বাস্তবতার দীর্ঘশ্বাস!!!
(১)
কোথাও কেউ আছ নাকি? প্রশ্নের উত্তরে নীরব হয়ে থাকল পুরো ফ্ল্যাটটা।পুনরায় আরো একটু উচ্চ স্বরে ডাক দিলেন কামাল সাহেব। কিন্তু কারো কোন সারা-শব্দ আসল না।
কামাল সাহেব মধ্যবয়স্ক। বাঙ্গালী মধ্যবয়স্ক বললে চোখে যেমন ছবি ভেসে ওঠে তিনি অনেকটাই সেরকম।বয়স ৬৫ এর একটু এদিক-সেদিক। মাথার চুল পড়ে গেছে প্রায়,পেছনের দিকে কিছু বাদে।চোখে ভারী কাচের চশমা,বহুল ব্যবহারে বিক্ষত ফ্রেম। কাচা-পাকা দাড়িতে পাকাগুলো সগৌরবে নিজদের আধিক্য প্রকাশ করে চলেছে।
তিনি ডাকছিলেন কাউকে একটু পানি খাবেন বলে।বিছানা থেকে উঠে হেটে ডায়নিং রুম এ গিয়ে পানি খাওয়া তার জন্য বেশ কষ্টকর। শরীর তার না থাকার মত। আথ্রাইটিসের ব্যাথায় মাঝে মাঝেই ভয়ংকর কষ্ট হয়।ব্লাড প্রেসারটাও ইদানিং খুব বেড়েছে।সপ্তাহান্তে ইন্সুলিন পুশ-ইন করতে হয় চিনির দোষের কারণ।বন্ধু-বান্ধবরা স্বর্গবাসী হয়েছেন অনেকেই। তিনিও মাঝে মাঝে শুনতে পান শেষের ডাক, মনে হয় মৃত্যুদুত শিয়রে দাঁড়িয়ে বলছে,কামাল,যাবার সময় যে হয়ে এল।
কামাল সাহেব ব্যাথায় হাপাতে লাগলেন। কোনমতে আস্তে আস্তে বেসিনের কাছে গিয়ে আজলা ভরে পানি পান করলেন।এরপর ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে চোখ মুদলেন।
হঠাত গেট খোলার আওয়াজ পেলেন। স্কুলপড়ুয়া নাতিটি এসেছে স্কুল থেকে।দাড়োয়ান এর চিল্লানোর আওয়াজ কানে আসল তার, “প্রত্যেক দিন এমনে পারমু না।নিজের পোলারে নিজে স্কুল থেইকা আনতে পারে না?এই চাকরি ছাইড়া দিমু আমি। পাইছে আমারে,প্রত্যেক দিন লাটসাহেবের পোলারে স্কুল থেকে আনতে হইব!”
“দাদুভাই,কই তুমি? স্কুল থেকে আসলে বুঝি?” বিছনায় উঠতে উঠতে ব্যাগ্রস্বরে ডাক দিলেন।
নাতিটি কিছুক্ষণ পর এসে দরজায় দাড়াল।“দাদু,আমার একদম সময় নেই।স্যারের হোমটাস্ক করতে হবে,আর্ট স্কুলে যেতে হবে। ডাকাডাকি করে ডিসটার্ব করবে না।”বলেই ঝড়ের বেগে পালিয়ে বাচল যেন!
