somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জিঘাংসা

০৩ রা জুন, ২০১৭ রাত ৮:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


রাত এখনো গভীর হয়নি।
রতনের ছোট চাচা এসে রতনের বাবাকে শাসিয়ে গেল, সব কাহিনী এখনই শেষ করতে হবে!
সে আর এখন কাউকেই তেমন ভয় পায় না। আকার ইঙ্গিতে এর কারণটাও বুঝিয়ে দিল। তার শশুর বাড়ির লোকেরা, সবাই নাকি বাঘা বংশের মানুষ!
রতনের বাবা, মাহতাব আলি অবশ্য এসব কথায় তেমন কোন গুরুত্ব দিল না। এমন কথা সে এর আগেও কয়েকবার শুনেছে। তবে ছোট ভাইয়ের এরকম আচরণ এর আগে কখনও দেখেনি। তার কিছুদিন আগের সন্দেহটা কেন জানি সতেজ হয়ে উঠল। রতনের দাদাকে হয়ত মাহবুবই মেরে ফেলেছে। সবাই হঠাৎ উৎসুক হয়ে উঠল, কেমন করে?
বালিশ চাঁপা দিয়ে।
রতনের আগ্রহ আরো খানিকটা বেড়ে গেল, মেরে ফেলল কেন?
মাহতাব আলি এর কোন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না।

রতন, মাহতাব আলির একমাত্র ছেলে। এ পাড়ায় তার মত ভাল ছাত্র খুব কমই আছে। শুধু ভালো রেজাল্টের কারণেই নয়, এলাকায় তার মত ভালো ছেলে খুঁজে বের করতে হলে পরিশ্রম করতে হবে।
এক কথায়, রতন সাধারণ কেউ না। সে সবার থেকে আলাদা।
অতি আগ্রহী প্রতিবেশিরা অবশ্য এতটুকুতেই সন্তুষ্ট হয় না। তারা আরো কিছুটা জানতে চায়। ছেলেটার মাথায় মনে হয় একটু সমস্যা আছে। ঠিকমত কথাবার্তা বলে না।
শুধু রতনের মা ভাবে একেবারেই অন্য কথা। সে ঠিকমত কথা বলে না তো কি হয়েছে? সে তো সবার কথাই মনোযোগ দিয়ে শোনে। তার কান দুটা নাকি খুবই পরিষ্কার।
এই কথা সত্য, তবে শতভাগ না। রতন কেবল একজন মানুষের কথাই পুরো মনোযোগের সাথে শোনে। এ মানুষটা হলো তার বাবা। মায়ের চেয়েও তিনগুণ বেশি ভালোবাসে সে তার বাবাকে। শুধু বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না বলেই কলেজ হোস্টেল বা কোন মেসে ওঠেনি। বেশ বাবাভক্ত ছেলে রতন।

পরদিন, সকালবেলা।
রতন বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। গতকালের মত আজও হাঁটছে বেশ ধীর পায়ে। কারণ, কলেজ বাস আসার এখনো দেরী আছে। যে বাস কখনও তার মিস হয় না।
তবে আজ কয়েক ধাপ যাওয়ার পরই একটু থামল। দেখল, রিনিও ওবাড়ি থেকে বের হয়েছে। পাশাপাশি বাড়ি তাদের। কিন্তু আজকাল প্রায় প্রতি সকালেই তাদের দেখা হচ্ছে। এবং মেয়েটা কেমন ফ্যালফ্যাল তাকায় তার দিকে। অবশ্য সে এর মাঝে অস্বাভাবিক কিছু খুঁঝে পায় না। ব্যাপারটা তার কাছে সেই ছোটবেলার মতই মনে হয়। তবে রিনি আর আগের মত ছোট নাই। পাড়ার স্কুলে কøাস নাইন-এ পড়ে সে।
রতন নীরস গলায় ডাক দেয়, আয়, একসাথে যাই।
রিনি স্বাভাবিক সংকোচ নিয়ে এগিয়ে যায়।
কিছুদূর যাওয়ার পর সে আরেকবার তাকায় রতনে দিকে, সেই আগের মত করে। রতন এ চোখের ভাষা বুঝতে না পারলেও এবার আর তাকে উপেক্ষা করতে পারে না। জিজ্ঞেস করে, তারপর, তোর পড়াশোনার খবর কী?
ভালো।
সংক্ষিপ্ত উত্তর শেষ করেই রিনি মাথা নিচু করে ফেলে। আরেকবার তাকানোর ইচ্ছা থাকলেও আর কোন আগ্রহ সে পায় না।
রিনি রতনের একমাত্র চাচাতো বোন। যার শৈশব আর কৈশরের অনেক লম্বা একটা সময় পার হয়েছে শুধু রতনের হাত ধরে।

