প্রচন্ড রকমের মন এবং মেজাজ দু'টাই খারাপ করে বসার ঘরে এসে টিভি খুলে বসলো মুহিব। এই মূহুর্তে টিভি দেখার মতো মন বা মানসিকতা কোনোটাই নেই মুহিবের। কিন্তু বিক্ষিপ্ত মনকে ডাইভার্ট করার জন্য এর চেয়ে ভালো আর কোন উপায় ওর মাথায় আসে নাই। একটু আগে রুপার সাথে তুমুল ঝগড়া করেছে ও। রুপা ওর স্ত্রী। আট বছরের দাম্পত্য জীবন ওদের। এই আট বছরে রুপার সাথে এই লেভেলের ঝগড়া ও কোনদিন করেছে বলে মনে পড়ে না। বউকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে ও। তাহলে কি এমন ঘটনা ঘটলো?
ঘটনা হলো, ওরা নিঃসন্তান। যদিও মুহিব এটাকে তেমন কোন সমস্যা বলে মনে করে না। পৃথিবীতে কতো লাখো দম্পতিরই তো বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি। তাই বলে কি জীবন থেমে থেকেছে কারো? তবে রুপা এসব উচ্চ শ্রেনীর দার্শনিক কথা মানতে নারাজ। ওর কথা হলো, যে কোনও উপায়ে হোক, ওর একটা বাচ্চা চাই।
বিয়ের প্রথম দুই বছর বলতে গেলে চোখের পলকে চলে গিয়েছিল। প্রেমের বিয়ে ওদের। বিয়ের আগে বিবাহ-পরবর্তী যা যা পরিকল্পনা ওরা দু‘জনে মিলে করেছিল তার সবকিছুর বাস্তবায়নও হচ্ছিল ধীরে ধীরে। বিয়ের দু‘বছর যেতে না যেতেই দু'পক্ষের বাবা-মায়েরাই আকারে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করেছে, এভাবে উড়াধুরা জীবন আর কতোদিন? এবার বাপু তোমরা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে একটু থিতু হও। এভাবে চলে আরো বছর তিনেক। পাচ বছর পার হওয়ার পরে শুরু হয় আত্মীয়-স্বজনদের তরফ থেকে উপদেশ আর দিক-নির্দেশনামূলক কথাবার্তা। ওরা তো আর মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারে না, আরে আমরা তো চেষ্টা করছি……..আমাদেরকে সময় দিতে হবে না? তাছাড়া বাচ্চা-কাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্তটা তো বাবা-মায়ের উপরই বর্তায়, তোমরা এতো মাথা ঘামাচ্ছো কেন! আকারে ইঙ্গিতে বলেছেও এসব কথা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! লোকজনের কথায় অতীষ্ঠ হয়ে শুরু হলো ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সমস্যার সমাধান না করলে ওদের অসামাজিক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও গতান্তর থাকবে না। এই টেস্ট, সেই টেস্ট…..ওমুক ডাক্তার তমুক ডাক্তার! গত তিনটা বছর ধরে এসব করতে করতে মুহিবের জীবন মোটামুটি কাহিল! সারাদিন অফিস, ডাক্তার আর ডায়াগোনোস্টিক সেন্টারে চক্কর কাটে, শেষে রাতে বাসায় এসে পাড়ার নেড়ি কুত্তাগুলোর মতো আধহাত জিহ্বা বের করে হাপায় আর ভাবে, বিয়ে করে এ কি সমস্যায় পড়লো!! মোটামুটি বেতনের একটা চাকুরী করে ও। স্বচ্ছন্দে জীবন চালানোর জন্য যথেষ্টই বলা যায়। কিন্তু ডাক্তার আর ডায়াগোনোস্টিক সেন্টারগুলোর চক্কর কাটতে কাটতে ওর সন্চয় যা ছিল তাতো শেষই, উল্টা বন্ধু আর আত্মীয়মহলে বেশকিছু ধার দেনাও হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে।
সব ডাক্তার একই কথা বলে…….আপনাদের তো দেখি সবই স্বাভাবিক, তাহলে কনসিভ হচ্ছে না কেন বুঝতে পারছি না! শেষে খরচের কথা না ভেবে দেশের অন্যতম বিশিষ্ট গাইনোকলজিস্ট ডা. টি. এ চৌধুরীকেও দেখিয়েছে। সব দেখেশুনে ডা. চৌধুরী মুহিবকে বললেন, মুহিব সাহেব, আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনও সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করেনি। আপনাদের সবই স্বাভাবিক। কিন্তু কোন এক অজানা কারনে আপনার স্ত্রীর ফার্টিলাইজড এগ ইউটেরাসের দেয়ালে ইম্প্ল্যান্টেড হচ্ছে না। আমি আপনাকে বলবো, আপনারা চেষ্টা করতে করুন। এ'ধরনের সমস্যাগুলো অনেক সময়ে হঠাৎ নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায়। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
