আমাদের তানিয়ারা
তানিয়া বর্তমানে আমার বাসার কাজের হেল্পার। দুই কাজ দিয়েছি তানিয়াকে। তবে দুই কাজের মাঝে আবার এক্সট্রাও রেখেছি। একদিন কাপড় ধোয়া বন্ধ রেখে ওয়াশরুম পরিষ্কার করাই। আবার কখনো আলমারির কাপড় গুছিয়ে দেয়। তানিয়া ছোট খাটো হালকা গড়নের শ্যামলা মেয়ে। চুল অনেক লম্বা। চোখ দুটো বড় বড়, এক কথায় তানিয়াকে আমার খুব ভালো লাগে । খুব সুন্দর তানিয়ার হাসি।
যে কোন কাজ সে হাসি মুখে করে। রোজ সকালে তার সাথে আমার অনেক গল্প হয়। তানিয়া এসেই আমার বিছানা গুছিয়ে ঝাড়ু দিয়ে ঘর ঝাড়ু দেয়। তাকে আমি কখনো বলিনি এই কাজটি করে দিতে। সে সানন্দে করে। আমার ভালো লাগে। সকালে তাকে এক কাপ চা অথবা চায়ের সাথে রুটি কিংবা বিস্কিট দেই খেতে। তানিয়া তখন সিঙ্কের সব ধুয়ে মুছে রাখে ঝুড়িতে। আমি বলি তুমি চা খেয়ে চলে যাও দেরী হয়ে যাবে। তবুও সে টুকটাক অন্য কাজ করে দেয়।
যদিও কাজে ফাঁকিবাজ আছে। সব হেল্পারই এমন ফাঁকিবাজ থাকে আমার দেখা মতে। চোখের সামনে থাকলে কাজগুলো ভালোভাবে করবে। চিপাচাপা সুন্দর করে ঝাড়ু দিবে। যদি সামনে না থাকি তবে হইছে, সোফার নিচেও হাত যায় না। তানিয়াকে ভাত খেতে দিলে এত্ত খুশি হয়। তার খুশি দেখে ইচ্ছে হয় রোজ ভাত খাওয়াই কিন্তু তা আর হয় না। তানিয়ার হাতে সময় থাকে না।
তানিয়ার বাড়ি ময়মনসিংহে। তানিয়ার বয়স মনে হয় খুব একটা হয়নি। বিশ থেকে বাইশ হবে আমার ধারণা। তার দুইটা মেয়ে, বড় জনের বয়স ৪ আর ছোটজনের বয়স দেড় বছর। দুটো মেয়েকে ময়মনসিংহে রেখে সে ঢাকায় মান্ডা থেকে মতিঝিলে বাসাবাড়ীতে কাজ করে। দুধের বাচ্চাটাকে রেখে এসেছে শুনে প্রথম থেকেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
তাও দুই বোন দুই জায়গায় রাখতে হয়েছে। দুইজনের খরচ তার শাশুরী নিতে চায় না। তাই একজন থাকে দাদীর কাছে একজন নানীর কাছে। যাই হোক সে অনেকগুলো বাসায় কাজ করে ১০/১২ হাজার টাকা ইনকাম করে। সে মান্ডাতে স্বামীর সঙ্গে থাকে। কাহিনী হল, তানিয়ার জামাই নাকি একটু লম্বা আর একটু ফর্সা সুন্দর (আমি দেখি নাই) । তানিয়ার কাছে শুনেছি। তানিয়া বলে আফা কত সিস্টেম করে চলতে হয়, নইলে ত্যাড়া হয়ে যায়। বাসায় ফিরে আসে না। আসল কথা হলো তানিয়ার ছেলে নাই দুইটাই মেয়ে। আর তানিয়া ছোটখাটো। চঞ্চল মেয়ে দেখলেই বুঝা যায়। কোনদিনও মুখ বেজার করে কাজ করেনি আমার বাসায়।
তানিয়ার জামাই আস্ত একটা বদ লোক (যদিও একজনের বক্তব্য হতে ধারণা)। তানিয়া বলে আফা সে একদিন কাজে গেলে ছয়দিনই বাসায় হুইত্তা থাকে। কাম করে না। মাস শেষে তানিয়ার সব টাকা নিয়ে নেয়। তানিয়ার হাতে ৫০০ কিংবা এক হাজার টাকাও দেয় না। বেতন পেলে তার মানিব্যাগ হতে সব টাকা হাতিয়ে নিয়ে যায়। বাসার ভাড়া দেয় আর রঙ ঢং করে টাকা উড়ায়।
যেই না তানিয়া বলে সব টাকা দেব না। সেই শুরু তানিয়ার উপর অত্যাচার, বুকের মাঝে লাত্থি সহ সারা শরীরে মারের দাগ। দুই মাস আগে সে বাড়িতে গিয়েছিল। সেখানে তানিয়ার মায়ের বাড়ীতে মায়ের সামনে বুকে লাত্থি মেরে ফেলে দিয়েছে। আরেকটা বিয়ে করবে বলে হুমকি দিয়ে সে নাই হয়ে যায়। তানিয়া ঢাকা ফিরে এসে অনেক কষ্টে তার ফোন নাম্বার যোগাড় করে টাকা পাঠায় মোবাইলে। তারপর আবার ফিরে আসে।
