somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাটপাড়া নীলকুঠি ও উনিশ শতকে মেহেরপুর অঞ্চলের গ্রাম

২৯ শে আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১০:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আবদুল্লাহ আল আমিন

কৃষ্ণনগরের মায়া ত্যাগ করে নদীয়ার মহারাজা রাজেন্দ্র বাহাদুর কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮২) পরলোক গমন করেছেন। তার জমিদারির ব্যাপ্তিকাল ছিল পঞ্চাশ বছরের অধিক । তার পুত্র শিবচন্দ্র ১৭৮৮ সালে এবং শিবচন্দ্র-পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র ১৮০২ সালে অমৃতলোকবাসী হন। লর্ড কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দেবস্তো প্রথা প্রবর্তিত হওয়ার পর ঋণের ভারে নুইয়ে পড়তে থাকেন ঈশ্বরচন্দ্র রায়। পূজা-পার্বণ, শ্রাদ্ধ-উপনয়ন, উৎসব-আতিথেয়তা, মন্দির-নির্মাণ, ভোজন-ব্যসনের বিশাল ব্যয় মেটাতে গিয়ে বিক্রি করতে হয় অনেকগুলো পরগণা, আয়তনে ছোট হয়ে যায় নদীয়া রাজবংশের জমিদারি। ১৮০২ সালে মহারাজা ঈশ্বরচন্দ্রের প্রয়াণের পর পিতা-পিতামহদের ঋণের দায় কাঁধে নিয়ে নদীয়া রাজবংশের হাল ধরেন ষোল বছর বয়সী গিরীশচন্দ্র। তিনি নাবালক বিধায় তার পিতৃরাজ্য এখন কোর্ট অব ওয়ার্ডের অধীন। তিনি বিলাসব্যসন,পান- ভোজন, পারিবারিক সংস্কৃতিচর্চা, জলসা-মজলিস পছন্দ করেন। প্রপিতামহ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার মতো তাঁর রাজসভাও আলো করে থাকেন প-িত, ভট্টাচার্য, কবি ও রসিকজনেরা। মেহেরপুরের বাড়িবাঁকা গ্রামের কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ীকে রেখেছেন সভাকবি হিসেবে। তিনি মুখে মুখে পদাবলী রচনায় অসাধারণ পারদর্শী । তাই রাজা তাকে আদর করে সম্বোধন করেন ‘রসসাগর’ বলে। ইতিহাস, পুরাণ, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি নিয়ে কেউ কোনো কবিতার একটি পঙক্তি বললে, কৃষ্ণকান্ত সুন্দর অর্থপূর্ণ ও উচ্চমানের কবিতা তখনই মুখে মুখে রচনা করতে পারেন। মহারাজা গিরীশচন্দ্র রায় বাহাদুর সভাসদের ব্যয়ভার আর বহন করতে পারছেন না। তিনি সভাসদের পরিধি ছোট করতে চান। প্রপিতামহ কৃষ্ণচন্দ্রের যে-আয় ছিল, তেমন আয় আর হয় না জমিদারি থেকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিওয়ানি লাভের পর সব কিছু বদলে যাচ্ছে। মুর্শিদকুলি খাঁর জাহানকোষা কামানে মরচে পড়েছে অনেক আগেই। মুর্শিদাবাদের গা থেকে ক্রমাগত খান্দানি ছাপ খসে পড়ছে, অনেক আগেই নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্যালেসভেসে গেছে ভাগীরথীর জলে । নবাব মোবারকউদ্দৌলা ১৭৯৩ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে দুনিয়া ছেড়ে গেছেন। তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার ধাক্কা সামলাতে পারেননি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অভিশাপ নিয়ে ইতোপূর্বে বসন্ত রোগে মারা গেছেন, তার বৈমাত্রেয় ভাই নবাব সাইফুদ্দৌলা। এরপর নবাবের সিংহাসন লাভ করেন নবাব নাজিম বাবর আলী। তিনি ‘নবাব নাজিম’ উপাধি ধারণ করেছেন। এ সময় বাংলায় গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন