌকাটিকে খিজির আঃ ফুটো করে দিয়েছিলেন, ওই অসহায় ছেলেটির নৌকাটিকে সেই দেশের রাজা কর্তৃক সিজ করা আটকাতে।]

কিস্তি-৩: কৃতজ্ঞতা-অকৃতজ্ঞতা-কৃতঘ্নতা-প্রত্যুপকার:

Taken for granted-সম্ভবত বাঙালীদের কথা ভেবেই এই কথাটার উৎপত্তি হয়েছে।

এই জাতটা সবকিছুকে নিজের অধিকার-হক্ক মনে করে। কারো উপকার, কারো সৌজন্য, কারো বদান্যতা, কারো মানবিকতা-এ সব কিছুকেই মনে করে তার নিয়মিত পাওনা। বাড়তি কিছু না।

কেউ কেউতো আরেক কাঠি সরেস। তারা এক কদম আগে বেড়ে এমনই approach নেয়, যেন, তাকে উপকার করে দিতে পেরে ওই বেটাই বরং ধন্য হয়েছে। ঠিক যেমন বাঘের গলার কাঁটা বের করে সারস ধন্য হয়েছিল।

আমার মনে পড়ছে, সেই পিচ্চিকালে একবার পৌষ মাসের ২৬ তারিখ, আমার দাদার মৃত্যুবার্ষিকী। আবার বাবা সেই উপলক্ষ্যে কাঙাল ভোজ (আসলে কয়েকজন গরীব কে একবেলা ডাল-ভাত খাওয়ানো) করাতেন।

তো, সেবার, দুপুর বেলা, বাজারে নিয়মিত ভিক্ষা করেন, এমন একজন গাড়িওয়ালা (বেয়ারিং গাড়িধারী) পঙ্গু ভিক্ষুক দুপুরের কাঙাল ভোজে এসেছেন রিক্সা করে। এসেই নেমে তিনি আমাকে ডেকে বললেন,

“মনু, এই খাওন কি তোমাগো বাসায়?” সেটা নিশ্চিত হয়ে তিনি বললেন, “যাও মনু, তোমার আব্বারে কও রিক্সাভাড়াডা দিয়া দেতে।”

আমি ভীড়ের মধ্যে কাজের বাসায় আব্বার নিকট হতে তাকে রিক্সাভাড়া দেয়াবার ব্যবস্থা করার সাহস পেলাম না। তাই মাকে গিয়ে বলে ম্যানেজ করলাম। টুইস্ট সেখানে নয়।

খাওয়া শেষ হলে তিনি আমাকে বললেন,

”মনু, যাও, তোমার আম্মারে যাইয়া কও, একটা পান দেতে। সুরভী জর্দা দিয়া। তাকে পান দিলাম। অতঃপর তিনি যাবার উদ্যোগ করে আমাকে বললেন, “মনু, যাওনের রিক্সাভাড়াডা তোমার আব্বারে দিয়া যাইতে কও।”

কসম বলছি, এই ঘটনা আমি আজও মনে রেখেছি, এই চিন্তা করে, যে, ওই ভদ্রলোক সেদিন কাঙাল ভোজ খেতে এসে আমাদের ধন্য করেছিলেন, এবং আমার প্রয়াত দাদাকে তার পোলার পূণ্যে স্বর্গে পাঠাবার জন্য সদয় সম্মতি ও সদাশয় পদার্পন করে আমাদের কার্যত বাধিতই করেছিলেন।

প্রত্যুপকারী বলে একটা শব্দ বাংলা অভিধানে আছে ঠিকই, তবে সেটা ব্যবহার হয়নি কোনোকালেই। তাই উপকার ফেরতের আশা তো দিল্লী কা বাৎ। কৃতজ্ঞতা যে একটা প্রকাশ করার জিনিস, স্বীকার করার জিনিস-এই বিদ্যাই বাঙালদের কেউ দেয়নি কোনোকালে।