এখন ঈদের আগে আবার টাকা পয়সার জন্য মারধোর করেছে। তানিয়া ঈদে বাড়ী গিয়ে ফেরত আসেনি এখনো। ফোন করে জানতে পারি সে মেয়েসহ বাপের বাড়ী । দেন দরবার চলতেছে। তানিয়ার জামাই তানিয়াকে ছেড়েও দিতে পারে। তানিয়া একটা সুন্দর মেয়ে। শুধু তার নিজের দুটো মেয়ের জন্য জামাইরে কতই না তোয়াজ কতই না যত্ন আত্মি করতেছে। মেয়েরা এখানেই ধরা খায়। সন্তানের দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে যাওয়ার চিন্তাও করে না।
তানিয়ার মেয়ে দুটোকে আমি দেখেছি। মাশাআল্লহ এত সুন্দর। বড় মেয়েটা পুতুলের মতন। আরেকটা কথা তানিয়ার ছোট বোন তানিয়ার চেয়ে একটু লম্বা। মোটামুটি সেও সুন্দর। সে উত্তরা বাসায় থাকে। জামাইর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এই বোনটাই নষ্টের মূল আমার ধারণা। তানিয়ার জামাইর সাথে দিনে রাতে ফোনে আলাপ করে। অই বাসা থেকে তানিয়ার কাছে বিচার আসছে। তানিয়া কথায় কথায় বলতেছিল আফা আমার বোন আমার সংসারটা নষ্ট করে দিবে মনে হয়।
এতসব লিখার কারণ হল, এই তানিয়াদের কাহিনী আমাকে খুব কষ্ট দেয়। দুইটা বাচ্চা ছোট । রেখে কাজে আসে ঢাকা। সে যে সময় বাড়ীতে যায় এসেই হাউমাউ করে কান্ধে। বলে আফা মেয়েরা রাতে জোরে ধইরা ঘুমায় যাতে আমি ঢাকা না আসি। সে রাতে ঘুম পাড়িয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয় প্রতিবার।
চোখ দিয়ে যখন ঝরঝর করে পানি পড়ে তখন ভেতরটা কেঁপে উঠে। সন্তানদের জন্য মায়ের মমতা দেখে ভাবি আমাদেরকে আল্লাহ অনেক ভালো রেখেছেন। ছোট মেয়েটা কথা বলতে শিখেছে। সেই নিয়ে প্রতিদিনই বলে আফা ছোট মেয়েটা কী সুন্দর কথা বলে যদি শুনতেন। বড় মেয়েটার নাম সোহানী, ছোটটার নাম মনে নাই।
মায়ের মমতা আর বাবার স্বার্থপরতায় কত সংসার যে এমনেই ভেঙ্গে যায়। তানিয়াদের জন্য কেউ এগিয়ে আসে না। বেটাদের কী, মেয়েদেরকে মায়ের কাছে দিয়ে সে আরেকটা বিয়ে করবে। আর এদিকে তানিয়া না পারবে বিয়ে করতে আবার না পারবে সন্তানদের ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে।
তানিয়াকে নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম ফেসবুকে। এক বিদেশী ভাই তানিয়াকে সাহায্য করতে চেয়েছিল। আমিও ভেবেছিলাম আমিও সাহায্য করবো যদি সে তার সন্তানদেরকে ঢাকায় নিয়ে আসতে পারে। তানিয়াকে কত বুদ্ধি দিয়েছি। বলেছি মতিঝিলে আসো, এখানে কত রকম ব্যবসা আছে, আমি টাকা দেব তোমার জামাইকে বলো সে যেন কিছু একটা ব্যবসাতে লেগে যায়। তানিয়ার জামাই কোনোভাবেই রাজী না। তার মেয়েদেরকে সে ঢাকায় আনবে না। তাই আর কথা বাড়াইনি। আর বিদেশী ভাইটাকে বলেছি, যদি প্রয়োজন হয় আমি তাকে পরে জানাবো। এরকম বেকার বেটা যে বসে বসে খায় তাকে টাকা দিলে সে টাকা উড়াবে আর রঙ ঢঙে চলবে। তাই তাকে সাহায্য করতে আর আগাইনি। সেদিন তানিয়াকে ফোন করেছিলাম কবে আসবে, সে বলল আফা সে মাইর মারছে তার জন্য ঔষধ খাচ্ছি, ভালো হলে চলে আসবো। আসলে এই সমাজে এমন তানিয়াদের অভাব নেই। আল্লাহ তানিয়াদের সহায় হোন।