somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লোকসাহিত্য

০৪ ঠা জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৩:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আবদুল্লাহ আল আমিন
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, আমাদের দেশটি মূলত গ্রামপ্রধান এবং সমাজটিও গ্রাম্য-সমাজ। এখানে নগরও ছিল, কিন্তু তার সংখ্যা খুবই কম। বাংলাদেশের গ্রাম মানে ‘স্থির, শান্ত ও অচঞ্চল’ গ্রাম। পরিবর্তনের প্রবল ¯্রােত বয়ে গেছে নগারিক জনজীবনের ওপর দিয়ে, বদলে গেছে নগরের রাজনীতি ও অর্থনীতির পরিকাঠামো, কিন্তু গ্রামীণ সমাজ শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে যেমন ছিল, তেমনটি রয়ে গেছে। ‘ হিন্দুযুগে ও মুসলমান যুগে রাজনৈতিক আঘাতে অথবা রাষ্ট্রিক বিপর্যয়ের ঝড়ঝঞ্ঝায় এই গ্রাম্য-সমাজের শান্তিভঙ্গ হয়নি অথবা তার একটানা সুস্থির প্রবাহে কোনো তীরভাঙা নতুন ¯্রােত সঞ্চারিত হয়নি। গ্রামের কৃষক, কারিগর, ব্রাহ্মণ- বৈদ্য-কায়স্থ ও অন্যান্য বর্ণের লোকরা বংশ পরম্পরায় কৌলিক বৃত্তি পালন করতো, কদাচ তার ব্যতিক্রম ঘটতো না । জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গ্রাম্য-মানুষের জীবন কয়েকটি নির্দিষ্ট ছন্দে ও সুরে বাঁধা থাকতো। এই ছন্দ ও সুর হলো কাস্টম বা সামাজিক প্রথা ও ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য,পুরুষানুক্রমিক ধারা।’ ( বিনয় ঘোষ : ‘বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা’। ঢাকা সংস্করণ, ২০০৩, পৃষ্ঠা : ৯-১০।) গ্রামীণ সমাজের শতকরা ৯০ জনই স্বল্পবিত্ত দরিদ্র কৃষক ও শ্রমশীল মানুষ। এই ৯০ ভাগই ‘লোক-সাধারণ’ এবং এদের প্রাত্যহিক জীবনাচরণই লোকসংস্কৃতি। তাই এ কথা বললে অতিশায়িত হবে না যে, বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস মূলত লোকজসংস্কৃতির ইতিহাস। প্রকৃতপক্ষে লোকজসংস্কৃতির মর্মমূলেই আবহমান বাংলা ও বাঙালির প্রকৃত পরিচয় ও ইতিহাস নিহিত আছে। লোকসংস্কৃতির স্মৃতি ও ছাপ এখনও নগরগুলো বহন করে চলেছে। বলতে প্রলুব্ধ হচ্ছি যে, আবহমান বাংলার গ্রাম ও তার সমাজ-সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে আধুনিক বাংলাদেশে ও বাঙালির ইতিহাস রচনা করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে আহমদ শরীফের ভাষায় বলা যায়:
‘বস্তুত বাঙালীর ইতিহাস লোকধর্মের, লোকায়ত দর্শনের, লোকসাহিত্যের, লোকশিল্পের, লোকসঙ্গীতের ও লোকবিশ্বাস- সংস্কারের ইতিকথারই অন্য নাম।’ ( বাঙলা, বাঙালী ও বাঙালীত্ব, পৃষ্ঠা:৯) হাজার বছরের প্রবহমান বঙ্গ-সংস্কৃতির সবচেয়ে উজ্জ্বলতর ধারা লোকসাহিত্য, যা গ্রামীণ জনজীবনের আনন্দ- বেদনা, সাহস-সংগ্রাম, উৎসব-পার্বণ নিয়ে রচিত হয়। এ সাহিত্যের ধারক-বাহক ও রচয়িতারা অধিকাংশই নিরক্ষর, অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক ও সামাজিকভাবে দীর্ণ। লোকসাহিত্য ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা রচিত হলেও এর লালনক্ষেত্র সমষ্টির জীবনচর্যায়। এজন্য লোকসাহিত্য সমষ্টির আবেগ, ঐতিহ্য, চিন্তা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে। অসংহত ও অপরিপরিশীলিত ভাষারীতি প্রয়োগ করে রচিত হলেও লোকসাহিত্যে শিল্পসৌন্দর্য, রস ও আনন্দবোধের ঘাটতি থাকে না। লোকসাহিত্য লোকসংস্কৃতির একটি জীবন্তধারা, এর মধ্য দিয়ে জাতির হৃদয়-স্পন্দন শোনা যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ একে ‘ জনপদের হৃদয়-কলরব’ বলে অভিহিত করেছেন। অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের প্রেরণা বাঙালি লোকসাহিত্যের মর্মদর্শন থেকে পেয়েছে। বাংলার লোকসাহিত্য কোনো ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি নয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মিলিত সাধনা ও কর্মপ্রয়াসের সোনালি ফসল। আবহমান বাংলার অতুল বৈভবম-িত লোকসাহিত্যের দিকে তাকালে মুগ্ধ ও বিস্মিত হতে হয়। লোকসঙ্গীত, লোকছড়া, গীতিকা, লোকাহিনী, লোকনাট্য, প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধাঁ প্রভৃতি শাখায় বিভক্ত আমাদের লোকসাহিত্য। উল্লিখিত শাখাগুলো আবার নানা উপবিভাগে বিভক্ত।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি যেমন কোনো অবিভাজ্য ও অখ- সংস্কৃতি নয়, বরং নানা ভাগে বিভক্ত, খ--বিখ-। এই খ-তা ও বিভক্তির ছাপ লোকসাহিত্যের বিস্তৃত অঙ্গনেও পড়েছে । ভৌগোলিক বিভাজন, ধর্ম- লোকাচার- জীবনাচরণের ভিন্নতা বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসাহিত্যের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লোকসাহিত্যের রয়েছে উল্লেখ করার মতো স্বাতন্ত্র্য ও ঐশ্বর্যম-িত বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশ প্রতিবেশ:
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল বলতে বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা জেলাকে বোঝায়। ভূপ্রকৃতি অনুসারে সমগ্র অঞ্চলটি মৃতপ্রায় গাঙ্গেয় বদ্বীপ হিসেবে পরিচিত এবং প্রাচীন পলি দ্বারা গঠিত। ভৌগোলিক অবস্থান ও নদী, নিসর্গ, প্রাকৃতিক পরিবেশ এ অঞ্চলের জনজীবন ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। বলা প্রয়োজন, মানুষের অন্তর্জীবন ও বহির্জীবন গঠনে পরিবেশ ও প্রকৃতি পালন করে অনন্য ভূমিকা। ‘জাতির মন ও চরিত্র গঠনেও প্রকৃতির প্রভাব ন্যূন নয়। ভূপ্রকৃতির রুক্ষতা অথবা রমনীয়তা, আবহাওয়ার শুষ্কতা অথবা আর্দ্রতা মানবদেহে ও মানবমনে গভীর প্রভাব মুদ্রিত করে।’ ( ওয়াকিল আহমদ : ‘বাংলার লোকসংস্কৃতি। ঢাকা, ডিসেম্বর ২০০৪,পৃষ্ঠা: ২৯)। পদ্মা, মাথাভাঙ্গা, গড়াই, ভৈরব, ইছামতি, চিত্রা,নবগঙ্গা, কপোতাক্ষ, মধুমতি, রূপসা, পশুর বিধৌত পললভূমি; কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা, মৃদু ও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু, সুন্দরবনের অবস্থান ও বৈচিত্র্যম-িত বৃক্ষরাজি, এবং পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া-মুর্শিদাবাদ-চব্বিশ পরগণার ভৌগোলিক সংলগ্নতা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন ,সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ভিন্নমাত্রিক বৈশিষ্ট্য দান করেছে। সাধক-দরবেশ, মহাজন, পির-ফকিরদের মানবিক চেতনার ও মরমি ভাবুকতা এ অঞ্চলের লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর ফেলেছে গভীর ছাপ। বৃহত্তর ফরিদপুরের মতুয়া সম্প্রদায়ের উদার অধ্যাত্মভাবনা, অবিভক্ত নদীয়ার কর্তাভজা, সাহেবধনী, বলরামী, খুশি বিশ্বাসী, ভগবানী, সখীভাবুক প্রভৃতি লোকধর্মের উদার-মানবিক ও দ্রোহী ঐতিহ্য এবং খান জাহান আলি, দরবেশ মেহের আলি, শাহ ফরিদ, রেজা শাহ চিশতি, সলেমান শাহ প্রমুখের সুফিবাদী দর্শন এ অঞ্চলের জনজীবনের গভীরে প্রবেশ করেছে প্রবলভাবে। এসব কারণে এ অঞ্চলে সমন্বয়বাদী মরমি ভাবনা খুব সহজেই প্রসারিত হয়েছে। ‘সমন্বিত ভাবনা বিস্তার লাভ করায় সত্যনারায়ণ অতি সহজেই সত্যপিরে রূপান্তরিত হয়েছে এবং সুফি সাধকেরা ধর্মীয় প্রচারের সাথে সাথে একটি সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে তুলেছিলেন।’ ( রমেশচন্দ্র মজুমদার : ‘বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ’। ২য় খ-। তৃ-স, কলিকাতা ১৩৮৫, পৃষ্ঠা : ২৩৪-২৩৫।) তাই বৈষ্ণব পদাবলী, বাউল গান, বিচ্ছেদি গান, এ অঞ্চলে অনায়াসে সৃষ্টি হয়েছে এবং এসব গানের সাথে যুক্ত হয়েছে ইসলামি সুফিবাদ। ‘ এখানে জীবনকে জানবার তীব্র বাসনা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা নিঃশেষিত হয়ে পড়ে।.... এখানে যে অধ্যাত্মবোধের জন্ম হয়েছে তা শাস্ত্রগত সংশয়ে নয়- এ অধ্যাত্মবোধ একান্তই লৌকিক।’ ( ড. আনোয়ারুল করীম : ‘বাংলাদেশের বাউল’। ঢাকা, জানুয়ারি ২০০২, পৃষ্ঠা : ৫১) এছাড়াও গাজী কালু-চম্পাবতীর উপাখ্যান, বনবিবি, বেদের মেয়ে, আলোমতি, মানিক পীরের গান, গাজির গান ও গুনাইবিবির ভাষা, ধ্বনি, কাহিনী ও বিষয় বৈচিত্র্যে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনমানস প্রসূত সংস্কৃতির পরিচয় বহন করছে। ভৌগোলিক কারণে এ অঞ্চলের কোনো কোনো এলাকার জনজীবন আরামপ্রিয় আবার কোনো কোনো এলাকার মানুষ নদীভাঙন ও বন্যার বৈরী প্রভাবে সাহসদীপ্ত-সংগ্রামী। এক সময় গান-বাজনা, যাত্রা-পাঁচালি, আসর-মজলিশ, উৎসব-পার্বণে এ অঞ্চলের মুখরিত থাকতো। বর্তমান জটিল জীবনপ্রবাহ ও নানামুখী প্রতিকূলতার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, তারপরও চিরায়ত গানের সব সুর-ছন্দ মুছে দিতে পারেনি বৈরী সময়, জনজীবনের প্রাত্যহিকতায় লোকসংষ্কৃতির কিছু কিছু ছাপ এখনও দৃশ্যমান।

