গত ২৪শে মার্চ ২০২০ এর কথা।
সকালে ঘন্টাদেড়েক দেরী করে অফিসে গিয়েছি। ক্রিস এসে দাত বের করে বললো, বস তোমারে খুজতাছে। সকাল থিকা দুই বার খুজছে।
আমি বললাম, খুজছে ভালো কথা। খোজাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তুই দাত বাইর করতাছোস ক্যান এইটা তো বুঝলাম না!
ক্রিস এইবার পুরাপুরি দন্ত বিকশিত করে বললো, বসে আমারে জিগাইছে, ক্রোকোডাইল ম্যান আসে নাই? অহনও ঘুমাইতাছে নাকি? খবর লও!
বস আমাকে 'ক্রোকোডাইল ম্যান' বলেছে? আগুনচোখে ওকে ভস্মীভূত করতে করতে বসের রুমের দিকে হাটা দিলাম। আমাকে এই নামে মাঝে-মধ্যে একমাত্র ক্রিসই ডাকে। তাও সেটা অফিসের বাইরে। বসের কানে যেহেতু এটা গিয়েছে, এই ফাজিলটা ছাড়া আর কেউ এটার জন্য দায়ী হতে পারে না।
ঘটনা হলো, আমি একটু আইলসা টাইপের…….না, এভাবে বলা ঠিক না; আরেকটু ভদ্রভাবে বলি, আমি আসলে আরাম প্রিয় টাইপের মানুষ। শীতের আগে / পরে যখন রোদটা খুব মিষ্টি থাকে, রোদে সুন্দরবনের কুমীরের মতো গা এলিয়ে দেই। রোদে আধশোয়া হয়ে বই পড়া আমার খুবই প্রিয় একটা বিলাসিতা। অবধারিতভাবেই এক পর্যায়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। কাজ জমানো আমার আরেকটা অভ্যাস। জমাতে জমাতে আমার নিজস্ব সিস্টেম যখন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়, তখন নাকে-মুখে সব তাড়াহুড়া করে শেষ করি। সব কাজ আমি একাই শেষ করি, কখনও কারো সাহায্য নেই না। তবে এটা নিয়ে দুর্মুখেরা আমাকে প্রতিনিয়ত কটু-কাটব্য করে এবং তার শিরোমনি হলো আমার গৃহকর্ত্রী। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমি আমার অভ্যাস এখন পর্যন্ত জারি রেখেছি। এরই ধারাবাহিকতায় আমার বউ প্রায়ই বলে, আমি নাকি আগের জন্মে কুমীর ছিলাম। ভুলক্রমে এবার মনুষ্য সমাজে পতিত হয়েছি। আমার অলসতা নিয়ে সুযোগ পেলেই ও অনেক সত্য-মিথ্যা কাহিনী ফেদে বসে; আর ক্রিসের মতো ডাইহার্ড শ্রোতা পেলে ওর মনে হয় ঈদ লেগে যায়!
যাই হোক, আপনাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ক্রিসের সাথে আমার সাফারীতে (সাফারী পার্কে কয়েকটা ঘন্টা) বেড়ানোর কথা। সেটাতে আমার যতোটা অনীহা (সত্যি বলতে, বাসা থেকে বের হতেই আমার প্রচন্ড অনীহা) ছিল, বিপরীতে আমার বউয়ের ততোটাই আগ্রহ ছিল। তো সেদিনের সেই লম্বা জার্নিতে গাড়ীতে বসে অনেক কথাই হয়েছিল। তখন আমার বউ রসিয়ে রসিয়ে আমার কিছু গুণকীর্তন করেছিল ক্রিসের কাছে। তারমধ্যে আমার অলসতার অনেক বর্ণনাও ছিল। আমাকে বাসা থেকে বের করার রাগে ওর বেশকিছু টাকা খসিয়েছিলাম সেদিন। তার প্রতিশোধ নিতেই কিনা জানি না, সেদিন থেকেই ও আমাকে 'ক্রোকোডাইল ম্যান' ডাকা শুরু করেছিল। আমি অতোটা গুরুত্ব দেই নাই কখনও। কিন্তু গাধাটা যে এটা বসের কানেও তুলবে তা আমি চিন্তাও করি নাই।
এগুলো ছিল আসলে তবলায় টোকা। এতো কথা কেন বললাম, তা একটু পরে বুঝবেন। তাহলে এবার আসল কথায় আসি।
বছর দশেক আগেও ব্লগ সম্পর্কে আমার ধারনা ছিল ঝাপসা। বেড়ানো যেহেতু আমার নেশা; বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্লগারের এ'সংক্রান্ত লেখা পড়েছি। তবে এই পড়া আমার কাছে যতোটা না ছিল ব্লগের লেখা, তার চেয়েও বেশী ছিল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর আর্টিকেল জাতীয় কিছু একটা। আর এসবই ছিল ইংরেজীতে। বাংলায় যে ব্লগ আছে, আর তাতেও যে এমন বিভিন্ন ধরনের লেখা হয়, তাই জানতাম না তখন।
