somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রৌদ্দুর খুঁজে ফিরি (২য় পর্ব)

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দুই
শৈলীর স্বামী বদরুদ্দিন ধূর্ত প্রকৃতির ধান্দাবাজ মানুষ। তার প্রধান কাজই হচ্ছে সবকিছুর জন্য নতুন নতুন ধান্দা খুঁজে বের করা। কত সহজে বিনা পরিশ্রমে কাজ হাসিল করা যায় সেটাই তার উদ্দেশ্য থাকে সবসময়। আরেকটি কাজ সে খুব ভালো পারে। কথায় কথায় স্ত্রী আর শালাকে বাপ মা তুলে গালিগালাজ করা। এই কাজে সে কখনো কোনো ক্লান্তি বোধ করে না।
বারো বছর আগে কী যে মতিভ্রম হয়েছিল তার, সেটা ভেবে এখনো সে নিজেকে ‘গাধা’ ‘গাড়ল’ বলে বকাঝকা করে। মতিভ্রমই তো হয়েছিল! তা না হলে এমন কাজ কেউ করে! চাল নাই চুলো নাই...বাপ-মায়ের স্বভাব চরিত্রের ঠিকঠিকানা নাই...এমন ঘরের মেয়েকে কেউ বিয়ে করে! একটা মানুষের কাছে সে আহ্লাদ করে নিজের শ্বশুরবাড়ির গল্প করতে পারে না। হুঃ! গল্প করার আছেটাই বা কী!
দিব্যি পয়সাওয়ালা শ্বশুর ছিল। এক ছেলে এক মেয়ে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে মেয়ের নামে যে সয়-সম্পত্তি লিখে দিত, তাতেই শেষ বয়সে পায়ের ওপরে পা তুলে কাটিয়ে দেওয়া যেত। কাজের ধান্ধায় এভাবে অফিসে অফিসে ধর্ণা দিয়ে বেড়াতে হতো না। তার মধ্যে গোদের ওপরে বিষফোঁড়ার মতো বউটা আবার বাজা। এত বছরে একটা বাচ্চা কাচ্চাও বিয়োতে পারেনি। এমন অকাজের মেয়ে মানুষকে দিয়ে কী ঘোড়ার ডিমটা করবে বদরুদ্দীন!
শ্বশুর ছিল এক সরকারী অফিসের বড় ইঞ্জিনিয়ার। মালপাত্তি জীবনে কিছু কম কামায়নি। ঢাকা শহরেই স্বনামে বেনামে তার দু’তিনটি বাড়ি ছিল। সব খবরই রাখতো বদরুদ্দিন। রাখবেই না বা কেন? তার কাজই তো ছিল এসব অফিসারদের পিছে পিছে ঘুরে বেড়িয়ে কাজকর্ম আদায় করা। ঠিকাদার বদরুদ্দিন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একবার করে সেই অফিসে ঢুঁ মারতো। কাজের আশায় অফিসারদের রুমে গিয়ে বসে থাকতো।
দিনের পর দিনের সাধনায় অফিসারদের সুনজরে পড়তো কখনো সখনো। সেরকম ভাবেই একদিন শ্বশুর হেলাল উদ্দীনও তার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।
তার শ্বশুর হেলালউদ্দীনের জুরিসডিকশনে কাজকর্মের অভাব ছিল না। তাই সেখানে বদরুদ্দিনের একটু ঘনঘনই যাতায়াত ছিল। মাঝে মাঝে ছোটখাট কাজকর্ম কিছু দিলেও বড় কোনো কাজ বদরুদ্দিন কখনোই পেত না।
একদিন যথারীতি অফিসে গিয়ে ধর্ণা দিয়ে বসে আছে। অফিসারের রুমে অনেক লোকজন। রুম ভেতর থেকে বন্ধ। বদরুদ্দিন বসে আছে হেলালউদ্দীনের পিএ’র রুমে। ব্যস্ত পিএ কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিরক্তিমাখা চোখ তুলে দেখলেও কিছু বলতে পারে না। এসব ঠিকাদারদের রাগানো ঠিক না। একেকজনের হাতে বিপুল ক্ষমতা। তেজ দেখানোর বেলায় একেবারে ওস্তাদ। তাছাড়া বসরা পর্যন্ত এদের তোয়াজ করে চলে অনেকসময়। তাই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও এদের সাথে হাসিমুখে কথা বলতে হয়।
বদরুদ্দিন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হাতঘড়ির দিকে তাকায়। পাক্কা দু’ঘণ্টা ধরে বসে আছে। এত কী কথা চলছে ভেতরে? বসে বসে তিন কাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে তার। পিএ কে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘কীসের মিটিং চলছে ভেতরে? আমি দেখা করতে চাই জানিয়েছেন?’
