আমার এই পোষ্টটা মূলতঃ একটা ছবি ব্লগ।
তবে ছবিগুলোতে যাওয়ার আগে এই পোষ্টের উদ্ভব কোথা থেকে হলো, সেই ব্যাপারে কিছু কথা বলে নেই। বিগত দিনগুলোতে আমি বেশ কিছু সময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম। খাই, দাই, অফিসে যাই…….দৈনন্দিন কাজ-কর্ম সবই করি; কিন্তু কোথায় যেন একটা ছন্দপতন ছিল। জীবনের সুরটা কেটে গিয়েছিল যেন। কোন কাজেই উৎসাহ পাচ্ছিলাম না, করতে হবে তাই করছিলাম। আমি যে আমার সহজাত স্বাভাবিকতাতে নাই…….এটা পারিবারিকভাবে, কর্মক্ষেত্রে, বন্ধুমহলে সবখানেই ক্রমাগত শুনতে হয়েছে। বিষয়টা যে আমিও অনুভব করি নাই, তা না; তবে আমার করার কিছুই ছিল না। সেটা ছিল আমার ''বিয়ন্ড মাই কন্ট্রোল'' অধ্যায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমরা শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি হলেও উনি আমাদেরকে কিছু সীমাবদ্ধতা দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সেটা বেশ উপলব্ধি করেছি তখন। ইনফ্যাক্ট, এখনও করি।
সে যাই হোক, একদিন সকালে আমার সুযোগ্য সহধর্মিণী আমাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে জানালো যে, সে সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কথা বলে একটা এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে। আমি যেন যাই। তো, গেলাম। এর আগেও ভিন্নকারনে কয়েকটা সেশান নেয়াতে এই ব্যাটা আমার মোটামুটিভাবে পরিচিত। তার সাথে কথোপকথনটা সংক্ষেপে তুলে দিলাম। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বুড়োটা লাফিয়ে উঠলো,
- হ্যালো ইয়াংম্যান! আসো আসো…..তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম!
- আমার সৌভাগ্য! তবে আমি ইয়াংম্যান না, কাজেই এটা বললে যে আমি খুব খুশী হবো তেমনটা মনে করার কোন কারণ নাই।
- আরে চ্যাত দেখাও ক্যান? ইয়াং-ওল্ড এসব রিলেটিভ টার্ম। আমার কাছে তুমি ইয়াংম্যানই। যাই হোক…..লেটস গেট ডাউন টু দ্য বিজনেস ডাইরেক্টলি। তোমার বউ আমাকে সবই বলেছে। আমার মনে হয়, ভিন্ন একটা পরিবেশে তুমি যদি সপ্তাহ দু'য়েক সময় কাটিয়ে আসো, তাহলে ইউ উইল ফিল মাচ বেটার। এখন চোখ বন্ধ করে ভাবো, কোন জায়গায় তুমি নিজেকে দেখলে সবচাইতে ভালো বোধ করবে?
- অবশ্যই বাংলাদেশে! কিন্তু এই মূহুর্তে সেখানে যাওয়া সম্ভব না। পরিবারের সবাই এই সময় একসাথে যেতে পারবে না। তাছাড়া এই বছরের সব ছুটি আমার ইতোমধ্যেই নেয়া হয়ে গিয়েছে, নতুন বছর শুরু হবে ৬ই এপ্রিল, তার আগে আমি ছুটিও পাবো না।
- ছুটির বিষয়টা তুমি আমার উপরে ছেড়ে দাও। আর সবাইকে নিয়ে যেতে হবে কেন? তুমি একাই যাও। তোমার বউয়ের সাথে আমার কথা হয়েছে। সে তোমাকে একা ছাড়তে রাজি। নিজের মতো করে দুই সপ্তাহ কাটিয়ে আসো। বেস্ট অফ লাক!!!
ডাক্তারকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে এলাম। চোখে রঙ্গীণ স্বপ্ন। আবার দেশে যাবো!!!
