somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানসিক রোগে শারীরিক সমস্যা

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কামরুল সাহেব অনেক দিন ধরেই অসুস্থ। দিনে দিনে নতুন নতুন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। শুরুটা বছর তিনেক আগে মাথাব্যথা দিয়ে । প্রথমে অল্প অল্পই হতো। বাড়তে বাড়তে তা এখন অসহ্য হয়ে উঠেছে। সেই সাথে চোখে ঝাপসা দেখা,হাঁটুতে ব্যথা,পেটে অস্বস্তি থেকে শুরু করে শতেক রকমের সমস্যা। চোখের ঘুম হারাম। সারাদিন অসুখ নিয়েই চিন্তা। প্রথমে নিজে নিজে ওষুধ কিনে খেতেন, তারপর ওষুধের দোকানদার,এল.এম.এ.এফ,স্থানীয় এম.বি.বি.এস ডাক্তার,শহরের বড় প্রফেসর – অনেককেই দেখিয়েছেন। শুধু এলোপ্যাথি নয় যাবতীয় সবধরনের চিকিৎসাই নেয়া হয়ে গেছে। প্রথম কিছুদিন ভাল লাগে, তারপর আবার সেই একই দশা। বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা দেখেন, টেস্ট করান একগাদা, শেষে বলেন আপনার তো কোন সমস্যা নাই; তাও কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি খেয়ে দেখেন, আশা করি ভাল লাগবে। ভাল তো আর লাগেনা, গফুর সাহেবও আর উনাদের কাছে যান না। একবার গিয়েছিলেন – আর সেই ডাক্তার উপদেশ দিল মানসিক রোগের ডাক্তার দেখাতে। শুনে উনার এমন রাগ হল – রোগ ধরতে পারেনা, রোগী ভাল করতে পারেনা, উল্টো রোগীকে বলে পাগল!

সেই থেকে একের পর এক ডাক্তার দেখিয়েই চলেছেন- ডাকটিকিটের মত হাজারো প্রেসক্রিপশনের সংগ্রহ তৈরি হয়েছে, ডাক্তার-চেম্বার-ওষুধের নামের জীবন্ত অভিধান হয়ে গেছেন; কিন্তু ভাল আর হতে পারলেন না। বন্ধু-বান্ধবরা পরামর্শ দিলেন – বাংলাদেশে আবার চিকিৎসা হয় নাকি, দেশের বাইরে যাও। টাকা বেশী থাকলে সিঙ্গাপুরই যেতেন, তা যখন হচ্ছে না- তখন ভারতেই যাবেন। তবে দেশে শেষ চেষ্টা হিসেবে দেশের একমাত্র মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন এক বেয়াইয়ের পরামর্শে।

বহির্বিভাগের বারান্দায় বসে আছেন দেখানোর জন্য। কথায় কথায় এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হল। তার কাছ থেকে শুনলেন অনেকটা তার মতোই কাহিনী। উনার ছিল পেটের গণ্ডগোল। এখানে বলা হয়েছে, এটা এক ধরণের মানসিক সমস্যা। একমাস ওষুধ খেয়ে এখন বেশ ভাল আছেন, দ্বিতীয়বার দেখাতে এসেছেন। ভদ্রলোকটিও প্রথমে মানতে চাননি ডাক্তারদের কথা, তবে এখন অনেক ভাল লাগছে - তাই বুঝতে পারছেন কথাটা সত্যি।

এই প্রথম কামরুল সাহেবের মনে নিজের ভাবনার উপর সংশয় এলো। তবে কি তিনি এতদিন ভুল করেছেন? ছাত্রজীবনে ভাল কবিতা আবৃত্তি করতেন। তাই মনে পড়ে গেল একটি লাইন - “খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর”। তবে কি তিনিও ‘পরশপাথর’ কবিতার খ্যাপার মত?

এ পর্যন্ত লেখাটা গল্পের মত শোনালেও নামটা বাদে আর সবই সত্যি। প্রমাণ হিসেবে আপনার আশেপাশে এরকম দুয়েকজন পেয়েও যেতে পারেন।

হয়তো ভাবছেন - তবে কি এসব রোগীর আসলেই কোন সমস্যা নেই? সবকিছুই কি মানসিক? এটা আবার কি ধরণের কথা – রোগটা মানসিক, কিন্তু যন্ত্রণা শারীরিক! অনেকটা হুমায়ুন আহমেদের ‘মিসির আলী’ টাইপ রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আসলে ব্যাপারটা কি? তাহলে চলুন, কিছু সাধারণ কথা জেনে নেওয়া যাক।

আমরা প্রায় সবাই ‘মন’ এবং ‘শরীর’-কে দুইটি আলাদা ব্যাপার ভাবতে অভ্যস্ত হলেও, এরা যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সে বিষয়ে একেবারে নিঃসন্দেহ। আবার শারীরিক অসুবিধার কারণে মন খারাপ হওয়াও আমাদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। অতএব, মনের কারণে যে শারীরিক অসুবিধা হতে পারে তাতে আর কি সন্দেহ।

সমস্যা হয় তখনি, যখন কেউ বলে এই যে আমার এত শারীরিক কষ্ট, যার জন্য এক দুর্বিষহ জীবন আমি ভোগ করছি, তার কারণ আসলে মানসিক। শুনতেই মনে হয় যেন সব ইচ্ছে করেই করছি, সবাই ব্যাপারটা গুরুত্বহীন ভাবছে, কিংবা আমাকে ভণ্ড ভাবছে।

