somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প- গওহর

৩১ শে জুলাই, ২০২১ রাত ১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সিলেট গেলেই শোভন ভাইয়ের কাছে একবার যাওয়া চাই আমার!
কারণটা বহুমাত্রিক। শোভন ভাই আমার ইউনিভার্সিটির বড়ভাই। এক সময়ের চৌকষ বক্তা শোভন ভাই ভালো বাঁশি বাজাতো। থাকতো মহসিন হলে। আমরা বাসা থেকে এসে মাঝে মাঝে তার রুমে আড্ডা জমাতাম। শোভন ভাই এমনিতে খুব যে আড্ডাবাজ ছিল তা নয়, কিন্তু গল্প বলায় তার ছিল অসামান্য পারদর্শিতা। কোনো কাজ খুঁজে না পাওয়া অবসন্ন দুপুরে তার রুমে গেলেই স্মিতমুখে বলতো, ‘কী... মন খারাপ? একটু বসো। বাঁশিতে একটা সুর তুলি। দেখি তোমার মনটা ভালো করে দিতে পারি কী না!’
আমার বউ অরুনিমার সাথে ইউনিভার্সিটি জীবন থেকেই আমার মন দেওয়া নেওয়া চলছিল। তাই মনের ব্যারোমিটারের ওঠানামার খবরটা শোভন ভাইয়ের অজানা ছিল না। কারণে অকারণে কত যে জ্বালিয়েছি তাকে, তার হিসেব নেই। শোভন ভাই কখনো বড়ভাই সুলভ গাম্ভীর্যে দূরে সরিয়ে রাখেনি। বরং ছোটভাই থেকে কখন যে বন্ধুর স্থানটাতে বসে পড়েছি, বুঝতে পারিনি।

ইউনিভার্সিটি জীবন পার করেছি প্রায় বাইশ বছর হতে চললো। মাথার চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে আরো বছর পাঁচেক আগে থেকেই। বুঝতে পারি কখন যেন চুপিসারে জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে শুরু করে দিয়েছি।
শোভন ভাই পাশ করার পরপরই ঢাকা ছেড়েছে। একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে দেশের এমাথা থেকে ওমাথা কাজের অযুহাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যখন যেখানে শোভন ভাইয়ের পোস্টিং হয়েছে, সময় সুযোগ পেলেই সেখানে হানা দিয়েছি। এতদিনেও সংসার ধর্মে মন বসায়নি। এখনো দিব্যি চিরকুমার সেজে দিন পার করে দিচ্ছে। শোভন ভাইয়ের ডেরাতে যখন তখন হানা দেওয়ার পেছনে এই কারণটাও কাজ করে। আগের সেই মিশুকে গল্পকথক মানুষটির গল্পের ভাণ্ডার দিনে দিনে আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। অথচ তার সময়কে ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের আবির্ভাব ঘটেনি। তাই গল্প করে আর গল্প শুনে এখনো আগের মতোই আনন্দ পাই।

শোভন ভাই সিলেটে বদলী হওয়ার পর বেশ কয়েকবার তার বাসায় উঠেছি। শহর থেকে খানিকটা দূরে নান্দনিক প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে শোভন ভাইয়ের দোতলা নিলয়। পুরোটা একাই দখল করে নিয়ে বাস করছে। জনা দুয়েক কেয়ারটেকার, মালি, দারোয়ান নিয়ে একেবারে আলিশান কারবার। বাসার চারপাশ জুড়ে নানারকম গাছগাছালির ঘন নিবাস। পাখির গুঞ্জনে মোহনীয় পরিবেশ। কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে একেবারে ছাদ অব্দি। সেখানে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ চা বাগান।
খাওয়ার টেবিলে প্রতি বেলায় এলাহি কারবার। যা খেতে ইচ্ছে করবে শুধু মুখ দিয়ে বলা চাই। যদিও শহর থেকে জায়গাটির অবস্থান বেশ অনেকটা দূরে। তবে শোভন ভাইয়ের এক্সপার্ট বাবুর্চি কোত্থেকে যেন সব ব্যবস্থা করে ফেলে। রাতে কাঁচ ঘেরা বারান্দায় বসে চাঁদের আলো পান করতে করতে শোভন ভাইয়ের মুখের অমৃত কথন শুনি।

এবারেও আমাকে দেখে শোভন ভাই খুব খুশি হলো। আলিঙ্গনে জড়িয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, ‘তারপর... গওহর আর তার মায়ের কী খবর? ওদেরকেও নিয়ে আসতে এবার!’
গওহর আমার মেয়ের নাম। নামটা শোভন ভাইয়েরই দেওয়া। আত্মীয় বন্ধুমহল সবার দেওয়া নাম থেকে এই নামটিই আমার স্ত্রী অরুনিমারও পছন্দ হয়েছিল। বললাম, ‘ওদের নিয়ে এলে কি আর ইউনিভার্সিটি জীবনের সেই আনন্দটা পাবো? আপনার কাছে আসিই তো সেই নস্টারজিয়ার টানে!’

