আমার শাশুড়ি একদম বাঙালি বেশভূষায় অভ্যস্ত। ঘরোয়া পরিবেশে কাজের সুবিধার জন্যে সালোয়ার কামিজ পড়লেও বাইরে গেলে সবসময়ই তিনি শাড়ি পড়ে বের হন। যদিও এখন শাড়ি পড়া নারীর সংখ্যা কমতে কমতে উধাও হওয়ার পর্যায়ে এসে ঠেকেছে।
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আগ্রহের কারণে একটু দেরিতে হলেও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ সংগঠন ছায়ানটের সাথে যুক্ত হয়ে নজরুল সঙ্গীতে তালিম নেয়া শুরু করেন এবং নিজের যোগ্যতা ও মেধার বলে প্রমাণ করেন তিনি কোনো অংশেই তরুণ-তরুণীদের চেয়ে কম যান না। সংসার, ধর্ম, কর্ম, সমাজ, সংস্কার সব সামলিয়ে তিনি প্রথম মান নিয়ে ছায়ানট থেকে নজরুল সঙ্গীতে কোর্স সম্পন্ন করেন। কোর্স শেষ করেই তিনি জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, উত্তরা শাখায় খুব দক্ষতার সাথে ছাত্রছাত্রীদের নজরুল সঙ্গীতে শেখানো শুরু করেন। গানের প্রতি তার আগ্রহ দেখার মতো। আমি দীর্ঘদিন দেখেছি যখনই কোনো বিশেষ কাজে বাইরে যান নিজের আলমারি থেকে সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো শাড়িটি বের করে তা পড়ে বের হন। এতে করে শাড়ির প্রতি তার যে প্রেম, দরদ তা বোঝা যেত।
প্রতিদিনের মতো গত বুধবার বিকেলও আমার তিনি শাড়ি পড়ে সুন্দর পরিপাটিভাবে সাজগোজ করে ক্লাস নেয়ার জন্য বের হন। সন্ধ্যার সময় আমি আর আমার স্ত্রী বের হচ্ছিলাম একটা কাজে। এরমধ্যে হঠাৎই ফোন আসে। ফোনের ওপার থেকে জানা যায়, তিনি ভয়ানক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। আমি আর আমার স্ত্রী তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। যাওয়ার পথে অনেক কিছুই ভাবছি। কি হতে পারে? কোনো অসতর্কতার কারণে হল কিনা? নাকি কোনো বড় গাড়ি এসে ধাক্কা দিল? বিভিন্ন দুঃশ্চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
আমি ধারণা করেছিলাম রিকশাসংক্রান্ত কোনো কারণে উনি হয়তো ভয়ানক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে সোহাগ নামের একজনের সাথে কথাও হয়েছে যিনি আমার শাশুড়িকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছেছেন। আমরাও দ্রুত পৌঁছে যায়। পৌঁছে দেখি ততক্ষণে তাকে জরুরী বিভাগে রেখে ছোটখাট একটা অপারেশন করা হচ্ছে। সোহাগ অপেক্ষমাণ চেয়ারে বসে আছে। আমরা এগিয়ে তার সাথে কথা বললাম। পুরো ঘটনাটা তার মুখেই শুনলাম।
ক্লাস শেষ করে বের হয়ে তিনি রিকশাতে উঠতে গিয়েছেন। শাড়ি পরনে ছিলেন তিনি। এক পা দিয়েছেন এমন সময় বোকা রিকশাওয়ালা রিকশা টান দেয়। যাত্রী উঠেছে কি উঠেনি তা না দেখেই। টান দেওয়ার সাথে সাথে আমার শাশুড়ি শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে মুখ থুবড়ে পিচ ঢালা রাস্তায় পড়ে যান। এমনভাবে পড়েছেন যে চোখের আশেপাশে সবজায়গায়ই প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছেন, ঠোঁট কেটে গিয়েছে, রক্তপাত হয়েছে।
সবচে বিপদজনক হল, মুখ থুবড়ে পড়েই তার ক্রমাগত রক্তপাত হচ্ছিল। রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়েই ছিল! একটু ধরল না পর্যন্ত। সোহাগ দৌঁড়ে এসে আমার শাশুড়িকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে আসে। সবশুনে আমি হতবাক হয়ে যায়। ওই সময় খুব একা মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল শূণ্যে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। যে মানুষটা দিনরাত এক করে একটা সংসার টিকিয়ে রেখেছেন তিনি এখন ভয়ানক দুর্ঘটনার শিকার। এই বয়সে খুবই বাজেভাবে আঘাত পেয়েছেন যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বোকা রিকশাওয়ালার চরম বোকামির কারণে এই বয়সে এসে এইরকম আহত হয়েছেন।
ঘটনাটি আসলে শাড়ির কারণে ঘটেনি, রিকশাওয়ালার চরম বোকামি এবং উদাসীনতার কারণে এইরকম ঘটনার শিকার হতে হয় আমাদের সবারই। এই ক্ষত সারতে আমার শাশুড়ির বেশ ভালো বেগ পেতে হয়েছে। এই ঘটনার পর কেউ যদি শাড়ির উপর রাগ করে শাড়ি ছেড়ে দেন তবে তার বোকামি।
বিনয় দত্ত
কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]