আসলে তা নয়।

চিকিৎসা শাস্ত্রে এর আলাদা একটা নাম আছে। ইংরেজিতে বললে, “Somatic Symptom Disorder”. আক্ষরিক অনুবাদ না করে সহজভাবে বলা চলে “মানসিক রোগে শারীরিক সমস্যা”।
এক্ষেত্রে, এক বা একাধিক উপসর্গ থাকতে পারে। এ সকল উপসর্গের অন্য কোন রোগের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকা না থাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, এসবের কারণে রোগীর অত্যন্ত অসুবিধা বোধ করা, এমনকি বিভিন্ন দৈনন্দিন কাজেও ক্রমাগত ক্ষতি হওয়া। মোটকথা, রোগীর কষ্টটাই আসল, সত্যি; এই কষ্টের কারণ হিসেবে কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা থাকুক আর নাই থাকুক। অনেকটা “ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত” এই ধরণের।

সেই সাথে রোগীরা এসব উপসর্গ নিয়ে বা তার স্বাস্থ্য নিয়ে সারাক্ষণ অতিমাত্রায় ভাবতে থাকে, খুবই দুশ্চিন্তা করতে থাকে। দিনের বেশিরভাগ সময় এই কাজেই ব্যয় হয়ে যায়। তারা অহেতুক উদ্বিগ্নতায় ভুগতে থাকে, উপসর্গগুলোর ভুল ব্যাখ্যা করতে থাকে। অনেকে এমনকি ভালোভাবে বুঝানো সত্ত্বেও যুক্তিহীনভাবে খুব খারাপ কিছু হয়ে গেছে ভেবে ভয় পেতে থাকে। যদিওবা বোঝান যায়- তা হয় ক্ষণস্থায়ী।

এসবের ফলস্বরূপ তার আচার-আচরণ থেকে শুরু করে অন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক - সব কিছুতেই পরিবর্তন হতে থাকে, যা অন্যরা ঠিকই বুঝতে পারে। এ ধরণের রোগীদের ক্ষেত্রে তাই একই সমস্যার জন্য একসাথে অনেক ডাক্তারকে দেখানো, জোর করে এমনকি কারো পরামর্শ ছাড়া নিজ উদ্যোগে একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আর কেউ যদি মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলে তবে প্রায় ক্ষেত্রেই খুব অবাক হয়ে যায় অথবা সরাসরি অমত করে, অনেকে রেগেও যায়।

তবে রোগ হিসেবে বলতে গেলে এসবের স্থায়িত্ব ৬ মাসের বেশী হতে হবে।

উপসর্গ গুলি সুনির্দিষ্ট হতেও পারে (যেমন মাথাব্যথা), আবার নাও হতে পারে (যেমন শারীরিক দুর্বলতা)। উপসর্গগুলি হয় বিচিত্র রকমের – ব্যথা, ক্লান্তি, বমিভাব, বমি, পেটে অস্বস্তি, অবশতা, দুর্বলতা, চোখে ঝাপসা দেখা, কানে শব্দ হওয়া, গলায় কিছু আটকে থাকার অনুভূতি, শ্বাসকষ্ট, হাতের তালু-পায়ের তালুতে জ্বালা-পোড়া অনুভূতি - এক কথায় মাথা থেকে পা পর্যন্ত যেকোনো জায়গায় যেকোনো অসুবিধা। সবকিছু বলতে গেলে অনেকটা “আলসার থেকে ক্যান্সার”-এর সস্তা ওষুধ বিক্রেতার কথার মতোই শোনাবে। তবে, উপসর্গ হিসেবে ব্যথার অবস্থান সবার প্রথমে। আবার অল্পবয়সীদের বেশী হয় পেটে ব্যথা, মহিলাদের বেশী হয় তলপেটে ব্যথা।

বলা হয়ে থাকে, এ রোগ হবার সম্ভাবনা বেশী থাকে – মহিলা, বৃদ্ধ, নিম্নবিত্ত, বেকার, সমস্যা-পূর্ণ শৈশব ইতিহাস, যৌন নিগ্রহের শিকার, কোন দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক বা মানসিক রোগাক্রান্ত, সামাজিক চাপের শিকার ব্যক্তিদের। এছাড়াও, যে সকল ব্যক্তি হতাশা-বাদী বা নিজ জীবনের খারাপ দিকগুলো নিয়েই বেশী ব্যতিব্যস্ত থাকে তাদের মধ্যেও এই রোগের সম্ভাবনা বেশী।

সমস্যা নিয়ে তো অনেক কথাই হল, এবার চিকিৎসার কথায় আসি।

চিকিৎসার ব্যাপারে চিকিৎসা শাস্ত্রে অনেক কিছুই বলা আছে, তবে সে সব গুরুগম্ভীর আলাপ-আলোচনায় মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

দরকার রোগ সম্পর্কে সম্যক জানা, জানার মাধ্যমে সচেতন হওয়া, সচেতন হওয়ার মাধ্যমে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা।

রোগটা নিজেরই হোক অথবা ঘনিষ্ঠ কারো - শারীরিক অসুবিধা বা বিভিন্ন উপসর্গ মাত্রই যে মানসিক রোগ নয়- তা জানা যেমন জরুরী, তেমনি মানসিক রোগের কারণে শারীরিক অসুবিধা দেখা দিলে সেটা স্বাভাবিক ভাবে নেয়ার মানসিকতা বা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলাও জরুরী। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে কুণ্ঠা বোধ না করাটাও এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কেবল তখনই কমবে ভোগান্তি, বাঁচবে জীবনের মূল্যবান সময় আর দেখা মিলবে মানসিক শান্তির।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×