লর্ড ওয়েলেসলি। লর্ড ওয়েলেসলির পক্ষ থেকে স্যার জন হ্যারিংটন নবাবকে নজরানা দেন ১৬ লক্ষ টাকা । সেই টাকা দিয়ে তিনি হস্তিপৃষ্ঠ থেকে টাকা ছিটান, ২৫০০০ অশ্বারোহী ও ৫০০০ জন পদাতিক সৈন্য নিয়ে নগর পরিভ্রমণ করেন নবাব নাজিম আলী বাবর। ঠিক ওই সময়ে, নদীয়ার গ্রামে গ্রামে নীলকুঠি স্থাপিত হচ্ছে। অবশ্য, তারও আগে হুগলী তীরবর্তী চন্দনগরের গোন্দলপাড়া ও তালডাঙ্গা গ্রামে নীলকুঠি স্থাপন (১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দ) করে লুই বোনার্ড নামক এক ফরাসি বণিক রমরমা নীলব্যবসা আরম্ভ করে দিয়েছেন। বোনার্ড এর জন্ম ফ্রান্সের মার্সেল শহরে। এরপর তিনি কুঠি স্থাপন করেন মালদহে। এক বছর পর নদীয়ার কুষ্টিয়ায় কুঠি স্থাপন করেছেন ক্যারল ব্লুম নামের এক ইংরেজ তরুণ। কুষ্টিয়া, কুমারখালি, খোকসা প্রভৃতি এলাকায় আরও কয়েকটি কুঠি স্থাপনের ইচ্ছা তার রয়েছে। কৃষ্ণনগরের জৌলুশ তখনও কমেনি, যদিও নদীয়া রাজবংশের রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারের রংমশালগুলি নিবু নিবু প্রায়। জগদ্ধাত্রী পূজার উৎসব ছাড়া অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি কমিয়ে আনা হয়েছে। রাজা গিরীশচন্দ্র আর নবাব নাজিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন না, কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-ই এখন নদীয়া রাজবংশের অভিভাবক। ইংল্যান্ড ও ওয়েজ ইন্ডিজ থেকে নীলকর সাহেবরা বাংলায় আসতে শুরু করেছেন। কলকাতার রাস্তাঘাট ও অলিগলির নামকরণের আয়োজন চলছে। উনিশ শতকের প্রারম্ভে গ্রামের মতো কলকাতার রাস্তাঘাটও পুকুর-মন্দির-মসজিদ ইঙ্গিত করে বলতো লোকে। থিয়েটার রোড, মিডলটন স্ট্রিট,ক্যামাক স্ট্রিট এসব নামকরণ হয়েছে আরও পরে । পদ্মা- মেঘনা- বুড়িগঙ্গা বিধৌত পূর্ববঙ্গ তখন জঙ্গলে আকীর্ণ। নদ-নদী, খালবিল আর দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। কোথাও জনবসতি, কোথাও শূন্য প্রান্তর। কয়েকটি বাড়ি মিলে ছোট ছোট গ্রাম। পূর্ববঙ্গের গ্রামগুলিতে স্থায়ী বসতির ধারা কখনও গড়ে ওঠেনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জমিদারদের অত্যাচার, নদী ভাঙন প্রভৃতি কারণে মানুষকে গ্রাম ছাড়তে হয় চিরদিনের জন্যে, তাই গ্রামগুলো ছোট ছোট। শহর বলতে কেবল বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী দু মাইল দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ঢাকা শহরকেইবোঝায়। উনিশ শতকে এ শহরের অধিকাংশ বাড়িই ছিল জীর্ণ। মোগল আমলের দুর্গ, মসজিদ, রাজপ্রাসাদসমূহ জঙ্গলে ঢেকে গিয়েছিল। শহরের আশেপাশে বাঘ ঘুরে বেড়াতো। ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর নগর ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। যশোর শহরে চলাচলের জন্য ছিল মাত্র দুটো গরুরগাড়ি। কুমিল্লা ছিল গোমতীর দক্ষিণে সুন্দর, ছিমছাম ছোট শহর। গাছে ঢাকা রাস্তার দু ধারে নেটিভ বাজার, কাচারি আর সাহেবদের বাসভবন। শহরের হালহকিকত যদি এমন হয়, তাহলে তখন কেমন ছিল পূর্ববঙ্গের গ্রামগুলি ? কেমন ছিল নদীয়া জেলার মেহেরপুর এবং তৎসন্নিকটবর্তী অঞ্চলের গ্রামগুলি ? করিমপুর, ত্রিহট্ট, গাংনী, দামুড়হুদা,চাপড়া, কৃষ্ণগঞ্জ এলাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব-ই বা কেমন ছিল ? কুমুদনাথ মল্লিক তাঁর ‘নদীয়া কাহিনী’তে বলেছেন, মেহেরপুর একটি ‘প্রাচীন গ্রাম’। ‘গ্রামখানি উত্তরে-দক্ষিণে প্রায় ৫ মাইল লম্বা।’ এর পশ্চিমে ভৈরবনদ প্রবাহিত। রাজা গোয়ালাচৌধুরী এক সময় এক সময় এই গ্রামে বাস করতেন। তাঁর মা রাজু গোঁসাই ছিলেন বাগোয়ান গ্রামের এক স্বচ্ছল গৃহস্থ ও গোয়ালিনী। নবাব আলিবর্দি তাকে রাজাপুর পরগণা দান করেন। উনিশ শতকে মুখুয্যে ও মল্লিক জমিদাররাও মেহেরপুরে বাস করতেন দোর্দ- প্রতপে। পলাশীর আ¤্রকানন, যেখানে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন, সেখান থেকে মেহেরপুর গ্রাম খুব বেশি দূরে নয়। পলাশীর গা ঘেঁেষে বয়ে যাওয়া ভাগীরথীর তীর পর্যন্ত এক সময়ের মেহেরপুর মহকুমার সীমানা প্রসারিত ছিল। পলাশীর পশ্চিমে ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার সীমানা। পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে থেকে সাহারবাটী, কাজীপুর, কাথুলি, শিকারপুর,রহমতপুর, জামসেদপুর, মুরুটিয়া, তেহট্ট প্রভৃতি গ্রামগুলিও খুব বেশি দূরে নয়। গ্রামগুলি এ অঞ্চলের প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ গ্রাম। উনিশ শতকে সাহারবাটী বেশ বড়সড় ও প্রসিদ্ধ গ্রাম। আমঝুপি, পিরোজপুর, আনন্দবাস, বাগোয়ান, কাজীপুর, করমদী, বামনদী, চরগোয়ালগ্রাম, হোগলবাড়িয়া, মঠমুড়ার মতই বর্ধিষ্ণু গ্রাম- সাহারবাটী। গ্রামটি অবস্থান জলাঙ্গী কিংবা ভৈরবের পাড়ে হলে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হত নিশ্চিতভাবে। গ্রামের গা ঘেঁষে পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট নদীটার নাম কাজলা। বর্ষায় জল উথাল-পাথাল করে, একূল-ওকূল দুকূল ভেসে যায়। সারা বছর তার হাঁটুজলে গ্রামের লোকেরা ঘর-গৃহস্থালির কাজ চালায়, তার পাড়গুলিতে গরু-বাছুর চরে, চৈত্রে গোয়ালপাড়ার গরুগুলো বিরাগমাখা মুখে বিচালি আর পাকুড়ের পাতা চিবায়। হিন্দু মেয়েরা সূর্যোদয়ের আগে কাজলায় ¯œান করে এসে মাঘম-লের ব্রত করে, চুন-সুরকি-তুষপোড়া ইত্যাদি দিয়ে আল্পনা আঁকে ঘরের মেঝেতে। আর, দাশপাড়ার ছাগলগুলি ঘুরে ঘুরে বেড়ায় কাঁঠালের কাঁচা পাতা চিবানোর জন্যে। কাজলার গা ঘেঁষে দক্ষিণে পালপাড়া, গোয়ালপাড়া, কৈবর্তপাড়া, মুসলমানপাড়া আর উত্তরে ভাটপাড়া। কেউ কেউ বলেন, একই গ্রামের দু’প্রান্ত, আবার কেউ বলেন দুটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকেই গ্রামটি নদীয়া রাজবংশের জমিদারির আওতাভুক্ত। রাজা গিরীশচন্দ্রের সময় (১৮০২-১৮৪২) এটি কিনে নেয় মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানি। নদীয়া জেলার প্রথম জেলা প্রশাসক মি. এফ রেডফার্ন ১৭৮৬ সালে এশবার মেহেরপুর থেকে বাহাদুরপুর হয়ে সাহারবাটীর দক্ষিণ পাড়ায় এসেছিলেন। তিনি যেদিন এ গ্রামে আসেন, সেদিন মাইল দুই রাস্তা জল ছিটানো হয়েছিল যাতে ধুলা না উড়ে। পালপাড়া, গোয়ালপাড়া ও কৈবর্তপাড়ার কূলবধূরা রাস্তার দুধারে নেমে আসে তাকে এক নজর দেখার জন্য। স্বচ্ছল বাড়ির