পিএ মনের বিরক্তি চেপে রেখে বলে,
‘স্যার একটু বিজি আছেন আজকে। আপনি বরং...’
‘কীসের বিজি মিয়া! আমার কার্ড দিয়া রাখেন। দেখা না কইরা যাওয়া নাই।’
অবশেষে আরো আধা ঘণ্টা পরে ডাক আসে। খালি রুমে বদরুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে হেলালউদ্দিন বলেন,
‘তা আপনি কাজ চান! বেশ। কাজ একটা আছে। করতে পারলে লাভ ভালোই থাকবে আশা করছি।’
বদরুদ্দিন উৎসাহিত হয়ে বলে,
‘স্যার কাজের জন্যই তো রোজ রোজ আসি। নইলে কী আর আসতাম!’
এরপরে হেলালউদ্দিন তাকে ভারী অদ্ভূত এক কাজ দিলেন। তার বাসার মেরামত কাজ। প্ল্যাস্টারিং, আর এটা সেটা টুকিটাকি কাজ। বদরুদ্দিনের মেজাজ খারাপ হলো। এসব কাজে লাভ মোটেও কিছু থাকে না বললেই চলে।
কিন্তু তারপরে হেলালউদ্দিন যা বললেন, তা শুনে তো বদরুদ্দিনের আক্কেল গুড়ুম! তার বাসার কাজ মোটেও করার দরকার নেই। শুধু মাঝেমাঝে গিয়ে একটু হাজিরা দিয়ে আসলেই হবে। কাজ করতে হবে অন্য এক বাসার। সেখানেও তেমন বড় কিছু কাজ নয়। এই কাজ বাবদ বরাদ্দকৃত পুরো টাকাটাই বলতে গেলে তার লাভ থাকবে। কিন্তু বাইরের কাউকে দিয়ে তিনি সেই কাজ করাতে চাইছেন না।
এভাবেই বদরুদ্দিন হেলালউদ্দিনের অন্য বাসা ও সেই বাসায় বসবাসকারিনীর সন্ধান জানতে পারে। এক ভদ্রমহিলা তার একটি বাচ্চাকে নিয়ে সেই বাসায় থাকেন। এখন সেই ভদ্রমহিলার সাথে হেলালউদ্দিনের কী সম্পর্ক সেটা জানার জন্য তো আর গোয়েন্দা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না!
বাথরুমের সামান্য কিছু মেরামতের পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো কাজ করে দিয়ে বদরুদ্দিন একেবারে তিন লাখ টাকার বিল পেয়ে গিয়েছিল।
অবশ্য আরো একটা বড় লাভও হয়েছিল তার।
হেলালউদ্দিনের বাসায় দু’একদিন কাজের ছুঁতোয় গিয়ে তার মেয়ের সাথে একটু চোখাচোখি করে আসার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল সে। মেয়ে যাকে বলে অপূর্ব রূপসী। বিশ একুশ বছর বয়স। তবে কেমন যেন মনমরা ভাব সমসময়। চিন্তা ক্লিষ্ট মুখ।
তবে তা দিয়ে বদরুদ্দিনের কী! বড়লোকের মেয়ে হাসলেও ভালো, না হাসলেও ভালো। একবার পটাইতে পারলেই ভবিষ্যত ফকফকা।
হেলালউদ্দিন সাহেবের বউ কিন্তু তেমন সহজ মানুষ নন। তিনি বদরুদ্দিনের হাবভাব ভালোই বুঝে গেলেন। একদিন তাকে ডেকে এনে বললেন,
‘এই যে শোন, কী যেন নাম তোমার? তোমার স্যারকে বলো, যে জায়গার কাজ করাতে চাইছে নিশ্চিন্ত মনে করাক। আমি গিয়ে তার চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে নালিশ করে আসবো না। এভাবে শুধু শুধু কাজের ছুতোয় এই বাসায় এসে ঘরের মধ্যে ঘুরঘুর করবে না। আমার ভালো লাগে না, বুঝেছো? আর ট্যারা চোখে কী দেখ? ঐটা আমার মেয়ে। সোজা চোখে দেখতে পারো না?’
