somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প: মপেতিস

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দেশটা অদ্ভুত! অদ্ভুত না বলে অদ্ভুত সুন্দর বলা উচিত। এরকম নিয়ম কানুন কোনো দেশে থাকতে পারে, এটা হয়ত আমরা ভাবতেই পারি না। আমি জাহাজ থেকে নামার পর থেকে শুধু অবাক হচ্ছি আর হচ্ছি। দেশটিতে কোনো পাবলিক বিমানবন্দর নেই, অর্থাত চাইলেই সেখানে যে কেউ সহজে যেতে পারবে না, সমুদ্র পথেই যেতে হয়। শুধু দেশের জরুরী কাজে তারা একটি বিমানবন্দর ব্যবহার করে। নাগরিক সেবার কাজেও সেটি ব্যবহার করে, তবে দেশ ভ্রমণ বা এরকম কোনো কাজে বিমান বন্দরটি ব্যবহৃত হয় না।
দেশটি একটি দ্বীপ দেশ। প্রশান্ত মহাসাগরের বুক চিরে এটির অবস্থান। আমি বিশ্বের সেই ভাগ্যবান দশজনের একজন যে দেশটিতে আমন্ত্রিত হয়ে যাবার সুযোগ পাচ্ছি। বাইশ দিন সমুদ্র পথে ভ্রমণ শেষে আমরা পৌঁছেছি ছোট্ট দেশ মপেতিসে।
নামার সাথে সাথে আমাদের অর্ভ্যত্থনা জানালো দশজন শিশু, ওরা কারো সাথে আসেনি, ওরাই আমাদের নিয়ে গেল গেস্ট গাউসে। সমুদ্রের পাড়ে গেস্ট হাউজ। যাওয়ার আগে বন্দরে আমাদের ডাবের পানি এবং কাঁঠালের মতো এক ধরনের ফল খাওয়ালো। শুকনো ফল।
এই শিশুদের শিশু বলা কঠিন, কারণ, ওরা এতটা স্বাভাবিকভাবে আমাদের সাথে কথা বলছে যে মনে হচ্ছে এটাই তাদের পেশা, অথচ পরে জেনেছি যে ওরা পেশাদার নয়, হোস্টেল থেকে লটারির মাধ্যমে দশজনকে পাঠানো হয়েছে। ওদের কারো বয়স দশ বছরের বেশি হবে না। ভাষার কোনো সমস্যা হচ্ছে না, কারণ, দেশটির ভাষা ইংরেজি। পাঁচজন তরুণ ইংরেজি পর্যটক ১৭৬২ সালে এখানে একটি দেশের গোড়াপত্তন করে, নিয়মকানুনও বেশিরভাগ তাদেরই তৈরি।
একটি সুউচ্চ ভবনের ৩৬ তলায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। এখান থেকে চারিদিকে সমুদ্র দেখা যায়। দশজনের জন্য সুবিশাল দশটি রুম ওরা গুছিয়ে রেখেছে। আমাদের সাথে এক মাস ধরে ইনডোর গাইড হিসেবে কাজ করবে এই দশটি শিশু।
ওদের থাকার জন্য দেখলাম ক্লাসরুমের মতো বড় একটি রুম, যেখানে সুশৃঙ্খলভাবে ওরা থাকে। ওরা যে সবসময় এখানে থাকে তা নয়, যখন গাইড হিসেবে কাজ করে তখন থাকার জন্য এই গণরুমটা। খোঁজ নিয়ে জেনেছি কেন ওদের প্রত্যেককে আলাদা রুম দেওয়া হয় না। এভাবে থেকে ওরা ভ্রাতৃত্ববোধ শেখে, একে অপরের প্রতি সহমর্মী হয়। কাজগুলো ভাগ করে নেয়। আমাদের সাথে থেকে এক মাসে ওদের যে অভিজ্ঞতা হবে সেটি ওরা আবার লিখিতভাবে রিপোর্ট করবে। বলা যায় এটা এক ধরনের পরীক্ষা। তবে কর্তৃপক্ষ কখনই বলে না যে এটা পরীক্ষা, কোনো মার্কস নেই এর জন্য, কেউ প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয়ও হয় না।
মাত্র ৩৭ বর্গকিলোমিটারের একটি দেশ মপেতিস। লোকসংখ্যা বর্তমানে এক লক্ষ তেরো হাজার সাতশো সাইত্রিশ জন। আমরা বন্দরে নামার সাথে সাথে একটি ডিসপ্লে বোর্ড চোখে পড়েছে সেখানে দেখিয়েছে—
দেশের মোট লোকসংখ্যা: ১,১৩,০০০ জন। অতিথি ৭৩৭ জন। আমরা নামার আগে অতিথি লেখা ছিল ৭২৭ জন। শিশুদের সংখ্যাটা আলাদাভাবে লেখা দেখলাম। শিশু আছে দেশটিতে বর্তমানে ২৮,০০৭ জন। আরো অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য সেখানে রয়েছে।
দেশটিতে দুই সন্তানের বেশি নেওয়া যায় না। কুমারী মেয়েরাও মা হতে পারে। অবশ্য কুমারী বা বিবাহীত বলে এদেশে কিছু নেই। দেশটির পুরো গল্প অনেক লম্বা। এক মাসে অনেক গল্প জমা হয়েছে। শুধু সন্তান ধারণ এবং সন্তান লালন পালনের বিষয়টি বলি, সব বলতে গেলে গল্পটা বিশাল হয়ে যাবে। প্রতিটি সন্তান দেশটিতে হাসপাতালে জন্ম নেয়। একটিই হাসপাতাল, বিশাল হাসপাতাল। প্রতি দশ কিলোমিটার পর পর হাসপাতালের শাখা রয়েছে, তাই চিকিৎসা সেবা দেওয়ার কজটি কঠিন নয়। সন্তান জন্ম নেওয়ার সাথে সাথে ঐ সন্তানকে মা বা বাবা কেউ দেখতে পারে না। সন্তানটিকে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে পাল্টে দেওয়া হয়। একদিনে দশ থেকে বিশটি শিশু জন্ম নেয় মপেতিসে। শিশুগুলো অদল বদল করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ কেউই তার নিজের পেটের সন্তান নিয়ে বাড়ি ফেরে না। নিজের সন্তানটি ছেলে নাকি মেয়ে হয়েছিল তাও জানার সুযোগ থাকে না। প্রাথমিকভাবে যে পরীক্ষা নীরীক্ষাগুলো করা হয় সেগুলো সাংকেতিক ভাষায় লেখা হয় এবং হাসপাতালেই সংরক্ষিত থাকে। শুধু হাসপাতাল কতৃপক্ষ জানে জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুর ঠিকুজি। পিতা-মাতারা জানতে পারে যে শিশুটিকে তারা পালন করছে তার সম্পর্কে তথ্য।
তাছাড়া কার পেটে কার সন্তান সেটিও অনেক সময় বলা মুশকিল। দেশটির নাগরিকরা নিজেদের মধ্যে ইচ্ছেমতো মেলামেশার সুযোগ পায়। পরকীয়া বৈধ, বরং বাধা দেওয়া অবৈধ। অবশ্য পরকীয়া আর স্বকীয়া বলে সেখানে কিছু নেই, আছে শুধু প্রেম। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব বলেও কিছু নেই, কারণ, সব সুযোগ সুবিধাই সেখানে হাতের নাগালে এবং নাগরিক সুবিধা হিসেবে প্রাপ্য। আছে আকর্ষণ, ভালোবাসা, সহমর্মিতা, কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
মেলামেশা অবাধ হলেও তা অবৈজ্ঞানিক নয়, আবার প্রেম বিবর্জিতও নয়। ছোঁয়াচে রোগের কোনো সুযোগ বা সম্ভাবনা সেখানে নেই। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কোনো নাগরিক দেশ ত্যাগ করতে পারে বা অন্য কোনো দেশের নাগরিক সেখানে ঢুকতে পারে।
আমরা যেদিন এখানে এসেছি সেই রাতেই একজন নার্স মতো এসে আমাদের জিজ্ঞেস করে গেছে যে আমাদের সঙ্গী লাগবে কিনা। নারী অতিথি আসলেও তাদের জন্য একই ব্যবস্থা করা হয়, একইভাবে প্রশ্ন করা হয়। আমি রাজি হলাম। আধা ঘণ্টার মধ্যে একজন নারী এসে হাজির হলো আমার রুমে। নিয়মানুযায়ী আমাকে কমপক্ষে এক ঘণ্টা তার সাথে কথা বলতে হবে, পাশাপাশি সকল নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে। আমার সাথে কথা বলে ভালো লাগলেই তবে মেয়েটি এই এক মাসের জন্য আমার সঙ্গী হতে রাজি হবে।
প্রথম দিন আমি ব্যর্থ হয়েছি। এভাবে তৃতীয় দিনে গিয়ে আমি সফল হয়েছি। প্রথম মেয়েটি প্রথম দর্শনেই আমাকে অপছন্দ করেছিল। দ্বিতীয় দিন আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম ব্যালকনিতে ডেকে নিয়ে তাকে সমুদ্রে চাঁদের লুটোপুটি দেখার আমন্ত্রণ না জানানোয়। তৃতীয়দিন আমি সফল হয়েছি বিশেষ কিছু না বলে— মেয়েটিকে বসতে বলে চা অফার করেছি। প্রতিটি রুমেই চা করার ব্যবস্থা আছে, ওকে চা বানিয়ে খাইয়ে নিজে হঠাৎ আনমনা হয়ে রুমের দেয়ালে টানানো একটি ছবিতে মনোসংযোগ করার চেষ্টা করলাম। অবশেষে মেয়েটিই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রথমদিনেই খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায় ওর সাথে। ফিরে আসার দিন ও অনেক কেঁদেছিল।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে সন্তান নিয়ে কারো মনে কোনো খেদ থাকে না আর। বিষয়টি সবাই সজ্ঞানে মেনে নিয়েছে। ফলে দেশের সকল শিশুই যেন সবার সন্তান, এক ধরনের মায়াভরা দৃষ্টি থাকে প্রতিটি শিশুর দিকে সবার। প্রতিটি পিতা মাতা মনে করে এটি হয়ত আমারই সন্তান। অবশ্য দেশটিতে অনেকেই আবার সন্তান নিতে আগ্রহী হয় না। আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে— মপেতিসে বিবাহ প্রথা বলে কিছু নেই। কে কার সাথে কতদিন থাকবে সেটি একেবারেই তাদের ইচ্ছের ব্যাপার। বিচ্ছেদের কারণে সন্তানরা কখনই পিতামাতা হারা হয় না, আগেই বলেছি দেশটিতে প্রতিটি শিশুই যেন সবার সন্তান। নিয়ম হচ্ছে বয়স সাত বছর হলেই সন্তানকে হোস্টেলে দিয়ে দিতে হয়। হোস্টেলে থেকেই পড়াশুনা শেষ করে মপেতিসের শিশুরা। মাধ্যমিক পর্যন্ত সেখানে একমুখী শিক্ষা, এরপর যে যার পছন্দ মতো পড়ে একই সাথে সেই পছন্দের কাজটিও করে। আঠারো বছর বয়স থেকেই দেশটির প্রতিটি নাগরিক চাকরিজীবী, অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই তারা বিভিন্ন কাজ করে অভ্যস্ত। আর একটি বিষয় লক্ষনীয়— দেশটির প্রতিটি নাগরিক বিভিন্ন খেলাধুলায় বিশেষভাবে পারদর্শী। আমাদের নারী সঙ্গীদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে আমরা নাস্তানাবুদ হয়েছি।
ওদের কারো দেহে বাড়তি কোনো মেদ নেই, যেন কোনো শিল্পী নিজ হাতে প্রত্যেককে গড়েছেন, দেখতে যে যেমনই হোক প্রত্যেকের দেহের গড়ন সুন্দর এবং পরিপাটি, ফলে কাউকে অসুন্দর মনে হয় না। প্রথম প্রথম তো আমাদের পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা, এ কোন স্বর্গে এসে আমরা পড়লাম!
ওরা কাজ যেমন করে প্রচুর আবার হাতে সময়ের কোনো অভাব নেই। ঘোরাফেরা, বিনোদন ওদের মতো কোনো দেশের মানুষ বোধহয় করে না। বিভিন্ন জায়গায় জটলা চোখে পড়ে, খেলাধুলা করে— স্কিং, সার্ফিং, ফুটবল, ক্রিকেট —এমন কোনো খেলা নেই যা ছোট্ট এই দেশটির মানুষ করে না। সুন্দর সুন্দর পার্ক রয়েছে সেখানে, জিমনেসিয়াম রয়েছে। জিমনেসিয়ামগুলো উন্মুক্ত, শুধু উপরে একটি ছাউনি থাকে। দেশটিতে নারী পুরুষের জন্য আলাদা কিছু নেই, জিমনেশিয়াম, বিউটিপার্লার —এরকম সবকিছুই একসাথে। কেউই সেখানে ক্ষুধার্ত নয়, তাই কারোরই চোখে অপরিচ্ছন্ন কোনো ভাষা নেই, কিছু কেড়ে নেওয়ার প্রয়োজন তো নেইই। সবাই সেখানে সুন্দর, নৈতিক, সবাই সম্ভাবনাময়, সবাই কাঙিক্ষত।
ওরা যেগুলো না বলার জন্য অনুরোধ করেছে সেগুলো বলছি না, তবু শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে একটু বলি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চারদিন ক্লাস হয়, সপ্তাহের বাকী তিনদিন বিভিন্ন বিনোদনমূলক কাজ এবং একস্ট্রা কারিকুলাম থাকে। কেউ চাইলে এই সময় নিজের মতোও থাকতে পারে। কর্মক্ষেত্রও সপ্তাহে চারদিন খোলা থাকে, বাকী তিনদিন যে যার মতো কাটায় দেশটিতে। সপ্তাহে একদিন সন্তানরা তাদের পিতামাতার সাথে থাকতে পারে। ইচ্ছে করলে প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটি ঘণ্টায় পিতা-মাতারা তাদের সন্তানের সাথে হোস্টেলে এসে দেখা করতে পারে।
এভাবে দ্রুতই প্রতিটি শিশু হয়ে ওঠে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, বিশেষভাবে পারদর্শী এবং স্বনির্ভর। তাদের চাল-চলন আচার-ব্যবহার দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। প্রতিটি শিশু ভিন্ন ভিন্নভাবে অসাধারণ এবং আকর্ষণীয়। ছবি তোলা নিষেধ ছিল, তাই দেশটির কোনো ছবি আপনাদের দেখাতে পারছি না বলে দু:খিত।
সপ্তম দিনে একটি বাড়িতে আমরা আতিথেয়তা নিলাম। দেশটিতে প্রতিটি বাড়িই দোতলা, শুধু সরকারি ভবনগুলো সুউচ্চ। এক অর্থে সবই সেখানে সরকারি, মানে পাবলিক। বয়স আঠারো বছর হওয়ার সাথে সাথে প্রতিটি নাগরিক সেদেশে একটি দুই রুমের বাসা পায়। সুন্দর সাজানো দুই রুমের একটি ফ্লাট। নিজের যোগ্যতায় চাইলে কেউ সর্বোচ্চ চার রুমের একটি ফ্লাট নিতে পারে, এর বেশি নয়। তবে বাড়তি সুযোগ সুবিধার জন্য সরকারকে বাড়তি ট্যাক্স দিতে হয়।
দেশটিতে মূলত তিনটি বিষয়ে নাগরিকেরা স্বাধীনতা পায়— খাওয়াদাওয়া, পোশাক এবং সঙ্গী বাছাই। ঘোরাঘুরির ক্ষেত্রেও স্বাধীনতা রয়েছে। যেহেতু বছরে একটানা তিন মাস যে কেউ স্ববেতনে ছুটি নিতে পারে, তাই দেশ ছেড়ে অন্য দেশে ঘুরতে যেতে পারে যে কেউ। যদিও যেতে হয় জাহাজে, খুব দ্রুতগতির জাহাজ রয়েছে, তারপরও বিদেশ যাওয়াআসা দেশটির নাগরিকদের জন্য খুবই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিমান ব্যবহার করতে পারে, যারা আন্তর্জাতিকভাবে দাবী করার মতো কোনো যোগ্যতা অর্জন করেছে, যারা বিভিন্ন প্রয়োজনে বিদেশে আমন্ত্রিত হয়। দেশে কারো চিকিৎসা যথেষ্ট না হলে এরকম কাউকেও সরকারি খরচে দেশের বাইরে চিকিৎসা করিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। তবে সেরকম খুব একটা প্রয়োজন হয় না, কারণ, দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থা বিশ্বমানের। আবার সবকিছু পরিকল্পনামাফিক হওয়ায় রোগ শোকও সেখানে কম, দুর্ঘটনা নেই বললেই চলে, খুন জখম হয় না, থানা পুলিশ নেই।
তেমন কিছু তারা আমদানী করে না, শুধু মেশিনারি, ওয়েল, মেডিকেল এবং কেমিকেল প্রোডাক্ট ছাড়া। মজার বিষয় হচ্ছে, তেমন কোনো কলকারখানা তারা গড়ে তোলেনি, এটা করতে তারা রাজিও নয়। কোনো প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করে না। দ্বীপের এক ধরনের গাছের পাতা তারা খাদ্য পরিবেশনের কাজে ব্যবহার করে। এই গাছ তারা চাষও করে, কারণ, এই গাছের কাঁঠালের মতো ফলটি খেতেও সুস্বাদু। দেশটির প্রধান রপ্তানী দ্রব্য সামুদ্রিক মাছ, মাছের তেল এবং আরও বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক পণ্য। বলতে গেলে দেশের প্রতিটি নাগরিক কোনো না কোনোভাবে সমুদ্রে মাছ ধরার কাজে যুক্ত, এটা তারা উপভোগও করে, বড় বড় জাহাজে করে মাছ ধরতে যাওয়ার মজাই আলাদা। আমরাও এই এক মাসে একদিন মাছ ধরতে গিয়েছি।
বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান দেশটিতে নেই, তবে কোনো নাগরিক কোনো উদ্যোগ নিলে সেটিতে সরকারি সহযোগিতা দেওয়া হয়, প্রতিষ্ঠানটি সরকারের সাথে যৌথ মালিকানায় চলে। ব্যক্তিগত একক মালিকানায় কোনো প্রতিষ্ঠান দেশটিতে নেই। কারো কোনো নতুন পরিকল্পনা থাকলে তা উৎসাহিত করা হয়, যাচাই বাছাই করা হয়।
মপেতিসে পূর্ণবয়স্ক প্রতিটি লোক সরকারি চাকরিজীবী, বেতনের নয়টি গ্রেড রয়েছে। প্রাথমিকভাবে নিয়োগ হয় দুটি গ্রেডে। বাকি গ্রেডগুলো প্রমোশনের ভিত্তিতে। যেহেতু বেশিরভাগ সুযোগ সুবিধা দেশটিতে নাগরিক সুবিধা হিসেবে প্রতিটি নাগরিক প্রাপ্ত হয়, তাই বেতনের টাকা ওরা খরচ করে মূলত ভোগ বিলাসিতার কাজে, নিজেদের পছন্দের কাজগুলিতে।
সেখানে স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় একটি, একই নামে, শুধু শাখা রয়েছে। চান্স পাওয়ার কিছু নেই, স্কুল পর্ব শেষে করে সবাই চাকরিতে ঢোকে এবং একইসাথে সবাই সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টি মূলত একটি গবেষণাগার, বিভিন্ন ধরনের উচ্চতর গবেষণা করা হয়। যে কেউ প্রাথমিকভাবে গবেষক হতে চাইতে পারে, তবে বেশিরভাগই কিছুদিন পরে ঝরে পড়ে। সফল গবেষকদের সরকারিভাবে ফান্ড দেওয়া হয়, চাকরির পাশাপাশি বা চাকরি ছেড়ে চাইলে তারা গবেষণায় মনোনিবেশ করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে স্লোগানটি রয়েছে তার বাংলা করলে দাঁড়ায়– যার অর্ন্তদৃষ্টি নেই সে গবেষক নয়। এই লাইনটিই বলে দেয় গবেষণা কাজে কাদের মনোনিবেশ করা উচিৎ। গবেষণার বিষয়গুলো সেখানে গতানুগতিক নয়, সাহিত্য এবং দর্শনলব্ধ জ্ঞান গবেষণা কাজে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম থেকে গবেষণার উপাদান নেওয়া হয়। বিজ্ঞানী এবং সাহিত্যিকরা সেখানে খুবই সম্মানিত।
যাইহোক, আমি যেহেতু আলোচনাটা শুধু শিশুদের বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছি, তাই সে বিষয়ে আর একটু বলি। তাছাড়া দেশটির প্রশাসন আমাকে অনুরোধ করেছে তাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিয়ে আমি যেন বেশি কিছু না বলি। এমন কিছু গোপন বিষয় আমার সাথে ওরা শেয়ার করেছে যেগুলো আমি বলছি না। বলে রাখি– এক বছর পরে আমি আবার সেখানে আমন্ত্রিত।
পিতা-মাতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে কিছুই মপেতিসের শিশুরা পায় না। পিতা বা মাতা মারা যাওয়া মাত্রই সম্পদ রাষ্ট্রের কোষাগারে চলে যায়। যেহেতু দেশের প্রতিটি নাগরিকের সম্পদ সুনির্দিষ্ট তাই পিতা-মাতার যৌথ সম্পদ বলে কিছু নেই। অর্থাৎ দেশটিতে কেউই জন্মসূত্রে কিছু পায় না শুধু একটি দেশ এবং দেশের সম্পদে অংশীদারিত্ব এবং নাগরিক সুবিধা ছাড়া।
এবার আমাদের ফেরার পালা। আমাদের প্রত্যেকের সাথে এই এক মাসে একটি করে শিশু এবং একজন নারী সঙ্গী ছিল। শিশুরা অবশ্য শুধু ‘হোটেল বয়’ হিসেবে কাজ করেছে, ওরা আমাদের সাথে বাইরে যায়নি। বাইরে যাওয়ার কাজটি করেছে নারী সঙ্গীটি। এর মধ্যে সুইজারল্যান্ডের লোকটির সাথে যে নারীটি ছিল সে কনসিভ করেছে। নারীটি বলছে বিষয়টি প্রেমঘটিত। যেহেতু দেশটিতে সাধারণভাবে গর্ভপাতের কোনো নিয়ম নেই, এবং বাইরের কোনো নাগরিকের স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ নেই, বিবাহসূত্রেও সেখানে নাগরিক হওয়া যায় না, তাই বিষয়টির ফয়সালা হয়েছে এভাবে যে মেয়েটি চাইলে সুইজারল্যান্ড চলে যেতে পারবে। মেয়েটি তাইই করল, ও আমাদের সাথে চলে আসল। সুইস নাগরিকটিও খুব খুশি দেশটিতে তার শশুর বাড়ি বানিয়ে আসতে পারায়!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৫:১৫
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×