somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুখ ফিরিয়ে নেবার সময়/ এহসান হাবীব

১৫ ই নভেম্বর, ২০০৯ রাত ৮:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবিতা এক অনন্ত ধারাবাহিক উপাখ্যান। অর্থাৎ কাল পারম্পর্যে কবিতা এক কবির হাত থেকে অন্য আরেক কবির হাত ধরে অনাগত কালের দিকে এগিয়ে যায়। এই যাত্রার মিছিলে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য কবি থেকে শুরু করে অনুল্লেখ্য কবির থাকে কৃতিত্ব, থাকে দায়বদ্ধতা। কারন আজ যে কবিতাটি লেখা হলো তার বীজ আরও অনেক আগে অন্য অনেক কবি বপন করেছিলেন। ফলে পৃথিবীর সকল কবি মিলেমিশে কেবল একটি কবিতাই রচনা করে চলছেন- এমন বক্তব্যে আমার আস্থা নেই। সমর্থনও করিনা। আমি জানি কবিত্ব ছাড়া কবি হওয়া যায় না। আর কবিত্ব হচ্ছে এমন এক জিনিস যা যার আছে তার আছে যার নাই তার নাই এমন কি অনুশীলন করেও পাওয়া যায় না। মোদ্দাকথা কবিত্বশক্তি জন্মগতভাবে পেতে হয়, জিনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এই মহার্ঘ বস্তুটি। আবার কবিত্বশক্তি থাকলেই যে, কেউ অনায়াসে কবি হয়ে যাবেন তারও কোন কথা নেই। কারন আপনার ভেতরে যে অপূর্ব প্রাণশক্তির উচ্ছ্বাস আপনি টের পেয়েছেন তাকে তো জিইয়ে রাখতে হবে। আর এই জিইয়ে রাখার উপায় হচ্ছে সাধনা। সাধনা করে এই কবিত্বশক্তি অর্জন করা যায় না ঠিকই আবার সাধনা ছাড়া কবিত্বশক্তি ধরেও রাখা যায় না। তো এই সাধনার ব্যপারটি কী? বন-জঙ্গলে অথবা পীর মুর্শিদের আখড়ায় গিয়ে নাম জপ করা? প্রকৃত ব্যপারটি কবি মাত্রই জানেন এবং মানেন। সাধনা করার পূর্ব শর্ত হলো নিজেকে সাধনা করার যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা। কবির ভেতরে যদি মৌল মানবিক গুণাবলির উদ্বোধন না ঘটে, কবি যদি ব্যক্তিজীবনে সৎ না হন তাহলে তার এই কঠিন ব্রতে না আসাই উচিত।

অনুশীলন করে কবি না হতে পারলেও কবির মতো কিন্তু হওয়া যায়। আর চারপাশে এই ‘মতো’ কবিদের প্রাচুর্যে আমাদের কাব্যভূবন ঠাসা। এরাই ধারাবাহিকতার ইতিহাস তুলে কারন এরা জানে অনুশীলন করে যা অর্জন করেছে তা পূর্ববর্তী অনেক কবির দেখানো ভুবন থেকেই আহরিত। এরাই কবিতার বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করে, নামকরণ করে, কবিতায় টেকনিক খাটায়। এদের মধ্যে যারা আবার নতুনত্বের কথা বলে তারা নতুনত্বের নাম করে বিচিত্র সব ভাব-সাবের আশ্রয় নেয়, আতলামিপূর্ণ আলাপ-সালাপকে কবিতা বলে চালিয়ে দিতে চায়-

তবু কবিতা আসে না
প্রতিক্ষণ
মন খুঁজে মন
দেহ চায় দেহ
না-পেয়ে কি লেখালেখি শ্রেয়?
না-খেয়ে কি ুধা
শীর্ষক রচনা লিখবে বোকাচুদা?

যত পার খাও
ইউ এন- এর একটি শাখা ফাও
সেই ফাও-ফাউ না
যতই করি বর্ণনা।
অবশেষে
বলি আধা হেসে
যাকে চিনি- সেই তো অচেনা
ডিভোর্স লেটার আসে
বাড়ি ভাড়ার নোটিশ, আসে টেলিফোন বিল
শুধু কবিতা আসে না ....