প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি, পশ্চিমা বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য, স্ট্রেস, ট্রমা……..এসবকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। সাইকিয়াট্রিস্টের এডভাইজরী নোট কোন প্রতিষ্ঠানই অগ্রাহ্য করে না, করতে পারেও না। বাংলাদেশের যারা এসব দেশে থাকেন, তারা বিষয়টা জানেন (অবশ্য দু'য়েকজন বাদে!!!)।
তো, আর দেরী না করে হাওয়াই জাহাজে চড়ে বসলাম।
যাচ্ছি আমার প্রিয় কাতার এয়ারওয়েজে। এটাতে আমি কিছু সুবিধাও পাই ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লায়ার হিসাবে। সাধারনতঃ প্লেনে আমি ঘুমাতে পারি না। সময় কাটানোর প্রধান মাধ্যম হয় মুভি দেখা। এবার মুভি দেখেও আরাম পাচ্ছিলাম না। আম্মাবিহীন দেশে এই প্রথম যাচ্ছি। মাথায় কতো কথা, কতো স্মৃতি খেলে যাচ্ছিল!! কেমন যেন একটা মিশ্র অনুভূতি! মুভি বাদ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মেঘের খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎ মাথায় একটা আইডিয়া এলো। আকাশে মেঘের চেহারা ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। এগুলোকে ফ্রেমবন্দী করলে কেমন হয়? ব্লগারদের সাথে এই অভিজ্ঞতা তো ভাগাভাগিও করতে পারি! কাজেই শুরু করলাম, ছবি তোলা। যাওয়া-আসার সময়টা কেটেছে দ্রুত এবং চমৎকার।
দুরের দিগন্তে দেখেন, আরেকটা প্লেনের উড়ে যাওয়া!
দোহাতে অবতরণের প্রস্তুতি!
দোহা থেকে আবার যাত্রা শুরু। এবার দেশের পথে!
''ওই দেখা যায় তালগাছ, ওই আমাদের গা'' দেশের সীমানায় ঢুকলাম। এই সময়টাতে আমি সব সময়েই খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। অনেক সময়ে কোন অজানা কারনে চোখে পানিও চলে আসে। দেশের আকাশসীমায় ঢোকার পর থেকে আমি কখনও জানালা থেকে চোখ সরাই না।
ঢাকায় অবতরণের প্রস্তুতি!
এবং অবতরণ!!
দুই সপ্তাহ কেটে গেল চোখের পলকে। ভাই-বোনেরা সবাই দেশে, আবার একত্রিত হলাম। কিছু নতুন অভিজ্ঞতা হলো। সময় করে আপনাদের সাথে শেয়ার করার ইচ্ছা রইলো।
এবার ফেরার পালা। রানওয়েতে বিমান। ফিরতি যাত্রা হলো শুরু।
আপাততঃ শেষবারের মতো ঢাকাকে দেখে নিলাম। আবার কবে ফিরতে পারবো, জানি না।
দোহাতে এসে ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স পেতে একটু দেরী হয়েছিল। তাতে ভালো হলো। কয়েকটা ছবি তুললাম, যেটা স্বাভাবিকভাবে পেতাম না, হয়তো।
উপর থেকে দেখলে সমুদ্র উপকুলের গভীরতা-অগভীরতা সম্পর্কে এই রকমের চিত্র পাওয়া যায়।
পাখির চোখে সমুদ্রে গড়ে তোলা কৃত্রিম দ্বীপ লুসাইল সিটি।
পার্ল কাতারের দু'টা ছবি। এটাও কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা।
অবশেষে দোহায় অবতরণ। নামার সময়ে মনে হয় যেন সমুদ্রে নামছি!
এবার যাত্রা শুরু লন্ডনের উদ্দেশ্যে। মেঘের এই ছবিটা দেখলে মনে হয় না……...তুষারে আবৃত কোন এলাকা?
মেঘের আরো তিনটা রুপ!
দিগন্তে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। আর মেঘের চেহারা পাল্টাচ্ছিল ঘন্টায় ঘন্টায়!!!
এই ছবিটা খুবই ইন্টারেস্টিং। হোভারক্রাফট যেভাবে সমুদ্রের বুক ছুয়ে উড়ে উড়ে যায়, প্লেনটাকেও পাইলট সেভাবেই উড়াচ্ছিল! ঠিক মেঘের উপরিভাগ ছুয়ে ছুয়ে, প্রায় ঘন্টাখানেক!! ছবিতে ততোটা বোঝা যাচ্ছে না সম্ভবতঃ। তবে, আমি সন্দেহাতীতভাবেই খুব রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।
মার্চের মাঝামাঝি দুই সপ্তাহ দেশে ছিলাম। আমার জন্য খুবই দরকার ছিল এই ট্রিপটা; নিজের মনকে, মানসিক অবস্থাকে রিকনসাইল করার জন্য। নিজেকে আবার ফিরে পাচ্ছি। যাদের যাদের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে, তাদের সবাইকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ।
জয় বাংলা!!!
শিরোনামের ছবিটা হিথ্রো, টারমিনাল ফাইভ এর (প্লেনের পেটের ভিতর থেকে তোলা)। সবগুলো ছবির কৃতিত্বই আমার মোবাইল ফোনের।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০২২ দুপুর ১:৫৯