সে রাতের পর থেকে মাহতাব আলি কেমন জানি গম্ভীর হয়ে আছে। কারো সাথেই তেমন কোন কথা বলছে না। কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলেই রেগে যাচ্ছে। মেজাজটা চরম খিটখিটে হয়ে আছে তার। গত কয়েকদিন ধরে প্রায় সারা রাতই জেগে থাকে সে। খানিকক্ষণ এখানে সেখানে উদ্দেশ্যহীনভাবে পায়চারি করে। তারপর রাত গভীর হলে পুরাতন সব কাগজপত্র নিয়ে বসে। আশেপাশে কাউকে ভিড়তে দেয় না। তবে রতন মাঝে মধ্যে তার বাবার কাছে গিয়ে বসে। এই বোকা মেধাবী ছেলেটাকে মাহতাব আলি একটু বেশিই ভালোবাসে। কেন ভালোবাসে, সেটা সে নিজেও জানে না।
কিছুদিন পর, রতনের ছোট চাচা মাহবুব আলি আবারো আসে রতনদের বাড়িতে। তবে এবার আর ভিতরে ঢোকে না। পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দেয়, তাদের সম্পর্কটা খারাপের দিকে যাচ্ছে। সে বাইর থেকেই কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে চলে যায়, আমারে এতটা মূর্খ ভাবা তোমাদের কোনভাবেই উচিৎ হয়নি। আমার হাতে কি শক্তির অভাব? সব নিজ হাতে বের করে ফেলামু! শুধু সময়ের অপেক্ষা।

মাহবুব আলির মত তাদের পাড়ার অনেকেই ব্যাপারটা নিয়ে কম বেশি জানে। তারা জানে অনেকটা লোক-কথার মত। সব গল্পই মুখে মুখে শোনা। একজনের সাথে আরেকজনের গল্পের তেমন কোন মিল নাই। তবে মাহবুব আলির কাছে মনে হয়, এটা বোধ হয় নির্ভেজাল সত্য নয়। কিন্তু সে এখন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তা যা-ই হোক, সবকিছু নিজ হাতে বের করে ফেলবে। এ যন্ত্রণার অবসান দরকার তার।
প্রায় সত্যটা জানে মাহতাব আলি। ছোট বেলায়, এ গল্প সে তার বাপের কাছে শুনেছিল। একটা সোনার কলস! যে কলস নিয়ে তাদের পরিবারে কয়েকটা কলহের গল্পও আছে। যার সবগুলোই ভয়াবহ! এসবই তার নিজের কানে শোনা।
এসব গল্পের কিছুটা জানে রতনের মা। আর মায়ের কাছ থেকে জানে রতন। তবে একদিন রাতের বেলা, গল্প শেষে মাহতাব আলি আঁতকে উঠেছিল। কারণ এটা একান্তই তার নিজের গল্প। অন্যকে বলা কোন ভাবেই উচিৎ হয়নি। কারণ নিজের স্ত্রীও পর হয়ে যেতে পারে। এবং তা বিরল কিছু না।
মাহবুব আলির কাজকর্মে রতনের বাবার অস্থিরতা বাড়তেই থাকল। এখনতো তার সাথে নিকট আত্মীয়রাও পিছনে লেগেছে। মাহতাব আলিকে দেখলেই সবাই কেমন জানি মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সবাই মুখ ফুটে কথা বলতে শুরু করল। এবং এরা সবাই খুব ভদ্র ভাষায় বলে, এসব লুকায়ে থাকার মত জিনিস নয়।
এর মানে কী?
এর মানে হলো, এসব জিনিস নাকি লুকায়ে রাখা যায় না।
মাহতাব আলি গলা উঁচু করে জানিয়ে দেয়, আমি কিচ্ছু জানি না। সমস্ত বাড়ি ছেড়ে দিলাম। দরকার হলে খুঁজে দেখো।
প্রতিবেশিরা তখন অবশ্য খুঁজে দেখার কোন আগ্রহ দেখায় না। তাদের হাতে এত সময় নাই। তারা শুধু চায় গল্প করতে!
পুরাতন গল্পটা এরা আবার নতুন করে সাজায়। যে গল্পের সারকথা দাঁড়ায়, জিনিসটা মাহতাব আলির বাড়িতেই আছে। তারা প্রায় শতভাগ নিশ্চিত!