কবিতা আসেনা/ টোকন ঠাকুর

আচ্ছা বলুন তো এটা কোন ধরণের কবিতা। বাজারের ভেজাল খাদ্যদ্রব্য নিয়ে দৈনিকে কিছুদিন আগে লেখা হয়েছে ‘আমরা কী খাচ্ছি’? ঠিক এই রকমভাবে এই কবিতাটি নিয়ে লেখা হতে পারে ‘কবিতার নামে আমরা কী পড়ছি’। আমাদের মিডিয়া মহাজনরা আমাদের কী পড়াচ্ছে? মিডিয়া মহাজনদের সাথে এদের আবার দহরম-মহরম ভাব। একজন আরেকজনের পিট চাপড়াচ্ছে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে। এই সমস্ত কবিতার সপে লিখিয়ে নিচ্ছে কবিতা সহজতার দিকে এগুচ্ছে। কবিতা এখন আর শিল্পের কাঠামোগত বলয়ে আবদ্ধ নেই। স্বতঃস্ফূর্তভাবে একজন কবি যাই বলে তাই কবিতা হয়ে যায়। আমাদের মতো দেশে যেখানে (শিক্ষিত জনগোষ্ঠির) পাঁচ ভাগ লোকও শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে না নিদেন পে পাঠকও হতে চায় না সেখানে এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে এখানে খুব সহজেই কবি হওয়া যায়। কবিতা লিখতে পারুক বা না পারুক কোন ক্রমে যদি কোথাও বলে ফেলা যায় যে ‘আমি কবি’ আর মাত্র একজনকেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের রেশ ধরে তার সপে দু’চারটি প্রশংসা বাক্য আওড়ানো যায় তাহলেই কেল্লাফতে। কারন আমরা বাস করি এমন পাঠককূলের মাঝে যারা কষ্ট করে কোন কিছু খুঁজে নিতে চায় না। কেউ একজন চিনিয়ে দিলে তাকে নিয়ে রীতিমতো হৈ চৈ পড়ে যায়। সে সরেস কাঁঠাল না মাকাল তা যাচাই করার সময়টুকু নেই। সাম্প্রতিক কালে ‘উত্তরাধুনিকতত্ত্ব’ বা এরও কিছুদিন আগে বিভিন্ন ইজম বা জেনারেশন নিয়ে যা যা হয়ে গেল তাই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর এই ফাঁকটিকেই ব্যবহার করছে চারপাশের ‘মতো’ কবিরা আর এই ‘মতো’ কবিদের দলটিই যেহেতু ভারী সেহেতু তাদের পে গলাবাজী করার মানুষের অভাব নেই। এক কবি লিখছেন ‘অমুক’ বাংলা কবিতায় বাঁকের সৃষ্টি করেছেন আবার ‘অমুক’ কবি লিখছেন এই কবি জীবনানন্দ দাশকে অতিক্রম করে গেছেন। এও এক ধরনের অনুশীলন, আর এই অনুশীলনের সাথে মাঝে-সাঝে যদি সহজতার নাম করে কিছু চমকও দেখানো যায় তাহলে সমাজে ‘কবি’ হিসেবে একটা কল্কে সে পেয়েই যায়। পাঠকের চোখও আটকে থকে এদের উপর। ফলে প্রকৃত অর্থের কবিতার সৃষ্টি এবং চর্চা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এতো গেল অনুশীলনের এক ধরণ। এই ধরণের বাইরে আবার আরেক অনুশীলন আছে। এটিকে আমরা সাধনা বলতে পারি। এই সাধনায় একজন পাঠক মগ্ন থেকে কবিতার মতো কিছু উজ্জ্বল পদ্য উপহার দিতে পারে যা সুখপাঠ্য-

তোমাকে মূর্ছিত রেখে চলে গেছে সিংহপুরুষেরা।
কত বাদাবন কত অমৃতের পুষ্করিণী পিছে
ফেলে রেখে যে এসেছি, আগুনের কুণ্ডু জ্বেলে আজ
শুনে না সেইসব? মূর্ছার ভেতরে একদিন
আমিও দেখেছি বটফল, উন্মাদের চিঠি পেয়ে
চলে গেছি জ্যান্ত হয়ে ক্রীড়ারত পুতুলের দেশে।

