এক শুভ্র জনসমুদ্রের মাঝ থেকে একদিন আমি হারিয়ে গেলাম । হারিয়ে গেলাম তেপান্তরের মাঠে । এরি মধ্যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে ফেলেছি । কেমন করে পার হলাম, সেটা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না । আমি পা চালাচ্ছি তেপান্তেরের মাঠে । আমার চারপাশে ফাঁকা ময়দান, আর মাঝে মধ্যে বিশালাকার পাথরের পাহাড় । পশ্চিম আকাশের রক্তিম সূর্যটা আমার ঠিক সামনে । এটা কিছুটা ভয়ের ব্যাপার যে, এ রকম ভূতুরে প্রান্তরে এর আগে কখনো আসা হয়নি ।
হঠাৎ মাথার মধ্যে এক মূল্যবান চিন্তা উঁকি দিল ।
আমি এই তেপান্তরের মাঠে কেন ? এই বিরামহীন হাঁটাহাঁটির কোন মানে আছে ?
না, আমার এই পা চালানো অনর্থক নয় । সবাই যে উদ্দেশ্যে এই ভয়ঙ্কর রাজ্যে আসে, আমার আগমন সেই একি কারণে । কিছুদূর অগ্রসর হতেই চারপাশ থেকে একটা গুঞ্জন ধ্বনি আমাকে পেঁচিয়ে ধরল । কিছুটা চমকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম । মনে হলো ক্ষাণিকটা ভয় পেয়েছি । চারপাশ একবার দেখে নিয়ে আবারো চলতে শুরু করলাম । পরক্ষণেই মনে হলো, এত সাধারণ একটা ব্যাপারে ভয় পাওয়া উচিৎ হয়নি। কারণ এটা তেপান্তরের মাঠ।
হাঁটতে হাঁটতে এক সময় যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়লাম । বিশ্রাম নিতে বসে পড়লাম এক পাহাড়ের ছায়ায় । বিশাল পাহাড়ের বিস্তৃত ছায়া। তবে এটাকে শীতল ছায়া বলার কোন সুযোগ নেই । চোখ খোলা রেখে আশেপাশে তাকাতেই দেখলাম, আমার ঠিক ডান পাশে আর বেশ খানিকটা দূরে, মসৃণ কোন ধাতব পৃষ্ঠে সূর্যের আলো পড়েছে । মনে হলো একটা ধারালো তরবারিকে উপর থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে । যেটার অগ্রভাগ দিয়ে অনবরত অগ্নিস্ফূলিঙ্গ বের হচ্ছে । অনেকটা সিন্দবাদের সেই ‘সুলেমানী’ তরবারির মতো । সূর্যটার দিকে একবার বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে পড়লাম । অনেক আশা নিয়ে সেখানে পৌঁছতেই আমার দুচোখ চকচক করে উঠল । এ এক অন্যরকমের পাওয়া । আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমারই ‘ধাক্ ধাক্’পক্ষ্ণীরাজ বাইক । সুবিশাল ময়দানটার দিকে আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম । মনে হলো, এটা আমার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে ।
বাইকটার উপর উঠে বসতেই চারপাশ থেকে হাজারো কন্ঠের অট্টহাসির শব্দ হলো । গোটা প্রান্তরটাকে কাঁপিয়ে তা আমার দুই কান দিয়ে মাথার মগজে গিয়ে ঠেকল । দেখলাম, কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাইকটা তীর বেগে জায়গা পরির্বতন করেছে।
