উইন্টার যুদ্ধের পটভূমিঃ পোল্যান্ডের যুদ্ধ পূর্বঅণুমিত সময়ের থেকে কম সময়ে শেষ। জার্মান এবং সোভিয়েতদের প্রভাব বলয়ের ভাগাভাগির ফলশ্রুতিতে লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়ার মত ছোট দেশ সোভিয়েতর সাথে আত্নীভূত তখন। স্টালিনের চোখ বিশ বছর আগে রুশ বিপ্লবের ডামাডোলে হারান ভূখন্ড ফিনল্যান্ডের দিকে অথবা রুশ সাম্রাজ্যর সাবেক রাজধানী তখনকার লেনিনগ্রাদের(পূর্বে এবং বর্তমানে সেন্টস পিটাসবার্গ)জন্য বাফার জমি পাশ্ববতী ফিনল্যান্ড হতে।
১৯৩৯ সালের শেষের দিক হতে ফিনল্যান্ডের থেকে বাফার জমি এবং ভবিষ্যত জার্মান-সোভিয়েত যুদ্ধের আশংকায় ফিনল্যান্ডে সৈন্য ঘাটি দাবি করল সোভিয়েত।ফিনল্যান্ডের স্বাধীনতার সময় ফিনল্যান্ডের সিভিল ওয়ারের পর্যায়ে বলশেভিক সমর্থিত লাল বাহিনীর সাথে ফিনল্যান্ডের সরকারী বাহিনীর সংঘর্ষে যে অবিশ্বাসের বীজ বপন হয়েছিল বিশ বছর পরে সেই বীজ হতে জন্ম নেওয়া অবিশ্বাসের বৃক্ষের কারণে ফিনল্যান্ড সোভিয়েত দাবি প্রত্যাখান করল।
ফিনল্যান্ড হতে প্রায় বিশ গুণ বড় একটি দেশ সোভিয়েত রাশিয়া , প্রায় দুই-তিনগুন সৈন্য, ট্যাংক এবং ব্যাপক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল।শুরু হল সোভিয়েত-ফিনল্যান্ড যুদ্ধ অথবা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের একটি ক্ষেত্র উইন্টার ওয়ার।
সোভিয়েত বাহিনী মূলত লেনিনগ্রাদের সেফটির জন্য কারেলিয়ান ইস্তুমুস দিয়ে অগ্রসর হলেও লাডজা লেকের উত্তরের দিকে ব্যাপক সৈন্য নিয়োগ করেছিল।
ছবিঃ সমগ্র যুদ্ধের ফ্রন্ট।
উপরের ছবি অণুসারে যুদ্ধের ফ্রন্ট তিন ভাগে বিভক্ত।
১। মেইন ফ্রন্ট তথা কারেলিয়ান ইস্তমুস(Karelian Isthmus) –নিচের বক্স অংশ
২।মেইন ফ্রন্টের সাপ্লাই লাইন - লাডোজা কারেলিয়া(Ladoga Karelia) –মধ্যর অংশ
৩। পেস্তামো বন্দর এবং অন্যান্য জন্য- মধ্য ফিনল্যান্ড থেকে বাকি অংশ।– উপরিভাগের অংশ
ছবিঃমেইন ফ্রন্ট ইস্তমুস(ডটেড লাইন সোভিয়েত-ফিনল্যান্ড বর্ডার ১৯৩৯ এবং বোল্ড লাইন ফিনল্যান্ডের ডিফেন্স লাইন নাম ম্যানহেরিম লাইন)
আমার পোস্টের আলোচ্য বিষয় মেইন ফ্রন্ট না,লাডোজা কারেলিয়া অঞ্চলের একটি ফিল্ড।
কারেলিয়ান ইস্তমুস অঞ্চলের একদিকে ছিল তৎকালিন ফিনল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ভিপুরি(Viipuri) এবং অন্যদিকে লেনিনগ্রাদ। যুদ্ধের পূর্ব্বতী সোভিয়েত ডিমান্ডের মধ্য ছিল ভিপুরি সোভিয়েতের হাতে ছেড়ে দেওয়া। তাই এই গালফ অফ ফিনল্যান্ড এবং লেক লাডোজার মধ্যবর্তী করিডোরটি হয়ে উঠে প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র। ফিনিশদের মেইন ডিফেন্স লাইন ম্যানহেরিম লাইন(ট্রেঞ্চ,ফোর্ট ইত্যাদি দিয়ে গড়া) ছিল এই অঞ্চলে। তবে এই মেইন ফ্রন্টের খাবার সাপ্লাই হত লেক লাদোজার উত্তরের জায়গা লাডোজা কারেলিয়া (মধ্যর যুদ্ধক্ষেত্র) দিয়ে।
১৯৩৯ এর ৩০ নভেম্বরে সোভিয়েত বাহিনী ফিনল্যান্ড বাহিনীর কয়েকগুণ বেশি সৈন্য,কয়েকগুন যুদাস্ত্র এবং সম্পূর্ণ বাতাসে বিমান বাহিনীর রাজত্ব নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল মধ্যর অঞ্চল লাডোজা কারেলিয়াতে, উদ্দেশ্য মেইন ফ্রন্টের জন্য রসদ সাপ্লাইকারি সড়কপথ সোড়তাভালা(Sortavala) থেকে জোয়নশু(Joensuu) দখলে আনা। বস্তুত এই অঞ্চল প্রাকৃতিক বৈরিময় হওয়ার কারণে এই অঞ্চলে ফিনল্যান্ড অপেক্ষাকৃত মর্ডান সোভিয়েত তথা রেড আর্মির ম্যাসিভ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাই যুদ্ধের প্রথম দিনেই সোভিয়েত আক্রমণে ফিনল্যান্ড বর্ডার এলাকা থেকে পিছু হটতে থাকে । তোলপাড় হয়ে যায় ফিনল্যান্ডের সেনা অধিদপ্তরে, কারণ সোভিয়েত বাহিনী সাপ্লাই লাইন দখলে নিতে পারলে মেইন ফ্রন্টের রসদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে এবং রসদ সরবারহ বন্ধ হলে অল্প কিছুদিনেই ফিনল্যান্ডের হার শিকার করতে হবে। সোভিয়েত অগ্রযাত্রার মুখে যুদ্ধ শুরুর চার দিনের মাথায় লেক লাদোজা এলাকার সেনানায়কের পরিবর্তন আনে ফিনল্যান্ড। তারপরেও থেমে থাকে না সোভিয়েত অগ্রযাত্রা। যুদ্ধ শুরুর সাতদিন পরে প্রথমবারের মত রেড আর্মি বাধার সন্মুখীন হয় ছোট্র এক নদী অথবা পানির ধারা সম্পন্ন এলাকা হতে যে ধারার নাম কোল্লা। এই স্থানে ফিনল্যান্ড উইন্টার ওয়ারের সব থেকে বিখ্যাত এবং অভঙ্গুর প্রতিরোধ গড়ে তুলে।
ছবিঃ মধ্যঅঞ্চলে প্রথমদিককার সোভিয়েত অগ্রগামিতা
কোল্লার প্রতিরোধ এবং সাদা মৃত্যদূতঃ
ছবিঃ বর্তমানে শান্ত যুদ্ধের কোল্লা এলাকা
ছবিঃ যুদ্ধ চলাকালীন ম্যাপ (সবুজ বক্স কোল্লা এলাকা, কালো দাগ রেললাইন)
প্রথম দিনে ডিসেম্বর-৭ ১৯৩৯ কোলাস্থ ফিনিশ বাহিনীর কাছে অর্ডার আছে কোল্লাস্থ রেললাইন সিকিউরড করা। ডিসেম্বরের ৭ তারিখে ফিনিশ বাহিনী আক্রমণে থাকলেও ডিসেম্বরের ৮ তারিখে সোভিয়েত আক্রমণে কোলাস্থ রেললাইন কিছুটা ভেঙ্গে পড়ে।আক্রমণ প্রতিরোধের পর ৩০ মিনিটের মধ্য ফিনিশ বাহিনী রেললাইন পুনরায় মেরামত করে। এভাবে আক্রমণ প্রতি আক্রমণে ফিনিশ বাহিনী কয়েকগুণ শক্তিশালী রেড আর্মির সামনে থেকে কোল্লা প্রতিরোধ গড়ে তুলে। কোল্লা অঞ্চলে ছিল অল্প কিছু সড়ক পথ,যা ফিনিশ গার্ড দ্বারা সংরক্ষিত থাকত। তার উপরে ছিল ১৮৩০ সালের পরের সব থেকে বেশি শীত(-২০ থেকে -৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) , মূলত সোভিয়েত সেনারা এত ঠান্ডা মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিয়ে আসে নাই যুদ্ধক্ষেত্রে।সাদা বরফের রাজ্য সাদা রংয়ের ড্রেস ছিল ফিনিশ বাহিনীর পক্ষান্তরে সোভিয়েত সেনাদের খাকি ড্রেস একদিকে ফিনিশদের যেমন বরফের রাজ্য লুকাতে সাহায্য করত অন্যদিকে সোভিয়েতদের সহজেই চোখে ধরা যেত।
ছবিঃ ক্রিসমাস্ট ডে তে কোল্লা ফিল্ডে প্রাথর্নারত ফিনিশ বাহিনী
যুদ্ধের শেষের দিকে মস্কো পিস চুক্তির একটু আগে ফিনিশরা সোভিয়েতদের কাছে কোল্লা অঞ্চলের খানিকটা হারিয়ে ফেলে। পুনরায় দখলে জন্য ফিনিশরা যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন হাইকমান্ড থেকে অর্ডার আসে পালটা আক্রমণ বন্ধের কারণ তার আগে (ফিনিসরা অপমানজনক মস্কো পিস চুক্তি মেনে নিয়েছে মূলতঃ মেইন ফ্রন্টে পরাজয়ের কারণে।)
ডিসেম্বর থেকে মার্চ এই দীর্ঘ সময় ফিনিশরা নিজেদের থেকে কয়েকগুণ সৈন্য সংখ্যা এবং অস্ত্রগুণে শক্তিশালি সোভিয়েতদের হাত থেকে কোল্লা রেল এলাকা মুক্ত রাখে। ব্যাটল অফ কোল্লা "kolla hold" নামক ফিনিশদের কাছে এক বিরোচিত মিথ হিসেবে পরিচিত।
কথিত আছে, উইন্টার যুদ্ধের শেষ পর্যায়ের দিকে কোল্লার দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনানায়ককে তার উদ্ধর্তন কর্তা যখন প্রশ্ন করে ছিল "Will Kollaa hold?" তখন কোল্লারর সেনানায়কের উত্তর ছিল-"অবশ্যিই কোল্লার প্রতিরোধ ধরে রাখা সম্ভব যতক্ষণ না পর্যন্ত সৈন্যদেরকে পশ্চাদপসরণের অর্ডার দেওয়া হচ্ছে।"
কোল্লার যুদ্ধ “kolla hold” মিথ ছাড়াও আরো এক কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে, সেই অন্য কারণ হল এক স্নাইপার যার উচ্চতা মাত্র পাচঁ ফুট তিন ইঞ্চি। এত কম উচ্চতা নিয়ে উনি ইতিহাসের বেস্ট স্নাইপারের মর্যাদা পেয়েছেন। না 'এনিমি এট দ্যা গেটের'(স্ট্যালিনগ্রাদ যুদ্ধের) ভাসিলি জাইতসেভ না ফিনিশ এই সাইমো হাইয়ার দখলে আছে সবোর্চ্চ শত্রু সেনা মারার রেকর্ড। স্নাইপারদের লগবুকে সাইমো হাইয়ার পাশে লেখা আছে ৫৪২ জনের বিরুদ্ধের জয়ের রেকর্ড,যেখানে ৪০০ জনের বিরুদ্ধে রেকর্ড নিয়ে ভাসিলির অবস্থান প্রথম পাঁচের মধ্য না।সোভিয়েতদের তৈরি মোসিন নাগান্টের ফিনিস ভার্সন M28 এবং এসএমজি ছিল কোল্লার যুদ্ধক্ষেত্রে সাইমো হাইয়ার অস্ত্র।
ছবিঃ কম উচ্চতার স্নাইপার শ্রেষ্ঠ সাইমো হাইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে তোলা ছবি
সাদা বরফ তার উপরে সাদা কাপড়ের সাক্ষাত যম সাইমো হাইয়া সোভিয়েতদের কাছে তার খুনে দক্ষতার কারণে উপাধি পেয়েছিল সাদা মৃত্য বলে। সাদা মৃত্যর নিপুণ খুনে দক্ষতায় ভীত সম্ভ্রস্ত্র কোল্লা ফিল্ডের সোভিয়েত কমান্ডাররা সাইমো হাইয়্যাকে ধ্বংসের জন্য ব্যাপক গোল্লা নিক্ষেপ করল ফিনিশ লাইনে, উড়িয়ে আনা হল সোভিয়েত স্নাইপার কিন্তু তারপরেও অব্যাহত থাকল সাদা মৃত্যর M28 এর নিখুত নিশানা। মার্চ ৬ ১৯৪০ প্রথম বারের মত এক সোভিয়েত স্নাইপারের বুলেট এসে লাগে 'সাদা মৃত্যর' মুখে, উড়ে যায় চোয়ালের সম্মুখভাগ, প্রাথমিকভাবে লুটিয়ে পরে শত্রুর কাছে সাদা মৃত্য খেতাব ধারি সাইমো হাইয়া। লুটিয়ে পরার পরক্ষণেই অজেয় সাইমো হাইয়া নিজের রাইফেল খুজে পায় এবং হত্যা করে বিপক্ষের স্নাইপারকে। নিজ দেশের সহকারিরা আহত সাইমো হাইয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সাইমো হাইয়া আহত হওয়ার এক সপ্তাহ পরে ফিনিশরা অপমানজনক মস্কো চুক্তি মেনে নেয় এবং হারায় নিজেদের ভুখন্ডের কিছু গুরত্বপূর্ণ অঞ্চল কিন্তু ধরে রাখে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য পরিচয়। কোল্লা অঞ্চলের যুদ্ধে আহত স্নাইপার গুরু সাইমো হাইয়্যার ভাঙ্গা চোয়াল নিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে সময় লেগে যায় কয়েক বছর , সেই কারণে অংশগ্রহণ করা হয়ে উঠে না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরেকটি পার্ট কন্টিনিউশন ওয়ারে। হয়ত অংশগ্রহণ করলে এই স্নাইপার মাস্টারের শিকার আরো বাড়ত।
ছবিঃ বিকৃত চোয়ালের সাদা মৃত্যদূত
উইন্টার ওয়ারের ৬২ বছর পরে ২০০২ সালে এপ্রিলের এক তারিখে আনুমানিক ৯৭ বছর বয়সে মৃত্য ঘটে এই ফিনিশ বীরের। মাত্র ১০০ দিনের যুদ্ধে পাচ শতাধিক মতান্তরে সাত শতাধিক শিকার সত্যিই বিস্ময়কর।
পরিশেষে, যুগে যুগে আধিপত্যবাদিদের বিরুদ্ধে যেসব বীরেরা মাতৃভূমির ডাকে অস্ত্র দিয়ে সাড়া দিয়েছিল তাদের সশ্রদ্ধ সালাম।
নোটঃ উইন্টার ওয়ারের উপর ভিত্তি করে একটি মুভি আছে নাম Talvisota (ফিনিশ মুভি), আমার নেক্সট ওয়ার মুভি টার্গেট।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১০:৩৭