লীলাচূর্ণ/ মজনু শাহ

আমাদের চারপাশে কবিতার নামে, সহজতার নামে, এক্সপেরিমেন্টের নামে যে সমস্ত কবিতা লেখা হচ্ছে এই কবিতার স্বাদ তার চেয়ে ভিন্নতর। কবিতাকে সুস্বাদু করতে ঐ কবি আশ্রয় নেন বাক চাতুর্যের। সাধনার দ্বারা ঐ কবি নিজের চারপাশে তৈরি করেন শব্দবলয়। আর শব্দের জাদু দিয়ে তিনি বশ করেন এক শ্রেণির হলুদ রোগাক্রান্ত পাঠক- আমরা যাকে বলি এলিট শ্রেণী- সাহিত্যের বেলায় অধ্যাপক পাঠক। ঐ যে কে যেন বলেছিল- ‘শব্দই কবিতা’। সেই দেড়শ বছরের পুরোনো বাক্যটিকে আজও এরা বহন করে চলছে শিরায় শিরায়। ফলে শব্দবাজী এখন বাংলা কবিতার প্রধানতম প্রবণতা। আর এর প্রধান পুরোহিত হলেন আল মাহমুদ। অবশ্য আল মাহমুদ এটি ধার করেছেন জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা থেকে। আশ্চর্যের ব্যপার হলো আল মাহমুদ পরবর্তী প্রজন্ম এই প্রবণতার দিকে ঝুঁকছে। এই প্রবণতার মগ্ন সাধকেরা নিজেদেরকে কবির কাতারে প্রায় খাড়া করেও শেষ পর্যন্ত পা বাড়িয়েছেন অগ্রজদের দেখানো পথে- এক অমোঘ ধারাবাহিকতায়; এর স্বপে তারা যুক্তিও দাঁড় করিয়েছেন- পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা একেবারে অভূতপূর্ব। আপনাদের রক্তের ভেতর, জিনের মধ্যে অভূতপূর্ব কবিতা রচনা করার মতা যদি নাই থকে তাহলে কি অস্বীকার করতে হবে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে? কিংবা বোদলেয়ার? জীবনানন্দ দাশ! কিংবা এই কবিতাটি-

স্বাধীনতা দিবসে
শিশুদের ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় গিয়ে দেখি,
এক শিশু এঁকেছে পৃথিবীর ছবি;
অথচ বিষয় ছিলোঃ স্বদেশের মানচিত্র আঁকা।

শিশুর নিজস্ব মানচিত্র
বয়ে যাচ্ছে এক নদী
নদী-পাশে এক সবুজ বনভূমি
নদী-তীরে শান্ত চোখের মতো নৌকা একখানা
বনভূমির দিকে
নীল আকাশ থেকে
নামছে এক ঝাক পাখি।

কৌতুহলে শিশুকে বল্লাম
ঃ কী নাম ঐ নদীর?
জানাল সহজ উত্তরে ঃ কেন ইছামতি।
আরার বল্লাম ঃ তোমার ছবিতে মানুষ কোথায়?
খুব সহজে দিল উত্তর
ঃ মানুষ আঁকবার কথা মনে আসে নাই।

শিশুর নিজস্ব মানচিত্র/ জাহিদ হায়দার

শব্দবাজির পাশাপাশি অনুশীলনবাদিরা আবার বেশ অনুকরণ প্রিয়ও। ধরা যাক জনৈক কবি দীর্ঘকবিতা লিখতে অভ্যস্ত; লিখে আরামও পান। দীর্ঘকবিতা তিনি লিখতেই পারেন। কবিতার ইতিহাসে আঙ্গিক আর কতটুকুই বা প্রভাব ফেলে। কিন্তু তিনি যদি ঘোড়ার বিচির মতো ঝুলে পড়া দীর্ঘকবিতাটির পে সাফাই গান এভাবে যে, কবিকে চিনতে হয় দীর্ঘকবিতা দিয়ে, যেমন- এলিয়টকে চিনতে হয় ‘ওয়েস্টল্যান্ড’ দিয়ে গিন্সবার্গকে চিনতে হয় ‘হাউল’ দিয়ে। আর এজন্যই তিনি দীর্ঘকবিতা লিখেন। আর এই অনুকরণবাদিরা বলে থাকেন একজন কবিকে হতে হবে দৃষ্টিপাতের গুণাবলী সম্পন্ন। যারা এই ধরণের কবিতা লেখেন-