২০১৩ সালে কিছু দুর্বৃত্তের হাতে ব্লগার থাবা বাবা ওরফে রাজীব হায়দার নিহত হয়। দেশব্যাপী ব্লগ এবং ব্লগার শব্দদু'টো বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে। আমিও একটু কৌতুহলী হলাম, একটা মানুষ কি এমন লিখলো যে তাকে এভাবে অকালে প্রান হারাতে হলো? রাজীব হায়দার আরও কয়েকটা ব্লগের সাথে সাথে সামু'তেও লিখতো। পড়লাম ওর কিছু লেখা, পড়ে দেশের অন্য অনেকের মতো ব্লগ এবং ব্লগার সম্পর্কে আমারও বিরুপ ধারনা হলো। আরেকটা জিনিসও তখন আমার পছন্দ হয়নি। সেটা হলো, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্লগটার নাম সামহোয়্যার ইন!! বাংলা ব্লগের ইংরেজি নাম! হলি কাউ!! ব্লগ সম্পর্কিত কিউরিওসিটির ওখানেই সমাপ্তি ঘটে।
এরপরে ২০১৫ সালের দিকে বেশ কিছুদিন দৈনিক ইত্তেফাকের অনলাইন ভার্সান পড়তাম। তখন হোমপেইজের একপাশে সামু'র আলোচিত পোষ্টগুলির শিরোনাম লিঙ্কসহ থাকতো। কোন শিরোনাম পছন্দ হলে পড়তাম। পড়তে পড়তে কিছু কিছু ক্যাচালও নজরে পড়তো। মজাই লাগতো। এভাবেই অতিথি পাঠক হিসাবে সামু'তে মোটামুটি নিয়মিত হয়ে গেলাম। আরো পরে একপর্যায়ে ভাবলাম, টুকটাক ছাইপাশ লেখালেখির অভ্যাস যেহেতু আমারও আছে…….রেজিষ্ট্রেশানটা করেই ফেলি। ২০১৬ এর মাঝামাঝি কোন এক সময়ে করে ফেললাম (আর সেই শুভক্ষণেই জন্ম হলো ভুয়া মফিজ এর) এবং ভুলে গেলাম। আরো প্রায় বছরখানেক পর হঠাৎ একদিন মনে হলো, আরে! আমি না সামু'তে যুক্ত হয়েছি? বেশী চিন্তা-ভাবনা না করেই একটা লেখা পোষ্ট করলাম। তখন রেজিস্ট্রেশানের পর কিছুদিন অবজার্ভেশানে থাকা, সেইফ হয়ে প্রথম পাতায় এক্সেস পাওয়া এসবের কিছুই জানতাম না। আমার প্রথম লেখা এমনিতেই প্রথম পাতায় এসেছিল। সম্ভবতঃ মডারেটর মহোদয় আমার কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েই আমাকে প্রথম পাতায় সরাসরি এক্সেস দিয়ে দেন!!
সামু'তে আমার প্রথম লেখা পোষ্ট করেছিলাম ৩রা জুন ২০১৭ তে বিলাতের খুচরা অভিজ্ঞতা: নদী দর্শন। ওই লেখাতেই প্রথম মন্তব্যকারী ছিলেন দ্যা ফয়েজ ভাই এবং প্রথম লাইক প্রদানকারী ছিলেন নিহাল নাফিস। দু'জনের একজনকেও বহুদিন ব্লগে দেখি না। প্রথম উৎসাহ প্রদানের জন্য এই দু'জনের প্রতিই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সেই লেখায় আরো মন্তব্য করেছিলেন ব্লগার সুমন কর এবং শোভন শামস। একইসঙ্গে পরবর্তীতে আমার সব ভুয়া লেখায় যারা বিভিন্ন সময়ে একইভাবে আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন, আরো লিখতে…….বরং বলা যায়, আরো ভালোভাবে লিখতে অনুপ্রাণীত করেছেন, সবার প্রতিই আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।
প্রথমে ভেবেছিলাম, সামু'তে আমার এক বছর পূর্তিতে কিছু একটা লিখবো। দুর্মুখেরা বলে, অলসরা নাকি তাদের সময়ের কাজ সময়ে না করার সপক্ষে অনেক যুক্তি দাড় করায়। এক বছর হয়ে যাওয়ার পর আমিও যুক্তি দাড় করালাম, অফিসিয়ালী আমার এক বছর হলেও আসলে আমি তো একবছর ধরে এক্টিভ না। রেজিস্ট্রেশানের পর প্রথম লেখাই দিয়েছি অনেক পরে। তাই ঠিক করলাম, পোষ্টের হাফ সেন্চুরী হোক, তখন দিব। এরপরে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম, তিন বছর হোক, তখন মাস্ট। আগের জন্মের কুমীর বংশের সদস্য বা ক্রোকোডাইল ম্যান হিসাবে আমার পারফর্মেন্স ধরে রাখার অংশ হিসাবে সেটাও ফেল মারলো। অগত্যা শেষমেষ ঠিক করলাম শততম পোষ্টটাই হবে আমার সেই কাঙ্খিত পোষ্ট। যাক, এবার হোলো; সো হিয়ার ইট ইজ!!!