প্রতি রাতের মতো রতনের বাবা আজও তার চেয়ারে চুপচাপ বসা। টেবিলে ছড়ানো ছিটানো পুরাতন কতগুলো কাগজ। এর আগেও কয়েকবার দেখেছে। সবগুলোই জমি-জমা সংক্রান্ত। এতদিনেও এসবের ভিতর থেকে সে কিছু বের করতে পারেনি। বের হবে এমন কোন আশাও দৃঢ়ভাবে করেনি। তবে সব আশা সে এখনো ছাড়েনি।
কাগজপত্রের গাঁট ছেড়ে মাহতাব আলি এবার একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে সফলও হয়। তবে মাঝরাতে হঠাৎ রতনের ডাক শুনে ধরফর করে উঠে বসে। রতন ফিসফিস করে ওঠে, বাড়ির পিছনে একজন কোদাল হাতে দাঁড়ায়ে আছে।
মাহতাব আলি একলাফে বিছানা থেকে নেমে খোলা জানালার একাংশ দিয়ে বাড়ির পিছনে তাকাল। অনেক দূরে একটা কুপি বাতি জ্বলছে। নতুন লাগানো তাদেরই একটা আম গাছের নিচে। বাতিটার পাশেই একজন কোদাল হাতে দাঁড়িয়ে। তবে সে বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকল না। চারপাশ একবার দেখে নিয়ে, বিস্তর টানাটানি করে আমগাছটা উপড়ে ফেলল। তারপর কোদালের কাজ শুরু করল। লোকটার মাথা আর মুখ গামছা দিয়ে পেঁচানো । অবশ্য মাহতাব আলির চিনতে একটুও অসুবিধা হয় না যে এ তারই ছোট ভাই মাহবুব। যে সবকিছু নিজ হাতে বের করতে চায়।
মাহতাব আলি রতনের দিকে তাকাল। অদ্ভুতভাবে হাসার চেষ্টা করল, এতো পুরাই পাগল হয়ে গেছে!
রতন তার বাবার কথায় নীরবে সায় দিয়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল।

সকালে রিনির সাথে আজও রতনের দেখা হয়। তবে আজ তার মুখ মলিন। চোখ দুটাও ঠিক আগের মত নাই। রতন তাকে পাশ কাটিয়ে নিজের মত হাঁটতে থাকে। বুঝতে পারে তাদের পারিবারিক ঝামেলাটা খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। এত আপন চাচাতো বোনটাকেও আজ পর পর লাগছে। তবে কিছুদূর যাওয়ার পর দেখে, রিনি তার সাথেই হাঁটছে। আরো কিছুদূর যাওয়ার পর একটু অবাক হয়ে দেখে, রিনি তার হাত ধরে হাঁটতে চাইছে। চোখের চাউনি সেই আগের মত। যা বুঝার চেষ্টা রতন কোনদিনই করবে না। বরং সে একটু হাসার চেষ্টা করে, কীরে, চকলেট খাবি?
রিনি সাথে সাথেই তার হাতটা ছেড়ে দেয়।

