somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চাপরাশ/বুদ্ধদেব গুহ (বই রিভিউ)

১০ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(এই রিভিউ’টি সামু’তেই বেশ কয়েক-মাস আগে একবার পোস্ট করেছিলাম। ধর্ম-অধর্ম কিংবা ধর্মহীনতা নিয়ে রব উঠলেই এই বইয়ের কিছু লাইন বার-বার মনে পড়ে যায়। কেন এমন হয় সেটা বইটি ভালো করে পড়লেই বুঝে যাবার কথা। অন্তত আমার’তো তাই মনে হয়!)
চাপরাশ যে নেয় তাঁকে আমরা চাপরাশি হিসেবে জানি! হয়তো আমাদের দৃষ্টিতে সে খুব বড় কেউ নয়! তবু একজন চাপরাশি শুধু জানে চাপরাশ বইবার আনন্দ! আর আমরা প্রত্যেকেই তো কোনও না কোনভাবে চাপরাশ বয়ে বেড়াই। সে চাপরাশ ঈশ্বরেরই হোক, কি কোন মানুষের, অথবা কোনও গভীর বিশ্বাসের!
গল্পের শুরুটা হৃশীকেশের ত্রিবেণী ঘাটে...। শহুরে স্বার্থ-সংঘাত আর নিত্যকার জীবনে হাঁপিয়ে ওঠা;মানুষের স্থূল বৃত্তিতে, মানুষের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস হারানো চারণ চাটুজ্যে! জাগতিক নিজেকে, নিজের ভেতরের নিজেকে, জীবনের এতো দিক আর আয়োজনের অর্থ খুঁজতেই হয়তো একদিন কলকাতা ছেড়ে নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে পড়েছিল! তার সেই পথ গিয়ে পৌছায় ভারতের দক্ষিন-পশ্চিমের উত্তারাখণ্ড রাজ্যের পাহাড়-নদীতে বেষ্টিত হরিদ্বারে। পুণ্যতোয়া গঙ্গার কোল ঘেঁষাএই হরিদ্বার; অগণিত ধর্ম সাধক, আর ঈশ্বর ভক্তের তীর্থস্থান! চারণ চাটুজ্যের মতো কলকাতার নামীদামী, আধুনিক মস্ত মানুষ যখন হরিদ্বার, হৃশীকেশের ত্রিবেণী ঘাটে বসে পুণ্য যোগাবার বদলে পুন্যার্থী আর পূর্ণিমা-অমাবস্যার কথা ভাবে, তখন তোপাঠককে চমৎকৃত হতেই হয়!
এই আধুনিক জীবনে আমরা কত কিছু পেয়ে আবার কত কিছু হারিয়ে ফেলছি তার খবর হয়তো আমরাও জানিনা, কিংবা জানতে চাইনা! স্থূল স্বার্থ, নিজেরটা বুঝে পাবার, নিজেরটা ভোগ করবার নেশায় আমরা দেবার মতো করে দেবার ব্যাপারটা ভুলতে বসেছি। অথচ, ‘নেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ থাকে সে আনন্দ সস্তা। দেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ, সব কিছু থেকেও তা ছেড়ে দেওয়ার ছেড়ে আসার যে কি আনন্দ সেটা এই দেব ভূমির সাধকদের দেখে বুঝা যায়!’ সুখ কি, জীবন কি, মানুষের কেন এমন নিত্য আসা-যাওয়া? এইসব প্রশ্নের জালে আবদ্ধ চারণ ত্রিবেণী ঘাটে ভীমগিরি নামক এক সাধকের দেখা পায়। পরে ভীমগিরির তাঁকে নিয়ে যায় নিজ গুরু ধিয়নগিরির কাছে। বছরের পর বছর ধর্ম সাধনা করা এইসব সাধক কোনও না কোনভাবে চারনের মতোই জীবন-মরন, ধর্ম-কর্ম নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন কিনা, কে জানে? ঈশ্বরকে পাবার জন্য তাঁরা ভোগ বিলাস ত্যাগ করে, নিজস্বতা ভুলে ঈশ্বরে বিলীন হবার সাধনা করেন। সাধারনের চোখে অন্তত তাই মনে হবে, আমরা তাদের সন্ন্যাসী বলি! কিন্তু, চারণের কাছে তাঁরা বলেন অন্য কথা! বলেন বছরের বছর তাঁরা সন্ন্যাস নেবার চেষ্টাই করছেন, সন্ন্যাসী হয়ে উঠছেন না! বাসনার নানা রকম হাতছানি, শারীরিক-মানসিক-লৌকিক প্রতিবন্ধকতা চাপিয়ে সন্ন্যাসী সবাই হতে পারেন না। যেমন, কবিতা লিখলেই সবাই কবি নন, এক-দুইজনই কেবল কবি! তেমনি সন্ন্যাস ব্রত পালন করলেই সবাই সন্ন্যাসী হয়ে যান না, দু-একজনই কেবল সন্ন্যাসী হতে পারেন!