সামু বলছে, আমি সামু'তে ৩ বছর ৯ মাস পার করেছি, আর আমার প্রথম পোষ্টকে যদি শুরু হিসাবে দেখি (আসলে আমার মতে ওটাই শুরু। কুমীর পর্বকে তো গণায় ধরা যায় না!), তাহলে আমি পার করেছি আনুমানিক ২ বছর ৯ মাস। সে যাই হোক, মেঘে মেঘে বেলা অনেক হলো। আশা আছে, এখানেই থামবো না। পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার আগ পর্যন্ত যতোদিন আঙ্গুল চলবে, যতোদিন মনের চিন্তা-ভাবনাগুলো গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারবো, ততদিন ব্লগিংটা চালিয়ে যাবো। বাকীটা উপরওয়ালার ইচ্ছা। হ্যা, সেই সাথে প্রিয় এই প্ল্যাটফর্মের সারভাইভালটাও জরুরী। না হলে লিখবো কোথায়?
কালের পরিক্রমায় এই সময়টা হয়তো অতি তুচ্ছ, তবে আমার জন্য এটা অনেক লম্বা সময়। পেশাগত ব্যাপার ছাড়া এতো দীর্ঘ সময় সক্রিয়ভাবে আমি কোনদিন কোন কিছুতে ধৈর্য্য ধরে লেগে থাকিনি, কারন ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন পুরাই অস্থির প্রকৃতির মানুষ। এন্ড এই 'ধৈর্য্য ধরে লেগে থাকা' রিমাইন্ডস মি, এই ধৈর্য্য আমি পেয়েছি ব্লগিং করতে করতে। তারপরেও ক্যাচালে পড়ে ধৈর্য্যহারা হয়েছি কখনও কখনও। পরে আবার নিজে নিজেই লজ্জিত হয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে ক্যাচালে না জড়ানোর। সেজন্যে অনেক সময়ে অনেককিছু বলার থাকলেও বলি না, এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। হ্যা, আরেকটা কথা না বললেই না; ব্লগিং করতে করতে টাইম টু টাইম বেশকিছু অসাধারন মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি। খুব ইচ্ছা করে, এই প্রিয় মানুষগুলার সাথে বসে চা খাই; ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলি। সুখ-দুঃখের আলাপ করি। কিন্তু হয়ে ওঠে না, ভৌগলিক দুরত্ব আর এ্যনোনিমাস ব্লগিংয়ের প্রতি আমার তীব্র আকর্ষণের কারনে। হয়তো একদিন হবে, হয়তো না। সময়ই বলে দিবে।
বেশ কিছুদিন ধরে একটা কথা ভাবছি। 'বলবো কি বলবো না' দোনোমোনো অবস্থায় আছি। আজ বলেই ফেলি বরং। আপনারা কেউ যদি কখনও লক্ষ্য করেন যে, টানা তিনমাসের উপরে আমি ব্লগে অনুপস্থিত, তাহলে ধরে নিবেন আমি আর আপনাদের মাঝে, এই জগতে নাই। চির বিদায় নিয়ে নিয়েছি। সেক্ষেত্রে আপনাদের কাছে আমার জন্য দোয়ার দাবী জানিয়ে রাখলাম। আমার জন্য দোয়া করবেন; যেখানেই থাকি, যে অবস্থাতেই থাকি, মহান আল্লাহ যেন আমাকে ভালো রাখেন। যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে রবি ঠাকুরের এই গানটা আজ কেন জানি খুব মাথায় ঘুরছে।
রবি ঠাকুর একসময়ে গেয়েছিলেন, আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ। আমি তো গাইতে পারি না, যদিও বা মনের ভুলে বেসুরো গলায় কখনও গাই; সচকিত হয়ে ভাবি, আশেপাশে কাক থাকলে নিশ্চিতভাবেই আমার সাথে সঙ্গ দিতে ঝাপ দিয়ে পড়তো। একটাই বাচোয়া, তা হলো এখানে পাতিকাক একেবারেই নাই, আর দাড়কাক মাঝে-মধ্যে দেখা গেলেও অতি দুর্লভ বস্তু! তাই মনে সাহস নিয়ে, ওনার একটা শব্দ বদলে দিয়ে গাইলাম……..আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ!
ছবিঃ গুগলমামার সৌজন্যে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০২০ রাত ১:৩৫