তুরস্কের সাম্প্রতিক সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা বিশ্ব দরবারে আলোড়ন তুলেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে আর তা হলো তার দেশের মানুষের দেশপ্রেম।সোশ্যাল মিডিয়াতে এক বড় ট্রেন্ড ছিল তখন সেই তুর্কি যুবকের আর্মি ট্যাংকের নিচে শুয়ে পরার ছবি-ঐ ছবিই ছিল তুর্কি জনগনের অদম্য সাহসের প্রতীক।তা ছিল তাদের প্রতিরোধের প্রতীক।নীরব থেকেও যেন তারা বলছিল "নিলে জীবন নিয়ে যা,দেশ নিয়ে যেতে দিবো না"।
তাদের এমন যুগান্তকারী সিদ্ধান্তকে স্যালুট,কিন্তু একই সাথে প্রশ্ন জাগে মনে যে তাদের মধ্যে এমন দেশপ্রেম!এ কী হঠাৎ জেগে উঠলো?
উত্তর হচ্ছে "না"।তুরস্কের জনগন এর আগে ঐতিহাসিকভাবে লম্বা সময় ধরে স্বৈরশাসনের অধীনে ছিল।খুব কম করে একশ' বছর আগেও তাদের মূল শাসনকর্তারা সবাই ছিল রাজতন্ত্রী।জনগন তখন নানা দুর্ভোগ সহ্য করেছে।সেই সময়ে তাদের উপায় ছিল খুব সামান্য।তারা মুখ বুজে সহ্য করে গেছে।এরপরেই এলো সেক্যুলার তুরস্কের সময় আর তার সাথে এলেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তাঁর বিখ্যাত "কেমালিজম" নিয়ে।
তাঁর সেই কেমালিজমের মূল বা অন্যতম প্রধাণ চেতনা ছিল ফরাসী লেসিজম(laicism) থেকে,কিন্তু তাঁঁর প্রগতিবাদী চিন্তায় ব্যাপারটা কিছুটা ভিন্ন রূপ নেয়।তাঁর চিন্তাভাবনার ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল দৃষ্টান্তমূলক।তিনি তুরস্ককে খিলাফত নামক ব্যর্থতা এবং ফেইলড শাসন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন,যা আধুনিক গনতান্ত্রিক তুরস্কের মূল।
সেই ১৯২৪ সালেই তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে রাষ্ট্রযন্ত্র আর ধর্ম পৃথক থাকা উচিৎ।তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার মূল মন্ত্র ছিল এটাই যে "ধর্ম হবে ব্যক্তিগত ব্যাপার।রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিতে ধর্মের প্রয়োগ হবে না।"
এখানে রাষ্ট্র পরিচালনা অনেক ব্যাপক অর্থ বহন করে।তাঁর দর্শনে ব্যাপারটা ছিল যে ধর্মীয় ব্যাপারগুলি গণতন্ত্র,রাষ্ট্রযন্ত্র বা বিজ্ঞানের কোন অগ্রগতিকে যেন কোনভাবেই বাধাগ্রস্থ না করতে পারে।তাতে লাভ হয়েছে অনেক।
তুরস্কের বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার অন্যতম কাণ্ডারী তিনি।তাঁর সেই মূলমন্ত্র অনুসরণ করেই তুরস্ক ইউরোপের "ধুঁকতে থাকা বুড়ি" থেকে অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি।সেই ধর্মনিরপেক্ষতা সেই দেশকে বর্হিবিশ্বের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেছিল।
তাঁর সেই সংস্কারের পরে সাম্প্রতিক সময়ের তুরস্ক আবার যেন হয়ে পড়ে "ইসলামিস্টিক" যা আসে তাদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মি.এরদোগানের হাত ধরে।
বর্তমানের তুরস্কের প্রেসিডেন্টের ভাবধারাকে বলা হয় "প্যান-ইসলামিক"।এই অবস্থায় সেখানে প্রধাণ বিরোধী শক্তি হচ্ছে আরেক আদর্শবাদ যা "Gulen movement" নামে বেশি পরিচিত।বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগানও এর অনুসারীই ছিলেন তার জীবনের পূর্ববর্তী সময়গুলোতে।
কথা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ তুর্কি জনগন এই মনোভাবের একজন মানুষকে ভোটের মাধ্যমে কেন বেছে নিল?কারণ তাদের কাছে অন্য কোনও উপায় ছিল না।অন্য সবগুলো বিকল্পই ছিল এর তুলনায় নিকৃষ্ট।তাই,তুর্কি জনগন তাদের সর্বস্ব দিয়ে তাদের পছন্দকে শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছে।
এখানে বিজয়ী হয়েছে গণতন্ত্র।
এই ঘটনা থেকে আমাদের জন্যও শিক্ষনীয় অনেক কিছু আছে।আমাদেরও যতটা সম্ভব ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠতে হবে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে।রাষ্ট্রযন্ত্র থাকবে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত।গণতন্ত্র হবে রাষ্ট্রের মূল কাঠামোর প্রাণভোমরা।আমাদেরও হতে হবে গণতন্ত্রের ধারক এবং বাহক,কারণ গণতন্ত্রেই রয়েছে প্রকৃত স্বাধীনতা তা সে যতটুকুই পাওয়া যাক না কেন!
গণতন্ত্রের যেকোনও দুর্যোগে আমাদেরও এগিয়ে আসতে হবে হাতে হাত মিলিয়ে।
অন্তত আমাদের,বাংলাদেশিদের,"জয় বাংলা" বলতে কুন্ঠিত হওয়া উচিৎ না,তা সে যেই মতেরই হোক না কেন-এই "জয় বাংলা" উচ্চারিত হবে আমাদের মহান স্বাধীনতার চেতনায়,যা অর্জিত হয়েছিল ১৯৭১এ কিন্তু তা ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই সুদীর্ঘ ২৪বছরের পরিশ্রমের ফসল।কারণ এর থেকেই আমাদের গণতন্ত্রের সূচণা।এতে আর কিছু না হোক আমাদের একাত্মতা প্রকাশ পাবে।দল যে যেটাই সমর্থন করুক গণতন্ত্র সমর্থনই যেন মূলমন্ত্র হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:০৯