শুক্রবার বেলা প্রায় শেষ। হাবিব আর রেণুমার বিয়েটা হঠাৎ করেই হয়ে গেল।
গল্পটা এভাবেই শুরু করা যায়। কিন্তু এই শুরুটা শুরু করার আগে অনেক কিছু নতুন করে শুরু করতে হয়।
প্রয়াত ব্যবসিক আলিমুদ্দি ভূঁইয়ার দুই ছেলে। বড় ছেলের নাম কালাম ভূঁইয়া, আর ছোট ছেলে সালাম ভূঁইয়া। বড় ছেলে ব্যবসা ভালো বোঝে। সামনের দিনে তার দুই ছেলে যথাক্রমে ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ার হতে যাচ্ছে। কালাম ভূঁইয়া অবশ্য এখানেও ব্যবসাটাকে ছুটি দিতে পারে নি। অনেক পরিশ্রম করে এতোদিনে সে ছেলেদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, ভালো পড়াশোনা মানে হলো ভালো বিনিয়োগ!
তবে কালাম ভূঁইয়া তার ছোট মেয়েটার ক্ষেত্রে হিসাব নিকাশে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। অবশ্য এসব নিয়ে চিন্তা করে সে কখনো দীর্ঘশ্বাসও ফেলেনি। এক রাস্তা বন্ধ হয়েছে তাতে কি হয়েছে। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেনি তাতে যেমন কোন সমস্যা নেই, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের ঘরে যাওয়ার পথেও কোন সমস্যা থাকার কথা না। কালাম ভূঁইয়ার ছোট মেয়েটার নাম রেণুমা।
সালাম ভূঁইয়ার একমাত্র ছেলে হাবিব রেণুমাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে ডাকে। যখনি ডাকে নিঃশব্দে ডাকে। সব নামের পিছনেই চোখ সংক্রান্ত ব্যাপার-স্যাপার জড়িত।
হাবিব শহুরে ভার্সিটিতে পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পিছনে ছুটতে শুরু করেছে। এর শেষ কোথায় এটা সে জানে না। সেও মোটামুটি তার বাবার মতই। ব্যবসাটা ভালো মত বুঝে উঠতে পারেনি।
রেণুমার বাবা কালাম ভূঁইয়া থাকে শহরতলীতে। রেণুমার দাদার পুরাতন বাড়িটা এখন পুরোটাই তাদের দখলে। সেখানে তারা রাজকীয় বসবাস শুরু করেছে। রাজকীয় বলার একমাত্র কারণ, বাড়িটা দেখতে অনেকটা রাজবাড়ির মত। এই কথাটা কালাম ভূঁইয়া মাঝে মধ্যেই ভাবে। কারণ, এ বাড়িতে থাকার যোগ্যতা কেবল সেই অর্জন করেছে।
হাবিবের দাদিসহ সালাম ভূঁইয়া থাকে শহরে। তারা থাকে ভাড়া বাড়িতে। সেই বাড়িতে একদিন শনিবার সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে হাবিব তার দাদিকে ডেকে নিয়ে বিছানার পাশে বসালো। হাবিবের দাদির নাম সারেফুন্নেসা। রাশ ভারি মানুষ। মুখচ্ছবির উপর গম্ভীর একটা ভাব সব সময় লেগে থাকে। তার চোখের উপর চোখ তুলে কথা বলতে সাহসের দরকার হয়। হাবিব সেই চোখের দিকে তাকিয়ে প্রথমে একটা শুকনো হাসি দিয়ে মুখটা গম্ভীর করে ফেলল। এরপর কিছুক্ষণ দম ধরে থাকার পর মুখ খুলল।
দাদি, আজ রাত্রে লম্বা চওড়া একটা স্বপ্ন দেখেছি। খারাপ না ভালো ঠিক বুঝা যাচ্ছে না।
কি স্বপ্ন?
স্বপ্নে আজ দাদাকে দেখলাম। সাদা পাঞ্চাবি, সাদা পায়জামা। দাড়ি-গোঁফ, সব সাদা।
হাবিবের দাদি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাল। জানালার পাশের সরু রাস্তাটার দিকে চোখ রেখে গলা নিচু করে বলল, কি দেখলি?
