খুব সকালে বাসা থেকে বের হয়। সাথে সন্তানসম্ভবা বউ। দুইজনেই অফিসে যাবো। বউকে বাসে তুলে দিয়ে আমিও উঠে পড়লাম। গ্রীষ্মের তেজ সকালেই শুরু হয়ে গেল। গরম বাড়ছে। সাথে মানুষের নিঃশ্বাস। বাস থেকে নেমে সোজা অফিস। তাপানুকূল পরিবেশে কিছুটা স্বস্তি। কিছুটা সময় থেকে শুটিং এর কাজে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। কাজ চলছে। জনদুর্ভোগ মানুষের, সাথে আমাদেরও। দুপুরের কিছুটা আগে বউ ফোন করে জানাল, গর্ভের আগত নবজাতকের নড়াচড়া কিছুটা কম। গতদিনের মতো আজকেও নীরব। আমি কিছুটা শঙ্কিত, সাথে আমার বউও। এখন ডাক্তারই ভরসা। ফোনে ডাক্তারের সিরিয়াল নিয়ে নিলাম।
সারাদিনের ক্লান্ত দেহে কাজ শেষ করে শেষমেষ বউকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটলাম। সবকিছু শুনে নবজাতকের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য আলট্রাসনোগ্রাম করতে বলল। বউকে পাঠিয়ে আমি অপেক্ষমাণ চেয়ারে পরিশ্রান্ত দেহে। এমন সময় আমার মুঠোফোনে বাবার ফোন। ফোন ধরেই আমার বাবার প্রথম কথা,
বাবা, তুমি কেমন আছো?
আমি বললাম, আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
বাবা বলল, ভালো আছি।
আমি আবারও বললাম, তুমি হাঁপাচ্ছো কেন? তোমার শরীর কি ঠিক আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
তাহলে হাঁপাচ্ছো কেন? তোমার কি হয়েছে?
তেমন কিছু না। বুকে হঠাৎ করে মোড়চ দিয়ে উঠেছে। তোমার কথা মনে পড়ল, তুমি ভালো আছো তো?
আমার ভিতরে ভয়ানক ভয় ঢুকে গিয়েছে। পাশের রুমে বউ নবজাতকের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য আলট্রাসনোগ্রাম করতে প্রবেশ করেছে আর অনেক দূরে আমার বাবা হাঁপাচ্ছে। ভয়ে আমি কাতর। একদিকে আমার নবজাতকের জন্য আমার দুঃশ্চিন্তা আরেকদিকে তার ছেলের জন্যে আমার বাবার দুঃশ্চিন্তা।
আমি বললাম, তুমি এখন কোথায়?
বাবা বলল, বাসায় যাচ্ছি।
আমি সাথে সাথে ফোন রেখে মা’কে ফোন দিয়ে সবকিছু বলি। আমাদের বাসার পাশেই মা মন্দিরে গিয়েছিল। মা’কে বলি তুমি তাড়াতাড়ি বাবার কাছে যাও। বাবা বাসায় ফিরছে।
বউ ফিরে এসেছে। জিজ্ঞেস করলাম কি অবস্থা? আলট্রাসনোগ্রাম করার সময় ডাক্তার বলেছে, নবজাতক ভালো আছে। সুস্থ আছে। এইরকম মাঝে মাঝে নড়াচড়া কম করে, তবে সুস্থ আছে। মনে স্বস্তি ফিরে এলো, সাথে প্রশান্তিও।
কিছুক্ষণ পরে আবার বাবা এবং মা’কে ফোন দিলাম। দুইজনেই বলল, বাবা এখন ভালো আছে। হঠাৎ গ্যাসের কারণে এই মোচড় দেয়া। ভয়টা কেটে গেল।
আমি এখনো সন্তানের বাবা হয়নি। কিন্তু সংকটময় মুহূর্তে সন্তানের কথা চিন্তা করা বা ভাবা এইটা কতটা উদারতা, কতটা মহত্বের পরিচয়, একজন বাবাই বুঝি এমন পারেন। যে ভয়টা আমার মধ্যে ছিল তা পূর্ণ মাত্রায় শিথিল হয়ে যায়। বাবা ডাক শোনার আগেই, সন্তানের প্রতি বাবার দায়িত্ববোধের ব্যাপারে নতুনভাবে অবগত হলাম। বাবা হওয়ার আগেই আমি বাবার ঐকান্তিক ভালোবাসার বন্ধনটা টের পেলাম।
বিনয় দত্ত
কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]