কেউ আপনাকে উপকার করেছে, কেউ আপনার প্রতি সদয় হয়েছে, কেউ একটা উপহার দিল, কেউ আপনাকে নিজের বন্ধুত্বে নিল, কেউ আপনার প্রতি মানবিকতা দেখালো, কেউ আপনার সাথে ভাল কিছু করল-সেটার প্রতিদান না হোক, অন্তত তাকে সেজন্য ধন্যবাদ দেয়া, তার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করা, তার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধটাকে মুখে প্রকাশ করার কাজটাও বাঙালী করাকে গুনাহ মনে করে।

আরেহ বঙাল দেশের বাঙাল ভাই, উপকারীকে বলা হয়েছে উপকার গোপন করতে আর উপকৃতকে বলা হয়েছে সেটা ফলাও করে প্রচার করতে। এদেশে হয়েছে উল্টা। আমাদের শেখানো হয়েছে taken for granted.

নেটে একটি গল্প কয়েকদিন ধরে চোখে পড়ছে--আমার আব্বা বহুদিন আগে একটি গরিব পরিবারকে আমাদের একটি জমিতে বিনামূল্যে ঘর তুলে থাকতে দিয়েছিলেন........বাঙালদের taken for granted চরিত্র এই গল্পে এত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে-যে বলার না।

আজকাল সন্তানাদিও বিশ্বাস করে, এবং রীতিমতো বাপ-মা'কে বলতেও শুরু করে দিয়েছে-"তোমরা যা করছ, তা তো নিজেদের স্বার্থেই করছ। আর যা করছ, তা তো তোমাদের দায়ীত্ব।" সুতরাং, উপকার করুন, মানবিকতা দেখান, বদান্যতা প্রদর্শন করুন আর বেশি বেশি ধন্য হোন।

[“বহুদিন আগে আমার বাবা তার খালি জমিতে একটা গরিব পরিবারকে থাকতে দিয়েছিলেন।” এই লেখাটি ব্যপক আকারে জুলাই ২০২২ মাসে ফেসবুকে দেখি। যদিও একজন বান্দাও তাদের লেখায় কোথায় বলেননি, যে, মূল লেখকটি কে ছিলেন। ফেসবুক নীতিগদ্যের বাঙাল ধারা মেনে সবাইই তাদের দেয়ালে কপি পেস্ট করে মূল লেখকের দাফন করে দিয়েছেন। আমি সামান্য খোঁজাখুঁজি করে দেখলাম, জনাব Leton Feroz Leton নামের এই ভদ্রলোকের পোস্টটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরোনো ৪ নভেম্বর ২০২১ । Click This Link তার আগে সেপ্টেম্বর ২০২১ এ একজন নারী তার লিংকডইনে পোস্ট করেন কালেকটেড লিখে-https://www.linkedin.com/.../shabnur-suraiya-32229b170.../।] ]

একবার এক বুজুর্গ ব্যক্তির কাছ থেকে শোনা একটি জ্ঞানগর্ভ কথা বলি। তিনি বলছিলেন, “কখনো কখনো বান্দা এত খুশি হয়, এত খুশি হয়, এত খুশি হয়, যে, খুশিতে বাগ বাগ হয়ে সে উচ্ছাসে ফেটে পড়ে বলে, ”হে খোদা, তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার রব!!!”

গল্পটি রূপক হলেও এর গভীরতা অনেক। কেউ কেউ ক্ষণিকের আবেগে, উচ্ছাসে, কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে মুহূর্ত মাত্র চিন্তা না করেই কাউকে সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়, “আপনার ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে পারব না। আজ হতে আপনি আমার কেনা গোলাম।”

সেই একই পুরষ্কারদাতা ব্যক্তি কিছুদিন পরে সেই একই ব্যক্তিকে আগের উচ্ছাস ছাপিয়ে “এই জীবনের পাতায় পাতায় লেখা যা, সবই ভুল” বলতেও দ্বিধা করে না। ফুলের মালা দেবার আগে আরেকটু ভেবে নিলে ভবিষ্যতে বাঁক নেবার রাস্তাটা আরেকটু খোলা থাকে।

(Re-post)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০২৩ সকাল ৮:৫৯
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×