অনেক কিছু দেখলাম। প্রথম থেকে বলি। দেখলাম আমি একটা বিরাট হল ঘরের ভিতরে। সেখানে পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদের উপস্থিতি দেখার মত। এমন জমকালো পরিবেশ এর আগে আমি কখনো দেখিনি। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগল।
কি ব্যাপার?
হাবিব দেখল তার দাদি খুব আগ্রহ নিয়ে কথা শুনছে।
সেই জমজমাট পরিবেশে সবাই গল্পে গল্পে মজে আছে কিন্তু আমার মুখে কোন কথা নেই। শুধু তাই নয়, একবার আমি আমার পাশেরজনের সাথে জোর করে কথা বলার চেষ্টাও করলাম, কিন্তু মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না।
তারপর কি হলো? হাবিবের দাদির আগ্রহ আরো খানিকটা বেরে গেলো।
তারপর আর কি? চুপ মেরে বসে থাকলাম। বসে থেকেও কেন জানি স্বস্থি পাচ্ছিলাম না। সবাই কথার ফাঁকে মিটমিট করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। এভাবে আরো কিছুটা সময় পার হয়ে গেল। ঠিক কতটা সময় আমি মনে করতে পারছি না।
সারেফুন্নেসা উৎসুক দৃষ্টিতে হাবিবের দিকে তাকিয়ে আছে। হাবিব একবার ঢোক গিলে আবার শুরু করল।
এরপর আমি নিজেকে গদি আঁটা বেশ বড় সাইজের একটা আরাম চেয়ারের উপর আবিষ্কার করলাম। এবার যে ঘরের মধ্যে বসে আছি সে ঘরটা বেশ ছোট-খাটো। ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকালাম। মাত্র কয়েকজনকে দেখলাম, তবে সবাই অপরিচিত। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ সামনে থেকে একটা দরজা খুলে গেল। তারপর একজন দুজন করে ভিতরে ঢুকতে শুরু করল। সবার মুখেই চিরচেনা এক কৃত্রিম হাসি। সবাই হাসিমুখে আমার সাথে কথা বলছে। আমিও মুখে হাসি হাসি একটা ভাব নেওয়ার চেষ্টা করলাম, তবে তেমন ভাবে মনে হয় হাসতে পারলাম না।
তারা কি কথা বলছিল?
সেটা আমার ঠিক মনে নেই। ওদের দু একজন বাদে প্রায় সবাই অপরিচিত। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটা হলো সেই ছোট্ট ঘরটাতে আমি ঠিকমত শ্বাস নিতে পারছিলাম না। একটুপর কোন কারণ ছাড়াই দরদর করে ঘামতে শুরু করলাম।
এখানে তোর দাদাকে দেখলি কোথায়? হাবিবের দাদির গলাটা ভারি হয়ে আসল।
দাদাকে দেখেছি আরো অনেক পরে। এখন আর বলতে পারব না। হাতে একদম সময় নেই। আজ একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে। দোয়া কর, যেন চাকরিটা হয়ে যায়। বেকার থাকতে আর ভালো লাগে না। বেকারের চেয়ে মেকার ভালো, এই কথাটাতো মনে হয় জানো। নাকি জানো না?
সারেফুন্নেসা এবার শুকনো হাসি দিয়ে বলল, বেকার না থেকে তোর দাদার মত ব্যবসা শুরু করে দিস না কেন? কাঁচা পয়সা, শুকনো পয়সা সব হাতের মধ্যে ছুটাছুটি করবে।
তোমার বুদ্ধিটা খুব খারাপ না। দাদার মত ব্যবসায়ী হতে পারাটা আসলে ভাগ্যের ব্যাপার। আামার দাদা মানে তোমার স্বামী ছিল একজন বিশুদ্ধ মানের ব্যবসায়ী। যার কাছে জীবনের মানেই ছিল ব্যবসা। কি ঠিক বলিনি?
সারেফুন্নেসা কোন কথা বলল না। লাজুক হাসিতে তার ঠোঁট দুটা শক্ত হয়ে এসেছে। হাবিব তাকিয়ে আছে সেই ঠোঁটের দিকে। তার মনে হলো, জীবন যত সুন্দর, জীবন নিয়ে ব্যবসা তার চেয়েও বেশি সুন্দর।
দুপুরে খেতে বসে হাবিব তার মায়ের কথা শুনে একটু চমকে উঠল।
তুই নাকি খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছিস?
