somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাক্ষাৎকার

২০ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১১:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিশিষ্ট তরুণ সাংবাদিক কাজী জিসান মোহাইমিন। কাজ করেন ঢাকার একটি বিখ্যাত রেডিও চ্যানেলে। সেই চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠানের জন্য জিসানকে এক ভদ্রলোকের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। অনুষ্ঠানটি খুবই দর্শকপ্রিয়, কারন এতে দেশের আনাচে কানাচে ঘটে যাওয়া নানান রকম অধিভৌতিক বা পরাবাস্তব কাহিনী তুলে ধরা হয়। ঠিক তেমনি এক ব্যাপারেই জিসানকে একটি সাক্ষাতকার নিতে হবে এক ভদ্রলোকের। কারন, সেই ভদ্রলোক দাবি করেন যে, তার বয়স সাড়ে চারশ বছর প্রায়। জিসান বেশ অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। তাছাড়া ভদ্রলোকের তথাকথিত বয়স তার মনে কৌ্তুহলের উদ্রেক করেছিল। তাই জিসান দায়িত্বটা আনন্দের সাথেই নিতে রাজি হলেন।

যাইহোক, নির্দিষ্ট দিনে জিসান সেই ভদ্রলোকের সাক্ষাৎকার নিতে চলে এলেন। তিনি থাকেন ঢাকার পরীবাগে, একটি পনেরতলা অ্যাপার্টমেন্টে। ভদ্রলোক তাকে দেখা করতে বলেছিলেন রাত ৮টায়। এটা নিয়ে জিসানের খুব আপত্তি ছিল। যখন সবার ছুটি তখনই তার ডাক পড়ল। এটা নিয়ে জিসান বেশ বিব্রত ছিলেন। তাছাড়া, ভদ্রলোকের কি দিনে কোন কাজ নেই? রাতে বিশ্রাম নেন না? এই ভাবতে ভাবতে জিসান অবশেষে তার বাসায় চলে এলেন, নির্দিষ্ট দিনে। ১৪ তলায় ছি্ল ওনার ফ্ল্যাট।

কলিংবেল বাজতেই একজন ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলেন। বাসার ভেতরটা ছিলো কিছুটা অন্ধকার, একটা ডিম লাইট জ্বলছিল। ফিকে আলোয় জিসান প্রথমবার ভদ্রলোক এর দিকে তাকালেন। অল্প আলোয় যা বুঝলেন, ভদ্রলোক খুবই সুন্দর ও সুদর্শন, উজ্জ্বল ফর্সা ধরনেরই হতে পারে, নাকের নিচে মোটা গোফ ও চুল লম্বা।

ভদ্রলোক আতিথেয়তার সাথেই তার অতিথিকে ঘরে আমন্ত্রণ জানালেন। একটি রুমে চেয়ারে বসালেন। রুমে শুধুই দুটি চেয়ার ও একটি টেবিল। জিসান চেয়ারে বসতে বসতে ভদ্রলোক তার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। বললেন যে তার পরিবার বলে এই দুনিয়ায় কেউ নেই।

অতঃপর জিসান সাহেব শুরু করলেন। বললেন যে তিনি এসেছেন ঢাকার একটি নামকরা বেসরকারি রেডিও চ্যানেল থেকে, একটি অধিভৌতিক অনুষ্ঠানের জন্য সাক্ষাৎকার নিতে চান।
ভদ্রলোক জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেন, “ভাল, তা কি জানতে চান?”
জিসান সাহেব বললেন, “আপনি নাকি দাবি করেন, আপনার বয়স প্রায় সাড়ে চারশ বছর? এই বিষয়টাকে আমরা জানতে চাই।”
“এতে আপনাদের কি লাভ?”, ভদ্রলোক কৌ্তুহলের সাথে জিজ্ঞেস করলেন।
“শ্রোতারা আপনার কথা রেডিওতে শুনবে, আপনার কাহিনী শুনবে।”, জিসান বললেন।
ভদ্রলোক বললেন, “ভাল তো। পুরোটাই কি শুনবেন? অনেক বড় কিন্তু। রেকর্ড করার পর দেখবেন অডিও ফাইলটা কত বড় হয়!”