বধূরা বাড়ির তুলসীতলার পাশে দাঁড়িয়ে শাঁখ বাজায়, উলুধ্বনি দেয়। পাকুড়তলার দুর্গামন্দিরের সামনে গানের আসর বসে। কৃষ্ণনগরের খ্যাতিমান শিল্পীরা মঞ্চ সাজায়। রেডফার্ন সাহেবের সঙ্গে মেহেরপুরের জমিদার মথুরানাথ মুখোপাধ্যায়ও এসেছিলেন। মথুরাবাবু বেশ তেজস্বী পুরুষ ছিলেন। তিনি যতদিন মেহেরপুরের জমিদার ছিলেন, ততদিন নীলকর সাহেবরা খুব বেশি বাড়াবাড়ি করতে পারেনি। এ অঞ্চলে নীলকর সাহেবদের সঙ্গে তিনি সমান তেজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মেহেরপুরের মুখার্জি জমিদাররা মাঝে মাঝে সাহারবাটীর দক্ষিণপাড়ায় আসতেন। জমিদারদের নায়েব- গোমস্তারা এ গ্রামে আসলে দক্ষিণ প্রান্তে আসতেন। উত্তর-প্রান্তে কে আসবেন ? উনিশ শতকে উত্তর-প্রান্তের ভাটপাড়া তো কোনো গোছানো গ্রাম নয়। ক’ঘর প্রান্তিক মুসলমান চাষি এবং অন্ত্যজরা মিলেমিশে সেখানে বাস করতো। গ্রামের চাষিরা নদীতীরবর্তী জমিগুলিতে ধান-পাট-তিল-তিসির চাষ করতো, জেলেরা মাছ ধরতো আর বাগদী- ব্যাধ-বুনোরা শুয়োর চরাতো-পাখি শিকার করতো। পুরো ভাটপাড়া ছিল লম্বা লম্বা ঘাস, আগাছা, বেত, ভাটফুলে ভরা । বৈশাখ মাসে ভাটঝোপগুলি থেকে জংলি গন্ধ বের হতো। নীলকর সাহেবরা যখন নীলের ভাটিখানা স্থাপন করেন, তখন থেকেই পাড়াটির নাম হয় ‘ভাটপাড়া’। এরপর থেকে পাড়াটির নামডাক চারদিক ছড়িয়ে পড়ে। দিনে-রাতে যে পাড়ায় হিং¯্র জন্তু জানোয়ার ঘুরে বেড়াতো, সেখানেই আসতে থাকেন বিলেতের সাহেব এবং কৃষ্ণনগর, রানাঘাটের জমিদাররা। আসতে থাকে বীরভূম, মানভূম থেকে বুনো ও বাগদীরা। উনিশ শতকে পুরো পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া ও চব্বিশ পরগণায় বন্য বরাহ ও বাঘের আধিক্য ছিল। গাংনী, মেহেরপুর, করিমপুর, তেহট্ট অঞ্চলে বন্য বরাহ ও বাঘের সংখ্যা এত অধিক ছিল যে, সন্ধ্যার পর একা একা ঘর থেকে বাইরে বেরুনো যেত না। ভাটপাড়ার পশ্চিমে কাজলা পার হয়ে নওপাড়া, কালীগাংনী। ওখানেও বাঘ-সাপ-শিয়াল-বরাহ ছিল প্রচুর। নওপাড়া মুসলমানদের গ্রাম, কয়েক ঘর কৈবর্ত ও মাহিষ্যরাও ছিল। কালগাংনীতে ছিল ক’ঘর কুলীন কায়স্থ, মুসলমান চাষি আর হিন্দু সম্প্রদায়ের কৈবর্ত ও মাহিষ্যরা। তারা ছিল সাহসী ও লেঠেল গোছের, বাঘ-বরাহে ভয় পেত না।
সেকালে গ্রামের মানুষের স্বপ্ন ও কল্পনার জগৎ নিজ গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । গ্রামের বাইরে তারা তেমন যেত না, সব সমস্যার সমাধান তারা গ্রামে বসেই সারতো। কিন্ত সাহারবাটী ছিল ব্যতিক্রমী গ্রাম, এ গ্রামে বাইরে থেকে লোকজন আসতো। এর দক্ষিণপাড়ায় অবস্থা সম্পন্ন কুলীন হিন্দুদের বাস-তাদের তুলসীতলায় প্রতিসন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বলতো, শোবার ঘরে জ্বালানো হত দীপ, স্বচ্ছল কৈবর্তবাড়ির নতুন বধূরা জা-ননদের সঙ্গে রূপটান মেখে রূপচর্চা করতো। কোনো কোনো দরিদ্রঘরের বধূরা ছিল পরমাসুন্দরী। তাদের শিশুরা রূপার চামচে দুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। বড় হলে চতুষ্পাঠীতে গুরু মশাইয়ের কাছে ব্যাকরণ, কাব্য, অলংকার, বেদান্ত শিখতো। নবদ্বীপের ‘গৌড়ীয় বেদান্ত চতুষ্পাঠী’তে পড়া এক অধ্যাপককে আনা হয়েছিল