তখনও মানুষ ছিলো পৃথিবীতে, কোন জাতিসঙ্ঘ ছিলো না তখনও নিষেধ ছিলো পায়ে পায়ে, আরও ছিলো পুরুত রাজারা। তোমাকে গুহায় রেখে, ধরো, মৃগয়ায় গেছে শিকারী পুরুষ। মৃত হরিণের দেহ কাঁধে নিয়ে সে আর ফিরেনি। ফিরে এলো জাতিসঙ্ঘ বহু-বহু বছরের পর তোমাকে পেলোনা পেল গুহার বিবর।

তখনও মানুষ ছিলো পৃথিবীতে কোন জাতিসঙ্ঘ ছিলোনা/ আবু হাসান শাহরিয়ার

তাদের নাকি দৃষ্টিপাত করার মতা নেই। প্রকৃত অর্থে এই সব অধ্যাপক কবিরা কবিতায় শব্দের চর্চা এমনকী ইতিহাস চর্চাও করেন আরোপিতভাবে। তাদের কে বোঝাবে এই কবিতার মাহাত্ম্য-

এক যোগ এক সমান দুই (১+১=২); এটা ভুল। এক যোগ সমান এক (১+১=১); এটা ঠিক। এক যোগ এক সমান এক লিখলাম। লিখে রহস্য সমাধান করলাম।

হিসেব / আশিক আকবর

যারা বলেন এই কবিতার কবিদের দৃষ্টিপাতের মতা নেই তারা একবার নিজেদের দীর্ঘকবিতাগুলোর পাশে এই কবিতা দু’টো রেখে পড়ুন। তারপর নিজেকে এলিয়ট ভাবুন আর গিন্সবার্গই ভাবুন কোন সমস্যা নাই।

ইদানিং আবার এই অনুশীলনবাদিদের তরফ থেকে দাবি উঠছে যে, স¤প্রতি বাংলা কবিতা এক বিশেষ বাঁক নিতে যাচ্ছে, বলা বাহুল্য সেই বাঁক তাদের হাত ধরেই আসছে। কিন্তু আসলেই কি কোন বাঁকের লণ আমরা দেখতে পাচ্ছি? আপনারা বলবেন- তুই ব্যাটা অন্ধ তাই বলিয়া প্রলয় বন্ধ থাকিবে কেন? কিন্তু ভাই আমি যে একবারেই অন্ধ না, আপনাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ-মুখ তো কিছুটা হলেও ফুটিয়েছি। সহজতা বলে যে বাঁকটির কথা বলছেন তা কেমন বাঁক- টোকনের কবিতাটা পড়লেই বুঝা যায়। কবিতার বাঁক তো বিষয় ভাবনাতেই বদলায়- আঙ্গিক নিয়ে যে সমস্ত হৈ চৈ চেঁচামেচি হয়েছে তা বাঁকের ভাগাড়েই জমা আছে। আর সেই বিষয় ভাবনার বাঁক কিভাবে নেয় নিচের দুটি কবিতা থেকেই দেখে নিন-
রবীন্দ্রনাথ-

আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান।
না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।

এই আলোক চেতনা থেকে যেভাবে বাঁক নেয় জীবনানন্দ দাশ-

অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে
হঠাৎ ভোরের আলোর মুর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে
ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুর্ণিবার বেদনা;
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে ওঠে
মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য
আমাকে নির্দেশ দিয়েছে
আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়-বেদনায়-আক্রোশে ভরে গিয়েছে;
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে
উৎসব শুরু করেছে।
হায়, উৎসব!
হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিযে ফেলে
আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,
অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে
থাকতে চেয়েছি।
কোনদিন মানুষ ছিলাম না আমি।