জিসান বললেন, “অবশ্যই! আপনার চিন্তার কিছু নেই, আপনি শুরু করুন।” এই বলে জিসান রেকর্ডার অন করলেন।
“বলুন আপনার নাম কি?” জিসান প্রশ্ন করলেন।
“আসগর আলি”, ভদ্রলোক বললেন।
জিসান বললেন, “তো আসগর সাহেব, আপনি করেন কি?”
আসগর সাহেব বললেন, “মানুষকে মুক্তি দেই, মৃত্যু থেকে মুক্তি।”
“তাই নাকি?” হেসেই দিলেন জিসান সাহেব।
“তো সেটা কিভাবে আসগর সাহেব? বলবেন কি?” জিসান সাহেব জানতে চাইলেন।
“সময় হলেই দেখবেন” আসগর সাহেবের উত্তর।
“রহস্য তো ভালই করেন। রুমটা অন্ধকার করে রেখেছেন কেন? আপনাকে দেখা যাবে না নাকি?” জিসান সাহেব বললেন।

অন্ধকার ছিল এমনটা বলা যাবে না। আলোটা ফিকে, তাই জিসান সাহেবের অনুরোধে আসগর সাহেব লাইট জ্বালালেন। তারপর এসে চেয়ারে বসলেন।

আসগর সাহেবকে দেখে জিসান সাহেব থমকে গেলেন। যা ভেবেছিলেন তার চেয়েও বেশি সুন্দর, আর এতটাই ফর্সা যে, চামড়ার নিচে শিরা ধমনীগুলো স্পষ্ট। মুখ রুক্ষ, শক্ত ও ধারালো। চোখগুলো বিড়ালের মতই, নিচে একটু কালচে। পুরোপুরি সুদর্শন লোক। সাদা পাঞ্জাবি ও চোস্ত পায়জামা পরা। অতিমানবীয় সৌ্ন্দয!

আসগর সাহেব বললেন, “আমাকে তো দেখলেন, এবার শুরু করুন।”
জিসান তো ভয় পেয়েই গিয়েছিলেন দেখে। একটু থমকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি নারকীয় কিছু না তো?”
আসগর সাহেব ঈষৎ হাসলেন। বললেন, “নরকের বাসিন্দা আমি, নারকীয় তো বটেই।”
ভয়াত কন্ঠে জিসান সাহেব বললেন, “মানে???”
“কিছু না। শুরু করুন” বলে আসগর সাহেব শুরু করলেন।

“আনুমানিক ১৫৮০ সাল। তখন আমার বয়স একুশ। আপনার চেয়েও অনেক ছোট। আমি ছিলাম এতিম। বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ ছিল না। আমার জন্মের সময় নাকি মা মারা যান। বাবা নিরুদ্দেশ ছিলেন। আমার দাদার মুখেই সব শোনা। বয়স নয় দশ হবে, তখন দাদাও মারা যান। সম্পদ বলতে আমার ছিল একটি কুঁড়েঘর ও একটি বলদ। বলদ নিয়ে সারাদিন চরে বেড়াতাম মাঠে ঘাটে। বলতে পারেন, আমি ছিলাম রাখাল। তখন এদেশটায় শহর বলতে কিছুই ছিল না। শুধুই সবুজের সমারোহ। যেখানে তাকাতাম, শুধুই মাঠ, খাল-বিল, নদী, বন-জঙ্গল আর গ্রাম। আমি থাকতাম ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। বর্তমানে ময়মনসিংহ।”

