somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবিতার কুলীনসভা / এহসান হাবীব

১২ ই অক্টোবর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পূর্বপুরুষেরা কবে ছিলো কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোয়াড়,
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস।
মুখ ঢাকে আলাওল-রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার।
সোনালী কাবিন-৬/আল মাহমুদ


পৃথিবীতে তবে সম্রটেদের আধিপত্য কখনও অস্ত যায়না বুঝি। তারা বারবার ফিরে আসে নতুন নতুন রূপ নিয়ে। এই মুহূর্তে যে সম্রাট আমাদের চারপাশে উজ্জ্বল উপস্থিতি নিয়ে বিরাজ করছে তার নাম পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদের একচ্ছত্র আধিপত্য পৃথিবীর অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করছে, না কি বিন্যস্ত করছে সে হিসাব অর্থনীতিবিদদের। কিন্তু একটা হিসাব স্পষ্ট যে, যদি হঠাৎ করে কোন নিচু আয়ের ব্যক্তিটির হাতে একটা মোটা অংকের পুঁজি জমা হয়ে যায় আর সেই পুঁজিটি তিনি যথার্থ অর্থে বিনিয়োগ করার যোগ্যতা না রাখেন তবে সেই থার্ডক্লাস পুঁজিবাদটি তখন তার পূর্বের অতীত ইতিহাস মুছে ফেলার জন্য সমাজে নাম কিনতে চান। এক্ষেত্রে তিনি চেষ্টা করেন সমাজের তথাকথিত সভ্য সংস্কৃতিবান এবং বুদ্ধিজীবী সার্কেলে ভিড়ে যেতে। এই থার্ডক্লাস পুঁজিবাদের কেউ কেউ তখন গায়ক হতে চেষ্টা করেন, অভিনেতা হতে চেষ্টা করেন। এদেশে কবি হওয়া যেহেতু তুলনামূলক সহজ। যদি কোনক্রমে একটা কবিতার বই প্রকাশ করা যায় আর কিছু টাকা খরচ করে একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে পরলে কিছু অনুসারী এবং হুঁক্কাহুঁয়া করার মতো কিছু কবিও জুটে যায়। কেউ কেউ আবার বুদ্ধিজীবী পুষেন। যেন কবিওয়ালা আর শায়েরের যুগ শেষ হবার নয়।

ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পর এই কবিওয়ালা আর শায়েরদের আবির্ভাব। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দৌলতে কোম্পানীর আনকালচার্ড, অশিক্ষিত গোমস্তা দালালদের দল অসদুপায়ে অর্থ উপার্জন করে রাতারাতি জমিদার বনে গেল। এবং নিজেদেরকে অভিজাত হিসেবে পরিচিত করে তুলতে টাকা দিয়ে পুষতেন কবি, শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবীদের। আর এই কবি দলটাকেই বলা হল কবিওয়ালা ও শায়ের। কিন্তু কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায় না তেমনি ওই গোমস্তারা জমিদার হলেও তাদের রুচির পরিবর্তন হয় নি। তারা সাহিত্যের নামে কবিদের কাছে চাইত স্থুলরুচির কামোদ্দীপনাপূর্ণ গান। আর এটও সত্যি যে পোষা পাখি প্রভুর ইচ্ছানুযায়ী বুলিই কেবল আওড়ায়। বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকরা কেবল ১৭৬০ সাল থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত এই কবিওয়ালা ও শায়েরদের চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাব হলো যখন রাষ্ট্রীয় শক্তি সাহিত্যের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করতে শুরু করলো কবিদেরকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠী অথবা ঐসব স্থলচিত্তের পুঁজিবাদীরা বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে শুরু করলো তখন থেকেই এই কবিওয়ালাদের উত্থান এবং আজ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি রয়ে গেছে। উদাহরণ স্বরূপ আমরা পড়তে পারি এই কবিতাটি-

আমার চুল বাঁধার কালো-মোটা রাবার ব্যান্ডে বাম হাতের তর্জনী প্রায় ঠেকিয়ে
১৪+ মেয়েটি বলল, মেয়েদের জিনিস লাগাইছেন ক্যান?
‘আরে! আমি তো পারলে মেয়েদেরই লাগিয়ে রাখতে চাই! মেয়েদের লাগাইতে
পারছিনা বলেই তাদের জিনিস লাগাইতেছি।