লোকগান
‘ আমাদের এই গ্রামবাংলার মানুষেরা তাদের জীবনের দুঃখ- বেদনা-বিরহ-প্রেম-অভিমান ইত্যাদি সব মানবিক অনুভূতি যে সব গানের সুরে- কথায় প্রকাশ করে থাকেন তা-ই বাংলাদেশের লোকগান।’ ( সাইমন জাকারিয়া : ‘ বাংলাদেশের লোক সংগীত’। ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৩, পৃষ্ঠা : ১১)। বাংলাদেশের লোকগানের রয়েছে সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্যিক পরম্পরা। শুধু তাই নয়, বিষয় বৈচিত্র্য, ভাবৈশ্বর্য, ধ্বনি-মাধুর্য়, দার্শনিক গভীরতার দিক দিয়েও আমাদের লোকগান অত্যন্ত সমৃদ্ধ। জারি, সারিগান, গম্ভীরা, গাজিরগান, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, কবিগান, আলকাপ, ধুয়াগান, বিচারগান, কীর্তনগান প্রভৃতি গানের ধারা ও উপধারা নিয়েই বাংলার লোকগানের ভুবন। এই গানের মাধ্যমে বাংলার বৃহত্তর জনমানুষ খুঁজে পায় কর্মে অনুপ্রেরণা, ধর্ম-অধ্যাত্ম সাধনায় অনুরাগ, দুঃখ- বেদনায় সান্ত¦না, পালা-পার্বণের উচ্ছ্বাস। এ গান বাঙালির মনকে তৃপ্ত করে, ভাবলোককে করে শান্ত, সমাহিত ও সমৃদ্ধ। প্রখ্যাত ভাষাবিদ, মনীষী ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ লোকসংগীতকে লোকসাহিত্যের গুরুতপূর্ণ শাখা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘পল্লীর সাহিত্য সম্পদের মধ্যে এই গানগুলি অমূল্যরতœ বিশেষ। সেই জারিগান, সেই সারিগান, সেই ভাটিয়ালি গান, সেই রাখালি গান, মুর্শিদি, ঘাটুগান, ভাওয়াইয়া গান, গম্ভীরা গান- গানের এক অফুরন্ত ভা-ার পল্লীর ঘাটে- মাঠে ছড়ানো আছে। তাতে কত প্রেম, কত আনন্দ, কত সৌন্দর্য, কত তত্ত্বজ্ঞান ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। চাষি, মাঝি-মাল্লা, ফকির, বৈরাগী এরাই এর রচয়িতা।’ ( উদ্ধৃত : আশরাফ সিদ্দিকী : ‘ বাংলার লোক সাহিত্য’ , ১ম খ-। পৃ : ১)।
বাউল গান : অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলাকে বঙ্গীয় সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ‘কুষ্টিয়া দীর্ঘকাল নবদ্বীপের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের আওতায় ছিল।’ ( সুকুমার সেন :‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’, ১ম খ-। কলকাতা ১৯৭০, প-স, পৃ: ১১৩)। ১৯৪৭-সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে বিভক্ত হয়েছে নদীয়া জেলার ভুগোল, তারপরও কালের অভিঘাত সহ্য করে এর কিছু চিহ্ন অবিভক্ত নদীয়ার অংশ বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা বহন করে চলেছে। অবিভক্ত নদীয়ার সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রখ্যাত গবেষক ও প-িত ড. এনামুল হক বলেন,
‘বাঙ্গালাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র ছিল নদীয়া। এ জেলা হইতে জ্ঞানের কথা, শাস্ত্রের কথা জন্ম লইয়াছে, তেমন মর্মের কথা, প্রেমের কথাও জন্ম লওয়া নিতান্তই সম্ভবপর। সংস্কার-শৃঙ্খলাবদ্ধ বাঙ্গালাদেশের বিরূদ্ধে নদীয়ার চৈতন্যদেবই সর্বপ্রথম ভাববিদ্রোহী, তাঁহার এই বিদ্রোহের পর দেশের চক্ষু ফুটিল।’
লালন সাঁই, গগন হরকরা, পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ, কুবির গোঁসাই-এর মতো ভাববিদ্রোহীদের জন্ম ও সাধনক্ষেত্রও বৃহত্তর কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা তথা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিতে আক্রান্ত বাঙালি সমাজকে এই ভাবুক-মহাজনরাই মানবিক-মূল্যচেতনায় প্রবুদ্ধ করেন। প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত কুষ্টিয়া তথা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলি লোকসংগীত চর্চাতেও সমগ্র বাংলাদেশে একটি গৌরবম-িত আসনে অধিষ্ঠিত। ভাব ও বিষয় বৈচিত্রের নিরিখে এই গানের কোনো কোনো শাখা লৌকিক অধ্যাত্ম- চেতনাপুষ্ট সাধন-সঙ্গীত, আর অন্যগুলি লৌকিক জীবন-ঘনিষ্ঠ সাধারণ সঙ্গীত। অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তর নদীয়া জেলার বিভিন্ন লোকধর্ম ও লোকায়ত দর্শনের প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে এসব গান। বলা বাহুল্য যে, বাউল, বলরামি, কর্তাভজা, সাহেবধনী, খুশি বিশ্বাসী প্রভৃতি সঙ্গীতাশ্রয়ী লৌকিক ধর্ম-সম্প্রদায়ের উদ্ভব ও বিকাশ এ অঞ্চলে। আবার, লালন সাই (১৭৭৪-১৮৯০), পাঞ্জুশাহ (১৮৮১-১৯১৪), দুদ্দু শাহ (১৮৪১-১৯১৯) , পাগলা কানাই, জহিরুদ্দি শাহ, গগন হরকরা, আরজান শাহ (১৮৮৫-১৯৫৮), গোঁসাই গোপাল (১২৭৬-১৩১৯ বঙ্গাব্দ), বেহাল শাহ, শুকচাঁদ ফকির, অমুল্য গোঁসাই, খোদা বকসো শাহ, আব্দুল করিম শাহ, গোলাম ইয়াছিন শাহ, গোলাম ঝড়– শাহ, আজাদ শাহ, মাতু ফকির, আবদুর রব ফকির প্রমুখ বাউল সাধক, গায়ক ও পদকর্তার আবির্ভাব অখ- নদীয়ার কুষ্টিয়া এবং এর সংলগ্ন অঞ্চলেই। এজন্য উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘কুষ্টিয়া অঞ্চল কেবল ভৌগলিক সংস্থানের জন্যই নহে অন্যান্য বিশেষ কারণেও নদীয়া, যশোর ফরিদপুর, পাবনা প্রবৃতি জেলার কেন্দ্রস্থল। ঐ সমস্ত জেলার মুসলমান ও ফকির ও বাউলপন্থী হিন্দু বৈষ্ণব প্রভৃতির ধর্মসাধন বিষয়ে অনুপ্রেরণারও এটি একটি কেন্দ্রস্থল।.........কুষ্টিয়া অঞ্চল হইতেই এই ভাবধারা চতুস্পার্শ্ববর্তী জেলায় ছড়াইয়া পড়ে এবং অনেক মুসলমান হিন্দু বাউলের উদ্ভব হয়।’ ( উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য : বাংলার বাউল ও বাংলার বাউলগান, ২য় খ-। কলিকাতা, ১৩৬৪,পৃ: ২)। এ জন্য কুষ্টিয়া অঞ্চলকে বাউল সাধনার তীর্থস্থন হিসেবে গণ্য করা হয়। কুষ্টিয়ার নিকটবর্তী যশোর অঞ্চলও বাউল সাধনার জন্য বিখ্যাত। পাগলা কানাই, পাঞ্জু শাহ, জহিরদ্দী শাহ, ইদু বিশ্বাসের মত বিখ্যাত বাউল সাধক কবিদের জন্ম যশোর অঞ্চলে। এসব বাউল সাধকের গান দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লোক সাহিত্যের ভা-ারকে ঐশ্বর্যম-িত করেছে। তবে বাউল গানকে কোনোভাবেই বিশুদ্ধ লোকসঙ্গীতের ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। বাউল গান মূলত বাউল সম্প্রদায়ের সাধন সঙ্গীত। বাউলদের সাধন ভজন, অধ্যাত্মচেতনা, লোকাচার, জীবনচর্যা এ গানের মধ্যে দিয়ে মূর্ত হয়। বাউল গানের চর্চা আগেও ছিল, তবে লালন সাঁইয়ের মাধ্যমে বাংলার বাউল গানের ভা-ার সমৃদ্ধ হয়েছে। আখড়া, আশ্রম, সাধুসঙ্গে সাধক-মহাজনরা তাদের ‘আপন ভজন কথা’ এ গানের মাধ্যমে ভক্ত ও অনুরাগী মাঝে তুলে ধরে। কিন্তু এখন আর এ গান আখড়া আশ্রমের ক্ষুদ্র গ-ির মধ্যে সীমিত নেই, এ গান মজলিশ ও মধ্যবিত্তের অন্দর-মহলে ঢুকে পড়েছে। এই গানের ভাব-তরঙ্গ বাঙালিকে সর্বমানবের মঙ্গলচেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা, শোষণহীন ও জাতগোত্রহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখায়। একটি গানে উচ্চারিত হয়েছে।
‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে,/ যেদিন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান/জাতি গোত্র নাহি রবে।’
জাতি গোত্রহীন অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এভাবেই ব্যক্ত হয়েছে ‘মানুষ সত্যের উপাসক’ বাউলদের গানে। তারা গানের মাধ্যমে আনন্দ , কল্যাণ ও সত্যের আলোকে জীবনকে ভিন্ন মাত্রিক ব্যঞ্জনা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু দিন যায়, রাত যায়, কাল নিরবধি বয়ে চলে, কিন্তু তাদের স্বপ্নের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় না। তারপরও ফুরায় না জীবনের স্বপ্ন। তাই বাউল কণ্ঠে উচ্চারিত হয়:
‘রাখলেন সাঁই কূপজল করে আন্ধেলা পুকুরে/কবে হবে সজল বরষা রেখেছি সেই ভরসা।’
এ রকম অসংখ্য বাউল গানে ভরে আছে এ অঞ্চলের লোক সাহিত্যের ভুবন।