নবপ্রতিষ্ঠিত চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপনার জন্যে। পরবর্তীতে তারা সংস্কৃতভাষার কুমারসম্ভব ও রঘুবংশ পড়তো। কেউ কেউ মেহেরপুর কিংবা আমঝুপিতে সাহেবদের স্কুলে গিয়ে ইংরেজি শিখতো। স্বচ্ছল গৃহস্থরা চাইতেন তাদের ছেলেরা যেন বড় হয়ে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মতো জ্ঞানী না হতে পারলেও মেহেরপুরের মুখার্জি-জমিদারদের সেরেস্তায় একটা মোটা মাইনের চাকরি পায়। কোনো কাছারির গোমস্তা হয়ে যেন পাকা বাড়ি বানাতে পারে। ছোটমাছ-পুঁচচ্চড়ি-গলাভাত খেয়ে কেউ কেউ ছেলেকে ভাটপাড়া কিংবা আমঝুপি নীলকুঠির নায়েব বানানোর স্বপ্ন দেখতো। শিশুরা মায়ের হাতে তালপাতার পাখায় হাওয়া খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়তো। জেগে উঠে মুখ ধুয়ে চিড়া, মুড়ি, নাড়– আর বাতাসা চিবাতো ঘুম ঘুম চোখে। এক গ্রাম্য গৃহস্থ চৌরাস্তার মোড়ে বট-পাকুড়ের গাছ লাগিয়ে দেন পথচারিদের বিশ্রামের জন্য, পাশেএকটি পুকুর খনন করেন। গোঁসাইপাড়ার কুলীন ব্রাহ্মণরা কাজলার পাড় ঘেঁষে চৈত্রমাসে জলকষ্ট নিবারণ ও প্রজাসাধারণের ¯œানের জন্য আরেকটি পুষ্করিণী খনন করেন। এটির নাম কানা পুকুর। গ্রামের কূলবধূরা এই পুকুর থেকে খাবার-জলও সংগ্রহ করে। কেন যে পুকুরটির নাম কানাপুকুর, তা জানা যায় না। সাহারবাটীর দক্ষিণ, পূর্বদিক বেষ্টন করে পাহারাদাররা চৌকি দিত। সাহারবাটীর দেবদেউল- কালীতলা- ষষ্ঠীতলা-পঞ্চায়েততলার হাঁকডাক ছিল। গোঁসাইপাড়ার ব্রাহ্মণদের ছেলেরা গোবিন্দপুর,জানবাজার, পাথুরিয়াঘাটা ও সদরপুরের জমিদারির সেরেস্তায় কাজ করে প্রচুর অর্থোপার্জন করে সুরকির পদ্মফুল আঁকা বড় বড় বাড়ি বানিয়েছিল। অনেকে হালিশহর থেকে বুড়ো মায়ের জন্য টাকা পাঠাতো বাহক মারফত। কেউ কেউ কুমারখালির তাঁত থেকে ধুতি-চাদর-শাড়ি কিনে এনে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করতো। তারা সখ করে ময়না-টিয়া-পুষতো। তাদের ছ্যাদলা পড়া ছাদে ঝাঁঝাঁ করতো রোদ । লেখাপড়া-জানা স্বচ্ছল গৃহস্থরা দুপুরে যাত্রাপালা কিংবা নভেল নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো- গাঢ় ঘুমে। জেগে উঠে দেখতো বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। গ্রামে যাত্রার দল ছিল, অনেকে জীবিকা- নির্বাহ করতো যাত্রাপালায় পার্ট করে । যাত্রাওয়ালাদের লোকে অধিকারী বলতো। যাত্রার অধিকারীরা তখন যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতেন। যাত্রায় অভিনয় করে অনেকে কোঠাবাড়ি বানিয়েছিলেন। মোনাখালি ও সাহারবাটীর যাত্রাগানের নামডাক ছিল এ তল্লাটে। মেহেরপুরের বসন্ত মেলায় সাহারবাটীর যাত্রাদলের ডাক পড়তো। উৎসব-পার্বণে গ্রামের বারায়ারিতলায় কবিগানের আসর বসতো। আসরে পার্শ্ববর্তী বাহাদুরপুর, গাংনী, আমঝুপি,শ্যামপুর বসন্তপুর গ্রামের লোকজনযোগ দিতো। কবির লড়াই বেশ উপভোগ্য ও আকর্ষণীয় ছিল। ভোলা ময়রা ও এন্টনি ফিরিঙ্গি সেকালে নামডাকওয়ালা কবিয়াল ছিলেন। একবার এ গ্রামের এক আসরে গোপালগঞ্জ ও নরসিংদীর বড় বড় কবিয়ালরা এসেছিলেন। আসরে এক কবিয়াল বলছেন: কহ সখি কিছু প্রেমের কথা। / ঘুচাও আমার মনের ব্যথা।।/ করিলে শ্রবণ, হয় দিব্যজ্ঞান, হেন প্রেমধন উপজে কোথা,/ আমি এসেছি বিবাগে, মনের বিরাগে, প্রীতিপ্রয়াগে মুড়াবো মাথা।’ গান শুনে উপস্থিত শ্রোতাম-লী মুগ্ধ হয়েছিলেন। আসরে উপস্থিত শ্রোতাদের কেউ বলছেন গানটি রাসু নৃসিংহের রচনা, কেউ বলছেন এন্টনি ফিরিঙ্গির। সেকালে দাশরথি রায়ের পাঁচালি এবং নীলকণ্ঠ মুখার্জি, মতিলাল রায় ও গোবিন্দ অধিকারীর যাত্রা মানুষ পছন্দ করতো।
