somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পারু-থাকসান মন্দিরের পথের বাঁকে-বাঁকে এবং নিঃসঙ্গ প্রকৃতি উপভোগ

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যাত্রা শুরু হল দশ সিটের এক গাড়ী করে। ড্রাইভারের পাশে মুন ভাই, রাস্তা ঘাটে বমির চর্চা থাকায় ড্রাইভারের পাশ বসে হেলপারের দায়িত্ব নি্লেন উনি। প্রথম তিন সিটে যখন আমাদের যাত্রা পথের দুই ভুটানি সঙ্গিনী বসল, তখন সৈনিক রমণীয় পারফিউমের অতি নিকট থেকে সুগন্ধ পাওয়ার আশায়, প্রথম সারির অধের্ক ভঙ্গ তৃতীয় সিট খান নিজের দখলে নিল। মধ্যর সিটে জানালার পাশে আমি উদাস, আমার পাশে বিবাহিত তরুণ আমু ভাই এবং আমাদের ভুটানিজ রাধুনি ভীম। পিছনের তিন খান সিট আমাদের শুকনা(চিপস, বিস্কুট) এবং ভিজা
খাবারের(ফানটা,কোক) দখলে চলে গেল।

হিমালয়ের পর্বতের খাজ কেঁটে ভারতীয়দের করা সর্পিল উচু-নিচু পর্বতময় রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ী ছুটে চলল। যাত্রা শুরুর আধাঘন্টা পরে এক আপেল বাগানের পাশে গাড়ী যখন থামল আমি ভেবে বসলাম হয়ত আপেল বাগান থেকে আপেল কিনব। নিজের হাতে আপেল গাছ থেকে আপেল পাড়ব ভেবে পুলকিত হলাম আমি। আমার পুলক থামতে ১০ সেকেন্ডও সময় লাগল না। হেলপারের পাশের সিট খান খুলে গেল এবং একটু পরেই মুন ভাইয়ের সজোরে ঘোৎ -ঘোৎ শব্দ অর্থাৎ বমি।
গাড়ি আবার যাত্রা শুরু করল। পারু এয়ারপোর্টের রাস্তা অতিক্রমের পর গাড়ীর ঝাকুনি আমার মত ঢাকার বাসে তিন ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার অভিজ্বতাসম্পন্ন তরুণের নাভিস্বাস উঠা শুরু করল। অল্পকিছুক্ষণ পর পাশে পাহাড়ী নদী পারু এবং তার মধ্য বড় বড় নুড়ি পাথর দেখে গাড়ী থামালাম। পারু নদী থেকে যখন পানির আজলা মুখে ছুড়ে দিলাম তখন মনে হল এই পানি মাত্র বরফ গলে নেমে এসেছে। নদীর কিনারে পা রাখা মাত্র পায়ের চাপে পাথর এবং মাটি সড়ে গিয়ে
নদীতে পরতে লাগল। অতি সাবধানে তীরের কিনারে দাড়িয়ে এক-দুই খান ফটো তুললাম আমরা। আর সেই সাথে একটু আড়ালে গিয়ে ছোট খান ত্যাগ করে এসে দেখি আমার দোস্ত সৈনিক ঘোড়ার মত দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। নাড়া দিতেই সৈনিকের উত্তর, মাইয়াগুলোর জায়গায় তুই থাকলে তোরে জড়াই ধরে ঘুমাতাম। যাত্রা শুরু করতে চাইলাম। সৈনিক এবং মুন ভাই যাত্রা শুরু করতে গড়রাজি, কারণ বমির ভয়। ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাদের গাড়িতে উঠান হল।

ছবিঃ পাহাড়ি নদী পারু এবং পিছনে প্রশাসনিক ভবন বা জং।
আবার যাত্রা শুরু হল। মধ্যপথে পারু শহরে থেকে পেয়াড়া জুস এবং পানি কেনা হল। উপত্যকায় গড়ে উঠা অনেকটা সমভূমির মত পারু শহর পাড়ি দেওয়ার পর মনে হল গাড়ি ক্রমাগত উপরে উঠছে। রাস্তার দুই পাশে নাম না জানা লম্বা লম্বা গাছের সারি। কিছুক্ষণ পর গাড়ি একটা সমভূমির মত জায়গায় এসে থামল।