“আমি এখন যেমন সুন্দর করে আপনার সাথে কথা বলছি, এর কাছে ধারেও তখন আমি ছিলাম না। পুরোপুরি গেঁয়ো ছেলে। সারাদিন মাঠে দৌড়াতাম, বাঁশি বাজাতাম, পরের জমিতে চাষ করতাম। দিনের শেষে কিছু পয়সা পেতাম। তা দিয়েই আমার দিন কেটে যেত।”

“তখন দেশে মোঘলদের শাসন এর পায়তারা চলছিলো। কয়দিন পর পর বার ভুইয়া দের সাথে যুদ্ধ। স্বাধীন সুলতানী শাসনের সমাপ্তির পর এই দেশের নাম হলো সুবাহ বাংলা। যদিও গ্রামদেশে সুবাদার এর কোন প্রভাব ছিল না। গ্রামে চলত গ্রাম পঞ্চায়েতের শাসন। যেকোন সমস্যার সমাধান, বিচার, সালিশ গ্রাম পঞ্চায়েত করত।”

“একদিন আমার উপর বিপদ নেমে এল। অন্যের ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলার অপরাধে আমার বলদটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হল, গ্রাম পঞ্চায়েতের আদেশে। শাস্তি হিসেবে আমাকে ক্ষতিপূ্রন দিতে হল, আমার ছোট কুঁড়েঘর ও বলদটা গেল। আমার সহায় সম্পত্তি বলতে আর কিছুই রইল না। পথেই বসে পড়লাম। সারাদিন বাপ-মা, দাদার কবরের পাশে বসে থাকতাম। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতাম, আমাকে যেন নিয়ে যায়। কিন্তু আমার জন্য অন্য একটা কিছুই যেন অপেক্ষা করছিল। সেটাই হল একদিন। এক রাতে যখন কবরের পাশে শুয়ে ছিলাম তখন একজন লোক আমার উপর আছড়ে পড়ল, চোখে অন্ধকার দেখলাম।”

“তারপর যখন চোখ মেললাম, দেখি আমি খাটিয়ায় শুয়ে আছি। আমার পাশে একজন লোক বসা। কিছুটা অদ্ভুত ধরনের, আমি বলব বেশ শক্ত প্রকৃ্তির, সুন্দর। ঘরের চারপাশে মোমের আলোয় ঘর আলোকিত।”

“আমি কিছুটা ইতস্তত হলাম। উঠে যেতে চাইলাম। কিন্তু সেই লোকটা আমাকে উঠতে দিল না। বলল, আমি কি চাই সেটা তিনি জানেন। আমার মনের কথা তিনি বুঝেন। তিনি আমাকে এই নরক থেকে মুক্তি দিতে চান। আমার কাছে জানতে চাইলেন আমি রাজি কিনা? আমার হারানোর কিছু ছিল না, রাজি হয়ে গেলাম।”

“এরপর তিনি কি করলেন?” জিসান সাহেবের প্রশ্ন।

“আমাকে নরক থেকে মুক্তি দিলেন ঠিকই। কিন্তু এমন এক মুক্তি যার রেশ কখনই কাটবে না। এই মুক্তি নরক থেকে স্বর্গ এর দিকে না। বরং আরেক নরকে, যা অনন্তকালীন।” আসগর সাহেব বললেন।

“হ্যা, মঈন আমাকে সেই উপহারটাই দিয়েছিল। একটি কালো জগতের উপহার।” আসগর সাহেব এই বলতে বলতে পায়াচারি শুরু করলেন।

“তো, সেই লোকের নাম তাহলে মঈন?” জিসান সাহেব বললেন।
“হুমম, তার নাম মঈন উদ্দিন। খুবই আকর্ষণীয় ব্যাক্তি, কিন্তু মুদ্রার ওপিঠে এক ভয়ানক শয়তান।” আসগর সাহেব বললেন।