এখন আমি বুলেট বেগে এগিয়ে যাচ্ছি । গতিবেগ ২০০ কি.মি./ঘন্টা । আমার গন্তব্য রাক্ষসপুরী । সম্ভবত, সেখানে এক ভিনদেশী রাজকন্যা সোনারকাঠি আর রূপোরকাঠির অসমবিন্যাসের মায়াজালে ঘুমিয়ে আছে । চারপাশের গুঞ্জনধ্বনিটা এবার একটু জোরালো হলো । চলতে চলতে হঠাৎ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মন্ত্রীপুত্রের কথা মনে পড়ল । তার তো এসময় আমার সাথেই থাকার কথা । তাহলে সে কি তেপান্তরের মাঠে হারিয়ে গেলো । আর যদি হারিয়ে যায় তো গেছে । সেটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার । এ বিস্তর মাঠে তাকে খুঁজতে যাওয়ার কোন মানে হয় না । আর খুঁজে পাওয়াটাও প্রায় অসম্ভব । সবচেয়ে পরিষ্কার কথা হলো, আমার হাতে এখন অনেক কাজ। যদিও সব পরিকল্পনা করে ফেলেছি ।
রাক্ষসপুরীতে আমার প্রথম কাজ হলো রাজকন্যার সাথে দেখা করা । দ্বিতীয় কাজ, রাক্ষসীবধ । কাজটা আমার জন্য খুব জটিল কিছু না । পকেটের মধ্যে অনেক আগে থেকেই এক বোতল ’ক্লোরোফরম’ আছে । প্রথমে সাতশ রাক্ষসীর প্রাণ-ভোমরা যে কৌটার মধ্যে আছে সেটা উদ্ধার করতে হবে । তারপর সে কৌটার মধ্যে অতি সাবধানে ক্লোরোফরম ছাড়তে হবে । পরে আঙ্গুলের চাপ দিয়ে সংঙ্গাহীন ভোমরার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে দিলেই কাহিনী শেষ । রক্ত ক্ষরণের কোন সম্ভাবনাই নেই । আর সব শেষের কাজটাতো সবচেয়ে সোজা । সেটা নিয়ে এখন মাথা না ঘামালেও চলবে ।
পশ্চিম আকাশের সূর্যটা রক্ত বর্ণের গাঢ়তা বাড়াতে বাড়াতে আমার অনেক কাছাকাছি এসে পড়ল ।এই সূর্যটাকে সামনে রেখেই চলতে হবে। এ পথের শেষ কোথায় আমার জানা নেই । একবার মনে হলো, আজকে হয়ত রাজকন্যা বা রাক্ষসী কারো সাথেই দেখা হবে না । কিন্তু ক্ষানিক বাদেই অনেক দূরে রাক্ষসপুরীর প্রধান ফটকটা চোখে পড়ল । এটা আশা নাকি নিরাশার লক্ষণ ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
ফটকের একপাশে বাইকটা দাঁড় করালাম । সেখান থেকে অপর পাশে তাকাতেই আমি পুরোপুরি অবাক হয়ে গেলাম । অপর পাশে আরেকটা বাইক দাঁড় করানো, আর সেটা মন্ত্রীপুত্রের । ভাবলাম ভিতরে মন্ত্রীপুত্রের কোন বিপদ হতে পারে । এখন সবকিছু আমাকেই সামলাতে হবে।
ফটকের লোহার দরজাটার কাছাকাছি এসে অনেক ভয়ে ভিতরে তাকালাম । দেখলাম, অপরপাশে দুই রাক্ষসী পাহারায় বসা। তবে তারা এখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে । অস্বাভাবিক ভয়ঙ্কর চেহারা, দেখতে অনেকটা চামচিকার মত । আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। এরপর দেখি মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গাকে ঘিরে উঁচু উঁচু অদ্ভুত সব দালান । মনে হলো, চারপাশ থেকে চারজন বিশালাকার রাক্ষসী মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে । সব দালান থেকেই সেই সাতশ রাক্ষসীর নাক ডাকার বিশ্রী শব্দ শোনা যাচ্ছে ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাকে এখন উপরে উঠতে হবে । চারপাশ কয়েকবার ঘুরে দেখে অনেক কষ্ট করে উপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজে বের করলাম । সিঁড়ি দেখে আমার নড়াচড়া একরকম বন্ধ হয়ে গেলো । অতিশয় চাঁপা একটা সিঁড়ি সোজা সাততলায় উঠে গেছে । সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রেখেছি ঠিক সে সময় চারদিক থেকে সেই হাজারো কন্ঠের অট্টহাসি সাথে করতালির শব্দ হলো। আমার তখন জমে যাওয়ার মত অবস্থা ।
