আন্তর্জাতিক কল থেকে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রবি-সোমবারের মধ্যেই কমপক্ষে পাঁচটি মামলা দায়ের করতে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিফোন কম্পানি বিটিসিএলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
দুদকের কমিশনার (অনুসন্ধান) বদিউজ্জামান গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে জানান, মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে বিটিসিএলের সদস্য (রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা) মোহাম্মদ তৌফিকও থাকতে পারেন। অন্য কমিশনার (তদন্ত) মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, রবিবার এসব মামলা দায়ের হতে পারে। তবে মামলায় বিটিসিএলের কোন কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব হচ্ছে না।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব ভট্টাচার্য্য বলেন, মামলা হলে সোমবার সংবাদ সম্মেলনে তা জানানো হবে।
এদিকে বিটিসিএল সূত্রে জানা যায়, মামলা ঠেকাতে বা মামলা থেকে প্রভাবশালী কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাদ দেওয়ার জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে জোর চেষ্টা-তদবির চলছে।
মোহাম্মদ তৌফিক সম্পর্কে জানা যায়, চাকরি জীবনে বিভিন্ন অভিযোগে চারবার তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সর্বশেষ গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এ-সংক্রান্ত মামলার কারণে ২০০৮ সালের ৩ মার্চ সাময়িক বরখাস্ত করা হয় তাঁকে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় চার কোটি টাকার সম্পদ দখলে রাখার অভিযোগে ২০০৮ সালের ২৫ আগস্ট রমনা থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারিতে ওই মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। তবে আগের মামলা-অভিযোগ সত্ত্বেও বর্তমান সরকারের আমলে তাঁর পদোন্নতি আটকায়নি। তিনি পরিচালক থেকে জিএম এবং পরে সদস্য পদে পদোন্নতি পান।
যে অভিযোগে মামলা হচ্ছে : দুদকের অভিযোগ, বিটিসিএলের এসটিএম এবং ই-১ অবৈধভাবে ব্যবহার করে ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকলের (ভিওআইপি) মাধ্যমে কল টার্মিনেশন করে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। বৈদেশিক ক্যারিয়ার নিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে। ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে বিটিসিএল তথা রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী চুক্তি করে এ লুটপাট চলেছে। বিটিসিএলের বৈদেশিক টেলিযোগাযোগ অঞ্চলের আওতায় মহাখালী ও মগবাজারের আইটিএঙ্গুলোর সিডিআর ডিভাইস অকার্যকর রেখে বৈদেশিক কলের ডাটা তাতে ধারণ না করা, সিডিআর অকার্যকর করার আগের সিডিআর গায়েব করা এবং বৈদেশিক ক্যারিয়ারগুলোর কাছে শত শত কোটি টাকা বকেয়া থাকার পরও বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দুদক প্রাথমিকভাবে এসব অভিযোগে বিটিসিএলের সঙ্গে সম্পর্কিত ২৮টি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার সম্পর্কে তদন্ত শুরু করে। এই ২৮টি কম্পানি প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বাকি রেখে এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এ ক্যারিয়ারগুলো হচ্ছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিস্টোকল সার্ভিসেস, স্কাই হাই, ফিউজন, আইএজিই ফোন ও এন টেল; যুক্তরাজ্যের অ্যাঙ্ফে টেল, রাইয়ান টেল, সিম্পল টেল, জিডিএঙ্সি, লাইকা টেল, মনি এন্টারপ্রাইজ, টেলিলিংক ও ওয়েস্টার্ন নেটওয়ার্ক; সিঙ্গাপুরের ডিজি টেক, এইচএসি জাপান, আই পাওয়ার, এনটিএস গ্লোবাল, ওয়ান ওয়ার্ল্ড, শাইন ওয়ার্ল্ড ও বিডিএইউ; হংকংয়ের আইসিএম গ্রুপ; কানাডার মাই এরবা, ইকো ক্যারিয়ার, ইবসেস, প্রাইম টেল ও শ্যাম লিমিটেড; মালয়েশিয়ার দেশি ডিজিটাল এবং অস্ট্রেলিয়ার ওয়ার্ল্ডটেল প্রাইভেট লিমিটেড।
এই ২৮টি ক্যারিয়ারের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিস্টোকল সার্ভিসেস ও স্কাই হাই, যুক্তরাজ্যের অ্যাঙ্ফে টেল, রাইয়ান টেল ও সিম্পল টেল, সিঙ্গাপুরের ডিজি টেক, এইচএসি জাপান, আই পাওয়ার, এনটিএস গ্লোবাল, ওয়ান ওয়ার্ল্ড ও শাইন ওয়ার্ল্ড, কানাডার মাই এরবা এবং হংকংয়ের আইসিএম গ্রুপের মোট ২৪৪ কোটি টাকা বাকি থাকায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বিটিসিএলের হিসাবে এই ১৩টি ক্যারিয়ারের কাছে ২৪৪ কোটি টাকা পাওনার বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ মাত্র ৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরের আই পাওয়ারের ৪৩ লাখ চার হাজার ৬৬৮ মার্কিন ডলারের বা ৩৫ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের বাড্ডা শাখা থেকে এই ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি ম্যানেজ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে বাড্ডা থানায় মামলা হয়েছে।
বাকি ১৫টি ক্যারিয়ারের মধ্যে মাত্র দুটির ৬৯ হাজার মার্কিন ডলারের বা ৫৬ লাখ ৯ হাজার ৭০০ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টির তথ্য বিটিসিএলের হিসাব শাখার নথিতে রয়েছে। অন্যদিকে এই ১৫টি ক্যারিয়ারের কাছে বিটিসিএল বা সরকারের পাওনা রয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা।
এসব ক্যারিয়ার ছাড়াও অন্যান্য ক্যারিয়ারের মাধ্যমে বিটিসিএলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রায় হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির তথ্য পান দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা।
দুদকের উপপরিচালক এস এম সাহিদুর রহমানের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল এ তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন। সূত্র জানায়, তদন্তে এ বিশাল দুর্নীতির সঙ্গে মোহাম্মদ তৌফিকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
দুদকের তদন্ত দল প্রথমেই আইসিএম গ্রুপ নামের একটি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের কথিত লোকাল এজেন্ট সাবিল আইটি লিমিটেডের দুর্নীতির তথ্য উদ্ঘাটন করে। হংকংভিত্তিক ওই ক্যারিয়ারের নাম ব্যবহার করে তিন কোটি ২৭ লাখ ১৯ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ৪০ পয়সা লোপাটের অভিযোগে সাবিল আইটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম মফিদুল ইসলাম, বিটিসিএলের সাবেক পরিচালক (আন্তর্জাতিক) মাহফুজুর রহমান, বর্তমান পরিচালক মাহবুবুর রহমান, আইটিএক্সের বিভাগীয় প্রকৌশলী এ কে এম আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে গত ২২ অক্টোবর রমনা থানায় মামলা করা হয়।
সুত্র