এবার একবার দেখুন তো এই যে এতসব সহজতা, সরলতা, বোধের বিবর্তনের কথা আপনারা বলছেন; আপনাদের কথিত বাঁকের কবিতাগুলো এই কবিতার চেতনা থেকে কতটুকু বাঁক নিয়েছে- একবার আমাকে বলুন? যদি পাল্টা প্রশ্ন করেন- জীবনানন্দের পর তাহলে আমাদের আর কোন অর্জন নেই? একথা সত্যি দাশ কাব্যের পর রাহমান, মাহমুদ, শক্তি, বিনয় বাংলা কবিতায় অবস্থান তৈরি করেছে। কিন্তু এরা কেউই জীবনানন্দের নৈরাজ্যবাদ থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারেনি। অনুবীণ দিয়ে খুঁজলে এদের একটা অস্তিত্ব অবশ্যই ধরা পড়বে তবে এরা চারজন যে গাছটির চারটি শাখা বিভিন্ন বর্ণে ও গন্ধে শোভিত করে তুলছেন সে গাছটির নাম জীবনানন্দ। শাখার দিকে তাকালে এদেরকেই কেবল চোখে পড়ে আর গোড়ায় তাকালে জীবনানন্দ স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। অথচ সা¤প্রতিক বাংলা কবিতার কবিরা পথ হাঁটছেন বাক-চাতুর্যের কবি আল মাহমুদ ও লাইনসর্বস্ব কবি বিনয় মজুমদারের অনুসৃত পথে আর এদের নিয়ে কী মাতামাতিটাই না এরা করছে, তারপরও দাবি করছে নতুন বাঁকের।

যারা না দিয়ে শুরু করে তাদের হয় না কিছুই, যারা হ্যাঁ দিয়ে শুরু করে তারা যেতে পারে বহুদূর। কিন্তু আমি শুরু করেছি ‘না’ দিয়ে তবে শেষ করতে চাই হ্যাঁ দিয়ে। একথা সত্যি যে আমাদের চারপাশের যারা কবিতা লিখতে আসছেন তাদের অনেকেই রক্তের ভেতর কবিত্বশক্তি নিয়েই কবিতা লিখছেন।
নিচের কবিতাটি এর সাক্ষ্য দেবে-

স্বপ্নের ভিতরে আমার জন্ম হয়েছিল

সেই প্রথম আমি যখন আসি
পথের পাশে জিগা গাছের ডালে তখন চড়চড় করে উঠছিলো রোদ
কচুর পাতার কোষের মধ্যে খণ্ড-খণ্ড রুপালি আগুন
ঘাসে ঘাসে নিঃশব্দ চাকচিক্য-ঝরানো গুচ্ছ-গুচ্ছ পিচ্ছিল আলজিভ
এইভাবে আমার রক্তপ্রহর শুরু হয়েছিলো
সবাই উঁকি দিয়েছিলো আমাকে দেখার জন্য
সেই আমার প্রথম আসার দিন
হিংস্রতা ছিলো শুধু মানুষের হাতে,
ছিল শীত, ঠাণ্ডা পানি, বাঁশের ধারালো চিলতা, শুকনো খড়
আর অনন্ত মেঝে ফুড়ে গোঙানি-
আমার মা
স্বপ্নের ভিতর সেই প্রথম আমি মানুষের হাত ধরতে গিয়ে
স্তব্ধতার অর্থ জেনে ফেলেছিলাম,
মানুষকে আমার প্রান্তরের মতো হয়েছিল
যে রাহুভুক।

অন্যমনস্কভাবে আমার এই পূনর্জন্ম দেখেছিলো
তিনজন বিষণœ অর্জুন গাছ।
সেই থেকে আমার ভেতরে আজো আমি স্বপ্ন হয়ে আছি
মা, স্বপ্নের ভিতর থেকে আমি জন্ম নেব কবে?

