স্কটল্যান্ড থেকে বেড়াতে আসা আমার এক মামাকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটলো কয়েকটা দিন। আমার আপন মামা না, বাল্যকালের এক বন্ধুর মামা; সেই সুবাদে আমারও মামা। তবে আপন মামার চেয়ে কম কিছু না। খুব অল্পবয়সে প্রবাসী হয়েছিলেন। দেশে থাকতে পাশাপাশি বাসা হওয়ার কারনে বন্ধুর কল্যানে উনার আনা বিদেশী চকলেট প্রচুর খেয়েছি একটা সময়ে; তখন থেকেই সখ্যতা মামার সাথে। বেশ কিছুদিন আগে স্কটল্যান্ড গিয়েছিলাম উনার মেয়ের বিয়েতে। ফিরতি মেহমানদারীর অমন্ত্রণ দিয়েছিলাম তখনই। উনিও আশ্বাস দিয়েছিলেন, আসবেন। মামা দেশের খবর বেশ ভালই রাখেন। একদিন আলাপের সময় জানালেন এই চলমান মহামারীতে দেশের বেসরকারী প্রাথমিক শিক্ষকদের দুরবস্থার কথা। বিষয়টা মাথায় ছিল। মামা বিদায় নেয়ার পর নেট ঘাটাঘাটি করলাম। বেরিয়ে এলো এক ভয়াবহ চিত্র। ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়া হয়ে যাচ্ছে। মূল প্রসঙ্গে চলে আসি বরং।
ছোটবেলায় ভাবসম্প্রসারন করতাম, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হতো, শিক্ষা কেন একটা জাতির মেরুদন্ড। একটা দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদেরকে ধরা হয় সেই মেরুদন্ড শক্ত করার প্রথম সারির কারিগর হিসাবে, কারন শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বুনিয়াদ তথা মেরুদন্ড শক্ত করার প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করতে হয় উনাদেরকেই। এই শক্তকরন প্রক্রিয়া ঠিকমতো না হলে জাতির কি দূর্গতি হতে পারে সেটা বিতং করে বলার কিছু নাই। যে কোনও প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ব্যক্তি খুব ভালোভাবেই জানেন। এখন এই শিক্ষকদের নিজেদের মেরুদন্ডই যদি অশক্ত হয়, তাহলে উনারা অন্যের মেরুদন্ড শক্ত করার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন, এটা আশা করা বাতুলতা, নয় কি?
প্রায় দু'বছর হতে চললো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। কারন, আশ্চর্যজনকভাবে করোনা ভাইরাসের ঘাটি মূলতঃ আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই বিদ্যমান। তাই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এই দুষ্ট ভাইরাস থেকে রক্ষার মহান দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজেদের কাধে তুলে নিয়েছেন। বেসরকারী প্রাথমিক শিক্ষকবৃন্দ এই দু'বছর কিভাবে চলছেন তা সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা না ভেবেছেন, না কিছু করেছেন। আমাদের বর্তমান মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যথাযথ শিক্ষা দিয়ে এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ধরেছেন। সম্ভবতঃ এ'বছরও অটোপাশের সক্রিয় চিন্তা-ভাবনা উনার বিবেচনাধীন। এক মনি তার কর্মতৎপরতায় কিছুদিন আগে আকাশ-পাতাল এক করে ফেলেছিলেন প্রায়, আরেক মনি দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থার আকাশ এবং পাতাল এক করার কাজ আরো আগেই সফলভাবে সেরে ফেলেছেন। জাতির এই দুই চোখের মনি'র এহেন কর্মকান্ডে এই হতভাগা জাতি আজ মোটামুটিভাবে দিশেহারা অবস্থায় নিপাতিত।
আপনারা দেশে যারা আছেন, নিশ্চয়ই এই বেসরকারী শিক্ষকদের বর্তমান মানবেতর জীবন-যাপনের বিস্তারিত জানেন। আমি তাতে কিছু যৎসামান্য যোগ করি; আশা করছি এতে করে সার্বিক চিত্র পর্যালোচনা করতে সুবিধা হবে। এই শিক্ষকরা না পারছেন ঠিকমতো খেতে, আর না পারছেন বাড়িভাড়া দিতে। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, জীবনধারনের মৌলিক চাহিদাগুলোই উনারা পূরণ করতে পারছেন না। তাই পেশা বদল করে কেউ হয়েছেন হকার, কেউ দিন-মজুর, কেউ চা-ওয়ালা, আর কেউ বা খেলনা বিক্রেতা। তাদের এই জীবনযুদ্ধ কেমন? দেখুন এই ভিডিও ক্লিপটাতে। দেখেছেন? খোদ রাজধানীতেই দু'জন প্রধান শিক্ষক/শিক্ষিকার জীবন সংগ্রাম যদি এমন হয় তাহলে দুর-দুরান্তের মফস্বল শহর আর গ্রামের স্কুলের শিক্ষকদের কি অবস্থা? সেটাও একটু দেখেন এখানে। আমাদের সরকারের লোকজন কি কিছুটা লজ্জা পাচ্ছেন? না, এতোটা উচ্চাশা আমি অবশ্য পোষণ করি না। আমি নিশ্চিত, উনাদেরকে জিজ্ঞেস করলে উনারা বলবেন, ''লজ্জা? সেটা আবার কি জিনিস?? খায় নাকি পিন্দে''???