গ্রামের অধিকাংশ হিন্দুরা ছিলেন কৈবর্ত ও মাহিষ্য শ্রেণিভুক্ত। এরা হিন্দু সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প-িত ভবদেব ভট্ট কৈবর্তদের অন্ত্যজ বা শূদ্র শ্রেণিভুক্ত করেন। কিন্তু স্মৃতি ও পুরাণে কৈবর্ত ও মাহিষ্যদের ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্যমাতার সন্তান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কৈবর্ত ও মাহিষ্যরা এক শ্রেণিভুক্ত হওয়ায় গ্রামে তারা আত্মীয়ের মতো থাকতো। মাছ ধরা ও মাছবেচা তাদের প্রধান পেশা। অনেকে চাষ করে স্বচ্ছল গৃহস্থ হয়েছিলেন। বেঙ্গল গেজেটিয়ার নদীয়া থেকে জানা যায়,তেহট্ট, দামুড়হুদা, দৌলতপুর এলাকায় কৈবর্তদের বাস ছিল অধিক। ১৮৭২ সালের সেনসাস থেকে প্রাপ্ত থেকে তথ্য থেকে বলা যায়, নদীয়ায় কৈবর্তদের সংখ্য ছিল ৪৪,০০১ জন। কেবল সাহারবাটী ও তৎপার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে নয়, সমগ্র নদীয়ায় কৈবর্তরা হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তর শ্রেণি। সাহারবাটী গ্রামে নবশাখ সম্প্রদায়ও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। এদের আচার-আচরণ অনেকটা কায়স্থদের মতো। এরা নটি শাখায় বিভক্ত ছিল বলে এদের নবশাখ বলা হতো। তারা নিজ নিজ জাতিগত পেশাতে নিযুক্ত থাকতো। এরা মূলত ব্যবসায়ী কারিগর। ব্রাহ্মণরা এ সকল জাতির হাতের ছোয়া জল গ্রহণ করতেন না। কেবলমাত্র সমাজে সৎশূদ্র হিসেবে পরিচিত গোপ, মালাকার, তিলী, তন্তুবায়, মোদক, বারুজীবী, কুম্ভকার, কর্মকার ও নাপিতদের জল গ্রহণ করতেন। নদীয়ার বিভিন্ন এলাকার মতো সাহারবাটী, শ্যামপুর, রামকৃষ্ণপুর, রাধাগোবিন্দপুর, লক্ষ্মী-নারায়ণপুর, নিত্যানন্দপুর প্রভৃতি গ্রামে সৎ শূদ্রশ্রেণির আধিক্য ছিল। মেহেরপুর নিবাসী লেখক দীনেন্দ্রকুমার রায়ের পূর্বপুরুষরা তিলী ছিলেন। তারা বসন্তপুরে একটি পুস্করিনী খনন করেন। কারিগর ও শিল্পকার হিসেবে পরিচিত বৈশ্যরা গ্রামের নির্দিষ্ট অংশে বাস করতো। মেহেরপুরের মল্লিক জমিদাররা বৈষ্ণবভাবাপন্ন ছিলেন, জমিদার রমনী মোহন মল্লিক অজ¯্র বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেছেন। সেই সব পদ এক সময় মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। সাহারবাটী, নিত্যানন্দপুর, জুগিন্দা,পাকুড়িয়া, চাঁদবিল , আমঝুপি প্রভৃতি গ্রামগুলিতে বৈষ্ণবভাবাপন্ন লোকজনের বসবাস ছিল উল্লেখ করার মতো। চাঁদবিল রাধাশ্যাম মন্দির প্রাঙ্গণে ৩২-প্রহর নামযজ্ঞ উপলক্ষে মেলা বসতো। বৈষ্ণবরা বর্ণপ্রথা, জাতপাত, ভেদাভেদ মানতেন না। তারা বলতেন, ‘ সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ চৈতন্যদেব প্রবর্তিত এ ধর্মের মূলমন্ত্র প্রেম ও ভক্তি এবং মানুষ ভজনা। ১৮৭২ সালের