কবিগান : বাউল গানের মত কবিগানও বাংলাদেশের লোক সাহিত্যের একটি শক্তিশালী ধারা। কবিগানের ভাবৈশ্বর্য অবলম্বনে পল্লীকবি জসীমউদদীন অজ¯্র কবিতা ও প্রবন্ধ রচনা করেন। বাংলার এক ক্রান্তিকালে পলাশীযুদ্ধের পর কবিয়ালদের হাতে যে মৌখিক-সাহিত্য সৃষ্টি হয় তা-ই কবিগান নামে পরিচিত। প্রাচীন কবিয়ালদের মধ্যে গোঁজলা গুঁই (১৭৬০- ?) অগ্রগণ্য। তার চারজন শিষ্য হলেন- লালু, নন্দলাল, রামজী রঘুনাথ দাস ও কৃষ্ণচন্দ্র দাস ওরফে কেষ্টা মুচি। এ যুগের শ্রেষ্ঠ কবিয়াল রামবসু (১৭৮৬- ১৮২৮) ছিলেন রামজীর প্রশিষ্য। হরু ঠাকুরের (১৭৯- ১৮২৪) শিষ্য ভোলা ময়রা উনিশ শতকে কবিয়াল হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তার গানে শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসগর ভোলা ময়রার গানের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাকে জাগাতে যেমন রামগোপাল ঘোষের মতো বাগ্মী, হুতোম প্যাঁচার মতো আমুদে লোকের প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন ভোলা ময়রার মতো লৌকিক গায়কদের।’ ভোলা ময়রা নিজেকে হরুর চ্যালা হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব অনুভব করতেন। তার একটি গানে অবিভক্ত বাংলার গৌরবগাথা বর্ণিত হয়েছে :
‘ময়মনসিংহের মুগ ভালো, খুলনার ভালো কই।/ ঢাকার ভালো পাতাক্ষীর, বাঁকুড়ার ভালো দই।/ কৃষ্ণনগরের ময়রা ভালো, মালদহের ভালো আম। / উলোর ভালো বাঁদর পুরুষ, মুর্শিদাবাদের জাম।/ রংপুরের শ্বশুর ভালো, রাজশাহীর জামাই। / নোয়াখালীর নৌকা ভালো, চট্টগ্রামের ধাই ।।/ দিনাজপুরের কায়েত ভালো, হাবড়ার ভালো শুড়ি।/ পাবনা জেলার বৈষ্ণব ভালো, ফরিদপুরের মুড়ি।।/ বর্ধমানের চাষী ভালো, চব্বিশ পরগণার গোপ।/ গুপ্তিপাড়ার মেয়ে ভালো, শীঘ্র- বংশলোপ।।/ হুগলির ভালো কোটাল লেঠেল, বীরভূমের ভালো বোল। / ঢাকের বাদ্যি থামলেই ভালো, হরি হরি বোল।।’
ভোলা ময়রারর এই গান এক সময় মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। কবিয়াল হিসেবে ঠাকুর দাস সিংহ ও এন্টনি ফিরিঙ্গিও খুব জনপ্রিয় ছিলেন। কবিয়াল রাম বসু ও যজ্ঞেশ্বরীকে এ কালের বব ডিলান ও জোয়ান বায়াজের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তাদের প্রেম ও রোমান্স নিয়ে অনেক রসাল কাহিনী রয়েছে। এক আসরে ভোলা ময়রা যজ্ঞেশ্বরীর উদ্দেশ্যে বলছেন : ‘ তুমি মাতা যজ্ঞেশ্বরী, সর্ব কার্যে শুভঙ্করী।/ তোমার ওই পুরণো এঁড়ে রাম বোস ধনে।’ এন্টনি ফিরিঙ্গি ও যজ্ঞেশ্বরীর মধ্যে এক লড়াইয়ে যজ্ঞেশ্বরীর গানে প্রকাশিত হয়েছে বাঙালি নারীর মানসিক যন্ত্রণার চালচিত্র। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর বঞ্চণার মর্মবেদনা প্রকাশিত হয়েছে এভাবে :
আমায় বন্দি করে প্রেমে / এখন ক্ষান্ত হলে ক্রমে ক্রমে/ এখন অধিনী বলে ফিরে নাহি চাও/ ঘরের ধন ফেলে পরের ধন আগলে বেড়াও।’
রাম বসুর সঙ্গে এন্টনি ফিরিঙ্গির প্রায় লড়াই হতো । একদিন এক আসরে রাম বসু বললেন:
‘একবার বলো হে, এন্টনি আমি একটি কথা জানতে চাই,
এসে এই দেশে তোমার গায়ে কেন কুর্তি-টুপি নাই।’
তৎক্ষণাৎ এন্টনি ফিরিঙ্গি জবাব দিলেন :
‘এই বাংলায় বাঙালির বেশে আনন্দেতে আছি।/ হয়ে ঠাকরে সিংহের বাপের জামাই কুর্তি-টুপি ছেড়েছি।’
এন্টনি ফিরিঙ্গি ছিলেন কা-জ্ঞানসম্পন্ন প্রতুৎপন্নমতিত্বের অধিকারী বাকশিল্পী। এক আসরে রাম বসু বলছেন :
‘সাহেব, মিছে তুই কৃষ্ণপদে মাথা মুড়ালি।/ ও তোর পাদ্রী সাহেব জানতে পারলে মুখে দেবে চুনকালি।’
শান্তকণ্ঠে সেই আক্রমণের জবাবে এন্টনি ফিরিঙ্গি বলছেন :
‘ খ্রিস্টে আর কৃষ্টে কিছু তফাত নাইরে ভাই।/ শুধু নামের ফেরে মানুষ েেফরে এও কথা শুনি নাই।’
এই এন্টনি ফিরিঙ্গি পর্তুগীজ ছিলেন, কিন্তু বড় হয়েছেন কলকাতায়। তিনি সৌদামিনী নামক এক ব্রাহ্মণ কন্যার পাণি গ্রহণ করে গোদালপাড়ার কাছে এক বাগানবাড়িতে বাস করতেন। কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যযুগীয় কবিয়ালদের যুগবসানের পর আসে পূর্ববঙ্গীয় কবিয়ালদের যুগ । উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে পূর্ববঙ্গের কবিগানের ধারাকে জনপ্রিয় ও বলবান করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যশোরের বাগজয়পুর গ্রামের কবি রসরাজ তারকচন্দ্র সরকার ও হরিচরণ আচার্য। দুজনই সমসাময়িক, তবে তারক সরকার বয়সে বড়। তারকের বাবা কাশীনাথ সরকারও কবিয়াল ছিলেন। তার বংশগত পদবী কড়াল। তিনি অন্ত্যজ শ্রেণিভুক্ত ছিলেন বিধায় তিনি সুরকার থেকে সরকার পদবী ব্যবহার করেন প্রথম। তখন থেকে কবিয়ালরা বংশগত পদবি ত্যাগ সরকার পদবি ব্যবহার করতে থাকেন। তারক সরকার পূর্ববঙ্গের প্রায় সব জেলায় কবিগান করেছেন। তিনি গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দির হরি ঠাকুর প্রবর্তিত মতুয়া ধর্মের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন।
দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কবিগানে সাঙ্গীতিক কুশলতা ও নৈপুণ্য দেখিয়ে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে পাঁচু সরকার (উনিশ শতক), নড়াইলের তারকচন্দ্র সরকার(১৮৪৫-১৯১৪), বাগেরহাটের রাজেন্দ্রনাথ সরকার(১৮৯২-১৯৭৪), নড়াইলের বিজয় সরকার (১৯০৩-১৯৮৫), অশ্বিনী সরকার (১৮৭৭-১৯২৭) এর নাম উল্লেখ যোগ্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নড়াইলের তারকচন্দ্র সরকারের শিষ্য-পরম্পরার কবিয়ালগণ বিশ শতকে বৃহত্তর যশোর, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশালে প্রতিনিধিত্ব করেন। গোপালগঞ্জের হরিবর সরকার, মনোহর গোঁসাই (১৮৭৯-১৯৩৯), বাগেরহাটের অনাদিজ্ঞান সরকার, কামিনী সরকার প্রমুখ ছিলেন তারক সরকারের শিষ্য-পরম্পরায় কবিয়াল। কবিয়ালরা অধিকাংশই নিরক্ষর, কেউ কেউ স্বল্প শিক্ষিত। তবে তারা সমাজ-রাজনীতি মনস্ক, তত্ত্বজ্ঞান ও রসবোধসম্পন্ন। তারক সরকারের শিষ্য পরম্পরার কবিয়ালদের মধ্যে রাজেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন সমাজ সচেতন এবং ব্যক্তিগতভাবে নি¤œবর্গীয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের বর্ণাশ্রম প্রথা, ছুঁৎমার্গ, অস্পৃশ্যতা, জাতপাতের বিরুদ্ধে রাজেন্দ্রনাথ সরকার গান করেছেন বিভিন্ন আসরে। তার মালশি গানের একটি বিখ্যাত অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো:
‘কতো মদের নেশায় বদের দশায় ব্রাহ্মণ খায় বেশ্যাবাড়ির ভাত।/তাতে হয় না জাতি পাত, মাগো বেশ্যালয় কি ঠাকুর জগন্নাথ।।/ নটীর হুঁকার তামাক খেয়ে কুলীন কোলায় বাড়ি গিয়ে/ এসব ব্রাহ্মণ কেন প্রণাম দিয়ে নটীর পদে কোটি দ-বৎ।
রাজেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন একাধারে সুগায়ক, প্রতিভাধর বাদ্যযন্ত্রী, প্রত্যুৎপন্ন বাকশিল্পী। তিনি কলকাতার মানুষকে পূর্ববঙ্গের কবিগান শুনিয়েছিলেন কলকাতার আলবার্ট হলে। রাজেন্দ্রনাথ সরকারের প্রায় সমসাময়িক নড়াইলের বিজয় সরকারেরও কবিয়াল হিসেবে খ্যাতি ছিল বাংলার সারস্বত সমাজে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও সুকুমার সেনের মত প-িতরাও তার গানের প্রশংসা করেছেন। বিজয় সরকার কবিগানকে খিস্তি খেউড়ের ঘেরটোপ থেকে বের করে এনে শিল্পোত্তীর্ণ সঙ্গীতে রূপান্তরিত করেছেন। তার গান যশোর , খুলনা, কুষ্টিয়া অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে মানুষের মুখে মুখে গীত হয়। তার গানের কয়েকটি পঙক্তি এখানে উদ্ধৃত হলো:
‘এ পৃথিবী যেমনি আছে তেমনি পড়ে রবে,
সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে।’
অথবা
‘তুমি জান নারে প্রিয় তুমি মোর জীবনের সাধনা।/ তোমায় প্রথম যেদিন দেখেছি/মনে আপন জেনেছি।’
বিজয় সরকারের এ সব মর্মস্পর্শী গান গ্রামের সাধারণ মানুষের হৃদয়কে আজও নাড়া দিয়ে যায়। কবিয়াল বিজয় সরকার পল্লীকবি জসীমউদদীনের‘ নক্সী কাঁথার মাঠ’ কাব্যের মূল চরিত্র রূপাই ও সাজুর জীবনালেখ্য অবলম্বনে একটি অনবদ্য গান রচনা করেন। গানটি শুনেছিলাম ১৪২৩ বঙ্গাব্দে মেহেরপুর জেলার সাহারবাটী গ্রামের বর্ষবরণ উৎসবে বাগেরহাটের কবিয়াল শঙ্কর সরকারের কণ্ঠে। এই আসরে তার প্রতিপক্ষ ছিলেন অনাদিজ্ঞান সরকারের শিষ্য মীরা সরকার।
‘ নক্সীকাঁথার মাঠে রে / সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি ।/ তাদের আশার বাসা ভেঙে গেছে রে/ তবু যায়নি ভালবাসাবাসি।।/ সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি।/ কত আশা বুকে নিয়ে (তারা) বেঁধেছিল ঘর/ কত সুখে মিশেছিল মিলন-মঞ্চ ‘পরে/ হঠাৎ আসিয়া এক বৈশাখী ঝড় রে/ সে ঘর কোথা গেল ভাসি।। সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি।/... নক্সীকাঁথার মাঠে লোকে আজো শুনতে পায়/ সাজুর ব্যথায় রূপাই মিঞার বাঁশরি বাজায় / পাগল বিজয় বলে পরাণে চায় ওে / আমি একবার গিয়ে শুনে আসি।।/ সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিঞার বাঁশের বাঁশি।’ ( উদ্ধৃত: সাইমন জাকারিয়া: বাংলাদেশের লোকসংগীত’। ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৩। পৃ: ২০১-২০২)।