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে (কবে হবে আল্লাহ মালুম!!) এই শিক্ষকগণ যখন তাদের পুরানো পেশায় ফিরবেন, উনারা হয়তো উনাদের পেশা ফেরত পাবেন, কিন্তু হারানো সন্মান কি ফিরে পাবেন? এমনিতেই বর্তমানে আমরা শিক্ষকদেরকে যথাযথ সন্মান দিতে কার্পন্য বোধ করি। তার উপরে ক'দিন আগের পুরানো কার্যকারন ভুলে গিয়ে সমাজ কি তাদের দিকে আঙ্গুল তুলবে না…….আরে তুমি তো দুইদিন আগে চা বেচছো, রিকসা চালাইছো, দোকানদারি বা দিনমজুরী করছো, তুমি আবার বাচ্চা-কাচ্চাদেরকে কি শিখাইবা! কেউ কি বলবে না….আরে উনি তো ''স্যার'' হওয়ারই যোগ্যতা রাখেন না!! সেই হারানো সন্মান ফিরে পাবার নিশ্চয়তা কি আছে? মাস গেলে উনারা বেতনের টাকা পাবেন ঠিকই, কিন্তু শিক্ষক হিসাবে যেই সন্মান, শিক্ষাদানের যেই উৎসাহ আর উদ্দীপনা, সেটা কি ফিরে আসবে? রাষ্ট্রের দায়িত্ব রাষ্ট্র পালন করবে না, কিন্তু শিক্ষকের দায়িত্ব শিক্ষক পালন করবেন…..এটা আশা করা কতোটা সঠিক!!!
এতো গেল শিক্ষকদের কথা। শিক্ষার্থীদের কি অবস্থা? গ্রাম বা মফস্বলের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ নিয়োজিত হয়েছে শিশুশ্রমের মতো কাজে। এদের বেশীরভাগই ঝরে পড়বে বলাই বাহুল্য; শিক্ষাজীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা এদের নাই বললেই চলে। বড় বড় শহরের শিশু-কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে গ্যাং কালচারের সাথে। রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে পথ-চলতি মেয়েদের সাথে ফস্টিনস্টি করা আর মোটরবাইক নিয়ে শো-অফ করা এদের নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। জড়িয়ে পড়ছে মাদক সেবন, বেচাকেনার সাথে; অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে। আর বাকী অংশের দৈনন্দিন রুটিন হলো টিভি দেখা আর ভিডিও গেইম খেলা। হ্যা.….অল্প কিছু অভিজাত স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা অনলাইন পড়াশোনাতে ব্যস্ত ঠিকই, তবে এটাকে যদি আপনি দেশের সার্বিক চিত্রের প্রতিফলন বলে মনে করেন, তাহলে বলবো এসব কুপমন্ডুকতা ছাড়েন। 'চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া বাহির হইয়া' দেখেন। এতে করে আশা করা যায়, কিছু বাস্তব চিত্র চক্ষু-সম্মুখে ধরা পড়বে!!!