“তথাকথিত মুক্তির পর, আমার মাঝে পরিবর্তন দেখা দিল। আমি সূয এর আলো সহ্য করতে পারতাম না। বের হতাম মেঘাচ্ছন্ন দিনগুলোতে। বেশিরভাগ সময়ে রাতে। তবে খাবার কোন তাড়া ছিল না। যেটা ছিল, শুধু তৃষ্ণা। এক বিকৃ্ত তৃষ্ণা। আর আয়নাতে দেখলাম নিজের পরিবর্তন। অমানুষিক একটা সৌ্ন্দয আমার দেহে ও শরীরে ফুটে উঠলো। আপনি যে আমাকে দেখে কিছুটা থমকে গিয়েছিলেন, আমার এই চেহারাটাই হলো সেই উপহারের ফলাফল। মঈন এর মতই।”

“মঈন হয়ে গেলো আমার নতুন সঙ্গী। সে শুধু সঙ্গী ছিল না, ছিল আমার নতুন জীবনের প্রথম গুরু। তার সাথেই আমি চলতাম ও থাকতাম। তাদের ছিলো একটি বিশাল বাড়ি, সাঁতগাও তে। সাঁতগাও ছিল মধ্যযুগে সুবাহ বাংলার বিখ্যাত বন্দর।”

“তারা ছিল তিন ভাই, আরো দুই ভাই হল সগীরউদ্দিন ও জালালউদ্দিন। সেই একইরকম, যেমনটা আমি। তবে তাদের সাথে আমার একটা তফাত ছিল, আমার মাঝে মানবিক কিছু গুন বেঁচে ছিল, এখনো আছে। কিন্তু তাদের মাঝে ছিলো না। তারা ছিল চরম নিষ্ঠুর ও বিকৃ্ত মানসিকতার। তারা মানুষের উপর অত্যাচার করত, নানান ছুতোয় মানুষকে মারত, কখনো কখনো তৃষ্ণাও মেটাত তাদের দিয়ে। আর মানুষকে প্রভাবান্বিত করার এক দারুণ ক্ষমতা ছিল তাদের মাঝে। সহজেই মানুষকে তারা সম্মোহিত করতে পারত, যেটাকে পুজি করে তারা যে কত পাপ করত তার ইয়ত্তা নেই। তারা মহিলাদেরকেও তাদের এই হীন উদ্দেশ্যের বাইরে রাখত না। মঈন আমাকে এসবই শেখাতে চেষ্টা করত। কিন্তু আমি ছিলাম তার বাজে ছাত্র।”

“সবই তো বুঝলাম, কিন্তু আপনাদের এই তৃষ্ণাটা কিসের?” জিসান সাহেব জানতে চাইলেন।

“তৃষ্ণা। হুমম। তৃষ্ণাটা হল এক আরকের, যা একজন মানুষকে প্রান দেয়। আমরা অন্যের প্রান নিয়ে নিজেরা বেঁচে থাকি। নোংরা পরজীবির মত।” আসগর সাহেব বললেন।
“এই নোংরা খেলা আপনাদেরকে ভাবাতো না, আপনারা এই জিনিসে কি সুখ পেতেন?” জিসান সাহেব জানতে চাইলেন।

“এইজন্যই আমি বলেছি, আমি এক নরক থেকে অন্য নরকে এসে পড়েছিলাম। এই জীবন আমি চাই নি, আমি মুক্তি চেয়েছিলাম। কিন্তু এরকম না। আমি শক্তি চেয়েছিলাম, সেটা এরকম না। এটা একটা পাশবিক নারকীয় জীবন”

“মঈনের দৃষ্টিতে আমরা ছিলাম একটা পরিবারের মত। সে, তার দুই ভাই ও আমি। আমি তাদের মত ছিলাম না বলে তারা আমাকে মাঝে মাঝে অপদার্থ বলত। আমি গায়ে মাখতাম না। কারন তাদের এই চিন্তা ভাবনা আমার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। আমার শরীরে নারকীয় পশুর রক্ত বইছিল, কিন্তু মনটা তখনো মানুষের মতই ছিল।”