কবিয়াল বিজয় সরকার ছিলেন পল্লীকবি জসীমউদদীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পল্লীকবি বিজয়ের গান সম্পর্কে বলেছেন, ‘বিজয়ের রচিত বিচ্ছেদ গান শুনিয়া পাগল হই। এমন সুন্দর সুর বুঝি কেহই রচনা করিতে পারে না।’ ( জীবনকথা) জসীমউদদীন শৈশব থেকেই কবিগানের গুণমুগ্ধ ভক্ত। অল্প বয়সে নিজ গ্রাম অম্বিকাপুরের সন্নিকটবর্তী লক্ষীপুর গ্রামে কবিয়াল হরি আচার্যের কবিগান ও তার জ্ঞানগর্ভ কথার ঝলকানিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরিণত বয়সে তিনি হরি আচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেছিলেন, “আপনার রচিত নিমাই সন্ন্যাস গানটি যদি আগে শুনিতাম, তবে হয়তো আমার ‘কবর’ কবিতা রচনা করিতাম না। আপনার নিমাই সন্ন্যাস যে আসরে গীত হয়, সেখানে শ্রোতারা কাঁদিয়া বুক ভাসায়।” (পল্লীকবির জীবন কথা, পৃ: ১১২)
এ যুগে কবিগানের সেই জৌলুশ তেমন নেই, তারপরও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলির বিভিন্ন এলাকায় কবিয়ালরা কবিগানের আসর করে থাকেন। এখনও যারা কবিগানের সাথে যুক্ত আছেন, তারা হলেন : নড়াইলের নারায়ণ বালা, মীরা সরকার; খুলনার বটিয়াঘাটার সদানন্দ সরকার; বাগেরহাটের মনিশঙ্কর সরকার, শঙ্কর সরকার; মেহেরপুরের রমজান আলী বিশ্বাস, কমরউদ্দিন বিশ্বাস, চুয়াডাঙ্গার নুর ইসলাম প্রমুখ। কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলায় কিছু সংখ্যক কবিয়াল রয়েছে, যারা কবিগানের ঐতিহ্যবাহী ধারা অব্যাহত রেখেছেন।
জারিগান : কারবালার প্রান্তরে মহানবী (স.) এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন এবং তার বংশধররদের করুণমৃত্যু ও শোকাবহ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মীর মশারফ হোসেন রচনা করেন কালজয়ী উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’। সেই মর্মস্পর্শী ও হৃদয়বিদারক কাহিনী অবলম্বনে বাংলার লোককবি ও বয়াতিরা রচনা করেছেন জারিগান। এই গান বাংলার লোকসাহিত্যের এক অমুল্য সম্পদ। সতীশচন্দ্র মিত্র (১৮৭২-১৯৩১) বলেছেন, ‘....মুসলমানগণই এই গীতের পালক, গায়ক, রচক ও প্রচারক। জারীগীতের প্রবর্তকদিগের মধ্যে পাগলা কানাই প্রথম এবং ইদু বিশ্বাস দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী। যশোরের উত্তরাংশ অর্থাৎ ঝিনাইদহ ও মাগুরা মহকুমা জারীগানের পীঠস্থান।’ (সতীশচন্দ্র মিত্র : যশোহর-খুলনার ইতিহাস, ২য় খ-। দ্বি-স, কলকাতা, জুন ১৯৬৫, পৃ: ৮৮০)। জারিগান কারবালার ইতিহাসের ছায়া অবলম্বনে রচিত হলেও; এতে ইতিহাসের চেয়ে মানবিক উপলদ্ধি ও কল্পনা অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। ভাবুক-পদকর্তাদের শিল্প প্রতিভা ও রসগুণে জারিগান লোকসঙ্গীত তথা লোকসাহিত্যের এক অনন্য শিল্প মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। পাগলা কানাই, ইদু বিশ্বাস ছাড়াও এ অঞ্চলে জারিগান জনপ্রিয় করতে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন মাগুড়ার হাকিমচান বয়াতি (উনিশ শতক), নড়াইলের সোনাউল্লাহ বয়াতি (১৮৮০-১৯৬২), খুলনার ছায়েজউদ্দীন মোল্যাহ (১৮৮৫-১৯৬০), নড়াইলের রমজান মোল্যাহ (১৮৫২-১৯০৮),নড়াইলের মসলেম মোল্যাহ বয়াতি (১৩১০-১৩৯৪), নড়াইলের মওলান খাঁ (১৯০৩-১৯৮৩) । জারিগানের বর্তমান অবস্থা আগের মতো সমৃদ্ধ ও বিস্তত আকারে না থাকলেও ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা প্রভৃতি জেলায় জারিগানের ঐতিহ্য ম্লান হয়ে যায়নি। প্রতিবছর মহরম উপলক্ষে ওইসব অঞ্চলে জারিগানের আসর বসে।
অষ্টক গান : এ অঞ্চলের বয়াতি ও লোককবিরা কেবল দুঃখের গান বাঁধেননি, তারা দুঃখজয় ও প্রেমের গানও বেঁধেছেন। ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল অঞ্চলের অষ্টক গান এক ধরনের প্রেম ভিত্তিক গান। রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলা ও লোক পুরানের উপর ভিত্তি করে রচিত এ গান নৃত্য সহকারে পরিবেশন করা হয়। সাধারণত চৈত্রসংক্রান্তি ও জন্মাষ্টমী উপলক্ষে গৃহন্থের উঠানে এ গানের আয়োজন করা হয়। আর খুলনা জেলার অষ্টক গানে পাওয়া যায় চ-ীদাস রজকিনীর চিরন্তর প্রেমের উপাখ্যান। এই উপ্যাখ্যানে আছে ব্রাহ্মণ-পুত্র চ-ীদাস ধোপাকন্যা রজকিনীর প্রেমে মগ্ন হয়ে বারো বছর ধরে রড়শি ফেলে বসে থাকে পুকুর ঘাটে। রজকিনী একসময় চ-ীদাসের প্রেমে মজে যায়। কিন্তু দুজনের মিলনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রচলিত সমাজ। শত প্রতিকুলতা সত্ত্বেও তাদের প্রেম সার্থক হয় মধুর মিলনের মধ্য দিয়ে। চ-ীদাস-রজকিনীর প্রেমভিত্তিক অষ্টক গানের একটি নমুনা :
‘তুমিশুন, শুন ওগো ঠাকুর নিবেদি চরণে/ তোমার হাতে ছিপ বরশি মাছ বাধাও দিবা রাত্রি/কওনা কথা কোন অভিমানে।/তুমি শুন ধরি রজকিনী বলি আজ তোমারে/গত হল বার বছর দিলে মাত্র একটি ঠোকর গো/চার খেয়েছে প্রথম ঠোকরে।’
অষ্টকগানের ভেতরে রয়েছে উচ্চমার্গের ভাব, যা এ অঞ্চলের লোক সাহিত্যের ভা-ারারকে সমৃদ্ধ করেছে। ঝিনাইদহের শৈলকূপার স্বরূপচন্দ্র বিশ্বাসের অষ্টক গানের শিল্পী হিসেবে খ্যাতি ছিল, তিনি সম্প্রতি পরলোক গমন করেছেন। তার শিষ্যদের মধ্যে নিরাপদ বিশ্বাস ও বিষ্ণুপদ ম-ল বেঁচে আছেন, কিন্তু পালা পরিবেশন করতে পারেন না। তবে বিষ্ণুপদ ম-লের শিষ্য রণজিৎকুমার বিশ্বাসের অষ্টক গানের দল আছে এবং তিনি গানের চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।
এছাড়াও বিভিন্ন লোকধর্মের সাধন সঙ্গীতও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লোকসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। মেহেরপুরের বলরামী সম্প্রদায়ের গানকে এ ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বলরামী সম্প্রদায়ের প্রবর্তক বলরাম হাড়ির জন্ম মেহেরপুর শহরের মালোপাড়ায়। অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে তিনি শাস্ত্রাচার বিরোধী বলরামী বা হাড়ি ধর্মের প্রবর্তন করেন। বলরাম প্রবর্তিত বলরামী সম্প্রদায়ের অনুসারীরা শাস্ত্র, মূর্তি, বিগ্রহ এব ংগঙ্গাজল ও সংস্কৃতমন্ত্রের মহিমায় বিশ্বাস করে না। গানে গানে তারা তাদের আরাধ্য দেবতা বলরামের পূজা করে। এ সম্প্রদায়ের গানও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লোকসাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য ধারা
বিচিত্র রকমের গান দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রাম গঞ্জে, ঘাটে-মাঠে প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে। এ সব গানের উজ্জ্বল আভায় ভরে উঠেছে আমাদের লোকসাহিত্যের মহাআঙিনা। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের গানের ভাব-ঐশ্বর্য, ধ্বনিমাধুর্য যেমন অনস্বাদিতপূর্ব সাহিত্যরস যোগায় , তেমনি এর উপাদান আধুনিক সাহিত্য সৃজনের মাল-মশলা সরবরাহ করে।
পির-প্রশস্তিমূলক আখ্যান বা কাহিনী:
ষোড়শ শতকে পির-দরবেশ, সাধক, লোকায়ত মুসলিম বীরদের জীবনালেখ্য অবলম্বনে মুখে মুখে কিসসা-কাহিনী ও পুঁথি রচনা শুরু হয়। সংস্কৃতি-তাত্ত্বিকগণ মনে করেন, এ ধরনের রচনা মূলত মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের প্রেরণাজাত। মঙ্গলকাব্যের আখ্যানসমূহ রচিত হয়েছে অপৌরাণিক তথা লৌকিক দেবদেবীদেরদের জীবনবৃত্তান্ত অবলম্বনে আর পির-দরবেশের মাহাত্ম্য জ্ঞাপক পুঁথি বা কিসসা-কাহিনী রচনা করেন মুসলিম কবিরা লোকায়ত মুসলিম পির-দরবেশদের নিয়ে। পির মাহাত্ম্য প্রকাশক মানিকপিরের গান, মাদারপিরের গান,গাজীর গান ও একদিলের গান দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লোকসাহিত্যের ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছে। পীর মাহাত্ম্য প্রকাশক কয়েকটি কাহিনী এখানে তুলে ধরা হল:
মানিক পীর ও মানিক পিরের গান : মানিকপির হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে উভয় সম্প্রদায়ের নিকট সমাদৃত। প-িত সুকুমার সেন ‘মানিকপির’কে যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গের যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ জেলায় মানিকপিরকে কেন্দ্র এক ধরনের ভক্তিমূলক নৃত্যগীত চালু আছে। মানিকপিরের গানের আখ্যান থেকে জানা যায় যে, করম বাদশা নামে এক প্রতাপশালী বাদশা ছিলেন। তার ধন- দৌলতের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। একদিন নিঃসন্তান করম বাদশার প্রার্থনার-ক্রন্দনে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে। আল্লাহ তখন ফেরেশতা জিবরাইলকে ডেকে মানিকপিরকে করম বাদশার ঘরে জন্ম নেয়ার কথা বলে দেন। আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী জিবরাইল ফুলবাগান থেকে মানিকপিরকে ডেকে বলেন করম বাদশার ঘরে জন্ম নিতে। মানিকপির করম বাদশার ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। করম বাদশা ও দুধবিবি আল্লাহর ইচ্ছায় মিলিত হয়। জন্ম হয় মানিকপিরের। কিন্তু জন্ম নেয়ামাত্র মানিকপির ফকির হয়ে যায় এবং মানুষ-গরুর মঙ্গলে নিজেকে উৎসর্গ করেন। সাতক্ষীরা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষকরা বিপদে-আপদে বিভিন্ন রকমের গীতিনাট্য পরিবেশনার মাধ্যমে মানিকপিরের কাছে মানত করে। অসুখ-বিসুখ দূর হলে কিংবা মহামারী চলে গেলে মানিকপিরের গানের বা পালার আয়োজন করা হয়। মানিকপিরকে নিয়ে রচিত কানু ঘেষের পালা এ অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়।
মাদার পির ও মাদার পিরের গান: লোকগবেষকগণ মাদারপিরকে ঐতিহাসিক পির হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই পিরের আসল নাম বদি আল দীন এবং পিতার নাম আবু ইসহাক শামী। শাহ মাদার উপাধি ধারনকারী এ পিরের জন্ম ১৩১৫ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ায়। বলা হয়ে থাকে তিনি হযরত মুসা (সা.) এর ভাই হযরত হারুণের বংশধর। তিনি অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন। তার মুখশ্রী দেখলে মানুষ পাগল হয়ে যেত, তাই তিনি মুখোশ পরে থাকতেন। ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে তিনি ভারতবর্ষে আসেন এবং বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। তিনি ১৪৩৭ খ্রিস্টাব্দে কানপুরের মকনপুরে দেহত্যাগ করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ পিরকে নিয়ে নানা ধরনের উৎসব-পার্বণ, কৃত্যাচার পালন করা হয়। মাদারপিরের আখ্যানে বলা হয়েছে, আল্লাহ একদিন ফেরেশতাদের নিয়ে সভায় বসেন। সভায় ফেরেশতারা আল্লাহকে বললেন, কেন তিনি আদমকে এত গুরুত্ব দেন। আল্লাহ তখন তাদের বললেন, আদমের মধ্যে যে নুর আছে তার এক যাররা পরিমাণ তোমাদের মধ্যে প্রবেশ করলে, তোমরা আমাকে ভুলে যাবে। হারুত-মারুত নামের দু ফেরেশতা আল্লাহর এ কথা মেনে না নিলে আল্লাহর নির্দেশে ওই দু ফেরেশতাকে ইরাকের বাবল শহরে নির্বাস দেন জিবরাইল (আ.)। পৃথিবীতে এসে তারা মানুষের মতো জীবন-যাপন ও চলাফেরা করতে থাকে। মানুষের মতো খাদ্য গ্রহণের ফলে তাদের এশকো বা কাম আসক্তির জন্ম নিল। হারুত-মারুতের কাম-আসক্তির ফলে জন্ম নেয় মাদারপির। এই পিরকে নিয়ে পালা, কিসসা-কাহিনী, আখ্যান রচিত হয়েছে। মেহেরপুর জেলার জয়পুর-তারানগরে মাদারপিরের দরগাহ আছে। এ অঞ্চলের মাদারপিরের অনুসারীরা মনে করেন, মাদারপিরকে পরীর সন্তান, তিনি বাঘের দুধ খেয়ে মানুষ। পথের ধারে জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে পান হযরত আলি এবং মা ফাতেমা তাকে বড় করে তোলেন। মাদারপিরের এক পালা থেকে জানা যায়, এক নিষ্পাপ শিশুর কলেরায় আক্রান্ত হওয়া এবং আযরাইল কর্তৃক শিশুটির জান কবজ করাকে কেন্দ্র আল্লাহর সঙ্গে মাদারপিরের দ্বন্দ্ব বেধে যায়। মাদারপিরের ওপর আল্লাহ অভিশাপ নেমে আসে। মা ফাতেমা এসে আল্লাহ ও মাদারপিরের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তার অবসান ঘটান। সর্বশেষে মাদারপির আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আল্লাহ স্বয়ং নিজে মাদারপিরকে প্রতিশ্রুতি দেন যে আর কখনো মাদারপিরের ভক্তদের কলেরা বা বিভীষণে আক্রমণ করবে। এ সব কাহিনী এ অঞ্চলের লোকসাহিত্যের পরিধিকে সমৃদ্ধ ও প্রসারিত করেছে।
একদিল পিরের গান : একদিল কোনো ঐতিহাসিক পির নন, তিনি লোকমানস প্রসূত লৌকিক পির। এই পিরের মাহাত্ম্য নিয়ে মুসলমান লোককবিরা যে নাট্যগীতি নির্মাণ করেছেন তা একদিলের গান নামে পরিচিত। গ্রামের মানুষ এই পিরকে অন্যান্য মুসলমার পিরের মতোই পরমপূজ্য হিসেবে মেনে চলে। কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা জেলায় এই পিরের সন্ধান পাওয়া যায়। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় একদিল শাহ’র নামে মাজার আছে। একদিল পিরের আখ্যান থেকে জানা যায় যে,শাহ নীল নামক নিঃসন্তান বাদশাহ ও তার স্ত্রী আশেক নুরি সন্তান কামনায় দিনরাত্রি কান্নাকাটি করতো। একদিন আশেক নুরির কান্না শুনে জিবরাইল ফেরেশতা আসে এবং বলেন, ‘কান্নাকাটি করো না বরং রোযা-নামায করো। বারো বছর রোযা-নামায করলে তোমার সন্তান হবে’ । জিবরাইলের কথা শুনে নুরি নামায- রোযা শুরু করে। একে একে বার বছর পার হয়। বারো পার হলে জিবরাইল এসে নুরিকে আরো বারো বছর এবাদত করতে বলে। আশেক নুরি আরো বারো বছর এবাদত পালন করে। এরপর জিবরাইল তাকে আরো বারো বছর এবাদত পালন করতে বলে। এভাবে আশেক নুরির এবাদত পালনের ৩৬ বছর পূর্ণ হয়। নুরির এবাদতে আল্লাহ খুশি হন এবং জিবরাইলের মাধ্যমে নুরির জন্য একটি বেহেশতি ফুল আল্লাহ পাঠান। জিবরাইল ফুলটি নুরির হাতে দিয়ে বলেন, এই নাও বেহেশতের ফুল । এই ফুল খেলে তোমার সন্তান হবে। তবে, শর্ত হল- সন্তানের জন্মের আড়াই দিন পর সেই সন্তানকে এক গরিবের ঘরে রেখে আসতে হবে।’ সেই ফুল খেয়ে আশেক নুরির গর্ভে একদিল পিরের জন্ম হয়। আড়াই দিন পর তাকে এক গরিব লোকের বাড়িতে রেখে আসা হয় এবং সেখানেই সে বড় হতে থাকে। একদিল পিরের আশীর্বাদের গরিবের অবস্থার উন্নতি হয়। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ও মেহেরপুরের গাংনীতে একদিল শাহ বা পিরকে নিয়ে এমন আনেক পালা বা কাহিনী চালু রয়েছে।
গাজী কালু চম্পাবতীর উপাখ্যান: গাজী কালু চম্পাবতী মধ্যযুগের পাঁচালি কাব্যের অনুকরণে রচিত পিরসাহিত্য। ব্যাঘ্রশঙ্কুল দক্ষিণবঙ্গে অর্থাৎ কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা জেলায় গাজীপিরের মাহাত্ম্য প্রচার এ কাব্যের উপজীব্য। ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়ের প্রতিপক্ষ হিসেবে গাজীপিরের বিবরণ পাওয়া যায় কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল (১৬৮৪) কাব্যে। এতে প্রথমে তাদের মধ্যে বিরোধ পরে বন্ধুত্ব দেখানো হয়েছে। রায়মঙ্গলের কাহিনী অবলম্বনে গাজী কালু ও চম্পাবতী কাব্য রচনা করেন শেখ খোদা বকসো (১৭৯৮-১৭৯৮)। এতে গাজী কালুর ফকিরবেশে দেশভ্রমণ, জনৈক হিন্দু রাজার সঙ্গে গাজীর যুদ্ধ, যুদ্ধে রাজার পরাজয় ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ, গাজী কর্তৃক প্রজাদের দুঃখ-দারিদ্র্য মোচন, রাজকন্যা চম্পাবতীর সঙ্গে গাজীর বিবাহ, পরিশেষে সকলকে নিয়ে গাজীর গৃহপ্রত্যাবর্তন ও সুখে জীবন যাপনের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। গাজী কালু চম্পাবতী কাব্য দ্বারা পরবর্তীকালে কবিরা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন।
গাজী কালু ও চম্পাবতীকে নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পটচিত্র,পটেরগান, যাত্রাগান, গাজীর গানের মতো জনপ্রিয় লোকশিল্প গড়ে উঠেছে, তেমনই চালু আছে নানা রকমের কিংবদন্তি। সম্প্রতি গাজীপিরকে নিয়ে নাটক করলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা বিভাগ। নাটকের নাম ‘গাজী কালু চম্পাবতী’। নাট্যরূপ দেন সাইদুর রহমান, জুনায়েদ ইউসুফ ও সাইমন জাকারিয়া। জনশ্রুতিতে পাওয়া যায়, বৈরাট নগররাষ্ট্রের রাজা ছিল সিকান্দার। বাদশার স্ত্রী বিবি ওসামা সুন্দরীর ছিল তিনপুত্র। জ্যেষ্ঠপুত্র জুলহাস, মেজপুত্র কাঁলাচাঁদ আর কনিষ্ঠúুত্রের নাম দয়াল মুরশিদ গাজী। এই দয়াল মুরশিদ গাজীই জিন্দাপির হিসেবে পরিচিত। আর চম্পাবতী ছিলেন সাপাই নগরের প্রতাপশালী রাজা রামচন্দ্র ওরফে মুকুট রাজার আদররের কন্যা। মুকুট রায় ও স্ত্রী লীলাবতীর ছিল এক কন্যা ও সাতপুত্র। চম্পাবতী ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। পুঁথিতে তার অপরূপ রূপের বর্ণনা আছে :
জ্বলিতেছে রূপ যেন লক্ষ কোটি শশী/ হঠাৎ চম্পার রূপ নয়নে হেনিয়া/ মূর্ছিত হইয়া গাজী পড়িল ঢলিয়া।