রাত এখনো গভীর হয়নি।
মাহতাব আলি রতনের দাদার সেই পুরাতন বাক্সটা আবারো বের করে আনে। ভিতর থেকে এক গাদা কাগজপত্র বের করে টেবিলের উপর রাখে। এসব কাগজের সব লেখায় তার পরিচিত। কোন উপদেশ বাণী, কোন রহস্য ঘেরা কালির আঁচড়; এখনো সে খুঁজে পায়নি। এমনকি তার বাবাও না। মাহতাব আলির চোখ মুখ হঠাৎ লাল হয়ে ওঠে। দুই হাতে মাথার চুল খাঁমচি দিয়ে ধরে।
কিন্তু এতেও তেমন কোন লাভ হয় না।
রাত দশটা পঁচিশ। মাহতাব আলি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করল। সাথে নিল তার একমাত্র ছেলে রতনকে। নির্ভরযোগ্য কোন সূত্র ছাড়া এসব খোঁড়াখোঁড়িতে কোন কাজ হবে না। তার পূর্বপুরুষরা মূর্খ মানুষ ছিল না। মাথা না খাঁটিয়েই তাদের তিন পুরুষের সম্পত্তি বের করা প্রায় অসম্ভব।
মাহতাব আলি ঘরের মেঝের উপর বিছানা পেতে অস্থির হয়ে বসে আছে। তার সামনে রতন বসে আছে কোন কথাবার্তা ছাড়াই। তার ভিতরে উৎসাহ থাকলেও অস্থিরতা বলে কিছু নাই। সে বড় বাক্সের ভিতরটা আগ্রহ নিয়ে দেখা শুরু করল। একটুপর এর ভিতর থেকে আরেকটা ছোট বাক্স বের করে আনল। এটা কাঠের এবং বেশ পুরাতন। কিছুটা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী এটা?
কিছু না। ভিতরে রাখ।
রতন বাক্সটার ঝাপ খুলে কতগুলো জীর্ণ শীর্ণ কাগজ বের করে আনল। এরপর দেখল, তলায় কতগুলো পয়সা পড়ে আছে। এক পলক দেখলেই বুঝা যায়, এসব বেশ পুরাতন জিনিস। রতন পয়সাগুলো কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর একটা হাতে তুলে নিল। এরপর তার বাবার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা কি সোনার পয়সা?
আরে নাহ্, চান্দি।
রতনের আগ্রহ শেষ হয় না। মাহতাব আলি তাকে ব্যাপারটা সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দেয়। পয়সাগুলো অনেক দিন থেকেই তার কাছে আছে। পুরাতন জিনিস। উপরের মার্কার কোন মূল্য না থাকলেও ভিতরের জিনিসের কিছু মূল্য আছে। সেই মূল্য নাকি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।
দরজায় একবার সজোরে টোকা পড়ল। এরপরই তা সশব্দে খুলে গেল।
দরজার ওপাশে যে দাঁড়িয়ে আছে তার সমস্ত শরীর ঘেমে ধুয়ে পড়ছে। শ্বাস প্রশ্বাস কোনভাবেই স্বাভাবিক না। দরজা খোলার পর থেকেই চোখ দুটা বিস্ফোরিত হয়ে আছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটা হলো তার যে হাতটা কিছুক্ষণ পর পর কেঁপে উঠছে, সেই ডান হাতে একটা ধারালো কোদাল।
মাহতাব আলি বিস্ময়ভরা চোখে মাহবুুবের দিকে তাকিয়ে আছে। সে যে পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকেছে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। সে যে এখন অন্য একজনের বাড়িতে আছে সে হুশও তার নাই। মাহবুব কোদালটা একপাশে রেখে কাঠের বাক্সটার দিকে ঝুঁকে পড়ল। তাকে এখন মাথা খারাপ অসুস্থ মানুষের মত দেখাচ্ছে। একটা পয়সা হাতে তুলে নিয়ে প্রায় হুংকার দিয়ে উঠল, কী হচ্ছে এখানে?
কী...
রতনের বাবার কী দিয়ে শুরু করা একটা কথা মুখের ভিতরেই জড়িয়ে গেল।
মাহবুব আলি দাঁতের সাথে দাঁত চেপে ধরে তার শেষ কথাটা বলে ফেলল, তোমাদের সাথে আমার আর দেখা হচ্ছে না। যদি দেখা হয় তবে সেটাই হবে শেষ দেখা।
শেষ দেখা মানে?
প্রতুত্তরে মাহবুব আলি সব কাজগপত্র দু হাতে জড়িয়ে নিয়ে ছাদের দিকে ছুঁড়ে মারল। তারপর কোদাল হাতে হনহন করে বের হয়ে গেল।
মাহতাব আলি উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার বসে পড়ল। সে তার কাঁপতে থাকা পা দুটাকে কিছুতেই স্থির করতে পারছে না।
রতন বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে মেঝের উপর ছড়িয়ে পড়ে থাকা কাগজগুলোর দিকে। একটুপর একটা পুরাতন কাগজ নিজের দিকে টেনে নিল। এটা সেই কাঠের ছোট বাক্সটার একটা। খানিকক্ষণ তীক্ষ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, এটা কী?
মাহতাব আলি এক নজর দেখেই বিরক্ত হয়ে বলল, এটা জমির নকশার একটা কাগজ। অনেক পুরাতন নকশা। পুর্বপুরুষের জিনিস, তাই সখ করে রাখছি।
আমি জানি এটা একটা নকশা। কিন্তু এটা কি?
রতনের আঙ্গুল অনুসরণ করে তার বাবা নকশার উপর একটা কালির আঁচড়ের দিকে তাকাল। কিছু আঁকাআঁকির চেষ্টা করা হয়েছে। লেখাটা তেমন স্পষ্ট না বলে কোনদিন তার চোখে পড়েনি।
মাহতাব আলি নকশাটায় তাদের জমির আল ধরে এগোতে শুরু করল। একের পর এক জমি পার করে একেবারে শেষ মাথায় এসে থামল। শেষ মাথার জমিটা তিনকোনা, এবং বেশ ছোটখাটো। এটা তাদের মাঠের শেষের জঙ্গলটা। বহুবছর আগে থেকেই এ জমি তাদের পারিবারিক কবরস্থান। লেখার আঁচড়টা শুরু হয়েছে এই ত্রিভূজাকৃতির জমিটার মাঝখান থেকে।
আজগুবি আর অহেতুক এক আঁকাআঁকি। ত্রিভূজাকৃতির জমিটার মাঝখান থেকে একটা সরল রেখা বাহিরে ফাঁকা জায়গায় বের হয়ে এসেছে। সরল রেখার শেষ মাথাটা কালির ঘষা লেগে একটু ভোঁতা হয়ে আছে। খুব কাছ থেকে দেখলে মনে হবে, এটা একটা তীর চিহ্ন। যে তীরের মাথাটা শেষ হয়েছে ছোটখাটো একটা বৃত্তের কেন্দ্রে। বৃত্তটা দেখলেই বুঝা যায় এটা খুব দ্রুত এবং একটানে আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। শুরুতে কালির দাগ স্পষ্ট হলেও, শেষের দিকে প্রায় নেই বললেই চলে। এবং এই বৃত্তটাকে দুই পাশ থেকে চাপ দিয়ে ধরে আছে দুটা সমান আকৃতির আয়তক্ষেত্র। একটু দূর থেকে দেখলে শুধু বৃত্তের কেন্দ্রটাই চোখে পড়ে।
প্রায় জ্যামিতিক কর্মকাণ্ড। তবে রতনের বাবার কাছে এটা এক ধরণের খামখেয়ালি, পুরোটাই অর্থহীন।
মাহতাব আলি একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। গলা নরম করে বলল, তোর কাছে এটা কি মনে হয়?
আমার কিছু মনে হয় না।
রতনের কণ্ঠে অতিরিক্ত উৎসাহের সামান্য আঁচড়ও নাই।
মাহতাব আলি বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকে কাছে ডাকল। বলল, একটা কাজ করে দিতে পারবি।
পারব।
মাহতাব আলি তাকে ভালো কলে বুঝিয়ে দিল। মাহবুব ইদানীং একটু বেশি বেড়েছে। এসব গুজবে নিয়ে সে একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অথচ তার ব্যস্ত থাকার কথা ছিল নিজের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে। তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভাবনাতো এখনই ভাবতে হবে। টিউশন শেষে বিকেল বেলা মেয়েটা একা একাই বাড়িতে আসে।
রতন এসব কথার মানে বুঝতে পারে না। সে সোজা গলায় জিজ্ঞেস করে, আমাকে কী করতে হবে?
রিনিকে একটু ভয় দেখাতে পারবি?
পারব।
আমাদের করস্থানের জঙ্গলটার পাশ দিয়ে যখন বাড়ি ফেরে। তোকে যেন চিনতে না পারে। মাথা মুখ কিছু দিয়ে পেঁচিয়ে নিবি। পারবি না?
কোনদিন যাব?
কাল অথবা পরশু।
ঠিকআছে, কালকেই যাব।
তবে খবরদার, এসব কথা যেন কেউ না জানে। এমনকি তোর মাও না।
রতন রাজি হয়ে যায়। সে আর কিছুই জিজ্ঞেস করে না। আসলে কোন প্রয়োজন মনে করে না। তার বাবা তাকে কিছু একটা করতে বলেছে, সে অবশ্যই করবে। যথেষ্ট বাবাভক্ত ছেলে এই রতন।