এরপরে আর কোন কথা থাকে না। দুর বিদেশ তো দুরের কথা, কাছের ভারতে গিয়েও চেষ্টা করার সামর্থ্য মুহিবের নাই, যদিও অনেকে সেই পরামর্শও দিয়েছে। রুপার ভারতে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ও জানে মুহিবের সামর্থ্য কতোটুকু। তাই এ'নিয়ে কোন উচ্চবাচ্চ্য করে নাই ও।
গেল সপ্তাহে রুপার এক বান্ধবীর বাচ্চা হয়েছে, দেখতে গিয়েছিল ওরা। সেখানে দুই বান্ধবী গোপনে ফুসুর-ফাসুর করে অনেকক্ষণ কথা বলেছে, মুহিব জানে না কি সেসব কথা। তবে সেখান থেকে ফেরার পর থেকেই রুপা কি যেন চিন্তা করে সব সময়। কোন একটা কথা জিজ্ঞেস করলে সাথে সাথে উত্তর পাওয়া যায় না। বোঝাই যায়, ওর মাথায় অন্যকিছু খেলা করছে। শেষে গতকাল রুপা ভয়ে ভয়ে মুহিবকে জানিয়েছে ওর ইচ্ছার কথা।
রুপার বান্ধবী লাবনীদেরও একই সমস্যা ছিল। বাচ্চা হচ্ছিল না। শেষে কামরাঙ্গীর চরের কোন এক ফকীর বাবার দরবারে ধর্ণা দেওয়ার কিছুদিন পরেই লাবনী কনসিভ করে। লাবনীর কথা অনুযায়ী খুবই কামেল সেই বাবা। এই বাবার কাছ থেকে যদি ঠিকভাবে দোয়া নিয়ে আসা যায়, তাহলে বাচ্চা হবেই, এটা পরীক্ষিত। লাবনী রুপাকে ওখানে একবার গিয়ে শেষ চেষ্টা করার পরামর্শ দিয়েছে। শুনেই মুহিবের মেজাজ টং হয়ে যায়। রীতিমতো বকাবকি শুরু করে দেয় রুপাকে। রুপাও জানতো, মুহিব এসব পীর-ফকিরের কথা শুনলেই ক্ষেপে যাবে। তাই ক'দিন ধরেই চিন্তা করছিল, কিভাবে মুহিবকে বিষয়টা ভেঙ্গে বলা যায়! এই নিয়েই ঝগড়ার একপর্যায়ে আজ মুহিব রুপাকে চড় মেরে বসে; তারপরে রুপাকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া অবস্থায় রেখে বসার ঘরে টিভি খুলে বসে।
বসে বসে দীর্ঘসময় আকাশ-পাতাল চিন্তা করলো মুহিব। রুপার গায়ে হাত তোলার কথা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবে নাই ও। আজ কি হয়ে গেল? অনুশোচনা আর অনুতাপে নিজের উপরেই চরম অভক্তি চলে এলো ওর। এখন তো রুপার সামনে যেতেও লজ্জা করবে! অনেকক্ষণ ধরে ও বসে আছে বসার ঘরে। রুপারও কোন সাড়া-শব্দ নাই। কোন শব্দ না করে আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে বেডরুমে উকি দিল। লাইট অফ না করেই এলোমেলো বিদ্ধস্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে রুপা।
চড় মারার পর থেকে মনটাও ওর অনেকটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছে। ভাবলো, সব পীর-ফকীরই যে ভুয়া এমন তো কোন কথা নাই। কারো কারো অলৌকিক ক্ষমতা থাকতেও তো পারে! লাবনীদের সব কথাই ও জানে। ওদের অবস্থাও তো একই রকমের ছিল। শেষ পর্যন্ত তো ওরাও সন্তানের মুখ দেখলো।অনেক চিন্তা-ভাবনা করে মুহিব সিদ্ধান্ত নিলো, ও আর বাধা দিবে না। রুপা যদি যেতে চায় যাক, তবে ওকে একা ছাড়া যাবে না। লাবনী যেহেতু আগে সেখানে গিয়েছে……...ও যদি সাথে যায়, তাহলেই শুধুমাত্র রুপাকে যেতে দিবে।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
বছর দেড়েক পরের কথা।
গত তিন মাস ধরে রুপা মুহিবকে যেন ঠিকমতো চিনেই না। সারাদিন বাচ্চা নিয়ে পড়ে থাকে। হ্যা, তিন মাস বয়স হলো ওদের ছেলের। পৃথিবীর সবটুকু সুখ যেন ওদের এই ছোট্ট ফ্ল্যাটটাতে এসে আটকা পড়েছে!