মনে মনে কিছুটা কষ্টই পেলেন কামাল সাহেব। তিনি বেশ বুঝতে পারেন, নাতিটি তাকে পছন্দ করে না। এরকমই একবার শুনেছেন অস্পষ্ট স্বরে নাতির মুখে পাশের রুম থেকে,কাজের মেয়েটাকে বলছে ‘ঐ অসুখের ডিব্বাকে আমার ভাল লাগে না।রুমে ঢুকলেই মনে হয় অসুস্থ হয়ে গেছি।’
(২)
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশে রাখা রবীন্দ্রনাথের বইটা টেনে নিলেন। মন আর বসল না। সাত –পাচ ভাবতে থাকলেন। হঠাত মনে পড়ল, সপ্তাহ খানেক আগে তার বন্ধুপুত্র রাহিতকে দেয়া কাজটার কথা। এই ছেলেটি তাকে বেশ পছন্দ করে,ভালবাসে।তাই কামাল সাহেবের মুখে এরুপ কাজের কথা শুনে কিছুতেই পারবে না বলতে লাগল প্রথমে। তার ছেলের সাথে কথা বলবে,সব ঠিক করে ফেলবে, এরুকম কাজ জীবন থাকতে সে করতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে সব কিছু ঠান্ডা মাথায় রাহিতকে বুঝিয়ে বললেন তিনি, রাহিতও কিছু কিছু জানত। অগত্যা রাজি হতে হল তাকে, রাহিত চলে যাবার পর কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল কামাল সাহেবের। কিন্তু সবার জন্য এই ভাল চিন্তা করে চেষ্টা করেছেন নিজেকে সামলাতে।
বিষয়টা আবার মনে পড়ায় আবার কষ্ট হতে লাগল তার।চোখ বুজে আসল আপনাপনি।
হঠাত লাফ দিয়ে উঠলেন যেন কাজের মেয়েটার চিতকারে।বুকের বাম পাশ চেপে ধরলেন, ব্যাথা অনুভব করছেন তিনি।
কাজের মেয়েঃ এই যে সাহেব,যান বাথরুমে যান। গরম পানি দিছি।ছাড়ের তো আবার গরম পানি ছাড়া গোসল হয় না। আর পারমু না পানি গরম করতে।এরপর খাইয়া আমারে উদ্ধার করেন।আবার শুইয়া আছেন? যান,যান।
কামাল সাহেবের মনে পড়ল তিনি কখনোই গরম পানি দিয়ে গোসল করেন না। কাল থেকে একটু জ্বর জ্বর লাগায় বলেছিলেন একটু গরম পানি দিতে।যাই হোক,মুখ ফুটে কিছু বললেন না।চুপচাপ উঠে গেলেন বাথরুমের দিকে।
ডাক্তার বলেছে, কয়েকদিন রুটি খেতে সবজি দিয়ে।খাবার টেবিলে এসে চোখ ফেটে পানি আসতে চাইল যান। ভাত ,ডাল, আলুভর্তা,কালকের বেচে যাওয়া গরুর মাংস রাখা ছিল ফ্রিজে-তাই গরম করে দেয়া। কোনমতে একটু ডাল দিয়ে কিছুটা ভাত গিলে নিয়ে রুমে আসলেন।বিছানায় বসতে বসতে মনে আসল স্ত্রীর কথা।
(৩)
গত বছর প্রয়াত হয়েছেন তিনি।তারা দুই বুড়োবুড়ি মিলে থাকতেন গ্রামে তাদের আধ-পাকা বাসায়। হঠাত স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বড় পুত্রের গলগ্রহ হতে বাধ্য হয়েছেন।ছোট পুত্র কানাডায় থাকে বউ নিয়ে।প্রথমে কিছুদিন ভালই চলছিল দিনগুলি। এরপর শরীরটাও খারাপ হওয়া শুরু করল,আশ-পাশের মানুষগুলিও বদলে যেতে থাকল।
ছেলেটা অনেক কিছু বুঝ দিয়ে গ্রামের বাড়ির জায়গা-জমি বিক্রি করে দিল।ছিলেন সরকারী মধ্য-আয়ের মানুষ।পেনসনের টাকাগুলির অধিকাংশই গেছে একমাত্র মেয়ের বিয়েতে, কিছু খরচ হয়েছে কানাডা যাওয়ার সময় ছেলের জন্য।বড় ছেলের বিয়েটা দিয়েছিলেন ঘটা করে-সেখানেও গেছে। যটসামান্য যা আছে, নিজের অন্তিম কাজের জন্য।
ছেলে-ছেলের বউ দুজনেই চাকুরী করে। বৌমার নিত্য লেগে থাকে পার্টি। বৌমা মেয়েটি খারাপ না। তার জন্য ফল-দুধ-ঔষধ কিনে আনে।মাঝে মাঝে ফোন করে খোজ নেয় কিছু লাগবে কিনা।কিন্তু অফিস, বাচ্চা,পার্টি,ঘোরাঘুরি মিলিয়ে মাঝে মাঝে মনেই পড়ে না শ্বশুরের কথা।ছেলে তো ইদানিং এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে বাবাকে।এমন একটা ভাব-দেখা হলেই বাবা বলে উঠবে এইটা লাগবে,ঐ টা লাগবে!