ছবিঃ গাড়ির মধ্য থেকে পারু শহর।

গাড়ি থেকে নেমে আমাদের চোখ ছানাবড়া প্রায়, গাড়ি করে মাত্র পাহাড়ের পাচ শতাংশ এসেছি, বাকি পথ উঠতে হবে আমাদের দুই পায়ের উপর ভর করে।পর্বতারোহণের আগে আমাদের সবাই একখান করে খাবারের পুটলি হাতে নিলাম। আমি একটু চালাকি করে নিলাম পেয়ারা জুসের বড় ক্যান, কারণ মধ্যপথে পানির পিপাসা লাগবে এবং নিজের হাতে মাল থাকলে অন্য কার হাত থেকে নিতে হবে না। উঠার পথের মোড়েই গরীব ভুটানিজরা লাঠির পসরা এবং ভুটানিজ মালা টাইপ জিনিস নিয়ে বসেছে। এক-একখান লাঠির দাম ২০ নিউট্রান। উঠার সময় হয়ত লাঠির দরকার হবে না, কিন্তু নামার সময় লাঠির প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হল। কিন্তু দামের কারণে লাঠি কিনার ইচ্ছে জলাঞ্জলী দিয়ে রওনা দিলাম।লাঠি প্রিয় সৈনিক আপনমনে বলে চলছিল- লাঠি একটা দরকার, পথের মধ্য ডাল ভেঙ্গে হলেও লাঠির ব্যবস্থা করব।
যাত্রা শুরুর দশ-পনের মিনিট পর একটা শয়ন করার মত সবুজ ঘাসের চত্তর পেয়ে মুন ভাইয়ের আহাজারি- আপনারা আমারে ছাইড়া দেন, এই যে আমি শুইলাম আর কিন্তু নড়তে পারমু না। মুন ভাইয়ের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যাত্রা শুরু হল আবার সবাইকে নিয়ে।মধ্য তিরিশ
সেকেন্ডের জন্য যাত্রাবিরতি হল একটি ছোট পাহাড়ি ঝর্ণার সামনে। উপর থেকে নেমে আসা এই ঝর্ণাধারাকে একটি ঘুরন্ত মেশিনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মেশিনটি একটি বন্ধ ঘরের মধ্য থাকায় মেকানিজম সম্পর্কে কোন ধারণা করতে পারলাম না, যদিও মেশিনের মেকানিজম নিয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। একটি ভাগের পানি থেকে কিছু আজলা ঠান্ডা পানি আমি আমার মুখে মাখলাম। তারপর আবার যাত্রা শুরু। এতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের যাত্রা পথের দুই ধারে ছিল লম্বা-লম্বা গাছ যা দুপুর এগার-বারটার রোঁদ থেকে আমাদের ছায়া দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরেই সেই ছায়াময়ি গাছের সারি ফুরালো। পর্বতের এক প্রান্তের এক চিলতে পথ দিয়ে ভেতো বাঙ্গালি চারজন এবং সাথে সুপার শক্তিশালি দুই ভুটানিজ রমণী এবং এক পুরুষের থেমে থেমে যাত্রা চলতে লাগল। এখানে বলাবাহুল্য- যাত্রা বিরতি হচ্ছিল আমাদের ভেতো বাঙ্গালীদের কারণেই, যার অধিকাংশ আবার মুন ভাইয়ের নিঃশ্বাসজনিত কস্টের কারণে। প্রতি যাত্রা বিরতিতেই মুন ভাইয়ের সকরুণ একইরকম আহাজারি- আমারে আপনারা মাফ করেন, আমি রাস্তার কিনারে একপাশে শুইয়্যা রইলাম, আপনার যান। যেহেতু ভুটানিজ রমনী দুইজন জাতিগত ভাবেই পর্বত আরোহণে ওস্তাদি তাই প্রতি যাত্রা বিরতেই তারা আমাদের অগ্রে অর্থাৎ রাস্তার উপরিভাগে আমাদের জন্য অপেক্ষা করত তারা দুইজন। একপর্যায়ে মুন ভাইয়ের
অতি আহাজারিতে আমি ফাজলামি করে বললাম- মুন ভাই, মাগিরা(ভুটানিজ রমণী দুইজন) উপরে থাকবে, মর্দরা নিচে থাকবে এটা কেমনে হয়। প্রতিউত্তরে মুন ভাই না বাচক যা বলল তা ব্লগের ভাষায় আর নাই বা লিখলাম(অতি অশ্লীল হয়ে যাবে তাই)।

