কথায় আছে, ''এক দেশের গালি, আরেক দেশের বুলি'' কিংবা ভাইস-ভার্সা। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতীরই নিজস্ব ভাষা রয়েছে মনের ভাব প্রকাশের জন্য। কিন্তু এই এত্তো এত্তো ভাষার অগুনতি শব্দে মাঝে মধ্যে গ্যান্জাম লেগে যায়। না, তারা নিজেরা কোন ঝামেলা সৃষ্টি করে না, ঝামেলার সৃষ্টি হয় তাদের প্রয়োগকারীদের মাধ্যমে। স্থান-কাল-পাত্র বলে একটা কথা আছে। এই স্থান-কাল-পাত্র এর কল্যানে এমন সব বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয় যার রেশ অনেকসময়ে থেকে যায় বাকী জীবনে। যাকগে, কথা আর বাড়াই না। আপনাদেরকে বরং কিছু ভাষার শব্দজনিত বিব্রতকর ঘটনা বলা যাক, যার অধিকাংশই আমার জীবনে ঘটেছিল।
ঘটনা একঃ
এখন হয় কিনা জানিনা, আমাদের সময় ঢাবির অনেক ডিপার্টমেন্ট-ই সার্ক দেশগুলোতে স্টাডি ট্যুরের আয়োজন করতো। আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকেও এমনি একটা ট্যুরের আয়োজন করা হয়। ভ্রমনের দেশগুলো ছিল ভারত, ভুটান আর নেপাল। আমরা ঢাকা থেকে বিমানে সরাসরি দিল্লী যাই, ওখান থেকেই আমাদের ট্যুর শুরু হয়।
অনেকদিন আগের কথা, পুরোপুরি মনে নাই; দিল্লীর গ্রেটার কৈলাশ এলাকার সম্ভবতঃ অলোকান্দা রোডের আশেপাশে কোন একখানে আমার আম্মার স্কুল জীবনের এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী থাকতেন, যিনি কিনা আবার আম্মার হাতে তৈরী জলপাই এর মিষ্টি আচারের দারুন সমঝদার ছিলেন। দিল্লী যাচ্ছি, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আমার উপর গুরুদায়িত্ব পড়লো সেই আচার উনার কাছে পৌছে দেয়ার। তো, যেহেতু পরে আর সময় পাওয়া যাবে না, দিল্লী পৌছেই আমার এক বন্ধুকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম উনার বাসার দিকে। বলে রাখা ভালো, আমার বা আমার বন্ধুর সেটাই প্রথম ভারত যাত্রা এবং আমরা দু’জনেই হিন্দির 'হ' ও জানতাম না।
জায়গামতো গিয়ে ঠিকানা খুজছি, এমন সময় শুনি একলোক হকারদের মতো করে হাক দিচ্ছে, ''বাল কাটনেওয়ালা''। শুনে আমার কান খাড়া হয়ে গেল, সেইসঙ্গে চোয়ালও ঝুলে পড়লো। একবার ভাবলাম, ভুল শুনলাম বোধহয়। পরমুহুর্তেই আবার চিৎকার, ''বাল কাটনেওয়ালা''। ভড়কে গিয়ে সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখও বাংলা পাচের মতো হয়ে গিয়েছে। 'কাটনেওয়ালা' না হয় বুঝলাম, মেনেও নিলাম; তাই বলে বাল! ছিঃ!!
নিজেরা আলাপ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, এ হচ্ছে ভ্রাম্যমান বাল কাটনেওয়ালা। তবে এখানকার মানুষ কেমনতরো বে-শরম যে অন্যকে দিয়ে নিজেদের বাল কাটায়! এ কোন দেশে এসে পরলাম রে বাবা!
পরে আন্টির ছেলে আমাদের ভুল ভাংগায়। আমরা জানলাম যে, হিন্দির 'বাল' হচ্ছে আমাদের মাথার চুল, আর সেই লোক ছিল একজন ভ্রাম্যমান নাপিত!