পরদিন বিকেল গড়িয়ে গেছে। রতন অপেক্ষা করছে রিনির জন্য।
তাদের এই পারিবারিক কবরস্থান, একটা ভূতুরে জঙ্গল ছাড়া আর কিছু নয়। দিনের বেলাতেও এর ভিতরে ঢুকতে সাহসের দরকার হয়। তবে রতন এখন ভূত-টূত নিয়ে তেমন কিছু ভাবছে না। তার মাথা মুখ গামছা দিয়ে পেঁচানো। সে ভাবছে রিনিকে কিভাবে ভয় দেখানো যায়।
তার পিঠের স্কুল ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে দৌড় দেওয়া যায়।
না, এটা ছেলেমানুষি খেলা ছাড়া আর কিছুই না।
জঙ্গলের ভিতর থেকে বিকট শব্দে চিৎকার দেওয়া যায়।
এতে বোধ হয় তেমন কাজ হবে না। সে হয়ত চমকে উঠে দৌড় দিবে। কিন্তু ভয়টা আসলে পাবে না।
পিছন থেকে আচমকা ঝাপটে ধরলে কেমন হয়। তারপর জঙ্গলের দিকে কিছুদূর টেনে নিয়ে আবার ছেড়ে দেওয়া যায়।
হ্যাঁ, এটা করা যায়।
রতন জঙ্গলের পাশে একটা ঝোপের আড়ালে অপেক্ষা করতে লাগল। তার শেষ কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে আরেকবার ভাবল। এবং এ ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই সে রিনির দেখা পেল।
রতন টের পেল তার পা দুটা হালকা কাঁপছে। এরপর দেখল হাত দুটাও কাঁপছে। এর মানে কী? সে এবার সামনে তাকায়। রিনি পাশে কেটে চলে যাচ্ছে। এমনকি বেশ কয়েক ধাপ চলেও গেছে। তবে কী সে তার বাবা কথা রাখতে পারবে না?
অবশ্যই পারবে।
সে প্রায় দৌড় দিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসল। রিনি টের পেয়ে এবার পিছনে তাকায়। তবে ততোক্ষণে রতন তাকে ঝাপটে ধরেছে। সে চমকে উঠে শুধু একবার চিৎকার দেয়। এরপর শত চেষ্টা করেও গলা দিয়ে আর কোন শব্দ বের করতে পারে না।
রতন একটু অসুবিধায় পড়ল। সে চেয়েছিল রিনিকে পিছন থেকে ধরতে। সামনে থেকে তাকে জঙ্গলে টেনে নিতে বেশ ঝামেলা হচ্ছে। মেয়েটা একটু বেশিই ছটফট করছে। তবে তারপরও সে টানতে থাকে। তার ভিতরে একরকম জেদ চেঁপে যায়।
একটুপর রতন তার শরীরে নতুন কিছু টের পায়। যার কথা একটু আধটু শুনলেও খুব কমই ভেবেছে। সে রিনিকে আরো শক্ত করে বুকের সাথে চেঁপে ধরে। ব্যাপারটা তার ভালো না লাগলেও সে এটাকে খারাপ কিছু বলতে চায় না।
এরকম ভুলের শুরুটা ওরা করলেও শেষটা করতে হয় রতনদের।
এরপর আরো কতটা পথ সে রিনিকে টেনে নিয়ে যায়, এ খেয়াল তার থাকে না। টের পায় হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার পর। জড়ে উঠে সে এবার তাকে আরেকবার খুব ভালো করে দেখে। দেখে রিনি মাটি থেকে উঠে পড়ার জোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সে তাকে উঠতে দিচ্ছে না। কেন? এরপর সে এমন এক ভুল করে যার কথা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না!