ছবিঃ যাত্রা বিরতি

ছবিঃ মধ্য-উধ্বর্গামী পথ থেকে পারু ভ্যালী
আমাদের বীর রাধুনি ভীম জঙ্গল থেকে এক খান লাঠি তথা গাছের ডাল নিয়ে আসল। দুপুর এগার-বারটা বাজায় সকালে যারা উপরে গিয়েছিল তারা তখন নিম্নগামী অর্থাৎ ফিরতি পথের যাত্রী,তাদের মধ্য কিছু রয়েছে ইউরোপ- আমেরিকানদের ন্যায় শেতাঙ্গ, কিছু জাপানি-কোরিয়ানদের ন্যায় নাকবোচা ,কিছু ইন্ডিয়ান। তাদের বেশ কিছু দলের সাথে হাই-হ্যালো কথার ফাঁকে প্রতিবার প্রশ্ন করতাম আর কত দূর উঠতে হবে আমাদের? একই রকম উত্তর আসত-মাত্র পথের পনের থেকে তিরিশ শতাংশ পার হয়েছি আমরা। ইউরোপিয়ান কেউ কেউ নির্ভয়ের বাণী দিয়ে বলল-উপরে একটা ভাল রেস্টুরেন্ট আছে, ওখানে ভাল রকম রেস্ট নেওয়া যাবে। তাৎ ক্ষণিকই আমাদের ভুটানি সঙ্গীনিরা সভয় দিয়ে বলল- রেস্টুরেন্টের জিনিসপত্রের দাম চওড়া, এক কাপ চায়ের দাম দুশত নিউট্রান।
আমাদের চারজনের মধ্য তিনজন বেরোজাদার ছিলাম যাত্রার শুরুতেই। কেবল আমু ভাইজান রোজা রেখে যাত্রাশুরু করেছিল। মধ্যহ্নের সূর্যের প্রখর রোঁদ এবং উচ্চতাজনিত নিঃশ্বাস নেওয়ার কস্টের কারণে উনি ঐ পাহাড়ি রাস্তার মধ্য আমার হাত থেকে জুসের বিরাট বোতল খান নিয়ে বলল-উপরে উঠার সময় কিছু খেলে মনে হয় রোজা ভাঙ্গে না। তারপর সেই বোতলের কিছু অংশ পানিয় উনি ঢক-ঢক করে উনার গলায় প্রবাহিত করে দিল।

ছবিঃ সৈনিক এবং তার লাঠি

ছবিঃবিধ্বস্ত ঘুমকাতুরে সৈনিকের বাশ জড়িয়ে রেস্ট নেওয়ার চেস্টা।
সেই পবর্তের একপ্রান্ত দিয়ে যাত্রাপথের কিছু উপরিভাগে এক সত্তরোধ্ব বয়স্ক দার্জিলিংয়ের লোকের সাথে দেখা। উনি আমাদের রাস্তার একধারে হাপাতে দেখে হায় হায় করে বলল-আমার মত বৃদ্ধ যদি এই পবর্ত উঠতে পারে দুই ঘন্টায়, তোমাদের মত ইয়ং গাই রাস্তার পাশে বসে হাপাচ্ছে, কেমন অদ্ভুত না ব্যাপারটা। আমার প্রয়াত দাদাজান থেকে সামান্য একটু কম বয়স্ক লোকের এই রকম টিটকারি মার্কা কথা শুনে আমার আতে যেন একটু ঘা লাগল। সাতাইশ বছর ছয় মাস বয়স্ক উদাসের সব ক্লান্তি যেন এক ঝটকায় দূরে চলে গেল। আমার বাকি সব সঙ্গী এবং সঙ্গীনিদের দূরে সরিয়ে সৈনিকের লাঠিখান ডান হস্ত করে, বাম হস্তে পেয়াড়ার জুস নিয়ে আমার একা-একা উধ্বর্মুখী যাত্রা শুরু হল। আমার এই নিঃসঙ্গ যাত্রার কিছুক্ষণ পরেই যেন রৌদ্রজনিত উত্তাপ কমাতে সামান্য দুরের পর্বতে মেঘের আনাগোনা শুরু হল,যার ঠান্ডা বাতাস আমার গা জুড়িয়ে দিচ্ছিল। আমার সাথীরা অনেক পিছিয়ে পড়ে যাওয়ায় তাদের জন্য মাঝে মাঝে দাড়াতাম। আবার যখন তাদের গলার আওয়াজ শুনতাম তখন উধ্বর্মুখী আমার যাত্রা শুরু হত।

