somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: বোধ

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



‘আমি তোমাকে কোন টাকা দিতে পারবো না’ – এই বলে আব্বা তার কালো ফ্রেমের চশমাটা চোখে দিয়ে পাশে রাখা দৈনিক পত্রিকাটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন।

আমি বুঝলাম এবার আর কোন কথা চলবে না। এটা আমার আব্বা মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মশিউর রহমানের সিগনেচার স্টাইল। আমার ত্রিশ বছরের জীবনে এই আচরণ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। সুতরাং আমি উঠে পড়লাম।

‘আব্বা রাজী হচ্ছে না। আপনি একটা ব্যবস্থা করে দেন।’ আমি রান্নাঘরে গিয়ে আম্মাকে বললাম।

আম্মার কাঁচকি মাছ ধুয়ে পরিষ্কার করছিলেন। সেখান থেকে মনযোগ না সরিয়ে বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘আমি আবার কি ব্যবস্থা করবো? তোর আব্বা আমার কথা কখনও শুনছে?’

‘আপনি ভাবীকে বলেন। ভাবী যেন ভাইয়াকে দিয়ে আব্বাকে বলে টাকার ব্যবস্থা করে। ভাইয়া বললে আব্বা রাজী হবে।’
‘রাজী হলেও এত টাকা কোত্থেকে দিবে?’
‘পাঁচ লাখ টাকা তো বেশী না আম্মা। অন্যদের দশ লাখ টাকা লাগতেছে, তাও ওদের হবে কিনা নিশ্চিত না। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় বলে আমার পাঁচেই হবে।’
‘কোটায় হলে আবার টাকা লাগবে কেন?’
‘কারণ ক্যান্ডিডেট বেশি। বাশার ভাই ভিতরে একটা লিংক খুঁজে বের করেছে। উনি স্পেশালি রেকমেন্ড করে দিবেন বলেছেন।’
‘তোর এই চাকরীটা খারাপ কি? বেতন তো এখন বেশি পাচ্ছিস।’
‘আপনি বুঝবেন না আম্মা। এইটা সরকারী চাকরী। বেতন ছাড়াও নানা সুযোগ সুবিধা থাকে। আপনি আব্বাকে রাজী করান।’
‘তোর আব্বার কাছে টাকা নাই।’
‘না থাকলে দশ শতকের জমিটা বন্ধক রাখতে বলেন। এই ধরণের সুযোগ বার বার আসে না। আর চাকরীটা হয়ে গেলে টাকাটা তুলতে বছরখানেকও লাগবে না।’
‘কই পাবি এত টাকা?’
‘পাবো।’
‘তোর আব্বা ঘুষ দিতে রাজী হবে না।’
‘ভাইয়া বললে হবে।আপনি ভাবীকে বলেন ভাইয়াকে দিয়ে যেন আব্বাকে বলায়।’
‘তোর ভাইয়াই রাজী হয় কিনা দেখ!’

এইটা সত্যিই এক চিন্তার বিষয়। ভাইয়া হচ্ছে আব্বার কপি। অনেস্ট এন্ড রিলিজিয়াস। কিন্তু চাকরীর এই সুযোগটা হারানো যাবে না। সেকেন্ড ক্লাস পোস্ট। বাড়তি সুযোগ সুবিধা আছে। তাছাড়া বাশার ভাইয়ের লিংকটা অথেনটিক, রিস্ক নাই। ভাইয়া হয়তো এমিনিতে রাজী হবে না, তবে ভাবী বললে রাজী না হয়েও পারবে না।