“এই পরিবর্তনটা কিভাবে হলো, কিভাবে আপনার শরীরে নারকীয় রক্ত প্রবেশ করল? বলেন নি তো…” জিসান সাহেবের প্রশ্ন।
“সময়ই তার উত্তর দিবে।”, আসগর সাহেবের উত্তর। তারপর আসগর সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন।

“শুনুন। আমি একবার তাদের এক পাশবিকতা একবার দেখে এতটাই তাদের প্রতি ঘৃণা জন্মেছিল যে, বাড়ী ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। তারা অই অঞ্চলের জমিদারের ছেলে হওয়াতে, যখন তখন যেকোন কৃষকের অন্ন ধ্ধংস করত, চাবুক মারত, ইচ্ছা হলে আরো অনেক কিছুই করত। এরকমই একবার এক কৃষককে খাজনা দিতে না পারার অপরাধে, তার উপর নির্মম অত্যাচার করে। শুধু তাই না, তারা সেই কৃষকের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে তার সামনেই হত্যা করে নিজেদের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য। আমি নিজে কৃষক ছিলাম, আগের জীবনে। তাই কষ্টটা আমি বুঝি। সহ্য হল না। রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম।”

“তখন ওই অঞ্চলে পর্তুগীজরা মোঘলদের অনুমাতি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। সম্রাট আকবর তাদের সারা ভারতবর্ষে ব্যবসা করার অনুমতি দেয়। সাঁতগাওতে তাদের ছিল অনেক কুঠি। সেখানে তারা ব্যবসার সুযোগে সাধারন মানুষের উপর নিপীড়ন শুরু করে। জোর করে ধর্মান্তর, ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া আরো অনেক কিছু। মানুষ অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সেই এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। তাছাড়া ভাগিরথী নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারনে সাঁতগাও এর গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। তাই আমি, মঈন, সগীর ও জালাল ঢাকায় চলে এলাম। ঢাকা, সুবাহ বাংলার রাজধানী ঢাকা। তখন ১৬১২ সাল।”

“ঢাকাতে ছিল সুবাদার আর নবাবদের আখড়া। তাদের আশেপাশে থাকত তাদের কর্মচারীরা। তাছাড়া বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ব্যবসায়ীরা থাকত, তাদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসাকেন্দ্র। ছবির মতই সুন্দর ছিল বুড়িগঙ্গা। এখনকার বুড়িগঙ্গা না। তাছাড়া, ছিল মসজিদ, বাঈজীখানা আরো অনেক। লালবাগের কেল্লা, বড় কাটরা, ছোট কাটরা, হোসেনী দালান, মীর জুমলা তোরন, মুসা খান মসজিদ ইত্যাদি সুন্দর স্থাপনা।”

“সবই ঠিক, কিন্তু ওই তিন ভাই এর সাথে থাকতে গিয়ে আমি হাপিয়ে উঠেছিলাম। ঢাকায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই তারা অনেক লোকের সাথে খাতির করে ফেলে। লোকদের সম্মোহন করার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করত তারা। আমি তো জানি, তারা সেটা করত তৃষ্ণা মেটাতে। যেটা আমি করতাম বিভিন্ন পশুপাখি দিয়ে।”

“পশুপাখিও তৃষ্ণা মেটানোর বস্তু?” জিসান সাহেব বললেন।
“হ্যা, আমাকে মঈন শিখিয়েছিল, কিভাবে বেচে থাকা যায়। এটা তারই অংশ। আমি বোধহয় এই একটা জিনিসই তার থেকে শিখেছিলাম। আমার বাঁচার তাগিদে।” আসগর সাহেব বললেন।