গল্পের যতো অগ্রগতি হতে থাকে ততো যেন চমক আর আকর্ষণ বাড়তে থাকে! এই পুণ্য ভূমিতে যেমন সাধক আছেন অনেক, তেমনি ভণ্ডেরও যে অভাব নেই একথাও সবাই জানে। এই এক রহস্যময় জায়গা, সবাইকে যেমন মহাপুরুষ মনে হয় আবার সবাইকেই মনে হয় ভেকধারী, ভণ্ড! এরই মধ্যে চারণের সাথে পরিচয় হয় পাটনের। কলকাতার মস্ত ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র মেধাবী পুত্র পাটন। আমেরিকার মতো ঝাঁ চকচক আরাম-আয়েস আর বিলাসের জীবন ছেড়ে যে কিনা ঠাই নিয়েছে হরিদ্বারে! গল্পের পরতে-পরতে এই পাটন যেন চারণের কাছে মূর্তমান এক ধাঁধাঁ হয়ে ওঠে! তবু এই পাটনই যেন চারণের আপনজন! অথচ, প্রকৃতার্থে আপনজন একজনের জীবনে ক’জন মানুষই বা হয়ে ওঠে!
হরিদ্বার, রুদ্রপ্রয়াগ, দেবপ্রয়াগের পথে-পথে, বনে-জঙ্গলে, নদীরধারে, কিংবা সাধু পুরুষদের ডেরায় ঘুরতে থাকা আধুনিক চারণের জীবনে একের পর এক চমক এসে উপস্থিত হয়। একেকজন সাধক যেন একেটি জ্ঞান কেন্দ্র। কি নির্লিপ্ত, নিবিড় চিত্তে পাহাড়ের গুহায়, প্রকৃতির মধ্যে, রোদ-বৃষ্টি-শীত-গরম সয়ে যান। বাহির থেকে ধর্মের তকমা এঁটে দেয়া হলেও তাঁরা তো কেবল ধর্ম চর্চা করেন না! আর সেটা তাদের সাথে কথা বলে কাছাকাছি থেকে বুঝতে পারে চারণ! আর যতো সে বোঝে ততো সে অবাক হয় ততো তার জানবার বুঝবার তৃষ্ণা যেন বেড়ে যায়! হিন্দু ধর্মের আদি জ্ঞান থেকে শুরু করে বর্তমান মানুষের জীবনদর্শন, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, সঙ্গীত কোনও কিছুই বাদ নেই! তুরতি, জিষ্ণু মহারাজ, সরলানন্দ নামক এইসব সাধকের জ্ঞানের রাজ্যে স্বামী বিবেকানন্দ থেকে শুরু করে তলস্তয়, রবি ঠাকুর, হুইটম্যান, কিটস, মীর কি মার্কস কেউই অনাহুত নন! অথচ তথাকথিত আধুনিকতার যুগে শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে অনেকেই আছেন যারা,আমি ধর্ম মানি কিংবা আমি ঈশ্বর মানি এই কথা বলতে রীতিমতো লজ্জা পান! লেখক এখানে তাদের পক্ষ থেকেও প্রশ্ন করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন! অথচ বহুদিন আগেই জ্ঞানী বলে দিয়েছেন, ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা আর ধর্মহীনতা, ধর্মবিদ্বেষ আর ঈশ্বরে অবিশ্বাস কোনদিন সমার্থক ছিল না।‘
তারপর, দেবী চন্দ্রবদনী মন্দিরে অনাগ্রহী চারণের জীবনে মানবী চন্দ্রবদনীর আগমন ঘটলো! আমরা এমন এক নারীর পরিচয় পেলাম, যিনি নারী হয়েও এমন অসীম ব্যক্তিত্বের আধার, যা ঐরকম অঞ্চলে দৈব লোকের আশীর্বাদ স্বরূপ! যার রূপের সাথে গুণের অসাধারন সমন্বয় ঘটেছে। যার শিক্ষার সাথে ভক্তির অপরূপ সংমিশ্রণ বিবাগী চারণকে নতুন জীবনের ভাবনায় এগিয়ে দেয়। পিতামহের আশ্রয়ে থাকা বিধবা তরুণী চন্দ্রবদনী; যেন নতুন এবং পুরানের এক অপূর্ব সেতুবন্ধন! যার প্রেম-ভালোবাসা-উচ্ছ্বাস কিংবা শোক সবই মাধুর্যের ধারক। এই নারী চারণের মধ্যে একই সাথে পূর্ণতা এবং অপার শূন্যতা দিয়ে ভরে দিয়েছে।
জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা নিয়ে ঘর ছেড়ে জীবনের মানে খুঁজতে আসা চারণ। সন্ন্যাস আর সন্ন্যাসীর জীবন তার কৌতূহলের কারণ হতে পারে কিন্তু সে নিজে সন্ন্যাসী হবে কি করে! তাই হয়তো জিষ্ণু মহারাজ তাঁকে জীবনের চাপরাশ নিতে উৎসাহী করেছেন! মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, অধিকার-অনধিকার, সত্য-মিথ্যা, জ্ঞান-অজ্ঞানতার নানা দিক নিয়ে বিস্তর আলোচনার মধ্য দিয়ে এতো সুন্দর একটা গল্প খুব কম হয়! এই দিকে লেখক অসাধারন প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন বলে আমার মনে হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:১৪
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মৃত্যু কাছে, অথবা দূরেও নয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



©কাজী ফাতেমা ছবি
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলি, আমারও সময় হবে যাবার
কি করে চলে যায় মানুষ হুটহাট, না বলে কয়ে,
মৃত্যু কী খুব কাছে নয়, অথবা খুব দূরে!
দূরে তবু ধরে নেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×