পুরো ব্যাপারটা মুহিবের এখনও স্বপ্নের মতো মনে হয়। মাঝে মাঝে বিশ্বাসই হতে চায় না, ওর কপালেও এতো সুখ লেখা ছিল! বেশ কিছুদিন ধরেই ও ভাবছে, যার দোয়ায় আজ ওদের সংসার পূর্ণতা পেয়েছে, তার কাছে মিষ্টি নিয়ে গিয়ে সুসংবাদটা দিয়ে আসা উচিত। রুপাকে একবার বলাতে ও ব্যাপারটাকে এমনভাবে উড়িয়ে দিয়েছে, যেন ওই ফকীরবাবার কোন অস্তিত্বই নাই এই দুনিয়ায়। তবে রুপার মতো তো ও এতোটা কান্ডজ্ঞানহীন হতে পারে না! তাই জরুরী কাজের কথা বলে অফিস থেকে আধাবেলা ছুটি নিয়ে একদিন চলে গেল কামরাঙ্গীর চরে ফকীর বাবার আস্তানায়। ঠিকানা জানাই ছিল, তবে যাওয়া হয়নি কখনও, ফলে বাবার দর্শনলাভও হয়নি।
আস্তানায় দর্শনার্থীদের বেশ ভিড়। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মুহিবের ডাক পড়লো। যেই রুমে ঢুকলো, ছোট্ট সেই রুম পুরোটাই কার্পেটে মোড়ানো, কোন আসবাবপত্রই নাই। মাঝামাঝি দু‘টা তাকিয়ায় ভর দিয়ে বাবা হাসি হাসি মুখ করে বসে আছেন। আরো দু‘জনের সাথে কথা বলতে বলতে ইশারায় মুহিবকে বসতে বললেন। আগে কোনদিন দেখা হয় নাই, তারপরেও বাবার চেহারাটা মুহিবের কেমন যেন চেনা চেনা লাগলো; বিশেষ করে চোখ থেকে কপালের গড়নটা। কথা বলতে বলতেই ডানদিকের দরজার দিকে মুখ করে কোন একজনকে ডাকলেন। তখনই মুহিবের চোখে পড়লো বাবার কপালের বাম ভ্রু'র ঠিক উপরে খয়েরী রংয়ের একটা জড়ুল।
বিদ্যুৎ-চমকের মতো মুহিবের মনের পর্দায় ছেলের চেহারাটা ভেসে উঠলো। ওদের বাবুটারওতো বাম ভ্রু'র ঠিক উপরে এমনি একটা জড়ুল আছে না!!!!
মোটামুটিভাবে ডায়ালগবিহীন একটা গল্প লেখার আগ্রহ ছিল। তাই এটা লিখে ফেললাম। কমেন্ট করার সময় সুপ্রিয় ব্লগারগন আমার এই এক্সপেরিমেন্টটার সফলতা কিংবা ব্যর্থতা নিয়েও যদি কিছু বলেন…...বড়ই কৃতার্থ হবো!!!
ছবিটা যথারীতি গুগল থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:০৯