গাজীর সঙ্গে চম্পাবতীর প্রণয় গড়ে ওঠে এক পর্যায়ে। কিন্তু সমাজের প্রথা ও ধর্ম তাদের মিলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রেমকে কেন্দ্র করে গাজী-কালুর সঙ্গে মুকুট রাজার যুদ্ধ হয়, গাজীর ব্যাঘ্র সেনার নিকট মুকুট রায়ের প্রতাপশালী দক্ষিণ রায় পরাজিত হন। পরাজিত হবার পর রাজা ও সভাসদগণ কালেমা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাণী লীলাবতীও আপত্তি করেননি ধর্মান্তকরণের প্রশ্নে। গাজীর সঙ্গে চম্পাবতীর বিয়ে জাকজমকের সহকারে। বিদায় কালে রাণী লীলাবতী গাজীকে বলেন :
বড় আহ্লাদের মোর কন্যা চম্পাবতী / সাতপুত্রর মধ্যে সেই আদরের অতি।/ তার প্রতি দয়া তুমি সদয় রাখিবা / অনিষ্ট করিলে মার্জনা করিবা।


এরপর চম্পাবতীকে নিয়ে গাজী-কালু দু ভাই ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারে চলে আসেন । আজো গাজী কালু চম্পাবতীর মাজারে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষ মানত করে। প্রতিবছর ওরস হয়, ওরস উপলক্ষে মাজার প্রাঙ্গণে মেলা বসে, নামে মানুষের ঢল।
আগে গ্রামেগঞ্জে গাজীর গানের আসর বসতো, এখন আর তেমন বসে না। এককালে গান এ অঞ্চলের মুসলমানদের নিকট খুবই জনপ্রিয় ছিল। জিন্দাপির গাজীকে আজোও এদেশের জনগণ স্মরণ করে। এদেশের অসংখ্য স্থানের নাম গাজীপুর, গাজীর হাট, গাজীরঘাট, গাজীর দেউল, গাজীডাঙ্গা, গাজীর খাল ইত্যাদি গাজীর নামে মহিমা বহন করে চলেছে। সুন্দরবনের মৎস্যজীবীরা গাজীর নামে পাঠা বলি দেয়। দুর্গম নদী-পথে ঝড় তুফানের মধ্যে মাঝি-মাল্লারা গেয়ে ওঠেন গাজীর গুণকীর্তন :
আমরা আজি পোলাপান / গাজী আছে লিঘবান / শিবে গঙ্গা দরিয়া / পাঁচ পির বদর বদর ।
এই পাঁচ পিরের মধ্যে সিকান্দার শাহ, গাজী ও কালুর নাম পরিচিত। অন্য দুজনের নাম জানা যায় না। তবে পাঁচ পিরের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন ও শামসুদ্দিনের নাম শ্রুত হয়। গাজীর গীতের মধ্যেও পাঁচ পিরের নাম পাওয়া যায়।
পোড়া রাজা গয়েসদি, তার পুত্র সেকেন্দার/ তার বেটা বরকান গাজী :/ খোদাবন্দ মুলুকের কাজী।/ কলিযুগে যার অবসর, / বাদশাই হিড়িন বঙ্গে / কেবল ভাই কালু সঙ্গে / নিজ নামে হইল ফকির।
বাংলাদেশের অনেক জায়গায় পাঁচ পিরের নাম শোনা যায়। বিলুপ্ত নগরী বারোবাজারে পাঁচ পিরের নাম খুঁজে পাওয়া যায়। সাতক্ষীরা জেলার লাবসা গ্রামে পাঁচ পিরের মোকাম বা দরগা আছে। চট্টগ্রামে ভক্তের কণ্ঠে বদর পিরের সঙ্গে গাজীর নামও উচ্চারিত হয় :
আমরা আছি পোলাপান/ গাজী আছে নিঘাবান / আলি নবি পাঁচ পির / বদর বদর।
সিলেটের একটি মাজারের ফলক থেকে জানা যায় যে, গাজীপিরের বহুপূর্বে বদর পির এদেশে আসেন। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারে গাজীর নামে গাজীর জাঙ্গল আছে। বারোবাজার রেলস্টেশন থেকে এক মাইল উত্তর-পূর্বে ছাপাইনগর গ্রাম রয়েছে, যেটি মুকুট রাজার স্মৃতি বহন করে চলেছে। গাজীপিরকে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গবেষকগণ, কিন্তু তাকে নিয়ে এত কিংবদন্তি চালু আছে যে, তার সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না। গাজীপিরকে নিয়ে ‘গাজী কালু চম্পাবতীর পুঁথি’, ‘গাজী মঙ্গল’, বরখা ‘গাজীর কেরামতি’,‘ দরাফ খানের গঙ্গাক্ষেত্র’ প্রভৃতি পুঁথি রচিত হয়েছে, এসব পুঁথি বাংলার পুঁথিসাহিত্য তথা লোকসাহিত্যের ভা-ার সমৃদ্ধ করেছে। এ সব কাহিনী বা আখ্যানও আমাদের লোকসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।





বনবিবির কাহিনী : দক্ষিণ রায় ও গাজীর মতো বনবিবিকে নিয়ে সুন্দরবন অঞ্চলে নানা ধরনের অলৌকিক গল্প চালু আছে। নৌকার মাঝিরা বনের মধ্যে প্রবেশ করে বনবিবির নাম স্মরণ করে। প্রবাদ আছে যে, বনবিবি গহীন অরণ্যে এক গাছ থেকে অন্য গাছে সহজে চলাচল করতে পারে। বনের হিং¯্র জীবজন্তুরা তার খুবই অনুগত। সুন্দরবনের মাঝিরা, এ কাহিনী গভীরভাবে বিশ্বাস করে। বনবিবির কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে ‘ বনবিবির জহুরনামা’। পুথিতে বলা হয়েছে যে, মক্কার এক অন্তঃসত্ত্বা রমনী নির্বাসিত হন। তিনি বনের মধ্যে শাহ জঙ্গুলি ও বনবিবি নামে দু জসজ পুত্র-কন্যা প্রসব করেন। পুঁথিতে বনবিবি সম্পর্কে বলা হয়েছে :
বনের হরিণ সব খোদার মেহের।।/ হামেশা পালন করে বনবিবি তরে।।/ বেহেশতের হুর এসে কোলে কাখে নিয়া/ তুষিয়া মায়ের মতো ফেরে বেড়াইয়া।।
ভাটিশ্বর দক্ষিণ রায়ের সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে অনাথ অসহায়, দুঃখী-দুর্বলকে রক্ষার জন্য বনবিবি ও তার ভাই শাহ জঙ্গুলি আল্লাহর হুকুমে সুন্দরবনে থেকে যান। পুঁথিতে আছে, বনবিবির সঙ্গে দক্ষিণ রায়ের যুদ্ধও হয়েছে, যুদ্ধে দক্ষিণ রায় পরাস্ত হয় বনবিবির নিকট। একবার ধোনাই- মোনাই নামে দু ভাই সপ্তডিঙা সাজিয়ে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে যায়। তাদের সঙ্গে এক দুখিনী মায়ের একমাত্র পুত্র দুঃখেও গিয়েছিল। তারা গড়খালি নদীতে পৌছলে দক্ষিণ রায় নরবলী দাবি করেন এবং বেছে নেয়া হয় দুঃখকে। দুঃখকে অসহায় অবস্থায় রেখে ধোনাই- মোনাই সুন্দরবন ত্যাগে বাধ্য হন। দুঃখের মা বনবিবির কাছে দুঃখের জন্য প্রার্থনা জানায় :
কহে মা বনবিবি কোথা রইলে এই সময়,/ জলদি করে এসে দেখ দখে মারা যায়।/ কড়াল দিয়াছো মাগো, যদি না পালিবে,/ ভাটি মধ্যে তোমার কলঙ্ক রয়ে যাবে।
দুখী মায়ের ক্রন্দনে তিনি সাড়া দিলেন। তিনি দুর্বল দুঃখের পক্ষ নিয়ে দক্ষিণ রায়কে যুদ্ধে পরাজিত করলেন। দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়ে বনবিবির বশ্যতা স্বীকার করলেন। এভাবে বনবিবির কৃপায় দুঃখ বিপদ থেকে রক্ষা পেলেন। বনবিবির কাহিনী মূলত লোকমানস প্রসূত গল্প, এর মধ্যে ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। তবে এই আখ্যানের মধ্যে সুন্দরবন লাগোয়া জনপদে বসবাসকারী জনমানুষের গভীর ক্রন্দন লুকিয়ে আছে। সুন্দরবন অঞ্চলে বনবিবি খুবই পরিচিত, তাকে বনের সর্বেশ্বরী হিসেবে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মাঝিমাল্লা ও মধুসংগ্রহকারীরা মান্য করে।


লোকছড়া :
বাঙালির চিরায়াত লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রধানধারা লোকছড়া। লোক পরস্পরায় মুখেমুখে রচিত ও প্রচলিত হওয়ায় এই ছড়াকে লোকছড়া বলা হয়। লোকছড়ার সংজ্ঞা নিয়ে সাহিত্যের প-িত ও গবেষকদের মধ্যে মতদ্বৈধতা থাকলেও প্রায় সকলেই একমত যে, কল্পনার রঙে যে কোন বিষয়ের বর্ণিত চিত্র অঙ্কনই ছড়ার প্রধান উপজীব্য। যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া অঞ্চলের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে আছে লোক জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ অজ¯্র ছড়া। তবে সুনির্দিষ্ট স্থানিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে এসব ছড়া পৃথক করা কঠিন। দীর্গকালের বির্তনের ধারায় এক অঞ্চলের ছড়া অন্য অঞ্চলের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে। নদীয়া ও চব্বিশপরগনার সংলগ্ন হওয়ায় এ অঞ্চলের ছড়ার শব্দ প্রমিত বাংলার কাছাকছি বলে ধরে নেয়া যায়। তবে সব জেলায় ভাষাতে খানিকটা আঞ্চলিকতার ছাপ রয়েছে। বিষয় বৈচিত্রের ছাপও এসব ছড়ায় লক্ষ্য করা যায়। বাঙালি সমাজে বহু বিবাহের পাশাপাশি পরকীয়াও ছিল। পরকীয়া প্রীতিতে মুগ্ধ অনেক কুলীন ব্রাহ্মণের উত্তম-মাধ্যম খেয়ে পা খোঁড়া হয়ে যেত। সে সব খোঁড়া ব্রাহ্মণকে উপহাস করে রচিত হয়েছে অনবদ্য ছড়া:
খোঁড়া ন্যাং ন্যাং ন্যাং/কার হাঁড়িতে ফ্যান খেয়েছিস কে ভেঙ্গেছে ঠ্যাং
অনধিকার চর্চা নিয়েও রয়েছে অসংখ্য ছড়া। যেমন:
চন্দ্র সূর্য অস্ত গেল, জোনাকি জ্বালায় বাতি।/ মোগল পাঠান হদ্দ হল, ফারসি পড়ায় তাঁতি।
বর্গীর হাঙ্গামার সঙ্গে বাঙালি মায়েরা গভীরভাবে পরিচিত। কথিত আছে, অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে বর্গী দস্যুরা ভৈরব নদী পথে এসে মেহেরপুরের স্থানীয় জমিদার রাজা গোয়ালা চৌধুরীকে আক্রমন করে। আক্রান্ত গোয়ালা চৌধুরী ভুতল কক্ষে আশ্রয় নেয় এবং অবশেষে নিহত হন। বর্গী ভীতি এতদঞ্চলে এত প্রবল ছিল যে, মায়েরা বর্গীর ভয় দেখিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়াতো ছড়ায় ছড়ায়।
ছেলে ঘুমাল, পাড়া জুড়ালো/বর্গী এলো দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, /খাজনা দেব কিসে?