ঘটনা দুইঃ
তখন মাস ছয়েকের মতো হয়েছে, আমার বউএর এই দেশে আসার। নতুন দেশের হাল-চাল বুঝতে একটু সময় লাগছে, সেটা স্বাভাবিকও বটে। দেশে থাকতেই ফেবুর কল্যানে সে তার এক হারিয়ে যাওয়া স্কুলের প্রিয় বান্ধবীর সন্ধান পেয়েছে যে কিনা এখন লন্ডনে থাকে। নাম তার নীগার সুলতানা। এখানে আসার পর থেকেই দেখি, সে দিনরাত তার বান্ধবীর সাথে ফুসুর-ফাসুর করে। আর প্রতিদিনই আমাকে বলে, কবে তাকে লন্ডন নিয়ে যাবো।
আজ না কাল, কাল না পরশু করতে করতে শেষমেষ ওর জ্বালাতন সহ্য করতে না পেরে একদিন গেলাম লন্ডনে। বো রোডে সেই বান্ধবীর বাসা। বউ-এর মাধ্যমেই তাকে জানালাম যেন সে বো রোড আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের বাইরেই অপেক্ষায় থাকে।
দীর্ঘদিনের না-দেখা বান্ধবীকে দেখার জন্য আমার সহধর্মিনীর আর তর সইছিল না। ট্রেন থেকে নেমে মোটামুটি কয়েক লাফে স্টেশনের বাইরে এসে দেখে বান্ধবী নাই। পর মুহুর্তেই তার নজরে পড়লো, তার প্রানের বান্ধবী রাস্তার ওইপাড়ে, রাস্তা পারাপারের সবুজ বাতির জন্য অপেক্ষমান। কাজেই আমার বউ স্থান-কাল-পাত্র ভুলে পুরাই দেশী স্টাইলে চিৎকার করে উঠলো, এ্যাই নীগার, এ্যাই; এইদিকে! আমি আতকে উঠে ওর মুখ চেপে ধরলাম, কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার, ততোক্ষনে হয়ে গিয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি, এখানে 'নীগার' একটা ভয়াবহ বর্ণবাদী গালি, যা কালোদের উপর প্রয়োগ করা হয়। আর বো রোডে প্রচুর স্বদেশী এবং কালোদের আবাস। কেউ যদি এই শব্দের প্রায়োগিক প্রমানসহ বর্ণবাদীর অভিযোগ দাখিল করে তাহলে জরিমানা মোটামুটি নিশ্চিত, জেলও হতে পারে।
যাইহোক, ঘটনায় ফিরে আসি।
এক কালো দম্পতি তখন তার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে আমাদের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। ভদ্রলোক দাত খিচিয়ে আমার বউকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি এইমাত্র কি বলেছ? আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। বললাম, দেখো, ও এইদেশে নতুন। তাছাড়া ও তোমাকে বলে নাই। ওর ওই বান্ধবীর নাম নীগার, নীগার সুলতানা। ওকে ডেকেছে। তারপরও তুমি যদি হার্ট হয়ে থাকো, আমরা তার জন্য দুঃখিত। ব্যাটার চেহারা দেখে বুঝলাম, আমার বক্তৃতা ওর মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। ততোক্ষণে আসল 'নীগার'ও আমাদের পাশে এসে দাড়িয়েছে। অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে নীগার সুলতানা তার ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করে ব্যাটাকে দেখানোয় সেযাত্রা রক্ষা পেলাম।
প্রস্থানের সময় কালো ভাইএর স্বগোতোক্তি, হাউ দিস ক্যুড বি এ ব্লাডি নেইম!!
পরে নীগার আমাদের জানিয়েছিল, নামের এই ভয়াবহতার কারনে পরিচিত-মহলে সে নায়লা নামে পরিচিত! 'নীগার' থেকে 'নায়লা', খুব একটা খারাপ না!
ঘটনা তিনঃ
তখন ক্লাশ ফোর কিংবা ফাইভে পড়ি। একদিন দুপুরে কয়েক বন্ধু মিলে মাঠে খেলছিলাম। মাঠের এক কোনায় একটা ছোটখাটো জটলা দেখে আমরা এগিয়ে গেলাম। দেখি, সাদা চামড়ার একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। বাংলা-ইংলিশ মিশিয়ে অদ্ভুদভাবে হাত-পা নেড়ে কিছু বলছে। তখন সাদা চামড়া মাত্রই একটা দর্শনীয় বস্তু, তাই এই জটলা।
গভীর মনোযোগের সাথে তাদের অঙ্গসন্চালন আর বক্তব্য থেকে আমরা যা উদ্ধার করতে পারলাম, তা হলো তারা এখানে 'ডাটা কালেকশান' করতে এসেছে। কিভাবে তাদেরকে সাহায্য করা যায়, তাই ভাবছি। এমনি সময়ে ত্রানকর্তা হিসাবে এগিয়ে এলো আমাদেরই এক বন্ধু। স্মার্ট হিসাবে বন্ধুমহলে তার অনেক সুনাম! সে ওদেরকে বললো, ডাটা কালেকশান করবা? নো প্রবলেম। আসো আমার সাথে। সবাই আমরা সদলবলে এগিয়ে গেলাম ওর সাথে।
তখন আমাদের মাঠের পাশেই একটা একবেলার ছোটখাটো অস্থায়ী কাচাবাজার বসতো। মোটামুটি সবই পাওয়া যেতো সেখানে। সে ওদেরকে এক সব্জীওয়ালার কাছে নিয়ে গেল, যে কিনা ডাটাও বিক্রি করে। ওদের দু’জনকে ডাটা দেখিয়ে আমার সেই বন্ধু বললো, দিস ইজ ডাটা। এখন কালেক্ট, যতোখুশী!!