ডয়চে ভেলের একটা রিপোর্ট পড়লাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩১ কোটি টাকার বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দ ১১ কোটি টাকা। আশ্চর্য হলাম! টাকা কি তেজপাতা? ১১ কোটি টাকা জলে ফেলে দেয়ার মানে কি? অর্থ সম্পদের কি নিদারুন অপচয়! এই টাকাটা বরং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে একটা মার্কেট বা আন্তর্জাতিক মানের রেস্টুরেন্ট তৈরীতে বিনিয়োগ করা উচিত। তবে হ্যা…...এটা জাতীয় বাজেটের একটা প্রকৃত প্রতিফলন বটে! আমাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের দৈন্যতা নিয়ে অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পোষ্টে বলেছি। বারে বারে এক জিনিস নিয়ে কথা বলতে উৎসাহ পাই না। বরং অন্য একটা কথা বলি। বলা হচ্ছে, ২২ হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেল প্রকল্প ঢাকার যানজট উল্লেখযোগ্যভাবে কমাবে। এখন আবার প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে পাতাল রেলের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। যদিও ঢাকার যানজটের আসল সমস্যার সমাধান না করে এসব প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদে কতোটা সুফল বয়ে আনবে, সেই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তবে এতে একটা কথা প্রমানীত যে, আমাদের সরকারের হাতে অঢেল টাকা রয়েছে। তাহলে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের এই দৈন্যদশা কেন? শিক্ষকদের এই দূর্গতি কেন? এর একটা খন্ডিতাংশ পরিমানও যদি শিক্ষাখাতে ব্যয় হয়, তাহলে দেশের চেহারাই পাল্টে যাবে; বাহ্যিক না হলেও আত্মীকভাবে তো বটেই! আর সেটার সুফল যে কতোটা সুদূরপ্রসারী হবে, সেটা কি সরকার বুঝতে পারছে না? ''জাতির মেরুদন্ড'' আর তার কারিগরদের মেরুদন্ড নিয়ে কাজ করতে সমস্যাটা কোথায়??
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে সন্মানীত সাধারন এবং একটা বিশেষ দলীয় আনুগত্য প্রদর্শনকারী ব্লগারদের কাছে আমার প্রশ্ন, এই দুই বছরে জাতির মেরুদন্ড কতোটা শক্ত হয়েছে বলে আপনারা মনে করেন? আর তার কারিগর শিক্ষকদের কতোটা অশক্ত??
আমার প্রিয় একজন ব্লগার হাসান কালবৈশাখী। প্রখর যুক্তিবাদী মানুষ। সময়ে সময়ে উনার যুক্তিগুলো এতোই কঠিন হয় যে, আমার মতো কম জানা মানুষের পক্ষে সেগুলো খন্ডন করা দুঃসাধ্য বিষয় হয়ে দাড়ায়। কয়েকদিন আগে উনি একটা পোষ্ট দিয়েছিলেন, ''দেশে শিক্ষিত বেয়াদব ধান্দাবাজ লোকের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে'' শিরোনামে। দেশে এই শ্রেণীর লোকের সংখ্যা বাড়ার পিছনে মূল কারনটার উপরে যদি উনি কিন্চিৎ আলোকপাত করতেন, তাহলে অনেক কিছুই আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে যেতো। জাতির মেরুদন্ড অশক্ত হলে এই জাতীয় বাই প্রোডাক্ট অবশ্যম্ভাবী কিনা, সেটাও জানা যেতো। উনার কাছ থেকে এমন একটা পোষ্ট আমরা দাবী করতেই পারি!!!
১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর চুড়ান্তভাবে পরাজিত হওয়ার প্রাক্কালে পাক হানাদার বাহিনী আর তাদের এ'দেশীয় দোসররা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এই দেশের ''মেরুদন্ড'' ভেঙ্গে দেয়ার ব্যবস্থা করে। সেই অপূরনীয় ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যে কোনও জাতির জন্যই একটা দূরুহ ব্যাপার। সেই ভাঙ্গা মেরুদন্ড গত পঞ্চাশ বছরে কতোটা মেরামত করা গিয়েছে সেটা একটা বড় প্রশ্ন বটে! পাকীরা এটা করেছিল সচেতনভাবে। আমাদের সরকারগুলো অবচেতনভাবে কি ঠিক সেটাই করছে না, বিশেষ করে বর্তমান সরকার!! সেই সময়ে যাদেরকে আমরা হারিয়েছি, তার সমপর্যায়ের বা কাছাকাছি পর্যায়ের কয়জনকে পরবর্তীতে গড়ে তোলা গিয়েছে, সেটা ভেবে দেখার সময় মনে হয় এসেছে।
প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয় বিবেক সৃষ্টি করতে না পারলে তার পরিনতি হয় ভয়াবহ। সেই ভয়াবহতা আমরা ইতোমধ্যেই আচ করতে শুরু করেছি। দূর্বল বা অশক্ত মেরুদন্ড ভবিষ্যতে কেবল পঙ্গুত্বই ডেকে আনতে পারে। আমাদের ভবিষ্যত কিন্তু আমার কাছে ভালো ঠেকছে না একেবারেই।
আপনাদের কি মনে হয়???
ফটোঃ প্রধান শিক্ষক এখন দোকানদার। নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কমের সৌজন্যে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০২১ বিকাল ৩:৩৯