“আমরা থাকতাম বর্তমান হোসেনী দালান রোডে। তিন ভাই আর আমি আমাদের বাসাটাকে নতুনভাবেই সাজিয়েছিলাম। আমরা অনেক জিনিস কিনেছিলাম। বিভিন্ন আসবাব, ঝাড়বাতি। সগীর ভাল সেতার আর জালাল ভাল তবলা বাজাতে পারত। প্রতি সপ্তাহে বাসায় জলসা বসত। মানুষ আসত, শুনত, তারিফ করত। বাঈজীও আনা হত। নাচের আসর বসত। আসর ও ভোগবিলাস শেষে কেউ ফিরত হাসিমুখে, কেউ ফিরত লালসার শিকার হয়ে পরপারে। আমি অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম।”

“এভাবেই প্রায় ১০০ বছর কেটে যায়। আমার নরকবাস চলছেই। তবে আমি যেটা চেয়েছিলাম, অবশেষে সেটা পেলাম। ১৭১১ সাল। আমার সাথে একজন লোকের পরিচয় হল। সেও আমার মতনই। নাম ঈসা শাহ। শাহবাগে হরিণ শিকার করতে গিয়েই পরিচয় হল।”

“ভদ্রলোক ছিলেন জয়দেবপুর এর সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তি। পরিচিত হয়ে ও কথা বলে যা বুঝলাম, তিনি মঈনকে চিনেন। চিনেন তার দুই ভাইকেও।”

“ভদ্রলোক আমাকে যেটা বুঝালেন, তাতে বুঝা গেল যে, তিনি এই বাংলা অঞ্চলের সবচেয়ে পুরানো লোক, যে আমার মতই। বলতে পারেন, সবচেয়ে বয়স্ক, আমাদের মধ্যে।”

“মঈনের কথা তিনি বললেন। বললেন তার দুই ভাইয়ের কথাও। তিনি আরো যেটা বললেন যে, তাদের চেয়ে আমি অনেকখানি আলাদা। অনেক ভদ্র ও সভ্য। আমার মাঝে মানবিক অনুভূতিগুলো আছে, যেটা তাদের মাঝে নেই। এই হিসেবে তারা আমার চেয়ে অনেক নিচ। কারন, তারা মনে করে এইটাই তাদের প্রবৃত্তি। তারা অতিমানবীয়, চিরস্থায়ী এক শক্তি লাভ করেছে বটে, কিন্তু তারা সেটার মুল্য দিতে জানে না। তারাই প্রকৃত ভীরু। আমি না। আমিই ঠিক”

“যাই হোক, তিনি মঈন ও তার দুই ভাই এর সাথে দেখা করতে চাইলেন। আমি তাদের নিয়ে এলাম, তারপর যা হল………”

“কি হল?” জিসান সাহেব জানতে চাইলেন।

“ঈসা সাহেবকে দেখে তো মঈন ও তার ভাইয়েরা রেগে একদমই আগুন! আমাদের কিছু ক্ষমতার সত্যিকার প্রদর্শনী যেন তখন শুরু হয়ে গেল। অতিমানবীয় গতির ঝড় এবং বিভিন্ন মারামারির কৌশলে ঘরটাই ধ্ধংসস্তূপ হতে সময় নিল না। আমি ওই তিন ভাই এর হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম। তাই ঈসা সাহেবকে বাচাতে একটা আস্ত ঝাড়বাতি খুলে তাদের তিন ভাই এর দিকে ছুড়ে দিলাম। সারা ঘরে আগুন। আমাদের সুস্থ হয়ে উঠার ক্ষমতা খুব দ্রুতগতির। তাই ওই ভাইদের মারতে আমি তলোয়ার হাতে তুলে নিলাম। এক কোপে মঈনকে শিরচ্ছেদ করলাম। অন্যরা পুড়ে মরল।”

“বাসার চারপাশে অনেক লোক। আগুন আগুন বলে তারা চিৎকার করছে। ইতিমধ্যে তা আশে পাশে ছড়িয়েও পড়েছে। আমি আর ঈসা সাহেব বেরিয়ে এলাম। দৌড়ে চলে এলাম বুড়িগঙ্গার পারে। তারপর নৌকায় করে পালিয়ে গেলাম সবার অলক্ষ্যে।”