সেনসাস রিপোর্ট অনুযায়ী, নদীয়া জেলায় বসবাসরত বৈষ্ণবের সংখ্যা ছিল ১৬,৮৮৮ জন। অষ্টকগান ও কীর্তনের দলে বৈষ্ণবদের সংখ্যাই বেশি ছিল। চৈত্রমাস এলে সাহারবাটীর গ্রামের অষ্টক পূজারির দল রাধাকৃষ্ণ সেজে ঢোল-কাঁসি-চাকি বাজিয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করতো। ওলাবিবি আসববার ভয়ে গাঁয়ের চতুর্দিক বেঁধে দিত মুসলমান গুণিনরা । কাজলার খোড়লগুলিতে জিয়ল-মাগুড়- কৈ-ল্যাটা- সরপুঁটি পাওয়া যেতো প্রচুর পরিমাণে। ফাল্গুন মাস আসার পর থেকে বাড়িতে বাড়িতে গ্যাঁদালপাতার ঝোল রান্না হতো। চৈত্র-বৈশাখ মাসে গ্রামে গ্রামে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা , চাষের জমি ফেটে ঁেচৗচির, পাড়ায় পাড়ায় মৈথাড়ানির দল, তাদের শত কণ্ঠে ‘ আল্লা মেঘ দে, ছায়া দে রে তুই’। ভরদুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদে চিলগুলো তীক্ষèস্বরে ডেকে আকুল হতো। চৈত্রের দাবদহে তারনগরের পদ্মবিল, ত্রিরাইল, চাঁদবিল, কানাপুকুরের জল ঘোলা হয়ে উঠতো, ঘোলাজলে পাঁতিহাসগুলি গুগলি খুঁজে হয়রান হয়ে পুকুরপাড়ে ঝিমুনি দিত, রাতকানা সারানোর জন্য মালোপাড়ার বৗঝিরা সব গুগলি রেঁধে সাবাড় করতো। শীতকালে গোরু-বাছুরের মঙ্গল কামনা করে মানিকপিরের নামে নানা ধরনের কৃত্য সম্পন্ন করা হতো। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি থাকলেও জাতপাতের বাড়াবাড়িটা বেশ ছিল, মুসলমান কিংবা নি¤œশ্রেণির কারো ছায়া পড়লে বামুনবাড়ির বৌরা ফেনাভাতের হাঁড়ি ফেলে দিত। মুসলমান ছেলেরা বিজয়া দশমীর দিনে নায়েব মশাইয়ের গিন্নিকে প্রণাম করলে তিনি ¯œান করে আসতেন। গোয়ালাবাড়ির ছেলেরা গরুছাগল হারালে নাটাইচ-ীর পুজো দিত। চৈত্রসংক্রান্তির ফলারে পিঠাপুলি বাতাসা থাকতো। মুসলমান ছেলে-বুড়োরা মহরমের দিনে কারবালার মর্মান্তিক কাহিনী কিংবা জারি শুনে হোসেনের শিশুপুত্র আলি আসগরের মৃত্যুর জন্য কেঁদে আকুল হয়ে বুক ভাসাতো। সাহারবাটীতে কোনো মসজিদ ছিল না; পিরোজপুর, আনন্দবাস, বাগোয়ান, বাহাদুরপুর ছাড়া অধিকাংশ গাঁয়েই মসজিদ ছিল না। গ্রামের মুনশিজিকে জিজ্ঞাসা করেও কোরআনের বাণীর মর্ম উদ্ধার করা যেত না। বাগোয়ানের ফৈজদ্দিন মুনশি কোরআর পড়া জানতেন, আবার গ্রামে গ্রামে বঁদ গান গেয়ে বেড়াতেন। চাপড়া বৃত্তিহুদা-গ্রামে কবিদার কুবির গোঁসাই-এর সঙ্গে ফৈজদ্দিন মুনশির কবির লড়াই জমতো বেশ। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতেও কেউ-ই কাসাসুল আম্বিয়া পড়তে শেখেনি । কেবল মহরমের দিনে কুতুবপুর, সহগোলপুর, কুলবাড়িয়া থেকে লাঠিখেলার দল এসে বিভিন্ন কসরৎ দেখিয়ে আনন্দ দিত। সাহারবাটী আর খোকসার জারিয়ালরা যখন পাগলা কানাই-এর জারি পরিবেশন করতো, তখন ছেলে-বুড়ো কেউ কারো পানে চাইতে পারতো না। সবার চোখে জল, সবাই অশ্রু ভারাক্রান্ত ! বাহাদুরপুরের শেখপাড়ায় কারো কারো বাড়িতে কাসাসুল আম্বিয়া, তাজকিরাতুল আউলিয়া, রেয়াজুস সালাতিন, চাহার দরবেশ পাঠ করা হতো। ধানখোলার বিদ্যেৎসাহী অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মুসলমানরা মওলানা জালালুদ্দীন রুমীর মসনভী পড়তেন, ছেলেমেয়েদের নিজেরা-ই বাংলা ও ইংরেজিতে