কে বলল তোমাকে?
কেন, তোর দাদি।
হাবিব চট করে মাথা ঘুরে পিছনে তাকালো। দেখে তার দাদি চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু না বলে চুপচাপ হাবিবের পাশে এসে বসল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর মুখটা আরো গম্ভীর করে ফেলল। হাবিব ভাবল তার দাদি হয়ত স্বপ্নের কথাটা এখানে আরেকবার তুলবে। তবে তার আগেই তার মা পুরাতন এক প্যাঁচাল শুরু করল।
তোর ইন্টারভিউ কেমন হলো?
হাবিব সময় নিয়ে তার মুখের ভাত গিলল। তারপর ঢক ঢক শব্দ করে এক গ্লাস পানি খেয়ে তার মায়ের দিকে তাকাল।
আগেরবার যেমন হয়েছিল।
তার মানে চাকরিটা এবারেও হচ্ছে না?
না হওয়ারই কথা।
কথা শেষ করে হাবিব তাকাল তার দাদির দিকে। তার দাদি মন খারাপ করে উঠে যাচ্ছে। সে চোখ নামিয়ে নিল। তার ইন্টারভিউ এখনো শেষ হয়নি।
খাওয়া শেষ করে হাবিব সোজা তার দাদির ঘরে গিয়ে ঢুকল। তারপর বিছানার উপর গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। তার দাদি কাছে এসে বসতেই একটু হাসার চেষ্টা করল।
দাদি, তোমাকে তো স্বপ্নটার সব কথা বলায় হয়নি। শেষ করেছিলাম সেই ছোট ঘরটার ভিতরের কথা দিয়ে। আমি সেই ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে আছি। গরমে গা জ্বলে যাচ্ছে। মাথার উপরে তাকালাম, ছোট্ট একটা ফ্যান বনবন করে ঘুরছে। কিন্তু ফ্যানের বাতাসে তেমন কোন কাজ হচ্ছে না। গায়ের ঘাম মোছার জন্য পকেটে হাত দিলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। পকেটে একেবাইে ফাঁকা।
ঘরটার জানালা দরজা কেমন ছিল? সারেফুন্নেসা হাবিবকে থামিয়ে দিতে চাইল। হাবিব থামল না।
তারপর কি হলো শোন। গায়ে হাত দিয়ে দেখি ঘামের চোটে কাপড় চোপড় সব ভিজে উঠেছে। একবার মনে হলো আশে পাশে কোন পুকুর থাকলে দৌড় গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব। কিন্তু সেই পাকা বাড়িতে পুকুর পাব কোথায়। একটুপরেই সব সমস্যার সমাধান হলো এক বৃদ্ধা মহিলার ডাক শুনে। আমার হাত ধরে সেই বদ্ধ ঘরটা থেকে বের করে নিয়ে গেল। সেই মহিলা দেখতে অনেকটা তোমার মত ছিল, তবে তুমি না।
কোথায় নিয়ে গেল? সারেফুন্নেসা হাবিবের আরেকটু কাছাকাছি এসে বসল।
সেটাই বলছি শোন। জনাকীর্ণ সেই হল ঘরটা পার করে আমাকে একটা বাথরুমের সামনে এনে দাঁড় করালো। হাতে একটা লুঙ্গি আর একটা গামছা ধরে দিয়ে ভিতরে ঢুকতে বলল। আমি ভাবলাম, গোসল শেষে এতগুলো মানুষের সামনে আমি লুঙ্গি পড়ে হাঁটাহাঁটি করব কেমন করে। কথাটা মনে হতেই সমস্ত গা জুড়িয়ে গেল। আমি সেই বৃদ্ধা মহিলাকে বললাম,
আমার গোসল লাগবে না।
লাগবে না কেন? বৃদ্ধা মহিলা চোখ গরম করে আমার দিকে তাকাল।
আমি গলার সুর নরম করে বললাম, আমার গা ঠা-া হয়ে গেছে।
তাতে কী হয়েছে। গা গরম হতে তো বেশি সময় লাগবে না! নাকি লাগবে?