“আমরা চলে এলাম তুরাগ নদী হয়ে জয়দেবপুর। ঈসা সাহেবের বাড়ি। তিনি আমাকে অনেক কথাই বললেন। তখনই তিনি আমাকে বললেন মঈন এর ব্যাপারটা। কেন মঈন ও তার ভাইয়েরা রেগে ছিল ঈসা সাহেবের উপর। তখনি তিনি বললেন যে মঈন সাহেবকে তিনিই অন্ধকার জগতে নিয়ে এসেছিলেন, আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে, ঠিক যেমন মঈন আমাকে নিয়ে এসেছিল। তিনিও তখন এই জগতে নতুন। লালসার বশবর্তী হয়ে হত্যা করেন তাদের বাবা-মাকে। আর তারা তিন জন হয়ে যায় নরকের বাসিন্দা। পরে তিনি এই লালসাকে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসেন। কালক্রমে হয়েও যান অন্যরকম। মানুষ যেমন বদলায়, আমরাও বদলাই। তিনি বুঝালেন, আমাদের দুঃখ চিরকালের। এটাকে আমাদের ভুলে চলতে হবে। ভাবতে হবে অন্যভাবে। No Remorse যাকে বলে।”

“আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার যেহেতু আর কিছুই নেই বাধা দেয়ার, সুতরাং আমি একাই চলব। তাই ঈসা সাহেবকে বললাম যে আমি একাই চলব। তাকে তাঁর জ্ঞান, মুল্যবান কতগুলো কথার জন্য ধন্যবাদ দিলাম। কিন্তু সাথে এটাও বললাম যে, আমি আর কখনই তাঁর সাথে দেখা করব না। আমার বুদ্ধি বিবেচনায় আমি চলব। শয়তান আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। যেহেতু চিরকালই আমি নরকে থাকব, আমার হারানোর কিছু নেই।”

“তারপর কি করলেন?” জিসান সাহেবের প্রশ্ন।

“আমি চলে এলাম পুনরায় ঢাকায়। এসে বড় কাটরা পাশে একটা বাসায় থাকতাম। ১৭৫৭ সাল। সিরাজুদ্দৌলা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হল। বাংলাসহ সারা ভারত ইংরেজদের অধিকারে এল। আমি তখন একটা মাদ্রাসায় ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করি। আরবি, ফারসি, বিভিন্ন ধর্মীয় বই, যদিও আমি এসব মানি না, তারপরও। তারপর পড়তে শুরু করলাম ইংরেজি, গনিত, বিজ্ঞান, বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফারসি সাহিত্য। সারাদিন জ্ঞান আহরন করতাম, সেতার বাজাতে শিখলাম। আমার সময়ের অভাব ছিল না, কারন আমি বাঁচতে শিখেছিলাম মঈন এর কাছ থেকে। দেখেছিলাম মানুষের দুবলতা। নিজের জ্ঞান আর অলৌ্কিক ক্ষমতা আমাকে শক্তিশালী করে রেখেছিল।”

“এভাবে ভারত স্বাধী্ন হল ১৯৪৭ সালে। ভারত ও পাকিস্তান। আমি থেকে গেলাম পাকিস্তানে। তারপর ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬২, ৬৬, ৬৯ এর গণ অভ্যুথ্থান। সবশেষে মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭১। আমিও মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম, তবে মানুষ এর তৈ্রি মারণাস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করিনি। করেছি নিজের লাভ করা ক্ষমতা দিয়ে। অসীম ও অলৌ্কিক সেটা। আর তখন আমার তৃষ্ণাও আমি মিটিয়েছি মানুষকে দিয়ে, বলতে পারেন মানুষরূপী কতগুলো পশুকে দিয়ে। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ স্বাধীন হল। তারপর নানান জায়গাতে ছিলাম, নতুন স্বাদ, নতুন স্টাইল, নতুন ফ্যাশন, বিবর্তন। আমিও আমার কাজ করতে থাকলাম, চলতে থাকলাম আগের মতন। এই আমার কাহিনী।”

