আমি কোন 'আলোড়ন সৃষ্টিকারী' এবং 'ছেলেবিটি' বলগার না, একেবারেই সাদাসিধা নিরীহ একজন ব্লগার। ব্লগে যারা আমাকে চিনেন, তারা আমার এই কথা অবশ্যই মানবেন। ব্লগিং শুরুর আগে আমি ভাবতাম যে আমি অনেক কিছু জানি। কিন্তু হায়, ব্লগে আসার পরে এত্তো এত্তো গেয়ানী-গুনীদের ভীড়ে বুঝতে পারলাম, আমি আসলে কিছুই জানি না। এই না জানার ধারাবাহিকতায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার মনে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়েছে, যেগুলোর উত্তরও জানি না কিংবা খুজে পাচ্ছি না। উত্তরগুলো পেলে কোটা আন্দোলনের অনেক হিসাব-নিকাশ মিলাতে পারতাম।। আমার মনের এই ধোয়াশা ভাব কাটানোর জন্য আশাকরি বিজ্ঞ ব্লগারগণ আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবেন।
আর কথা না বাড়িয়ে চলেন মূল প্রসঙ্গে যাই।
একটা সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করি। মুক্তিযোদ্ধা কে বা কারা? আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বর্তমানে আপনি এই ব্যাপারে কোন সহজ-সরল সংজ্ঞা পাবেন না। আমরা জানি, যারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে, অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে নিজের জীবনকে বাজি রেখেছে, তারাই মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুও ১৯৭২ সালে এমনই একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলেন। ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনের সময় মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল এভাবে, freedom fighter means any person who had served as a member of liberation force engaged in the war of liberation. Dictionary of Britanica-তে মুক্তিযোদ্ধা বা ইংরেজিতে Freedom Fighter-এর অর্থ লেখা রয়েছে এভাবে, a person who is part of an organised group fighting against a cruel and unfair government or system. অর্থাৎ যারা প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তারাই মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পরিগণিত হবেন।
এই সহজ-সরল বিষয়টাকে বিতর্কিত করার জন্যই বর্তমান তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ৬ নভেম্বর ২০১৬ প্রকাশিত গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণ করে। এই সংজ্ঞানুযায়ী পুরানো সংজ্ঞা পরিবর্তন করে মুজিবনগর কর্মচারী, শিল্পী, খেলোয়াড়সহ নানা ক্যাটাগরির সবাইকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গণ্য করার ফরমান জারি করে। সে অনুযায়ী ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ''১৯৭২-এর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন'' যুগোপযোগী আখ্যা দিয়ে জাতীয় সংসদে সংশোধন করা হয়। ২০১৮-এর আইনে বলা হয়েছে, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হইবেন, যথা-(ক) যে সকল ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করিয়া ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাহাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিলেন। (খ) যে সকল বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রাখিয়াছিলেন এবং যে সকল বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্ব জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন। (গ) যাহারা মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। (ঘ) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সহিত সম্পৃক্ত সকল এমএনএ বা এমপিএ, যাহারা পরবর্তীকালে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হইয়াছিলেন। (ঙ) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাহাদের সহযোগী কর্তৃক নির্যাতিতা সকল নারী (বীরাঙ্গনা)। (চ) স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সকল শিল্পী ও কলা-কুশলী এবং দেশ ও দেশের বাহিরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সকল বাংলাদেশি সাংবাদিক। (ছ) স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সকল খেলোয়াড় এবং (জ) মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী মেডিক্যাল টিমের সকল ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা সহকারী।’ মুক্তিযুদ্ধ একটি সামগ্রিক বিষয়। এখানে নানা ধরনের মানুষের নানা রকমের ভুমিকা ছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারও বা কোনো দলের একক প্রচেষ্টায় এ দেশ স্বাধীন হয়নি, এটাও সত্য। কারও ভূমিকাকেই এক্ষেত্রে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তাই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত সবার প্রতি সম্মান রেখেই বলতে চাই-সরকারের এই সংজ্ঞায়ন অবিবেচনাপ্রসূত ও অবৈজ্ঞানিক। সরকার চাইলে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত সবাইকে সম্মানিত করতে ও স্বীকৃতি দিতে পারে। কিন্তু সবাইকে ''মুক্তিযোদ্ধা'' আখ্যায়িত করতে হবে কেন? (যুগান্তর, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় অসংগতি, সায়েদুল ইসলাম মিঠু, ০৭ জুলাই ২০২২)।
আমার প্রশ্ন, তাহলে যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খাবার, তথ্য, আশ্রয় ইত্যাদি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে, তারা কি মুক্তিযোদ্ধা না? যারা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে কিন্তু বিভিন্ন কারনে যুদ্ধ করতে পারে নাই, তারা কি মুক্তিযোদ্ধা না?