মেয়েদের জিনিস/ মারজুক রাসেল

মারজুকের এই কবিতাটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় অতীতের কবিওয়ালাদের কুরুচিপূর্ণ সাহিত্যরস বিবর্জিত, উদ্ভট, স্থুল, অশ্লীল কবিতার কবিতার নামে সেই সব পঙক্তিগুলোর কথা। কবিওয়ালারা যেমন তাদের পূর্ববর্তী কবিদের কবিতার অনুকরনে বা চুরি করে কবিতা বানাতেন। তেমনি মারজুকও যথার্থ কবিওয়ালার মতোই এই কবিতাটি চুরি করেছেন নির্মলেন্দু গুণের ‘খচ্চর’ কবিতা থেকে। দুটো কবিতা একসাথে রেখে পড়লে তা সহজেই বুঝা যায়। কবিওয়ালাদের সেই সব কবিতার সমঝদার ছিলেন সেই নব্য ধনী হওয়া দালাল শ্রেণীটি। তেমনি আজকের যুগের এই কবিওয়ালাদের সমঝদার হলেন সেই থার্ডক্লাস পুঁজিবাদীরা। তাদের সৃষ্ট দৈনিক কিছু সাহিত্য পত্রিকা এমন কী লিটলম্যাগ নামধারী কিছু কাগজও এদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। ফলে তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় প্রকৃত কবিরা হয় উপেক্ষিত।

যুগটা যেহেতু বদলে গেছে। আগেকার মতো তো এখন আর কেউ এমনি এমনি কবি বা বুদ্ধিজীবী পুষে অযথা টাকা খরচ করে না। আর টেড হিউজের কল্যাণে কাক পাখিটি জনপ্রিয় হওয়ার পর কাকের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কবির সংখ্যা। সেহেতু এখন পুঁজিবাদীরা বিভিন্ন রকম যাচাই বাচাই করে কাকে দিয়ে তার আরও দু’চার পয়সা কামাই করা যাবে আরো বেশি নতজানু ক্রিড়নকে পরিণত করা যাবে- এসব হিসেব নিকেশ করে তবেই কবিকে তাদের কাঙ্ক্ষিত আনুকল্য দেন। এক্ষেত্রে ‘কৌন বনেগা কালিদাস’ প্রকল্পটি হতে নিয়ে থাকে তাদের নিয়ন্ত্রিত রাজধানী কেন্দ্রিক দৈনিক, সাহিত্য ও কিছু তথাকথিত ভুঁড়িওয়ালা ছোটকাগজ। সারাদেশের তরুণ কবিরাও কলিদাস হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে বিভিন্ন গোষ্ঠিতে ভাগ হয়ে এবং যারা এই দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পেরেছে তারা আরও দ্রুত সেই পুঁজিবাদীদের নজরে পড়ার জন্য দশ, পনের জনে ভাগ হয়ে নিজেদেরকে কুলীন বলে ভাবতে এবং রটাতে লাগলো- অর্থৎ আমরা জাতে উঠেছি আমাদের কিনে নিন। তবে এই স্রোতের বিপরীতেও দাঁড়িয়েছিলো কিছু সত্যিকারের কবি যারা রাজধানী কেন্দ্রিক এই ভন্ডামীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, কবিওয়ালাদের মতো বেহায়া হয়ে অসভ্য উল্লল্ফন তারা করে নি বরং; কেন্দ্র থেকে কবিতাকে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রান্তিকে। চেষ্টা করেছিলেন তারা শুদ্ধচারী কবির দাঁড়াবার জায়গা তৈরি করতে।