“কিন্তু আপনার কাহিনী তো ভাল হয়নি………” জিসান সাহেব বললেন। “কোন মজা নেই, প্রাণহীন। আরো কিছু বলুন।”
“অনেক কিছুই তো বললাম, আর কি বলব। এগুলোই আমার জীবনের কাহিনী।” আসগর সাহেব বললেন।
“কিন্তু শ্রোতারা তো এই কাহিনী শুনবে না, কিছু একটা বলুন। কাহিনীটা আকর্ষনীয় হওয়া দরকার।” জিসান সাহেব বললেন।
আসগর সাহেব ও বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, “হায়রে মানুষ!”

জিসান সাহেব তো নাছোড়বান্দা, কাহিনী বের করেই ছাড়বেন। হতাশ হয়ে একটা পযায়ে বলেই ফেললেন, “আসগর সাহেব, আপনি কি মনে করেন, আপনার এই বাজে কাহিনী শোনার জন্য আমি এতক্ষণ বসে আছি। একটা লোকও আপনার কথা শুনবে না।”

“কি বললি?” আসগর সাহেব হুংকার দিয়ে বললেন। পুরো রুমটাই এবার যেন কেঁপে উঠলো। রক্তলাল চোখে আসগর সাহেব গলা চেপে ধরলেন জিসান সাহেবের। তারপর মাটিতে তুলে আছড়ে ফেললেন। তারপর হুংকার দিয়েই বললেন,
“শোন, আমার জীবন কাহিনী যদি এতই বিরক্ত লাগে তো শুনতে এলি কেন? নরক যন্ত্রনা কাকে বলে জানিস? আমার ৪৫০ টা বছর আগুনের ভিতর দিয়ে গেছে, এই কষ্ট তুই কি বুঝিস? এতই আকর্ষণ খুঁজলে আমার কাছে এলি কেন? আর যদি তাই শুনতে চাস, তাহলে একবার সেই জীবনে এসেই দেখ, নিজের চোখেই দেখ………আমি এত দয়াবান নই, কারন আমিও বদলে গেছি। মানুষ বদলায়, আমরাও বদলাই। তুইও এবার দেখ, আমরা কি করে বদলাই, কি করে পরিবর্তিত হয়ে অমানুষিক হই। আমার কোন কাজে এখন কোন আক্ষেপ নেই, because I have no relation. I have no regret, no remorse!” তারপর আসগর সাহেব ঝাপিয়ে পড়লেন জিসান সাহেবের উপর।

জিসান সাহেব যখন বোধ ফিরে পেলেন, তখন সকাল হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে রোদ এসে তার গায়ে পড়ছে। প্রখর রোদ যেন তার কাছে অচেনা। তিনি সহ্য করতে পারছেন না। চোখ মেলে পুরো রুমে তাকালেন, কেউ নেই। তারপর উঠলেন, শরীরে কোন ব্যাথা নেই, কিন্তু আছে তৃষ্ণা। সেই তৃষ্ণা অনন্তকালের। কিন্তু কি করে এটা হল? জিসান নিজেকে চিন্তে পারছে না। প্রখর রোদের মত সে নিজেই এখন তার কাছে অচেনা!

এভাবে সবার প্রিয় জিসান সবার কাছে অচেনা হয়ে গেল, হারিয়ে গেল চিরকালের মত।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পুরনো ধর্মের সমালোচনা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেই নতুন ধর্মের জন্ম

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:১৫

ইসলামের নবী মুহাম্মদকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে এক বছরের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে প্রবেশনে পাঠানোর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×