ছবিঃসঙ্গীদের পিছনে ফেলে উদাসের উধ্বর্মুখী যাত্রা
এভাবে একা একা যাত্রা শেষে একটু সমতলের মত জায়গায় এসে দেখলাম একটা ঘন্টা বাজছে ছোট্র একটা ঘরের মধ্য থেকে। ঘর না বলে ছাউনি বলাই ভাল। তার সামনে বসে এক তামিল ভ্রমণকারি পরিবার তাদের দুপুরের খাবার নিচ্ছে। আমি ছাউনির অন্যদিকে গিয়ে শুয়ে পড়ে আবার যাত্রা সঙ্গীদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেকক্ষণ পর আমাদের যাত্রা সঙ্গীদের দেখা মিলল। সমতল এই জায়গা থেকে একদিকে চলে গিয়েছে রেস্তোরার রাস্তা, অন্যদিকে উধ্বর্গামী পথ।এই জায়গা থেকে থাকসান মন্দির অনেক পরিস্কার দেখা যায়। বেশ কিছুক্ষণ ফটো সেশন করলাম,বলা বাহুল্য সারা রাস্তায় আমাদের ফটোসেশন অব্যহত ছিল।কিছু গ্রুপ ফটো তুললাম। গ্রুপ ফটো তুলার এক পর্যায়ে আমার পাশে দাড়াঁনো ভুটানি রমণী আমার কোমরে হাত দিল।
তখন লাজুক-উদাস আমার মরি মরি অবস্থা,কবে কোন মেয়ের স্পর্শ পেয়েছিলাম ভুলে গিয়েছি অথবা আদৌ মা-নানী স্থানীয় ছাড়া কোন নারীর স্পর্শ আমার এই দেহে আছে কিনা মনে পড়ছে না। আমি তখন আমার স্বভাবজনিত লাজুকতা ভেঙ্গে প্রতিউত্তুরে সেই ভুটানি রমণীর স্কন্ধে আমার হস্তখান স্থাপন করলাম।

ছবিঃ যাত্রাপথের মধ্যস্থিত সমতল জায়গা থেকে থাকসান মন্দির

ছবিঃ গ্রুপ ছবি(কেবল উদাস নেই)
ক্ষণিকের ফটোসেশন শেষে আবার যাত্রা শুরু হল উধ্বর্গামী। এবার সৈনিক আমার সাথে অগ্রগামি যাত্রার সহচর হল। এবারের পথ অনেক ঠান্ডা, হালকা এক-দুই ফোটা অনেকক্ষণ পর থেমে থেমে বৃস্টি হচ্ছিল। এক পাশে উচু পর্বত, অন্য পাশে গুল্মময় লম্বা গাছ হালকা রোঁদ থেকে আমাদের রক্ষা করছিল। মধ্য গুহার মত একটা জায়গায় কিছুক্ষণের জন্য হালকা ফটোসেশন এবং পিছিয়ে যাওয়া সঙ্গীদের জন্য অপেক্ষা। তারপর আবার সেই পা ভেঙ্গে যাওয়া, নিঃশ্বাস নিতে কস্টকরময় উপরের দিকে যাত্রা শুরু।
কিছুক্ষণ পরেই পর্বতের উপরিভাগে একপ্রান্তে এসে পৌছলাম। এখান থেকে সোজা নেমে যেতে হবে নিচে তার পর আবার উপরে উঠতে হবে, তবেই পৌছা হবে থাকশান মন্দিরে। আমাদের তখনকার অবস্থান জায়গাটি প্রাকৃতিক ভাবে কম সুন্দর না। আণুভুমিক ভাবে সামান্য দূরে একটু নিচে অবস্থিত থাকসান মন্দির,পবতের প্রান্ত বলে অনেক নিচে অবস্থিত পারু উপত্যকা পরিস্কারভাবে দৃস্টিগোচর হচ্ছে। কিছুক্ষণ ফটোসেশন করলাম। আমার অধিকাংশ সঙ্গীরা
ফটোসেশনের জন্য আর অনেক সময় ব্যয় করতে থাকল। আমি পর্বতের এই শীর্ষ প্রান্ত থেকে নীচে নামার উদ্যোগ নিলাম। আমাদের সঙ্গীনি ফটোসেশনে ব্যস্ত ভুটানিজ রমণী আমাকে সভয় দিয়ে সাবধান হতে বলল এবং আর ও বলল নিকট অতীতে এই বিপদজনক রাস্তা দিয়ে নামতে গিয়ে এক-দুই জন পর্যটকের পর্বতের প্রান্ত থেকে নিচে পড়ে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে। আমি ও ভীম একসাথে নামতে লাগলাম।