তারপরে থেকে আর সেই বাসায় বদরুদ্দিন যেতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু চোখ কান সে খোলা রেখেছিল। মেয়েটাকে দেখে কেন যেন তার মনে হয়েছিল, সে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। শুধু সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুনছে।
একদিন সাহস নিয়ে ফোন নাম্বার জোগাড় করে সেই মেয়েকে ফোন দিয়ে ফেলে বদরুদ্দিন। মেয়েটিও তাকে হতাশ করে না। পুটপুট করে গল্প করে। নাম তার শৈলী। এরপর থেকে মাঝেমাঝেই ফোনালাপ চলতে থাকে। তারপরে আস্তে আস্তে সাহস আরো বাড়তে থাকে। তবে বেশি কিছু করার দরকার পরে না বদরুদ্দিনের। একদিন শৈলীই তাকে ফোন করে বলে,
‘আমাকে বিয়ে করতে পারবে? আজকেই?’
বদরুদ্দিন হতচকিত গলায় প্রশ্ন করে,
‘আজকেই কেন? তোমার বাবা-মা’কে জানাও আগে!’
‘কাউকে জানাতে হবে না। আমি নিখোঁজ হয়ে গেলেও কেউ খোঁজ করবে না। চিন্তা নেই। তুমি বিয়ে না করতে চাইলে বলো যে রাজি নও।’
বদরুদ্দিন বেশি কিছু ভাবনা-চিন্তা করার সুযোগ পায় না। এভাবে বিয়ে করার ইচ্ছে তার মোটেও ছিল না। এত বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে, সানাই বাজিয়ে মানুষকে না দেখাতে পারলে আর কী হলো!
কিন্তু শৈলী যেভাবে তাকে চেপে ধরেছে...এখন যদি সে বেঁকে বসে, তাহলে আমও যাবে ছালাও যাবে। অতএব বদরুদ্দিন আর কিছু বলতে পারে না। বড়লোকের মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে এসে রেজিষ্ট্রি বিয়ে করতে হয় তাকে।
তবে শৈলীর ভবিষ্যদ্বাণী একেবারেই ফলে গেল। তার বাবা-মা কেউই সেভাবে তাদের খোঁজ করেন না। শৈলী আসার আগে বাসায় চিঠি লিখে এসেছিল। যা বলার তা সব চিঠিতেই লেখা ছিল।
বদরুদ্দিন বিয়ের পরেই টের পায়, সে ধরাটা কোথায় খেয়েছে! উপরের চাকচিক্য আর ফুটানির আড়ালে তার শ্বশুরবাড়িতে ঝামেলার অন্ত ছিল না। হেলালউদ্দীনের অবৈধ সম্পর্ক ছিল এক ডিভোর্সি মহিলার সাথে, যাকে সে একটা বাড়িও লিখে দিয়েছে। এদিকে শৈলীর মা ও বসে ছিলেন না। তিনিও কোথাকার এক ব্যবসায়ীর সাথে নতুন সংসার শুরু করার আয়োজন শুরু করে দিয়েছেন। দুজনেরই গলার কাঁটা হয়ে বসে ছিল ছেলেমেয়ে দুজন। এর মধ্যে একজন তো নিজেই নিজের পথ দেখে নিয়েছে, এখন ছেলেটাকে কোথাও পাঠিয়ে দিতে পারলেই ঝামেলা চুকে যায়।
সে দায়িত্বও শৈলী নিজের কাঁধেই তুলে নেয়। বদরুদ্দিনের ভ্রুকুটিকে অগ্রাহ্য করে ছোটভাইকে নিয়ে আসে নিজের কাছে।
বাঁধামুক্ত হয়ে যায় তাদের বাবা-মা দুজন। সেই থেকে তারা চারজন মানুষ তিন টুকরো হয়েই বেঁচে আছে। (চলবে)

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৫৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×