বৃদ্ধা মহিলা এবার সত্যি সত্যিই রেগে গেল। আমি কিছু না বুঝেই মাথা নাড়লাম। এরপর সে আমার আর কোন কথাই শুনল না। জোর করে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিল। ভিতরে ঢোকার পর আমি বাইর থেকে দরজা আটকানোর শব্দ পেলাম।
তারপর কি হলো? হাবিরের দাদির আগ্রহ একলাফে তিনগুণ বেড়ে গেল।
ভিতরে ঢোকার পর আমার নড়াচড়া একরকম প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। বাথরুমের চারপাশের দেয়ালে আয়না লাগানো। মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতেই আমার অসংখ্য প্রতিবিম্ব ভেসে উঠল। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছে। সেই হাসি দেখে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল।
হাবিব আরেকবার ঢোক গিলে বিছানার উপর উঠে বসল। তার দাদির কাছে আরেকটু সরে গিয়ে আবার শুরু করল।
বাথরুমের ভিতর থেকেই বাহিরের অনেকের অস্পষ্ট কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। আগের ভয়টা কমতে বেশি সময় লাগল না। এরপর কাপড় চোপড় খুলে দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করলাম।
সারেফুন্নেসা হাবিবকে আবারো থামিয়ে দিল। তুই ভিতর তেকে দরজা আটকালি না?
নাহ্। স্বপ্নের কথা, এত কিছু খেয়াল ছিল না।
আচ্ছা ঠিকআছে। তারপর কী হলো?
আমার গোসল শেষ হওয়ার পর ওপাশ থেকে দরজা খোলার শব্দ পেলাম। বাহিরে এসে আমিতো পুরোপুরি থ হয়ে গেলাম। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমার দাদা। সুঠাম দেহ। কি সুন্দর চেহারা!
কথা বলা থামিয়ে হাবিব তার দাদির দিকে আড় চোখে তাকাল। সারেফুন্নেসা কথা শোনার পাশাপাশি এখন গিলতে শুরু করেছে।
আমিতো দাদাকে প্রথমে চিনতেই পারিনি। আমার সাথে কথা বলার পরই চিনতে পারলাম। কথা বলতে বলতে আমরা হল ঘরটা পার হয়ে হাঁটতে লাগলাম। তারপর এ গলি সে গলি শেষ করে একেবারে বাইরে চলে আসলাম। আমি মোটামুটি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ এ অবস্থায় একজন মহিলা মানুষের কাছে থাকার চেয়ে একজন পুরুষ মানুষের কাছে থাকা অনেক নিরাপদ। তাও আবার যে সে পুরুষ না, আমার নিজের দাদা।
এরপর কোথায় গেলি?
এরপর মনে হলো আমরা একটা প্রকা- বাড়ি পিছনে ফেলে সামনে পা চালাতে শুরু করেছি। বাড়িটা দেখতে অনেকটা রাজবাড়ির মতই। আমরা বের হয়েই একটা সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তাটা একেবারে নির্জন। দুই পাশে হরেক রকমের গাছপালা। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে দাদা আমার সাথে অনেক গল্প করল। প্রথমে শুরু করল...
আমার কথা কিছু বলেছে? হাবিবকে থামিয়ে দিয়ে সারেফুন্নেসা মাথাটা উঁচু করে ফেলল।
হাবিব ঠোঁটের কোনায় হাসি লাগিয়ে মুখ খুলল, প্রথমে তোমার কথাই জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম, ভালো আছে। তারপর তোমাকে সালাম জানাল।
কথা শেষ করেই হাবিব বালিশে মাথা লাগিয়ে শুয়ে পড়ল। সারেফুন্নেসা চট করে সেদিকেই তাকাল।
আর কিছু বলেনি?