বর্ণপরিচয় করিয়ে দিতেন। যারা মুর্শিদাবাদে যেতেন, তারা নানান ধরনের বই আনতেন, পাড়া-প্রতিবেশীকে সে সব বইয়ের পাঠ শোনানো হত। কেউ বুঝতো, কেউ বুঝতো না। মেহেরপুরে গোঁড়া বৈদ্যবাড়ির সোমত্ত ছেলেরা মুনশিজির কাছে ফারসি শিখে-আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের শ্লোক মুখস্থ করতো। বৈদ্যগিরি করে অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হতো। কায়স্থ বাড়ির ছেলেরা পড়তো জয়দেবের গীতগোবিন্দ, ব্যাকরণ ও ঋজুপাঠ। কলকাতা- ফেরত শিক্ষিত বাবুরা সন্ধ্যায় উঠানের বেলগাছ তলার চৌকিতে বসে ছেলেদের গল্প শোনাতেন। ঈশ্বরগুপ্ত তাদের প্রিয় কবি ছিল। ইংরেজি-জানা বাঙালি বাবুরা নিজ ছেলেদের রামায়ণ-মহাভারত থেকে বাইবেল থেকে গল্প শোনাতেন। গৃহস্থ বাড়ির বৌঝিরা সেজেগুজে সমবেত হয়ে ষষ্ঠীতলায় পূজা দিতে যেতেন। পূজা শেষে ষষ্ঠীর পাঁচালি শুনে উপবাস ভাঙতেন। স্বামীর আয়ুক্ষয়ের ভয়ে জমিদারবাড়ির বৌরা দিনের বেলায় স্বামীর মুখ-দর্শন করতেন না। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে এক গলা ঘোমটা দিয়ে সরে যেতেন।
চৈত্র- বৈশাখ মাসে আগুন লাগলে সাহারবাটীর পূর্বপাড়া, গাড়াবাড়িয়া, সহগোলপুর, বাবরপাড়া,শ্যামপুর, বাহাদুরপুর, হিজলবাড়িয়া,হিন্দা, জুগিন্দা, পাকুড়িয়া, চিৎলা, খড়মপুর ইত্যাদি গ্রামের বারোজাতের মানুষগুলির বাড়িগুলি পুড়ে ছাই হয়ে যেত। ক’জন স্বচ্ছল জোতদারের পাকাবাড়ি ছাড়া এ অঞ্চলের সব বাড়ি-ই খড়ের। যাদের ঘর পুড়তো, তাদের আশ্রয় হতো গাছতলা কিংবা আত্মীয়ের বাড়িতে। একে নিদারুণ দারিদ্র্য, ঘরে চাল বাড়ন্ত, তার ওপর ভয়াবহ অগ্নিকা-। মেহেরপুর কিংবা করিমপুর থেকে কোনো সাহায্য আসতো না। তাই কাজলার মাছ আর কচুঘেঁচুর ওপর একমাত্র ভরসা। গ্রীষ্মের প্রচ- খরতাপে ঝোপঝাড় ফাঁকা ফাঁকা- কশাড়ের জঙ্গল বিবর্ণ। চরদিকে হাহাকার! বর্ষায় সব বাড়ির খড়-বিচালির চালে পচন ধরে, চাঁচারিতে ঘুণ। তারপরও গ্রামে গ্রামে কুঠি স্থাপিত হয়। নীলকর সাহেবদের ঘোড়া দূরন্ত বেগে সাহারবাটীর নীলেরমাঠ থেকে বাহাদুরপুরে ধুলো উড়িয়ে ছুটে যায় আমঝুপির দিকে। ভবরপাড়া, বল্লভপুর, রতনপুরে গড়ে ওঠে খ্রিস্টানপল্লী, কর্তাভজাদের প্রলোভন দেখিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষাদান করা হয়। সুযোগসন্ধানী ‘নেটিভরা’ সাহেবদের অনুকম্পা লাভের আশায় ফন্দি আঁটে। পান-ভোজন চলে জলসাঘরে, কলকাতা থেকে বাঈজি-নর্তকীরা আসে। পাইক-বরকন্দাজ এবং বাঈজি-নর্তকী-প্রমোদবালাদের ছাড়া আমঝুপি-শিকারপুরের সাহেবদের রাত কাটে না। সিম্পসন, কেনীর বোটে পিয়ারিজান কিংবা মুন্নিজানের নাচ চলে সারা রাত। ভাটপাড়া কিংবা আমঝুপির কুঠিবাড়ি প্রাঙ্গণে জ্যোৎ¯œাধৌত আকাশের নীচে আসর বসে প্রতিদিন। ধান- কোষ্টা- তিসি-তরমুজ বুনে মুক্তি আসেনি চাষিদের, দাদন নিয়ে নীল বুনে উনিশ শতকে মেহেরপুরের গ্রামগুলির অর্থনৈতিক মুক্তি এসেছিল কী ? আবদুল্লাহ আল আমিন: লোকগবেষক ও প্রাবন্ধিক। সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর।


সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১০:৪১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×