নদীয়ার শান্তিপুর ও কুষ্টিয়ার বস্ত্রশিল্পের জন্য খ্যাতি ছিল। কৃষির পাশাপাশি তাঁতশিল্পের সমাদর ছিল সমাজে। তাঁতশিল্প যে তাঁতিদের জীবনে স্বচ্ছ্বলতা এনে দেয় তার প্রমাণ মেলে লোকছড়ায়:
চরকা আমার ভাতার পুত/চরকা আমার নাতি।/চরকার দৌলতে আমার/দুয়ারে বাধা হাতি।
চরকা আমার আশয়-বিষয়/চরকা আমার হিয়া।/চরকার দৌলতে আমার /সাত পুতের বিয়া।
কিন্তু তাঁতশিল্পের দুরবস্থার কথাও কোন কোন গানে বয়ান করা হয়েছে। যেমন: আলমডাঙ্গা নিবাসী সাহেবধনী সম্প্রদায়ের প্রধান গীতিকার কবির গোঁসাই এর গানে রয়েছে,
যুগীর ব্যবসা ভাত সানা/এই সুতো গায়ে মাখিয়ে তাই কাড়াই তানা/ আমার দুইদিকে খাটুনি আমি একবার কাড়াই একবার করি তাসুনি।
নীলকর কুঠিয়ালদের নির্মমতা ও নীলচাষিদের দুর্দশার কথা উঠে এসেছে লোকছড়া ও গানে। ‘নীল দর্পণ’ নাটকের অনুবাদ প্রকাশিত হলে নীলকররা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। এক পর্যায়ে ‘নীল দর্পণ’ নাটকের অনুবাদক যাজক রেভারেন্ড জেমস লঙের ১ মাসের কারাদ- হয়। ঘটনাটি যশোর জেলার সাধারণ মানুষকে গভীরভাবে আবেগ তাড়িত করে। যশোরের গ্রামীণ ছড়ায় এর প্রতিফলন দেখা যায়। এ রকম একটি ছড়া হল:
‘নীল-বাঁদরে সোনার বাঙলা করলে এবার ছারখার !/ অসময়ে হরিশ ম’লো, লঙ-এর হল কারাগার/ প্রজার আর প্রাণ বাঁচানো ভার।’
( সতীশচন্দ্র মিত্র: যশোহর-খুলনার ইতিহাস। কোলকাতা ২য় খ- ১৩২৯।পৃ: ৭৯৩।)
নীলকররা অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের মর্যাদা পেয়ে বিচারকের আসনে বসলে আদালতের প্রতি সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে । গ্রামীণ ছড়ায় বিষয়টির প্রতিফলন লক্ষ করা যায়:
‘হলো নীলকরদের মেজেস্টারি ভার / পড়েছে সব পাথর বক্ষে, অভাগা প্রজার পক্ষে,/ কুঠিয়াল বিচারকারী, লাঠিয়াল সহকারী/ বানরের হাতে হোল কলের খোন্তা- নোন্তা জলে চাষ।/ হলো ডাইনের কোলে ছেলে সোঁপা, চিলের বাসায় মাছ।/ হবে বাগের হাতে ছাগের রক্ষে, শুনেনি কেউ শুনবে না।’ ( উদ্ধৃত- ড. রেজাউল করিম : ‘যশোর জেলার নীলচাষ: নীলকর নীলচাষি সম্পর্ক’। বাংলা একাডেমি, ঢাকা, জুন২০১০। পৃ: ১৫৭)
এরপর নীলচাষিরা আদালতের শরণাপন্ন না হয়ে সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। বিভিন্ন গ্রাম-জনপদে কুঠিয়ালদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে বিদ্রোহ যা ইতিহাসে নীলবিদ্রোহ নামে পরিচিত।

কোন কোন ছড়ায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির হত্যাযজ্ঞের নায়ক চিক্কা খানের প্রসঙ্গও এসেছে। যেমন: ইলিশ মাছের মাছের তিরিশ কাটা/ বোয়াল মাছের দাড়ি।/টিক্কা শালা ভিক্ষা করে বাংলাদেশের বাড়ি।
এক সময় পৌষ মাসকে গ্রামবাংলার মানুষ লক্ষীর মাস মনে করত, এখনও হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ কেউ তাই মনে করে। পৌষ সংক্রান্তিতে হিন্দু রমনীরা ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে সমস্বরে ছড়ায় ছড়ায় বলে,
এসো পৌষ, যেও না/ভাতের হাঁড়িতে থাক পৌষ, যেও না, / পোয়াল গাদায় থাক পৌষ যেও না, পৌষ মাস, লক্ষীর মাস যেও না।
এছাড়াও ব্যবসা বাণিজ্য, কুটিরশিল্প , ধর্মবিশ্বাস, লোকউৎসব, লোকক্রীড়া, বিনোদন নিয়ে অসংখ্য ছড়া রয়েছে এ অঞ্চলে। তবে সময়ের পরিবর্তনের কারণে স্থানিক পসিরের গ-িতে এসবছড়া বিন্যাস্ত করা বেশ কঠিন।
প্রবাদ প্রবচন
প্রবাদ প্রবচনের মধ্য দিয়ে একটি জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রতিবিম্বিত হয়। লোক পরস্পরাগত, নীতিগর্ভ, অভিজ্ঞতা প্রসূত ক্ষুদ্রতম উক্তিকে লোকসাহিত্যে প্রবাদ হিসেবেগণ্য করা হয়। এই ক্ষুদ্রতম উক্তির মধ্যে নিহিত থাকে সমাজের আদর্শ, আচার সংস্কৃতি, জ্ঞান, শিক্ষা, ঐতিহ্য সব কিছুই। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের প্রবাদ গুলির মধ্যেও এ অঞ্চলের মানুষের আচার-আচারণের ভাষা ভাবনার ছাপ পাওয়া যায়।
প্রেম বিষয়ক প্রবাদ:
প্রেম জীবনে আনে আবেগময়তা আর এ আবেগ জাত-পাত-মানে না।
যেমন:- পিরিতি মজিলে মন, কিবা হাড়ি কিবা ডোব
পরকীয়া প্রেম বিষয়ক প্রবাদ:
বৈষ্ণব সাহিত্যে পরকীয়া প্রেম কখনও কখনও সমর্থন করা হয়েছে। কিন্তু বাঙালির প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় পরকীয়া প্রেমকে কখনই সমর্থন করা হয়নি। তাইতো পরকীয়া প্রেম সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে বিভিন্ন প্রবাদে।
১. ঘরের কথা বলতি নেই/নাঙ মরলে কাঁদতি নেই।
২. নাঙের বাড়ির গল্প/করলি করিস অল্প। ( মেহেরপুর)
অতিথি বিষয়ক প্রবাদ: বাঙালি পরিবারে অতিথিকে নারায়ণ ভাবা হয়। কিন্তু অভাবক্লিষ্ট পরিবারে অতিথির আগমন হলে গৃহস্বামী অপ্রসন্ন হন। এ ধরনের অসংখ্য প্রবাদ রয়েছে:
১. জ্বালার ওপর জ্বালা/তার ওপর আসলো মেয়ের খালা (মেহেরপুর)
২. আপনি পায়না শোবার জায়গা/শংকারারে ডাহে।(খুলনা)
নারীশ্রম বিষয়ক প্রবাদ : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ করে কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর জেলায় ব্যাপকভাবে তামাক চাষের প্রসার হওয়ায় নারীরা তামাক শিল্পে যুক্ত হয়েছে। নারীদের তামাকশিল্পে যুক্ত হওয়ার বিষয়টিও প্রবাদে এসেছে: ‘কনে যাচ্ছো নাচতি নাচতি/নাঙের বাড়ি তামাক বাচতি’।
চোর বিষয়ক প্রবাদ: চোর নিয়ে নানা প্রবাদ আছে বাংলার লোক সাহিত্যে । ‘চোর না শোনে, ধর্মের কাহিনী’-এটি একটি বহুল বহুল প্রবাদ। আর চোরের মার বড় গলা, ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ এ সব প্রবাদ বাঙালি সমাজে প্রচলিত রয়েছে বহুকাল ধরে। তবুও চৌর্যবৃত্তি বন্ধ হয় না। তাই প্রবাদে আছে:
‘চোর যদি যায় গঙ্গা¯œানে/মন থাকে তার গাঁঠরি পানে।
বহুবিবাহ বিষয়ক প্রবাদ: আমাদের সমাজে আজ াবধি বহু বিবাহ প্রথা চালু আছে। স্বামী প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পক্ষের প্রতি বিরূপ আচরণ করেন তা প্রবাদে ফুটে উঠেছে:
এক পক্ষের বউ আমার হেলাফেলা, /দুই পক্ষের বউ আমার তগলার মালা,/ তিন পক্ষের বউ আমার পাকা কলা/ চার পক্ষের বউ আমার কেঁদনা/চাল বিজিয়ে খাব, ভাত রেঁধো না।
যুগ পরস্পরায় লোকমুখে অসংখ্য প্রবাদ রচিত হয়েছে এ অঞ্চলে। এসব প্রবাদ প্রবচন ব্যক্তিগতভাবে রচিত হয়নি। রচিত হয়েছে সামষ্টিকভাবে। এত বিধৃত হয়েছে এ অঞ্চলের সমাজ ও সংস্কৃতির নানা উপাদান ও বৈশিষ্ট।
ধাঁধাঁ-হেয়ালি:
বাংলা লোকসাহিত্যের নানা উপাদানের মধ্যে ধাঁধা-হেয়ালি অন্যতম। গভীর জীবনবোধসম্পন্ন মানুষ যখন জীবনের নানাদিক পর্যবেক্ষণ করেন এবং সেই পর্যবেক্ষণলব্ধ নির্যাসকে সূত্রায়িত করে প্রকাশ করে তখন ধাঁধাঁ- হেয়ালির সৃষ্টি হয়। রহস্য ও রসবোধ, কৌতূহল ও জিজ্ঞাসার সমন্বয়ে রচিত ধাঁধাঁ বাংলা লোকসাহিত্যের ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছে। ধাঁধাঁ কেবলমাত্র চিত্তবিনোদনের মাধ্যমে নয়, ব্যবহারিক জীবনেও বাঙালি এই ধাঁধাঁর প্রয়োগ করে আসছে সুদীর্ঘকাল ধরে। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের পারিবারিক , সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের নানা অজানা পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়। এ অঞ্চলের প্রচলিত ধাঁধাঁর উদাহরণ:
১. ‘ইট ঘুঘুর পিঠটান, কোন ঘুঘুর চার কান’। (ঘরের চাল)
২. শুঁড় দিয়ে করি কাজ, নই আমি হাতি, /উপকার করি তবু খাই শুধু লাথি। ( ঢেঁকি)
৩. লাল বুড়ি হাটে যায়, চড় খাতি পরান যায়। (মাটির হাড়ি)
৪. হাসতে হাসতে গিয়ে বসে, পরপুরুষের কাছে,/ ঢোকানোর সময় কান্দাকাটি, হয়ি গেলিই হাসে। (চুড়ি পরা)
ধাঁধাঁ বা হেয়ালি এক অর্থে সমাজের দর্পণ। এ অঞ্চলের ধাঁধাঁ বিশ্লেষণ করে মানুষের মনস্তত্ত্ব, জীবন-জীবিকা, সমাজ অর্থনীতি বিশ্লেষণ করা সম্ভব।
ব্রতকথা:
গার্হস্থ্য জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি কামনা,সংকট থেকে পরিত্রাণের আশায় বাঙালি নারীরা যুগ যুগান্তর ধরে ব্রত পালন করে আসছে। আর এ থেকে নানা ব্রতকথার জন্ম হয়েছে। এ সব ব্রতকথার মধ্য দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় একটি অঞ্চলের রোক মানসের প্রতিচ্ছবি। খুলনার বটিয়াঘাটায় গ্রামের লোকজন পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষ্যে গৃহস্থবাড়ীর উঠানে হালুই পরিবেশন করে এবং সংগ্রহ করে চাল, টাকা পয়সা। সংগৃহীত চাল ও টাকা পয়সা দিয়ে উপকরণ কিনে গ্রামের কল্যাণে পূজা দেয়া হয়। দলবদ্ধভাবে তারা গেয়ে বেড়ায়।
ঘোষ গেল বাথানেতে যশোদা গেলেন ঘাটে/শূন্য গৃহ পেয়ে কৃষ্ণ সকল ননী লোটে/ ননী খাইছে কেরে গোপাল, ননী খাইছে কে।/আমি তো খাই নাই ননী, বলাই খেয়েছে।
এ অঞ্চলে ত্রিনাথ অর্থাৎ মহাদেবের সন্তুষ্টি লাভের জন্য ত্রিনাথের মেলা করা হয়। বিভিন্ন উপাচার দিয়ে পূজা করার সময় গান গাওয়া হয়। সন্তানের মঙ্গল কামনা করে। নির্দিষ্ট গাছতলায় আয়োজন করা হয় জাগরনী গানের আসর। রাত জেগে জেগে তারা গায়:
এসো মা সরস্বতী কণ্ঠে কর ভর/ আসিলে বসতে দেব মস্তকের পর।
ফাল্গুনের শেষ দুদিন ও চৈত্রের প্রথম দিন ঘা, পঁচড়া বসন্ত রোগ থেকে বাঁচার জন্য শীতলা দেবীর করুণা চেয়ে খুলনা এলাকায় কুলো ভাসানো গান হয়। মেয়েরা বিনা বাদ্যযন্ত্রে গায়,
হ্যাঁচড়া মাগির প্যাঁচড়াই চুল/তাইতে দেব কলার ফুল।
বটিয়াঘাটা এলাকায় আশ্বিনী সংক্রান্তি বা ধানসাধ হয়। ছেলে বুড়ো সবাই এতে অংশ নেয়।
এসব ব্রতকথাও এ অঞ্চলের লোকসাহিত্যের বিশেষ সম্পদ। ব্রতকথাগুলো ব্রতাচারের সংকীর্ণ গ-ির মধ্যে আবদ্ধ বিধায় এর সাহিত্যিক ও শিল্পমুল্য কম বলে অনেকেই মনে করেন। তারপরও এগুলি এ অঞ্চলের লোকসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, গার্হস্থ্য জীবন, লোকাচার, ধর্মবিশ্বাস, অর্থনীতি, সামাজিক স্তরবিন্যাস ইত্যাদির নানাদিক খুঁজে পাওয়া যায় লোকসাহিত্যে। আমাদের ধর্ম পরিচয়ের যে দ্বন্দ্ব তাও নিরসন হয়েছে লোকগান, লোকদর্শন, লোকপুরান, তথা লোকসাহিত্যের মর্মবাণী আত্মস্থ করে। এ কারণে স্বদেশ-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য অন্বেষার জন্য লোক সাহিত্যের পাঠ বাঙালিকে নিতেই হবে। বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণ, বাঙালি জাতীয়তার বিকাশ এবং সুষম ও সমতা ভিত্তিক অর্থনীতির বুনিয়াদ রচনা করতে লোকসাহিত্যের পাঠ এবং এর সংরক্ষণ জরুরী। বাংলা লোকসাহিত্যের বিপুল ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘দেশের কাব্যে গানে, ছড়ায়, প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষে, কীটদষ্ট পুঁথির জীর্ণপত্রে, গ্রাম্য পার্বণে, ব্রতকথায়, পল্লীর কুটিরে, প্রত্যক্ষ বস্তুকে স্বাধীন চিন্তা ও গবেষণার দ্বারা জানিবার জন্য, শিক্ষার বিষয়কে কেবল পুঁথির মধ্য হইতে মুখস্থ না করিয়া বিশ্বের মধ্যে তাহাকে সন্ধান করিবার জন্য তোমাদিগকে আহবান করিতেছি।’( সংকলন, বিশ্বভারতী। কলিকাতা, পৌষ ১৩৬৯। পৃ: ১৯)।
বাংলা লোকসাহিত্যের ভাব সম্পদ অনুসন্ধানে রবীন্দ্রনাথ পথিকৃতের দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশ্চাত্যে এরূপ দায়িত্ব পালন করেছেন শিল্পবিপ্লব পরবর্তী নূতন গণতান্ত্রিক সমাজের রোাম্যান্টিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ, সংস্কৃতিমনস্ক বিদ্যাজীবীরা তাদের সাংস্কৃতিক শিকড় সন্ধানের স্মৃতি কাতরতা থেকে।
উনিশ শতকের শেষ দশকে শিলাইদহ, শাজাদপুর, পতিসরের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠলে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল তথা শিলাইদদহ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেল লোকগান, লোকছড়া এবং লালন সাই ও গগন হরকরার বাউল গান সংগ্রহে ব্রতী হন। পরবর্তীতে লোকসংস্কৃতি ও সাহিত্যের সংগ্রাহক হিসেবে অনেকেই কাজ করেছেন। এক্ষেত্রে মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীন একটি স্মরণীয় নাম। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলির লোকসাহিত্য নিয়ে কোন লোকগবেষক পৃথক কোন কাজ করেননি। সুধীর চক্রবর্তীর ‘বলাহাড়ি সম্প্রদায় তাদের গান’, ড. আনোয়ারুল করিমের ‘বাংলাদেশের বাউল’, আবুল আহসান চৌধুরীর ‘লোকসংস্কৃতি বিবেচনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ (১৯৯৭), মুস্তফা মাসুদের ‘যশোরের লোক সাহিত্য’ (১৯৯৪), শিবপ্রসন্ন লাহিড়ীর ‘যশোর-খুলনার ছড়া’ (১৯৬৫), হোসেনউদ্দীন হোসেনের ‘যশোর জেলার কিংবদন্তী’ (১৯৭৪), বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের ‘বাউল গান ও দুদ্দশাহ’ (১৯৭১) , শেখ গাউস মিয়ার ‘খুলনার লোকসাহিত্যে সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের উপাদান’, ড. মযহারুল ইসলামের ‘কবি পাগলা কানাই’, মমতাজুর রহমানের ‘নড়াইলের লোক সংগীত’, মহসীন হোসাইনের ‘কবিয়াল বিজয় সরকারের জীবন ও সঙ্গীত’ ইত্যাদি গ্রন্থে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলির লোকসাহিত্য চর্চা সম্পর্কে খোঁজ খবর পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের লোকসাহিত্যকে বাঙালির চিরায়ত জীবন ও সংস্কৃতির রূপবৈচিত্র্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলোচনা করার কোন সুযোগ নেই। দেশের সামগ্রিক সংস্কৃতি বিবেচনায় এনে এ অঞ্চলের লোকসাহিত্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে হবে।





সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৩:২৮
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×