যা হোক, সব কিছু হজম করে অনেক কষ্টে উপরে উঠতে শুরু করলাম । চারপাশের সেই গুনগুন শব্দটা জোরালো থেকে জোরালোতর হয়ে উঠল । রাক্ষসীদের নাক ডাকার শব্দ আর বিশ্রী লাগল না । ধীরে ধীরে সেটা ভয়ঙ্কর হতে শুরু করল । যখন সিঁড়ির ঠিক মাঝখানে এসে পৌঁছেছি তখন একবার মনে হলো, এই বুঝি কোন রাক্ষসী নিচ থেকে আমার দিকে উঠে আসতে শুরু করবে । বুকের ভিতরের হৃদপিণ্ডটা কয়েকবার শব্দ করে কেঁপে উঠে আবার আগের মত স্বাভাবিক হয়ে আসল।
অবশেষে সাততলায় উঠে এলাম । আগের ভয়টা অনেকাংশেই কমে গেছে । ততোক্ষণে সূর্যটা হয়তো ডুবে গেছে কারণ চারপাশে আবছা অন্ধকার । অতি সাবধানে পা চালাতে শুরু করলাম । সবগুলো ঘর দেখতে একই রকম । প্রতিটা ঘরে সেই চামচিকাসদৃশ অসংখ্য রাক্ষসী । কোন ঘরেই আলোর ব্যবস্থা নেই । বেশকিছুক্ষণ পায়চারি করার পর একটা ছোট ঘরের দিকে চোখ আটকে গেল । সে ঘরের দরজা জানালার ফাঁক দিয়ে হলুদাভ আলো ছিটকে বের হয়ে আসছে । আমি কিছুটা হলেও পুলকিত। সম্ভবত খুঁজে পেয়েছি ।
এরপর ছোট ঘরটার দরজার সামনে এসে কান ছেড়ে দিলাম। না, কোন সাড়াশব্দ নেই । দরজায় হাত রাখতে যাব এমন সময় চারপাশ থেকে একটা তীব্র আর্তনাদের শব্দ হলো । আমি এক লাফে কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম । বুকের ভিতরে দফ বাজানোর মত শব্দ হতে শুরু করল । আশেপাশে নজর দিলাম। সবকিছুই ঠিক আছে । সাহসের উপর ভর দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো দরজায় হাত দিলাম । এবারে আর কোন অঘটন ঘটল না । সব রকম প্রস্তুতি আর মনের মধ্যে অনেক আশা নিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলাম । এরপর সামনে এক পলক তাকাতেই আমার সব অঙ্গ-প্রতঙ্গ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল । আমার প্রাণের বন্ধু, আত্মার দোস্ত, নিমকহারাম মন্ত্রীপুত্র রাজকন্যার শয্যার পাশে বসে আছে । প্রচণ্ড ঘৃণা আর ক্রোধে আমার দুই চোখ বন্ধ হয়ে আসলো ।
না...আ....আ......আ.......
চারপাশ থেকে আবারো সেই তীব্র আর্তনাদের শব্দে চোখ খুলে ফেললাম । এরপর মাথাটা স্বাভাবিক জায়গায় তুলে ধরে বামে তাকালাম। দেখলাম, আমার খুব কাছের বন্ধু আশফাক আমার পাশেই বসে আছে । নিচু গলায় গল্প করার চেষ্টা করেছে এক মেয়ের সাথে। মেয়েটা আমাদের ব্যাচেরই একজন । দূর কাশ্মীর থেকে আসা এই বিদেশীনী দেখতে অনেকটা রাজকন্যার মতই ।
আমার মনযোগ বিছিন্ন হলো। কারণ, আমাদের কমিউনিটি মেডিসিনের সাজেদা ম্যাডাম একি কথা আবার বললেন, আর পাঁচ মিনিট পড়ায়েই শেষ করে দিব।
নো.. ও...ও....ও.....। সবাই একসাথে গুঙিয়ে উঠল।
ম্যাডাম এবার একটু ক্ষেপে গেলেন, কি হচ্ছে এসব? এভাবে বারবার চিৎকার দেওয়ার মানেটা কী? বললাম না আর পাঁচ মিনিট!
কী আর করার, বাকি পাঁচ মিনিট দীর্ঘশ্বাস আর হাই তুলতে তুলতেই শেষ হয়ে গেল ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১২:৫৩