হাবিব চোখ দু’টা বন্ধ করে একটা লম্বা হাই তুলল। দাদি, খুব ঘুম পাচ্ছে। শেষ অংশটা রাত্রে শেষ করব।
হাবিবের দাদি একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখার অনেক চেষ্টা করেও পারল না।
সারেফুন্নেসা ঘর থেকে চলে যাওয়ার পর হাবিব বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। চুপচাপ জানালার পাশে বসে খোলা আকাশের দিকে তাকাল। সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে অসংখ্য সাদা রঙের ভেলা। হাবিব পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোন ভেলা দেখতে অনেকটা ঘোড়া গাড়ির মত। কোনটা দেখতে আবার সাজানো গোছানো একটা ছোট্ট ঘরের মত। ঘরটা ছোট হতে হতে পালকির মতো হয়ে গেলো। পালকির দরজার ফাঁক দিয়ে এখন একটা সুন্দর মুখ দেখা যায়। সুন্দর মুখ সহ পালকিটা ধীরে ধীরে পালিয়ে যাচ্ছে।
রাতের বেলা সারেফুন্নেসার সাথে হাবিবের আবার দেখা হলো। রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে ঠিক সেই সময় তার দাদি এসে ঘরে ঢুকল। তবে স্বপ্ন বাদ দিয়ে সে শুরু করল ব্যবসা দিয়ে।
তোর ব্যবসা নিয়ে চিন্তা ভাবনা কতদূর এগুলো?
এইতো, পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছি।
এই পরিকল্পনা কি কখনো শেষ হবে?
হতে পাওে, আবার নাও পারে।
তোর পরিকল্পনাটা কি শুনি?
সে এর কোন উত্তর দিল না। আবারো সেই কৃত্রিম হাসিটা তার দাদির চোখের সামনে ধরে নিঃসংকোচে মুখ খুলল।
দাদি, তোমাকে স্বপ্নের শেষ অংশটাতো বলাই হয়নি। হাবিব একটু চিন্তা করে নিয়ে শুরু করল।
যেখান থেকে শেষ করেছিলাম। দাদা আর আমি সেই গাছপালার ভিতর থেকে বের হয়ে এবার পিছন দিকে আসতে শুরু করলাম। কিছুদূর আসার পর হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলাম। কারণ আমি তখন তাকিয়ে আছি যে বাড়িটা থেকে বের হয়ে এসেছিলাম সে বাড়িটার দিকে। ঐ বাড়িটা হলো আমার দাদার সেই বাড়ি । আমার দাঁড়িয়ে থাকা দেখে দাদা পিছনে ফিরে একবার মুচকি মেরে হাসল। তারপর আমার হাতটা টেনে নিয়ে সামনে এগুতে লাগল।
হাবিব কথার ফাঁকে একবার তার দাদির দিকে তাকাল। দেখল, তার দাদি কথার মাঝে একেবারে ডুবে গেছে।
এরপর বাড়ি ভর্তি লোকজনদের পাশ কেটে, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে আমরা দুজন একেবারে তিন তলায় গিয়ে পা রাখলাম। তারপর ডানে বামে কয়েক ধাপ পা চালিয়ে একেবারে কোণার সেই ঘরটায়, মানে যে ঘরে দাদা থাকত সেই ঘরে গিয়ে থামলাম।
আমাকে ঘরের ভিতর রেখে দাদা বাইরে চলে গেল। এরপরই শুরু হলো সেই পুরাতন যন্ত্রনা। একজন দুজন করে আবারো ঘরটা ভরে উঠতে লাগল। সবাই হাসি মুখে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু আমি তাদের সাথে তাল মেলাতে পারছি না।
হাবিব কথা থামিয়ে সশব্দে হেসে উঠল। সারেফুন্নেসা হাবিবের এ হাসির মানে ঠিক ধরতে পারল না।
এভাবে অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। হঠাৎ একসময় দেখি সবাই হুরমুর করে একসাথে বাইরে চলে গেল। ব্যাপার কী? একটুপরেই দাদা এসে ঘরে ঢুকল। তার হাতে এক গাদা কাপড় চোপড়। সবগুলোই নতুন। সেগুলো খাটের উপর রেখে আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসল।
তাড়াতাড়ি কাপড়গুলো পড়ে ফেল।
আমি একটু নড়েচড়ে উঠলাম। এসব কাপড় পড়ে কি হবে?
কি হবে, সেটা না পড়লে কেমন করে বুঝবি।
দাদা মনে হয় একটু রেগেই গেল।
হাবিব এবার পুরোপুরি চুপ মেরে গেল। তার দাদি অবশ্য চুপ থাকতে পারল না।
তুই কাপড়গুলো পড়লি না?