জাতিস্মর/ আবিদ আজাদ

কেবলই উদাহরণ স্বরূপ আবিদ আজাদকে টেনে আনলাম। শুধু আবিদ আজাদই নয় যারা আজ বাংলা কবিতার শাদা পৃষ্ঠায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা সবাই এমনি সব সতেজ সীসাহীন বাতাসের প্রাচুর্য নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছিলেন। তবে একথাও মনে রাখা দরকার আজকে আমরা যাদেরকে যে যে কবিতাগুলো দ্বারা চিনি সেই কবিতাগুলো তাদের একেবারে প্রথম দিকের রচনা। তখন পর্যন্ত নাগরিক কেদ, চতুরতা আর বিত্তবৈভবের সহজ রাস্তাটির সন্ধান তারা পাননি। যেহেতু এই রাস্তাটির সন্ধান তারা পাননি সেহেতু তারা নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে পেরেছিলেন কবিতার সরলতম মৌলিক সাধনায়। কিন্তু যেই প্রথম কাব্যের ঔজ্জ্বল্যে তারা আমাদের কেবল একটু আশা দিতে পেরেছেন তখনি তাদের চোখ-কান ফুটতে লাগল- রাজধানীর মহাসড়কে এসে কেউ টাকার ধান্ধায় কেউবা শর্টকাট রাস্তায় নাম কুড়ানো ধান্ধায় এই তৃতীয় বিশ্বের র্থাডক্লাস পুঁজিবাদিদের খপ্পরে পড়ে গেলেন। এবং তাদের পোষ মানতে বাধ্য হলেন বা মেনে গেলেন। যেহেতু তাদের হাতেই ছিল আমাদের মিডিয়া সাম্রাজ্য আর কবি হিসেবেই তারা আশ্রয় পেয়েছিল তাদের প্রতিপালকদের কাছে সেহেতু তারা তাদের এই কর্মব্যস্ততার মাঝেও কবিতা লিখতে লাগলেন। এবার আর সাধনা নয় এ পর্যায়ে কবিতা হয়ে উঠলো তাদের কাছে অনেকটা ঐচ্ছিক বিষয় এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া এগুলোকেই কবিতার বাঁক বলে চিহ্নিত করতে থাকল। ফলে কবিতা ঘুরপাক খেতে থাকলো পুনরাবৃত্তিতা, অনুকরণবাদিতা ও চৌর্যবৃত্তিতায়। ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকেনি এরপর তাদের এই অবস্থান ধরে রাখার জন্য তারা নেমে পড়ে নোংরা দলাদলি ও কবিতার নামে কালোবাজারি এবং মাস্তানিতে। তাদের পথ ধরে অনুজরাও একই কায়দায় দ্রুত শিখে নিতে থাকে কেমন করে লুচি খাওয়ালে এক কবি আরেক কবির প্রশংসা করে, কেমন করে ‘তেল মারলে’ সম্পাদক তাকে স্পেশালভাবে তুলে ধরবে অথবা কেমন ভান করলে, কেমন ভাব ধরলে বড় কবি সেজে বসে থাকা যায়। হায় আফসোস ! এরাই না একদিন জেনেছিল- কবিতা এক শুদ্ধতম শিল্প এবং একজন কবির জীবনও কবিতার মতো শুদ্ধ হতে হয়। এই সত্য ভুলে গেলে কবিতার মাঠে একজন কবির জন্য আর কী অপো করে? একজন কবির জন্য অপো করার কথা ছিল কবিতা নাুী এক কুড়ি বছরের টগবগে যুবতী- যার বুকের ভাঁজে লুকিয়ে থাকে জিজ্ঞাসার পাহাড়, যার ঘাড়ের চুলের ভেতর লুকিয়ে থাকে রহস্যের ময়দান যার নাভিমূলে লুকিয়ে থাকে সম্ভাবনার আধার আর যার চোখের ভেতর লুকিয়ে থাকে আশার মুক্তোদানা। অবশ্য আজও বাংলা কবিতার কবিদের জন্য অপো করছে কবিতা নাুী কুড়ি বছরের যুবতী কিন্তু তার দিকে একবার তাকালে দ্বিতীয়বার আর তাকাতে ইচ্ছা করে না। একবার তাকাতেই স্পষ্ট বুঝা যায় এই যুবতী ভুগছে কামশীতলতায়।

অবশ্য আমি বিশ্বাস করি একটা জাতিগোষ্ঠিতে বছরে বছরে কবি পয়দা হয় না। পঞ্চাশ একশ বছরে কিংবা আরো সময়ের ব্যবধানে একজন কবির আবির্ভাব হয়। এই ফাঁকা সময়টাতে এই সব ‘মতো’ কবি এবং ভান-সর্বস্ব কবিদের উল্লম্ফন চলে। কিন্তু যখনই আমাদের সৎ এবং সাহসী কবিটি বেরিয়ে আসবেন সূর্যের আড়াল ছেড়ে তখনি ফেটে চুপসে যাবে এইসব ফাঁপা বেলুন এবং আমি এও বিশ্বাস করি তার সাথে আমার দেখা হবে। আজ নয়তো আগামিকাল।
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×