এবার আসি, রাজাকার কি বা কারা? আমি যা জানি তা হলো, আমাদের মু্ক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী 'ইস্ট-পাকিস্তানী রাজাকার অরডিন্যান্স' এবং 'মিনিস্ট্রি অফ ডিফেন্স অরডিন্যান্স' এর মাধ্যমে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। অখন্ড পাকিস্তানের সমর্থক বাঙ্গালী আর উর্দুভাষী বিহারীদের নিয়ে এই বাহিনী গঠন করা হয়। রাজাকাররা পাকিস্তানী আর্মীর অংশ ছিল এবং লাইট ইনফ্যান্ট্রি অস্ত্র পেতো। এছাড়া একাত্তরে শান্তি কমিটি, আল-বদর, আল-শামসও গঠন করা হয় পাক-বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য। এদের সবাইকে অন্তর্ভূক্ত করে সাধারনভাবে ''রাজাকার'' শব্দের উৎপত্তি।
আমার প্রশ্ন, রাজাকারের আত্মীয় স্বজন এবং সমর্থকদেরকে কি রাজাকার বলা যায়? আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা সুযোগ না পেলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?' তার মানে রাজাকারের নাতিপুতি তথা আত্মীয়স্বজনরাও পরিত্যাজ্য। তাছাড়া এই ব্লগেই শত শত মন্তব্য পাওয়া যাবে যেগুলোর মূল বক্তব্য হলো, বিএনপি-জামায়াত সমর্থন করা, আর রাজাকার সমর্থন করা সমার্থক। রাজাকারের আত্মীয়স্বজনরাও রাজাকার.........ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার প্রশ্ন, রাজাকার আসলে কারা? তথাকথিত চেতনাবাজরা উত্তর দিতে চাইলে সাবধানে দিবেন কারন এরপরে আমি যা বলতে যাচ্ছি তাতে আপনাদের অসুবিধা হতে পারে!!!!
গত সরকারের ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন দেশের বহুল পরিচিত একজন নেতা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা কি ছিল সেটা সবার জানা। তিনি শান্তি বাহিনী গঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে হানাদার বাহিনীকে প্ররোচিত করতেন। ''দৃশ্যপট একাত্তর: একুশ শতকের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগ'' বইয়ের ৪৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার বেয়াই ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন শান্তি কমিটির জাদরেল নেতা ছিলেন। তার পিতা নুরুল ইসলাম নুরু মিয়া ফরিদপুরের শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন। এই রাজাকার খন্দকার মোশাররফের ছেলে মাশরুর হোসেন মিতুই হলো পুতুলের স্বামী। এই দম্পতির তিন কন্যা এবং এক ছেলে রয়েছে। তো, রাজাকারের এই নাতিপুতিদের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কি? এই চারজন কি সরকারী কোন দায়িত্ব পাওয়ার যোগ্য?
জামায়াত-বিএনপির সমর্থক, রাজাকারের নাতিপুতিদেরকে নিয়ে যাদের এলার্জি আছে, তারাই দেখি এদের সাথে আত্মীয়তা করে। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে। এই ব্লগেও বহু নমুনা পাবেন। সকাল-বিকাল রাজাকার ধরে নাস্তা করা, দিন-রাত লম্বা-চওড়া কথা বলা এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ব্লগার এরকম একজনের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নেয়, বিভিন্ন ছেলেবিটি ব্লগার এবং তাদের খাস সহযোগীবৃন্দ এই ব্লগারের সাথে ঘোরাঘুরি করাসহ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে, ব্লগে মন্তব্যের আদান-প্রদান করে। আহা, কি প্রেম!!! পর্দার অন্তরালে আরো যে কি কি ঘটনা ঘটে তা একমাত্র আল্লাহ মা'বুদই বলতে পারবে।
আমার প্রশ্ন হলো, এই হিপোক্রেসীর উৎস কি? এদের কি লজ্জা করে না? কেন সচেতনভাবে এই ধরনের দ্বি-চারিতা করা হয়?
আমি জানি, ধরা খাওয়ার ভয়ে আমার এই পোষ্টে আওয়ামী চেতনাবাজদের আসার সম্ভাবনা কম। তবে এই চেতনাবাজদের বাইরে যারা আম-ব্লগার আছেন তারা চেতনাবাজদেরকে বাগে পেলেই এই প্রশ্নগুলো করবেন!!!!!!

ছবিসূত্র।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫১