ছোটবেলায় খুব খেলা পাগল ছিলাম। সারাদিন রোদের মধ্যে খেলা করতাম। পেটের টানে যখন বাড়িতে ফিরতাম, আমার মা যথাযথ আপ্যায়নের জন্য হাতে লাঠি নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো। “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, লাটির বাড়িও যেন অমৃত।” লাঠির মাইর খেয়েও দাঁতে দাঁত চেপে কান্না কন্ট্রোল করতাম। চিন্তা করতাম , “মা-বাবার হাতে মার খেয়ে তো সবাই কান্না করে, আমিও যদি কান্না করি তাহলে অন্যদের সাথে আমার কোন পার্থক্য রইলো না। ” এই পার্থক্য তৈরির জন্যই লাঠির বাড়িগুলো নীরব সহ্য করতাম। অবশ্য কান্না না করার ফলে লাঠির বাড়ি একটু বেশিই জুটতো কপালে।
ব্যতিক্রম একজন মানুষ হওয়ার ইচ্ছা আমার ছোটবেলা থেকেই ছিল। সেইটার রেশ ধরে একবার স্কুলের রিলে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। সবাই দৌড় দিল একদিকে, আর আমি ব্যতিক্রমী মহামানব পোদ্দারী করে উল্টাদিকে দৌড় দিলাম। সবার চেয়ে আলাদা হতে চাইলাম। স্যার সত্যি সত্যিই আমাকে আলাদা করে দিলেন। বাছাই পর্বেই দল থেকে বাদ করে দিলেন আমাকে।
স্বর্গে যাওয়ার জন্য পৃথিবীর সবাই যেখানে ভালো ভালো কাজ করার চেষ্টা করে, যেন মারা যাবার পর সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি থেকে সুখে থাকতে পারে, আমি সেখানে চিন্তা করি যে, "স্বর্গে গেলে তো সুখে থাকবোই, বরং নরকে গেলে যেন সুখে থাকতে পারি এই ব্যবস্থা করা দরকার।" তার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন শয়তানের সাথে বন্ধুত্ব। শয়তান হলেও, বন্ধু বলে হয়তোবা শাস্তিটা একটু কম দিতে পারে।
রাস্তায় সুন্দরী কোন মেয়ে হেটে গেলে নরমালী ছেলেরা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমার দৃষ্টি তাদের দিকে দেই না। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকাই সেইসব রমণীর দিকে, যাদের দিকে কেউ অপলক চোখে তাকায় না। এরকম রমণী খুজে পেতে অবশ্য একটু কষ্ট হয়ে যায়। এই কষ্টটাই আমি করি। কেননা ব্যতিক্রম হইতে হবে তো।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল ক্লাসে যাওয়ার জন্য/ভালো রেজাল্ট করার জন্য আর আমি বিদ্যাসাগর চিন্তা করলাম, "পড়াশোনা করে তো সবাই ভালো রেজাল্ট করতে পারে, আমি ক্লাশে না গিয়ে/রেগুলার পড়াশোনা না করে সবার চেয়ে ব্যতিক্রম একটা রেজাল্ট করে তাক লাগিয়ে দেব।" হলোও তাই- ইন্টারে অন্যরা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর মত ভালো রেজাল্ট করে পাশ করে গেল আর আমারটা হইলো ব্যতিক্রমধর্মী একটা রেজাল্ট; `টাইনাটুইনা' পাশ, যেইটা আর কেউ পায় নায়। অনেকের মধ্যে অনন্য বলে কথা।
অনার্স পরীক্ষা শেষ করলাম। এইটাতে যদি ব্যতিক্রম হতে চাই তাহলে দেখা যাবে, সবাই পাশ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে গেছে আর আমি পরের বছর একই পরীক্ষা আবার দেয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছি। জীবনে আর কোন ব্যাপারে আমার ব্যাতিক্রম হওয়ার কোন ইচ্ছা নাই। কোনরকম পাশ করে গেলেই আমি মহাখুশি। আমি অনার্সে সাধারণ ছাত্র হয়েই পাশ করতে চাই। ব্যতিক্রম হওয়ার সখ আমার মিটে গেছে।… "ছাইরে দে মা কাইন্দা বাঁচি।"