খানিকবাদে রিনি উঠে দাঁড়াল। নিজের সবকিছু সামলে নিয়ে সে এবার উন্মাদের মত দৌড়াতে লাগাল। এবং জঙ্গল থেকে বের হওয়ার আগেই রতন তার কান্নার শব্দ পেল।
রতন তখনই উঠল না। সে খেয়াল করল, তার মুখে গামছার সে পাতলা আবরণ ছিল সেটা অনেক আগেই খসে পড়েছে! তার নিজেকে মনে হলো ফাঁসির দ-প্রান্ত এক খুনের আসামি। আশেপাশের সবুজ গাছপালা তার কাছে জীবন্ত দর্শকের মত মনে হলো। যারা সবাই তার দিকে তাকিয়ে ভূতুরে হাসি হাসছে। রতন মাথা নিচু করে ফেলল। দেখল একটা স্কুল ব্যাগ, একান্ত অবহেলায় মাটির উপর পড়ে আছে। রিনির ব্যাগ। যেন তাকে এখনি খাঁমচি দিয়ে ধরবে।
রতন সত্যি সত্যিই চমকে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে সে দৌড় দিতে চাইল। তবে কয়েক ধাপ যাওয়ার পরই আরেকবার হোঁচট খেল। মাথা ঠেকল শক্ত পাথরের গায়ে। উঠে দাঁড়িয়ে দেখল, বেশ বড় আকৃতির পাশাপাশি দুটা কবর। যার চারধার পাথর দিয়ে বাঁধায় করা। এ জঙ্গলে, এরকম করব সে এই প্রথম দেখছে।

রিনি দৌড় দিয়েছে বাড়ির দিকে। ভিতরের কান্না আরো ভিতরে চেঁপে রেখে সে অনেক কিছুই ভাবছে। এসব কথা কাউকেই বলবে না। এসব বলার মত কিছু না। কিন্তু সে স্বাভাবিক হতে পারছে না, কোনভাবেই দৌড় থামাতে পারছে না।
তবে বাড়িতে ঢোকার পর তার অগোছালো সব পরিকল্পনা নিমেষেই হারিয়ে যায়। সে হঠাৎ তার মায়ের কাছে ছুটে যায়। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করে। তবে এসব অল্প সময়ের জন্য।
কী হইছে রিনি?
এ প্রশ্ন শুনে রিনি আঁতকে ওঠে। সে একটা বিরাট ভুল করে ফেলেছে। তার হঠাৎ কেঁদে ওঠা কোনভাবেই ঠিক হয়নি। কারণ এ কান্নার কারণ সে কোনদিনই বলতে পারবে না।
কান্না থামিয়ে রিনি শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। সে এবার দৌড় দিল তার ঘরের দিকে। ঢুকেই দরজায় খিল লাগিয়ে দিল।
রিনির মা বন্ধ দরজায় কয়েকবার ব্যর্থ আঘাত করে হতাশ হলো। আহত মনে সে সবকিছুর কারণ জানতে বাড়ির বাইরে বের হয়ে আসল। তবে সেখানে খুঁজে দেখার মত কিছু পেল না। সে ফিরে গেল রিনির ঘরের দরজার সামনে।
দরজা আগের মতই বন্ধ। এবং রিনির কান্নাও থেমে গেছে। রিনির মা কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করে। না, কোন সাড়া শব্দ নেই। সে রিনির ঘুম ভাঙানো মত করে একবার ডাক দেয়। এরপর দরজার ধাক্কা দিয়ে একবার। তারপর কয়েকবার।
রিনির মা আবারো বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে। ঘরের পিছন দিকের জানালা দিয়ে ভিতরে তাকায়। এরপরই চিৎকার দয়ে ওঠে। রিনি সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে! সে একেবারেই থেমে গেছে!