আমার এত কিছু মনে নেই দাদি। এরপর মনে হলো আমি সেই বাড়িটা থেমে বের হয়ে এসেছি। একটা সরু রাস্তা দিয়ে সামনে হেঁটে যাচ্ছি। যে রাস্তার শেষ মাথায় দাঁয়িয়ে আছে একটা ঘোড়া গাড়ি। গাড়িটা শত শত রঙিন ফুল দিয়ে সাজানো। আামার পিছনে অনেকেই হাঁটছে , কিন্তু আমি সেদিকে তাকানোর সাহস পেলাম না।
তোর দাদা কোথায় গেল?
হাবিব একটু থেমে আবার শুরু করল।
সেই সরু রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ একা একা হাঁটার পর হঠাৎ আমার পিঠের উপর কেউ একজন হাত রাখল। আমি দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর দেখি দাদা আমার ডান হাতের ভিতর একটা মেয়ে মানুষের হাত তুলে দিয়েছে। তারপর...।
তারপর কি? হাবিব থেমে গেলে সারেফুন্নেসা উৎসুক হয়ে উঠল।
তারপর আমার হাত পা কেমন জানি শিরশির ...
থাক আর বলতে হবে না। স্বপ্নটা তুই কখন দেখেছিস?
ফজরের সময়, ডান কাতে। হাবিব বিছানায় শুয়ে পড়েও তার মুখের হাসিটা ধরে রাখল।
অনুমান করতো দাদি মেয়েটা কে হতে পারে?
সারেফুন্নেসা বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, অনুমান করতে পারি না । আমার অনুমান শক্তি খুবই খারাপ।
হাবিব লম্বা চওড়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সকালে চোখ খোলার পর জানতে পারল তার দাদি বাড়িতে নেই।
সারেফুন্নেসা বাড়ি থেকে বের হলো রবিবার সকালে, আর ফেরত আসল বৃহস্পতিবার রাতে। বাড়িতে এসেই হৈ চৈ শুরু করে দিল। সবাই মোটামুটি বাধ্য হয়েই তার সবকিছু মেনে নিল। কারণ তার হৈ চৈ-এ বাধা দেওয়ার মত সাহস এ বাড়ির কারোরই নেই।
শুক্রবার সকাল বেলা হাবিব তার পরিবারের সবার সাথে এসে পৌঁছল তার দাদার বাড়িতে। গাড়ি থেকে নামার পরই দেখল এরি মধ্যে বাড়িতে অনেক মানুষের সমাগম হয়েছে। সবাই মিটমিট করে তাকাচ্ছে হাবিবের দিকে।
দুপুর বেলা হাবিব একবার রেণুমার সাথে দেখা করল। রেণুমাকে ঠিক এক বছর আগে যে প্রশ্নটা করেছিল সেই একি প্রশ্ন আবার করল।
কেমন আছো?
ঠিক এক বছর আগে রেণুমা যে উত্তর দিয়েছিল সেই একি উত্তর দিল।
ভালো না।
উত্তর শুনে হাবিব ছোট্ট করে একটা হাসি দিল। হাবিবের হাসি দেখে হাসল রেণুমা।
বেলা প্রায় শেষ। শুভ কাজে দেরি করতে হয় না, দেরি হলোও না। সারেফুন্নেসা হাবিব আর রেণুমাকে সাথে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসল। তাদের পিছনে আসল আরো অনেকেই। সবাই বাড়ির সামনের সরু রাস্তাটা ধরে হাঁটছে। সরু রাস্তায় শেষ মাথায় একটা ঘোড়াগাড়ি দেখা যাচ্ছে। গাড়িটা শত শত রঙিন ফুল দিয়ে সাজানো। রেণুমা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হাবিবের শক্ত হাতে হালকা করে একবার চাপ দিল।
গাড়িটা দেখতে সুন্দর না?
হুঁ।
হাবিব মাথা নাড়ে। তবে মনে মনে ভাবে অন্য কথা। এই দুনিয়ায় সুন্দরের সর্বজন স্বীকৃত কোন সংঙ্গা নেই। যে জিনিস একজনের কাছে অতি সুন্দর সেই একি জিনিস হয়ত অন্যজনের কাছে অতি কুৎসিত।
সে রাতের স্বপ্নের কথাটা হাবিবের আবারো মনে পড়ে। হঠাৎ তার ভিতর দিয়ে একটা শিহরণ খেলে যায়। হয়ত তার এই শিহরণে একটা তুফান উঠতে পারত, যদি সেই স্বপ্নটা সে সত্যি সত্যিই দেখত!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:৪৭