পরের দিন দুপুরে খাবার টেবিলে আব্বা বেগুন ভর্তা দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে চাকরীর প্রসঙ্গ তুললেন। ‘তুমি নাকি বলেছো এক বছরের মধ্যেই পাঁচ লাখ টাকা ফেরত দিতে পারবে? সেকেন্ড ক্লাস চাকরীতে সরকার এত সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে নাকি?’
‘সরকারী চাকরিতে সুযোগ সুবিধা তো আছেই। নতুন পে-স্কেলে বেতন প্রায় ডাবল হয়েছে৷ অন্যান্য সুবিধাও বেড়েছে।’
‘তাই বলে নিশ্চয়ই বছরে পাঁচ লাখ টাকা জমানোর মতো হয়নি। নাকি ঘুষ দিয়ে ঢুকে তারপর তুমিও দূর্নীতি শুরু করবে?’
‘দূর্নীতি করবো কেন? এই পোস্টে ট্যুর করতে হয়, ইন্সপেকশন আছে। সেসবের বিল থেকে টাকা আসে।’
‘নাকি ভূয়া বিল করে, ক্লায়েন্টের কাছ থেকে গিফট নিয়ে চলতে হবে? এইসব হারাম উপার্জনের জন্য আমি তোমাদেরকে বড় করি নাই। তোমাকে আমি ধর্ম শিক্ষা দিতে পারি নাই জানি, কিন্তু নৈতিক শিক্ষাটা তো দিয়েছি, নাকি?’
‘এই ধরনের সুযোগ বার বার আসে না আব্বা। আমি না নিলে অন্য কেউ এই সুযোগটা নিবে।’
‘অন্যায় সুযোগ নেয়ার দরকারও নেই। আমরা যারা সাধারণ লোকজন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম, তারা কেন গিয়েছিলাম তুমি জানো? আমরা ভেবেছিলাম, যুদ্ধ করে যদি পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করা যায়, তাহলে এই দেশে কোন অন্যায় থাকবে না, অবিচার হবে না। যার যা অধিকার সে সেটা ভোগ করতে পারবে। দূর্নীতি হলো অন্যায়, অন্যের ন্যায্য অধিকার নষ্ট করা। সরকারী চাকরী কেন এত লোভনীয় সেটা আমি জানি। এখানে দুই টাকার কাজে দশ টাকা খরচ হয়, মাঝে ভাগ বসায় সবাই। এ কারণে দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে হলেও চাকরীতে যোগ দিতে চায়, পরে সুদে আসলে তুলে নেয় সেই টাকা। এতে তার নিজের কি ক্ষতি হয় না? অবশ্যই হয়, কিন্তু লোভের কারণে সে আর ফিরতে পারে না। তুমিও লোভে পড়েছো, তাই তুমিও পাঁচ লাখ টাকা খরচ করতে রাজী। তোমার কাছ থেকে আমি এমনটা আশা করি নাই।'
‌'আমি না দিলে অন্য কেউ দিবে। এরকম সুযোগ বারবার আসে না।'
'তুমি তো আর সাধারণ দশটা বাবার ছেলে না। তোমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা এবং তিনি তোমাদেরকে সারা জীবন সততার শিক্ষা দিয়েছেন। বাকীদের বাবারা হয়তো মুক্তিযোদ্ধা না, তারা হয়তো সততার শিক্ষা দেয় নাই, আমি তো তেমন নই। তাহলে কেন? তোমার ভাই আমাকে অনুরোধ করেছে তোমাকে টাকা দেয়ার জন্য। কিন্তু তার এই অনুরোধ আমি রাখতে পারবো না, তোমাকে টাকাও দিতে পারবো না। তুমি চাকরীটা না পেলে আমার কষ্ট লাগবে না, বরং আমি খুশিই হবো এই ভেবে যে, সততার কারণেই তুমি চাকরী পাও নি। আমি খুশি হবো, কারণ মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা আমি তোমাকে দিতে পেরেছি।’

আমি চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়লাম। আব্বার কথাগুলো কানে বেজেই যাচ্ছিল। সত্যিই তো! উনারা নিশ্চয়ই এমন স্বাধীন দেশ চাননি। এমন দূর্নীতিবাজ দেশ পাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই জীবনের মায়া ত্যাগ করে জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হননি। তাহলে কেন আমরা ঘুষ দিয়ে চাকরী পেতে চাই? কেন সরকারী চাকরীতে যোগ দিয়ে দেশের টাকা লুটপাট করি?

আমি বাসা থেকে বের হয়ে পড়লাম। খুব ইচ্ছা করছিল বাশার ভাইকে ফোন করে জানিয়ে দেই এইভাবে আমি চাকরী পেতে চাই না। কিন্তু আমি ফোন দিলাম না। এইসব গল্প-উপন্যাস আর সিনেমায় হয়। আমার জীবন সিনেমা না। এই সেন্টিমেন্ট দিয়ে জীবন চলবে না। আব্বার দেয়া নৈতিক শিক্ষাটা আমি কাজে লাগাবো নিশ্চয়ই, তবে সেটা এখনকার কাজ না। এখনকার কাজ হলো নগদ পাঁচ লক্ষ টাকার ব্যবস্থা করা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:৪২
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×