সেই সন্ধ্যাবেলা আরো অনেকের সাথে রতনও আসল রিনিকে দেখতে। তবে সে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। কারণ সে খেয়াল করল, এখানে সেই একমাত্র ব্যক্তি যে কোনভাবেই কাঁদতে পারছে না।

বাড়ি ফিরে রতন মাথা নিচু করে তার বাবার সামনে দাঁড়াল। মাহাতাব আলি তাকে বুকের কাছে টেনে। বলল, কোন চিন্তা করবি না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আজকে আর বাইরে যাওয়ার দরকার নাই।
রতন খেয়াল করল, এই প্রথম তার খুব কান্না পাচ্ছে। তবে এ কান্না সে জোর করে দমিয়ে রাখল।
সেই সন্ধ্যারাতেই একটা কোদাল আর কুপি বাতি নিয়ে সে তাদের বাড়ির পাঁচিল টপকালো।

সেই কবরস্থানের জঙ্গলটার কাছাকাছি আসতেই রতন একবার পেঁচার ডাক শুনতে পেল। বড়ই অলক্ষণে এই ডাক। রতন একবার পিছনে ফিরে তাদের বাড়ির দিকে তাকাল। যতদূর চোখ যায়, জমাট বাঁধা অন্ধকার ছাড়া দেখার মত আর কিছু নাই।
জঙ্গলের ভিতর ঢুকেই সে বাতিটা জ্বালিয়ে নিল। কিছুদূর যেতেই কয়েকটা পাখি গাছের উপর থেকে ডানা ঝাপটা দিয়ে তার আগমনে সাড়া দিল। রতন দ্রুত এগোতে লগাল। তার হাতে সময় খুব কম। সামনে পিছনে অসংখ্য কবর। দু একটা ইট দিয়ে বাঁধায় করা, আর বেশির ভাগই ভেঙ্গে পড়েছে। সে তার হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিল।

রতন এখন দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের মাঝখানে, সেই পুরাতন কবরদুটার সামনে। আজ বিকেলেই যা সে প্রথমবার দেখেছে। এখানকার অন্য যে কোন কবর থেকে এদুটা খুব সহজেই আলাদা করা যায়। কারণ কবরদুটা পাথর দিয়ে বাঁধায় করা। রতন আরেকটু কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা দেখতে যেতেই গাছের উপর থেকে দুটা পেঁচা বিদঘুটে আওয়াজে একসাথে ডেকে উঠল। রতনের চমক লাগলেও ভয়টা আর পেল না।

রাত এখনো গভীর হয়নি।
মাহতাব আলি জমির নকশার সেই পুরাতন কাগজটা চোখের সামনে ধরে চুপচাপ বসে আছে। এসময় রতনের মা এসে জানাল, রতন এখনো বাড়ি ফিরেনি। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সে নকশাটার দিকে আবারো তাকাল। এবার তার চোখদুটা হঠাৎ জ্বলে উঠল। মনে মনে কাগজটাকে সে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়তে লাগল। সবশেষে দেখল তার শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে। মনে হয় কাগজটা ছিঁড়তে গিয়ে অনেক পরিশ্রম হয়েছে। অস্থিরতা কমাতে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তবে ঘরের বাইরে এক পা যেতেই থমকে দাঁড়াল।
দরজার ওপাশে রতন খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার গা ঘেমে ধুয়ে পড়ছে। হাতে পায়ে যেখানে সেখানে লেগে আছে কাঁচা মাটি।
তুই এত ঘেমে গেছিস কেন?
রতন এ প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে তার বাবার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। উত্তেজনায় তার ঠোঁট কাঁপছে, কলসটা পাওয়া গেছে!
রতনের বাবার ভিতরটা ঝিলিক দিয়ে উঠল।
কোথায় পাওয়া গেছে?
পরে সব বলব, এখন তাড়াতাড়ি চলো।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মাহতাব আলি বলল, তোর ছোট চাচার বাড়িতে পুলিশ আসছে! জানিস নাকি?
না।
তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলব।
রতনকে তেমন চিন্তিত মনে হলো না।