কামাল সাহেব বোঝেন সব। তার মন চিতকার করে বলে ওঠে ,বাবারে,আমার কিচ্ছু লাগবে না। খালি দুইটা ভাল ভাবে কথা শুনলেই আমার অন্তরটা শান্তি লাগে। আর কিছু না রে বাপধন।
কিন্তু মুখ ফুটে বলা হয় না। কিভাবেই বা বলবে? রাতের বেলা মাঝে মাঝে একসাথে খেতে বসা হয় তাদের।কিন্তু সবাই এত ব্যস্ত আর ক্লান্ত থাকে যে দুটো কথা বলা আর হয় না, বলতে ইচ্ছা করে না কি মনে করবে এই ভেবে।
ইদানিং তিনি খেতে বসলে নাতিটা বসে না ডায়নিং টেবিলে।বৌমা বকা দেয় বাচ্চাকে, ছি বাবা,এইসব কি?আমরা সবাই খাব একসাথে, ইত্যাদি,ইত্যাদি।কিন্তু অপারগ হতে হয়, ছেলে বলে,ওর আর কি দোষ!
কথাটার তীক্ষ্ণতা ঠিকই বিদ্ধ করে কামাল সাহেবকে। চুপ থাকেন তিনি। ইদানিং বুকের ব্যাথাটা বেড়েছে।ইউরিনারি ইনফেকশনটা ভাল হয়ে গিয়েছিল, আবার জাগি জাগি করছে।ইনসুলিন, প্রেসারের ঔষুধ, ইনফেকশনের ঔষধ তিনদিন হল শেষ হয়েছে।মুখ ফুটে বলা হল না যে ঔষধ শেষ হয়ে গেছে।মাঝে মাঝেই নিজের হাতের টাকা দিয়ে আনিয়ে নিতেন কাজের মেয়েটাকে দিয়ে।হাত ও এখন খালি। কাজের মেয়ের সাথে কথা বলতেও ভয় লাগে তার।
পরে রুমে এসে বুকটা ফেটে যায় কষ্টে;আর পারেন না সইতে।কি দোর্দন্ড পতাপেই না কেটেছিল আগের দিনগুলি।হাসি-আনন্দ-ভালবাসায় ঘেরা ছিল দিনগুলি।তবে এমন কেন হল?আর তো বেচে থাকতে ইচ্ছা করে না।কাতরস্বরে স্বর্গত স্ত্রীকে ডাকতে থাকেন,ওগো,আমাকে একলা ফেলে কেন গেলে? কাউকে পাঠিয়ে দাও না আমাকে নিয়ে যাক!আর পারি না গো,আর পারি না। চোখ জ্বালা করে উঠল তার।
হঠাত মুঠোফোনটা বেজে উঠল কামাল সাহেবের। রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ভেসে আসল রিহাতের কন্ঠ।
কামাল সাহেব চোখ খুলে ফেললেন।“কি বাবা,কি খবর?সব ব্যাবস্থা হয়ে গেছে? ধন্যবাদ বাবা,অসংখ্য ধন্যবাদ।টাকা যা দিয়েছিলাম হয়েছে ওতে? আচ্ছা,আচ্ছা।কালকেই? দুপুরে?আচ্ছা বাবা,তুমি এস।আমি প্রস্তুত থাকব।”
……………………………………
পরের দিন দুপুর বেলা। রিহাত গাড়ি নিয়ে এসেছে। সিড়ি দিয়ে নামছেন আস্তে আস্তে কামাল সাহেব।ভয়ানক কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। আর সামলাতে পারলেন না নিজেকে। চোখ দিয়ে ঝরতে লাগল অশ্রু।অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চশমাটিকে মুছতে মুছতে গন্তব্যের দিকে এক পা করে এগোতে থাকলে তিনি।
……………………………………..
কামাল সাহেবকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছেলে কাজের মেয়ের ফোন পেয়ে অফিস থেকে এসেছে।রাগত স্বরে বলতে লাগল,বুড়োর কান্ডজ্ঞান নেই?জ্বালিয়ে মারল। কই গেছে এই ভর দুপুরে?
বাবার রুমে ঢুকল সে । বিছানার উপর পড়ে থাকা খামটা দেখে ভুরু কুচকে গেল।খামটা তুলে নিয়ে ভেতর থেকে চিঠিটা বের করল,
“বাবা,খুব বেশী কিছু লেখার নেই।তোমরা অনেক ভাল থেক।দাদুভাইকে মানুষের মত মানুষ কর। বউমার দিকে খেয়াল রেখ।তোমরা ভাল থাকলে আমি যেখানেই থাকি অনেক ভাল থাকব।আমি আমার গন্তব্যে চলে গেলাম।কারো প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই।মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই দেখা হবে। তোমরা সুখে থাক। আর এই বুড়োর জন্য পারলে দোয়া কোরো।
-তোমার বাবা।
গন্তব্যঃ নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রম।”