ঘটনা চারঃ
এক মাসের ছুটিতে ঢাকায় গিয়েছি। গ্রাম থেকে আমার এক দুর-সম্পর্কের মুরুব্বি গোছের আত্মীয় এসেছেন বাসায়, উদ্দেশ্য ঢাকায় ডাক্তার দেখানো। একদিন উনি ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলেন। সেখানে আমার বড়বোনের দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে বসে মোবাইল টেপাটেপি করছিলো অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে।
ভদ্রলোক গ্রামের মানুষ, সারাদিন মোবাইল নিয়ে মেয়ের বসে থাকা সম্ভবতঃ উনার পছন্দ হয়নি। বললেন, মা, সারাদিনই দেখি মোবাইল নিয়ে বসে থাকো। কি করো এতো? আমার ভাগ্নির আবার উনার এই অযাচিত হস্তক্ষেপ পছন্দ হয়নি। একটু বিরক্তি নিয়েই সে বললো, চ্যাট করি।
রাতে খাবার টেবিলে দেখি মুরুব্বীর মুখ থমথমে। জানালেন, আগামীকালই উনি ফিরে যাবেন। বললাম, কালই চলে যাবেন, ডাক্তার তো এখনো দেখাননি ঠিকমতো। উনি বললেন, আর ডাক্তার, মন ভালো নেই। অনন্যাকে (আমার ভাগ্নি) জিজ্ঞেস করলাম মোবাইলে এতো কি করো? সে কিনা আমাকে বলে, চ্যাট করি। এই বয়সে এতোটুকু মেয়ের কাছ থেকে এটাও শুনতে হলো!!!
অভিজ্ঞজনেরা নিশ্চয়ই জানেন যে, বাংলায় 'চ্যাট' একটা গালি!
ঘটনা পাচঃ
এটা অনেককাল আগে, কলেজে পড়ার সময়, আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে শোনা, কাজেই সত্য-মিথ্যা কতোটুকু কি জানিনা।
বন্ধুর বড়ভাই প্রতিদিন রাতে টিভিতে খবর দেখতেন, সেইসাথে উনার ক্লাশ ফাইভে পড়ুয়া মেয়েও দেখতো। তো, একদিন খবর দেখতে দেখতে কোন এক কাজে উনি পাশের রুমে গিয়েছেন। ফেরত আসার সাথে সাথেই মেয়ের প্রশ্ন:
- বাবা, ভারতে কি টয়লেট নাই?
- থাকবে না কেন, আছে। তবে সবার নাই। কেন হঠাৎ এই প্রশ্ন? উনি একটু আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞেস করলেন।
- ভারতের প্রধানমন্ত্রীরও কি নাই?
- থাকবে না কেন, এটা কোন ধরনের প্রশ্ন? এবার একটু বিরক্ত হয়েই বললেন বড়ভাই।
- তাহলে এইমাত্র যে টিভিতে বললো, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী গতকাল বন থেকে হেগে এসেছেন! টয়লেটই যদি থাকবে তাহলে উনি বনে-জঙ্গলে হাগু করতে কেন গিয়েছিলেন?
আফসোসের সাথে বলতে হচ্ছে, বন যে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানীর রাজধানীর নাম, আর দ্য হেগ নেদারল্যান্ডের একটি অন্যতম প্রধান নগরী, এই তথ্য দু'টি ওই ছোট্ট মেয়েটির জানা ছিল না।
তথ্য সূত্রঃ আমার স্মৃতির ভান্ডার।
ছবি সূত্রঃ ইন্টারনেট।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:০৯