জঙ্গলে ঢোকার আগে রতন বাতিটা আবার জ্বালিয়ে নিল। তারপর তার বাবাকে নিয়ে ধীরে ধীরে পা চালাতে শুরু করল। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা পেঁচা বিশ্রি শব্দে ডেকে উঠল। রতনের বাবা মনে হয় একটু ভয় পেল। ধরা গলায় বলল, এটা পেঁচার ডাক না?
রতন হা না কোন উত্তরই দিল না। এ প্রশ্ন অপ্রয়োজনীয়।
রতন জঙ্গলের মাঝখানে এসে যেখানে বাতিটা রাখল সেখান থেকে সবকিছুই স্পষ্ট বুঝা যায়। মাহতাব আলি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক গর্তের দিকে। পাথরে বাঁধায় করা সেই কবর দুটার মাঝখানে একটা বৃত্তাকার গর্ত খোঁড়া হয়েছে। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। তাড়াতাড়ি গর্তটার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। রতন পাশ থেকে কুপি বাতিটা এগিয়ে ধরল।
প্রায় গলা পর্যন্ত খোঁড়া হয়েছে। গর্তের একেবারে মাঝখানে, ধাতব পৃষ্ঠে আলো পড়তেই তা চকচক করে উঠল। রতনের বাবা কোনরকমের দেরী করতে চাইল না। বাতিসহ প্রায় এক লাফে নিচে নেমে আসল। এরপর ধাতব পৃষ্ঠটা ভালো করে পরীক্ষা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাথা তুলে উপরে তাকিয়ে বলল, রতন, এটাতো পিতলের কলস। আমি জানতাম কলসটা সোনার।
সোনা ভিতরে আছে।
মাহতাব আলি তড়িৎ গতিতে মাথা নিচু করে ফেলল। সে এতক্ষণ খেয়ালই করেনি যে কলসটার মুখে একটা পিতলের বাটি দিয়ে ঢাকনা দেওয়া আছে। নিজেকে ভর্ৎসনা করতে করতে সে ঢাকনাটা সরিয়ে ফেলল। তারপর নির্দ্বিধায় ভিতরে ডান হাতটা ঢুকিয়ে দিল। একটুপর সে হাত যখন বের করে আনল, তখন দেখল তার মুঠোর ভিতরে উঠে এসেছে বেশ মজবুত কতগুলো সোনার গহনা এবং কয়েকটা স্বর্ণ মুদ্রা। সে ভালো করে পরখ করে দেখল। এবং তার কাছে সবকিছু খাঁটিই মনে হলো। কলসের ভিতরে সবকিছু রেখে দিয়ে সে আরেকবার মুঠো বাঁধল, এবার বেশ বড় করে। তারপর হাতটা বের করে আনার পর দেখল, সে আগের জিনিসই তুলে এনেছে। তবে আরো বেশি পরিমাণে।
বাতির আলোতে মাহতাব আলির চোখ দুটা খাঁটি সোনার চেয়েও বেশি চকমক করে উঠল।
আরো কিছুক্ষণ সোনার ঝলকানি দেখার পর সে এবার পুরো কলসটার দিকে নজর দিল। কলসটার মুখ ধরে প্রথমে আস্তে, তারপর একবার জোরে টান দিল। তবে যেরকম ভেবেছিল সেরকম কিছু হলো না। কলসটা তার হাতের সাথে উঠে আসল না। কপালের ঘাম মুছে সে আরেকবার সজোরে চেষ্টা করল। কিন্তু কোন লাভ হলো না। বাতিটা হাতে নিয়ে সে এবার চারপাশ ভালো করে দেখে নিল। কলসটার পেট পর্যন্ত তখনো মাটির নিচে। মাহতাব আলি চোখে একরকমের তিক্ত হতাশা। তার এই বোকা ছেলেটা এমন কেন?
কোদালটা কোথায় রাখছিস?
এইতো, আমার কাছে।
মাহতাব আলি মুহূর্তের মধ্যে উপরে উঠে আসল। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে লম্বা পায়ে রতনে দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। গর্তটা থেকে অল্প দূরেই দাঁড়িয়ে আছে রতন। এবং তার পাশেই আরেকটা গর্ত দেখা যাচ্ছে। রতনের বাবা ধীর পায়ে সেটার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। ভালো করে তাকিয়ে দেখে সেটা একটা কবর, একেবারে নতুন খোঁড়া হয়েছে। জঙ্গলের এক কোণা থেকে পর পর কয়েকটা পেঁচা ডাক দিল। মাহতাব আলি ভুরু কুঁচকে রতনের দিকে তাকিয়ে বলল, কে খুঁড়েছে এই কবর?
আমি খুঁড়েছি।
কিসের জন্য খুঁড়েছিস?
কেন, তোমার জন্য!
এর মানে কী?
প্রতুত্তরে রতনের চোয়ালের পেশিগুলা শক্ত হয়ে আসে, ভাসা ভাসা দুটা চোখ নীরবে জ্বলতে থাকে। সে তার ডান হাতে শক্ত করে ধরে থাকা ধারালো কোদালটা দুহাতের উপর তুলে নেয়। এসব ভুলের শুরুটা ওরা করে বলেই শেষটা করে এরা!
এরপর যা ঘটবে তা এ পাড়ার মানুষ যুগের পর যুগ মনে রাখবে।









সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৭ রাত ৮:২৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×