আর এই সতেজ পলিমাটির উপর দাঁড়িয়েই শুরু হয়েছিলো আমাদের পথচলা। কথা ছিলো এই জায়গাটিকে আমরা বিস্তৃত করবো। কিন্তু ঠিক এক দশকের আগের কবিরা যেখানে সাহিত্য পাতার সম্পাদক হয়ে গেলো কেউ পুরো দৈনিকের প্রায় সম্পাদক হয়ে গেলো, কেউ বা কবিতাকে পণ্য করে সারা দেশ ঘুরে স্টার হয়ে যাচ্ছে- তা দেখে আমরা ‘ঠাস্কি’ খেতে লাগলাম। কেউ কেউ ওদের মতো হব কি হব না- ভাবছিলাম। এমন সময় যারা জানতো- সোজা পথে তাদের কিছুই হবে না তারা ঢুকে গেলো ‘কৌন বনেগা কালিদাস’ প্রকল্পে এবং ঢাকাই বিজলী বাতি, দৈনিকের ছোটখাট রাজত্ব আর মোটাতাজা কাগজের লোভ দেখিয়ে প্রান্তিকের কবির গলায় ফাঁস লাগিয়ে টানতে লাগলো রাজধানী কেন্দ্রিক কবিতার কুলীন সভায়। ফলে প্রান্তিকের কবিটি মুখিয়ে থাকেন ঢাকার মোটাতাজা কাগজটির সম্পাদক তার লেখা চাইবে আর চাহিবামাত্র লেখাটি কম্পোজ করে সম্পাদকের বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসে। শুধু তাই নয় সংখ্যাটি প্রকাশ হওয়ার পর সম্পাদক বরাবর তৈলমর্দন করে ব্যক্তিগত পত্র লেখে আর সেই পত্র দৈনিক পত্রিকার সাময়িকী সম্পাদককে দিয়ে (পত্রলেখককে না জানিয়ে) প্রকাশ করালে পত্রলেখক বিব্রত হয়ে বলে- আমার চিঠি বিকৃত করা হয়েছে। অথচ তার পাশের ছোটকাগজ সম্পাদক তার কাছে লেখা চেয়ে ঘুরতে ঘুরতে হতাশ হয়ে যায়। অবশ্য এমনিভাবে আমাদের প্রান্তিকের সম্পাদকরাও কেন্দ্রে অবস্থানকারী লেখকের লেখা ছাপানোর জন্য হাপিত্যেশ করে। অথচ তার পাশের বাড়ির প্রতিশ্রুতিশীল তরুণটির লেখা ছাপতে তার কোন আগ্রহ দেখা যায় না। আর এমনি করেই আজ আমরা ঢুকে যাচ্ছি রাজধানী কেন্দ্রিক কবিতার কুলীন সভায়। কেউবা ঢুকছি অগ্রজদের সভায় মাথা নিচু করে। আর যারা একটু আগেভাগে শাহবাগে এসেছিলো তারা একটু বেশী মাতব্বরি ফলাতে চাইলে অগ্রজদের বিষ নজরে পড়ে যায়। ফলে তারা নিজেরাই গড়ে তুলে এক কুলীনকবিগোষ্ঠী। সাহিত্য যখন থেকে পণ্য হয়ে যেতে থাকলো অর্থাৎ যে সময় থেকে সাহিত্যবিক্রি করে রাষ্ষ্ট্রের বিভিন্ন রকম সুবিধা ভোগ করা যেত লাগল। বিভিন্ন মজলিশে সাহিত্য বিক্রি করে দু’চার পয়সা কামাই করা যেতে লাগল তখন থেকেই মূলত কুলীনকবিগোষ্ঠীর উদ্ভব। এবং আজ পর্যন্ত এরা বহাল তবিয়তেই আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অতীতের কুলীন কবিটি আজ আর নেই এবং আজকের কুলীনটিও কাল থাকবেনা। যে থাকে সে কবি, এক কথায় কবি। রূপ সনাতনের মতো হাজারো কুলীন কবি হারিয়ে গেছে পৃথিবীর প্রগাঢ় প্রস্রাবের ফেনায়। আর টিকে আছে পথের কবি, প্রান্তিকের কবি চন্ডীদাস, জয়ানন্দ, চন্দ্রাবতী.....


অতএব যারা এখনও ভিড় উজিয়ে হাঁটছেন তাদের আফসোস করার কিছুই নেই কেবল একটু সৎ আর সাবধানি হওয়া প্রয়োজন। আর যারা ভিড়ে মিশে গেছেন তাদেরও কিন্তু ফিরে আসার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় নি। কেবল এটু উপলব্ধি করতে শিখুন। কারণ সজনীকান্ত দাসের ইতিহাসও কিন্তু কবিতার ইতিহাস মনে রেখেছে।
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×