তৃতীয়বারের মত পিতা হচ্ছে ফিরোজ । বরাবরের মত তার আকাশপাতাল জ্বর ।আগের দুবারও তার একই অবস্থা । অসুস্থ স্ত্রীকে হার মানিয়ে যায় তার অসুস্থতা ।পুরুষ মানুষের অসুস্থতা মানে ভয়াবহ অসুস্থতা । মেয়েদের ঘরের কোনায় অসুখ হয় , ঘরের কোনায় সেরে যায় । পুরুষ মানুষ অসুস্থ হলে দশ গ্রামের মানুষও জানে ।
ফিরোজ এখন বমি করছে । দেহের সবকিছু উগড়ে দেওয়া দেওয়া ভাব । কিন্তু কিছু উচ্চগ্রামের শব্দ ছাড়া কিছুই বের হল না ।
ছোট মেয়ে , মানে যে কিছুক্ষনের মাঝে মেজ হয়ে যাবে ,তার নাম রাফিয়া । বয়স সামনে জুলাইয়ে চার হবে । সে বাবার এই অবস্থার সাথে পরিচিত না । সে ফুপিয়ে কাঁদছে , আর তার সংকীর্ন হাত দিয়ে বাবার বিস্তৃত কপালে বিপুল ভালবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছে ।
এসব দেখছে বড় মেয়ে রাজিয়া । দশ বছর ! এবারে সে বৃত্তি পরীক্ষা দেবে । রাজিয়ার চোখে এখনই চশমা । সে চশমার উপর দিয়ে রাফিয়া আর তার বাবার কর্মকান্ড দেখছে । গত দুদিন ধরে তার পড়াশোনায় মন্দা ভাব চলছে ! তাই আজ নিজ উদ্যোগে সে অংক করা শুরু করেছে । সে বড় মেয়ে বলে মায়ের অবর্তমানে রাফিয়ার দেখভাল করার ভার পড়েছে । রাফিয়া কে ,সে থামাতে পারছে না । রাফিয়া আছে বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত ।
ফাতেমা , ফিরোজের বৌ । তার মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে । এসময় এত উত্তেজনা ভাল না । চেপেও রাখতে পারছেন না । ফিরোজের বমির শব্দ শুনে তার মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল ।
যে , দাই আছে । সে বারবার বলছে মেয়ে হবে । সে নাকি মায়ের মুখ দেখে বলতে পারে ছেলে হবে না মেয়ে হবে । কিন্তু তার গত দুবারের অনুমান ভুল হয়েছে । সে বারবার বলছিল ছেলে হবেই । রাফিয়াকে , তো দেড় বছর ছেলের জামা পরে থাকতে হয়েছে । কারণ এই দাই ।
সে এবারও ছেলে ছেলে করছেন । এর জন্য পশ্চিমপাড়ার এক কামেল পীরের সরীষার তেল পড়িয়ে নিয়ে আসছেন । এই তেল ফাতেমার শরীরে মালিশ করা হয়েছে । এই তেলের বোতল দেখলেই ফাতেমার রাগ হয় ।
দিশেহারা হয়ে গেছে জোহরা বেগম । জোহরা বেগম ফিরোজের শ্বাশুড়ি । ফাতেমার ব্যাথা বাড়ছে আর ওদিকে জামাই এর আকাশ পাতাল জ্বর । জামাই তার লাখে একটা । শ্বাশুড়ির সে খুব যত্ন নেয় । ফাতেমা শুয়ে শুয়ে এক নাগাড়ে ফিরোজ কে বকাবকি করছে । কিন্তু , জোহরা বুঝতে পারছে . জামাইকে টেনশনে পেয়েছে ।
রাত দুইটা ।ফাতেমার ব্যাথা চরমে । নানি অনেক কষ্টে রাফিয়া কে ঘুম পাড়িয়েছেন । রাজিয়া কে ঘুম পাড়াতে পারেননি । সেবার মায়ের আগে রাফিয়াকে সে নিজেই কোলে নিয়েছিল । অবশ্য এ হিসেবে সে দাড়িয়ে নেই । তার চোখেও টেনশন । তার সাথে এতক্ষন বাসার কাজের ছেলে ছিল । সে মসজিদের ইমাম ডাকতে গেছে । রোদঘরে , তার মা আর নানি আছে । আরো আছে দাই আর আর তার দুই সহযোগী । তারা মাঝে মাঝে দুদ্দাড় করে ঘর থেকে বের বের হচ্ছে , আবার দুদ্দাড় করে ঘরে ঢুকে যাচ্ছে । রাজিয়া ভেতরে যুদ্ধ দেখতে পারছে না ।
ফিরোজের এখনও জ্বর । একেবারে কাবুকরা জ্বর ।সে চোখ খুলে তাকাতেই পারছে না । মাঝে মাঝে এটা ওটা শুনছে , কিন্তু কিছু বুঝতে পারছে না । তৃতীয় সন্তান আসতে খুব বেশি দেরি নেই । গত দুবার জ্বর হয়েছিল ঠিক এত জ্বর হয় নি । ফাতেমা এবারে একটা ছেলের জন্যে ক্ষেপা হয়ে আছে । ফিরোজ আসলে বুঝতে পারছে না , এই মেয়ে হলে কি সমস্যা । ছোট মেয়ে টা যখন কোলের উপর বসে বসে আনমনে গল্প শোনায় তখন তার কি যে , ভাল লাগে !
ফাতেমার এক কথা । মেয়ে চিরদিন তার কোলে বসে থাকবে না । বিয়ে দিয়ে তাকে লিখিত পড়িত ভাবে পর করে দিতে হয় ।
এই কথা চিন্তা করে নি ফিরোজ । এই কথা চিন্তা করলে তার বুকটা হুহু করে ওঠে !
ইমাম সাহেব এসে বসে আছেন । তাকে খেতে দেওয়া হচ্ছে । তিনি আষান দেবেন বলে এসেছেন । তার আশে পাশে রাজিয়া ঘুরঘুর করছে । তার সাথে সে গল্প করছে ।
�
খাওযা শেষ হওয়া মাত্রই ! নবজাতকের চিত্কার শোনা গেল । হাত ধুয়ে এসে বসতেই ইমাম সাহেবের কোলে পৌছে গেল সদ্য জন্ম নেওয়া আদম সন্তান । উচ্চস্বরে আযান দিলেন ইমাম ।
আযানের শব্দে ঘুম ভেঙেছে ফিরোজের । সারা শরীর তার ঘামে ভেজা । বাসা জুড়ে একটা চাপা আনন্দের বান এসে পড়েছে ।
কিভাবে , কিভাবে যেন রাফিয়া ঘুম ছেড়ে উঠে পড়েছে । বোনের কোলে একটা সাদা মতন বাবু কে দেখে সে অবাক হল । তার অপ্রশস্ত পাজাকোলার মাঝে তার ছোট্ট একটা ভাই !!
ফিরোজ এবার উঠে বসেছে । লাইট জ্বেলে তার রুমে শ্বাশুড়ি ঢুকেছেন । আর তার দুই মেয়ে ।
রাফিয়া তার কোলের অতিথি কে নিয়ে বাবার দিকে এগিয়ে গেল । চিকন কন্ঠে বলল বাবা , দেখ ! নানু ভাই টাকে কোথা খেকে যেন নিয়ে আসছে !!!