ছবিঃ প্রান্ত থেকে পাথরে হেলান দিয়ে আমু ভাই।
এক-দুই মিনিট পর পাচ ফিটের একচিলতে সমতল জায়গায় দুই-তিন খান ফটো তুলে আবার নিচে নামা শুরু করলাম।

ছবিঃ পাচ ফুট সমতল জায়গা থেকে ভীম, পিছনে মন্দির
একমিনিট নিচে নামার পর আমার চোখ ছানাবড়া। রাস্তা একেবারে খাড়া নিচে নেমে
গিয়েছে। আমার কেবল হাফ ফুট পাশেই খাড়া পর্বতের ঢাল, পা একটু ফসকালে সোজা নিচে। তার উপর আমার অ্যাপেক্স জুতা দিয়ে পা হচকানোর রের্কড আছে, সাথে যোগ হল আমার উচ্চতা জনিত ভীতি। আমি তৎ ক্ষণাৎ সিদ্বান্ত নিলাম আমি আর নিচে যাব না। আমার অবশিস্ট সঙ্গীদের অপেক্ষায় রইলাম ঐ ঢালু জায়গায়। কিছুক্ষণ পর আমাদের অবশিস্ট পাঁচ সঙ্গীরা এসে হাজির হল। বাঙ্গালী তিন জনের মধ্য দুই জন দোটানায় পড়ে গেল যাবে কি যাবে না। ইতিমধ্য খাড়া এই রাস্তা বেয়ে উপরে উঠে আসল এক বাঙ্গালী-আমেরিকান দম্পতি। আমেরিকান পুরুষটি বলল-নিচের রাস্তা অনেক খাড়া এবং বিপদজনক। ভুটানিজ দুই রমণী এবং ভীমের উৎসাহে অবশিস্ট তিন বাঙ্গালী নিচে রওয়ানা দিল। আমি বাঙ্গালী-আমেরিকান যুগলের সাথে উপরে উঠে আসলাম। উপরে উঠে সেই উচু পর্বতের একপ্রান্তে বসার মত পাথুরে বেঞ্ছে অবস্থান নিলাম।বাঙ্গালী-আমেরিকান যুগল কিছুক্ষণ পর আমার থেকে গুড বাই নিয়ে ফিরতি পথ ধরল। আর আমি সমুদ্র সমতল থেকে দশ হাজার ফুটের মত উপরে একা অবশিস্ট সঙ্গীদের অপেক্ষায় রইলাম।
প্রাকৃতিক নির্জনতায় ডুবে আমিঃ প্রকৃতির একাকিত্ব আমায় যেন গ্রাস করতে থাকল ধীরে ধীরে। সামনে পর্বতের চূড়ায় সাদা ঘন মেঘের খেলা। বেঞ্ছের উপরে এক পা ছড়িয়ে মাথা পাথরে হেলান দিয়ে আধশোয়ার মত করে বসলাম। আমার বাম দিকে পর্বতের খাড়া খাদ। বেঞ্ছের উপরে ছড়ানো বাম পায়ের দিকে সবুজ পারু ভ্যালী। এই সবুজের মধ্য দিয়ে পারু নদীকে মনে হচ্ছে যেন সবুজ কাগজের উপরে সাদা পেন্সিল দিয়ে ছোট কোন শিশুর আঁকা-বাকা দাগ। হালকা কুয়াশার মত একটা সাদা স্তর আমায় যেন ঘিরে ধরল, হালকা ঠান্ডা পানির ছোয়া যেন আমার মুখ স্পর্শ করল। আমার উদাস মন হারিয়ে গেল দূরে কোথায় যেন। মনে হল যেন যুগ যুগ ধরে এই প্রকৃতির মাঝে আমি বাস করতে পারি, প্রিয়ার স্পর্শহীন,বন্ধুর ভালবাসাহীন অবস্থায়। যেন আমার হ্রদয়ের গভীর প্রদেশ থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এই দৃশ্য শুধু উপভোগের শুধু ভোগের। তথাকথিত মানুষের গড়া কৃত্রিম সৌন্দর্য স্থান কখনও এই অপার্থিব সৌন্দর্যের মত ভাষাহীন, ভাবনাময় ,ভালবাসার আধার হতে পারে না। ঠিক আমার রাশির দুই বিপরীত চিহ্নযুক্ত মাছের মত কেন জানি উলটো মনে পড়ল কৃত্রিম ঢাকা শহরকে, যেখানে বাস করে আমার প্রিয় কিছু মুখ। মনে হল এই ভাষাতীত নিঃসঙ্গ সৌন্দর্য একা ভোগ না করে শেয়ার করি। পকেট থেকে মোবাইল বাহির করলাম। মোবাইলের গায়ে কিছু ফ্রিকোয়েন্সির দাগ দৃশ্যমান, বুঝতে পারলাম কল করা যাবে। কিন্তু যাকে ফোন করব বলে মোবাইল বাহির করা, আমার আঙ্গুল তার নাম্বারে ডায়াল করল না। ডায়াল হল এক ছোট ভাইয়ের নাম্বারে। দৃশ্য বর্ণণা করতেই ছোট ভাই আফসুসজনক আহা-উহু করল। মাকে ফোন দিলাম। একটি এসএমএস লিখলাম( যা এখানে সরাসরি তুলি দিলাম)ঃ
আমি অনেক উচু এক পর্বতের চূড়ায় এক পাথরে হেলান দিয়ে চারি দিককার পর্বতের উপরের মেঘ দেখছি। সেই মেঘের মধ্য দিয়ে সূর্যের এক চিলতে আলো দূরের পাহাড়ে খেলা করছে।আমার চারিধারে মেঘের আস্তর আছে মনে হয়।কেবল এখনি কিছু বৃস্টির ফোটা আমায় ছুয়ে গেল-উদাস।

এসএমএস খানি পাঠিয়ে দিলাম কিছু প্রিয় মানুষের ঠিকানায়, কেউ হয়ত পেল কেউ হয়ত পেল না।
এসএমএসে বর্ণিত দৃশ্য তখন আমার চারিধারে যেন আর সাবলীল ভাবে বিদ্যমান। নিঃসঙ্গ, উদাস, চিন্তাময় এবং শক্তিশালী চিন্তাহীন আমি বৃস্টির ঠান্ডায় কেপে উঠলাম। ভেবে নিলাম প্রকৃতিকে উপভোগ করতে হবে, ফুল হাতা শার্ট খুলে ফেললাম, জুতা-মৌজা খুলে ফেললাম।
চিন্তা করলাম হাফ হাতা টি-শার্ট খুলে ফেলব, কিন্তু প্রচন্ড ঠান্ডা মেঘ আমায় যেন কাবু করে ফেলছিল।তবুও খুলে ফেললাম গায়ের টিশার্ট-জয় হোক প্রকৃতির। মেঘের ফাঁক দিয়ে আসা সোনালি রোঁদ আমায় ওয়ারফেজের 'বসে আছি একা' গান মনে করে দিচ্ছিল। মোবাইলের জঘন্য টাইপ স্টেরিও সাউন্ডে শুনলাম প্রথমে 'বসে আছি একা', তারপর'আনফরগিভেন টু' এবং 'লিভিং অন প্রেয়ার'। তারপর মোবাইলে গান শোনা বন্ধ করে চারিধারে তাকিয়ে রইলাম। থাকশান মন্দিরের পাশে তখন রঙ্গধনু। কিছু ছবি তুললাম। তারপর সেই একইভাবে হেলান দিয়ে প্রকৃতিতে ডুব মারলাম।

ছবিঃ পাশের পর্বতে মেঘের খেলা

ছবিঃ বৃস্টিস্নাত থাকসান মন্দির এবং পাশে রঙ্গধনু
অনেক্ষণ পরে মনে হল নিচে কিছু শব্দ। টি-শার্ট পড়ে নিলাম। ফিরে এল আমার সঙ্গীরা। ফিরতি যাত্রা শুরু হল।

ছবিঃ আমার বন্ধুদের তোলা থাকসান মন্দিরের নিকটস্থ ঝর্ণা ও পর্বতের ভিতরে বাড়ী

ফিরতি পথে আমার মনে হল- মন্দিরে যাওয়া উচিত ছিল তাদের সাথে, আবার মনে হল প্রকৃতি যেভাবে আমি উপভোগ করতে পেরেছি সেভাবে হয়ত পারতাম না মন্দিরে গেলে।
আমার জন্য নিঃসঙ্গ উপভোগ অনেক বেশি উপভোগময় হয়েছে।








সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৩৩
১৭টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×