সারাদিন অনেক গল্প হলো। খাওয়া দাওয়া হলো একেবারে হুলুস্থুল পর্যায়ের। রাতে চায়ের কাপ হাতে বসে পড়লাম কাঁচঘেরা সুন্দর বারান্দায়।
আজ বিকেল থেকেই ঝির ঝির বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। লোডশেডিং এর দৌরাত্ম্যে চারপাশে কালিমাজা অন্ধকার। অদ্ভুত নিস্তরঙ্গ প্রকৃতি। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে প্রকৃতির এই ঠান্ডা নিস্তরঙ্গতা। কিছুক্ষণ মুগ্ধ আবেশে এই অপরূপ মৌনতা উপভোগ করলাম। নির্জনতার নাকি নিজস্ব ভাষা থাকে। সেই ভাষাটাকে অনুভব করতে হয় তার সুরে সুর মিলিয়ে। তাই আমিও চুপ করে থেকেই প্রকৃতির আহ্বানে একাত্ম হলাম।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে শোভন ভাইই মুখ খুললো, ‘ব্যাপার কী! একেবারে দেখছি মৌন ঋষি হয়ে গেলে! গল্প শোনার জন্য যে জোরাজুরি করছো না!’
বললাম, ‘আজ এই চমৎকার আবহাওয়ায় গল্প না শুনে ছাড়ছি নাকি আপনাকে? গল্প তো শুনবোই! এই আবহাওয়ায় ভূতের গল্প ছাড়া তো জমবে না শোভন ভাই! আপনি ভূতের গল্প জানেন? কোনোদিন ভূতের গল্প শোনাননি কিন্তু!’
শোভন ভাই হাসলো। অন্ধকারে সেই হাসি খুব ভালোভাবে দেখতে পেলাম না। ঘরের মধ্যে জ্বালিয়ে রাখা মোমবাতির হাল্কা আলো বারান্দায় লুকোচুরির ইন্দ্রজাল তৈরি করেছে। সেই ইন্দ্রজালের মায়ায় হাসিটাকেও কেন যেন খুব রহস্যময় মনে হলো আমার কাছে।

শোভন ভাই বললো, ‘ভূতের গল্প কী না জানি না। তবে রহস্যময় একটা গল্প শোনাতে পারবো। গল্পটা আমার নিজের জীবনেই ঘটেছে।’
আমি নড়েচড়ে বসলাম। মেঘলা আকাশ, আদ্র মন ও প্রকৃতি... সেই সাথে রহস্যময় গল্প। বললাম, ‘দেরি না করে শুরু করে দিন!’
শোভন ভাই শুরু করলো।

‘আমি তখন ঠাকুরগাঁয়ে থাকতাম। দেশের সবচেয়ে উত্তরের জেলা। চাকরিতে অল্প কিছুদিন হলো ঢুকেছি। ঢাকার বাইরে থাকতে হবে শুনেই আগ্রহী হয়েছি বেশি। মফঃস্বল শহরে বেড়ে ওঠা আমার। ঢাকা শহরের যান্ত্রিকতায় কেমন জানি হাঁপিয়ে উঠতাম। তাই বাইরে পোস্টিং পেয়েই লুফে নিয়েছি।
আমি তখন একেবারে জুনিয়র অফিসার। দেশের প্রত্যন্ত জেলার সাথে ঢাকার হেড অফিসের নেটওয়ার্কিং এর কাজটা মূলত দেখতে হয় আমাকে। আমাদের কোম্পানি যেসব সেক্টরে ইনভেস্ট করে, সেগুলোর রুট লেভেলের কাজগুলো আমার মতো জুনিয়র অফিসারদের দিয়ে করানো হয়। অফিস থেকে একটা বাসা বরাদ্দ করে দিয়েছে থাকার জন্য। দু’কামরার ছোট্ট একটা বাসা। স্থানীয় এক ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। পরে বাসাটা ভাড়া নিয়েছিল এক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তার নাকি কী একটা মাথার অসুখ ধরা পড়ে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। বাসাটা খালিই পড়ে ছিল এতদিন।

ঠাকুরগাঁ সদর থেকে আরো বেশ অনেকটা দূরে ছিল আমার অফিস। বাসাটাও অফিস থেকে খুব কাছে ছিল না। আশেপাশে আর তেমন কোনো বাসাবাড়ি ছিল না। প্রায় দুই মাইল দূরে স্থানীয় বাজার বসতো।
জুনিয়র লেভেলের অফিসারদের জন্য ঐ দুই কামরার ছোট্ট বাসাই স্বর্গ। সারাদিন খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। রাতে বাসায় এসে জামাকাপড় ছেড়ে খেয়ে দেয়ে খালি একটা ঘুম দিতে পারলে বেঁচে যাই।

কিন্তু রেডিমেড খাওয়াদাওয়া আর জুটছে কোথায়? অফিস বাসা বরাদ্দ করে দিয়েছে বলে কি রাঁধুনিও ঠিক করে দিবে? সেই ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে।
আমি অফিসের পিওন ছেলেটাকে ধরে বললাম একজন রাঁধুনির ব্যবস্থা করে দিতে। ঘরদোর পরিষ্কার করার জন্য একটা ছুটা বুয়া কাজে আসতো। সকালে এসে নিজের কাজকর্ম সেরে সে চলে যেত। রান্নাবান্নার কাজ করতে তেমন আগ্রহী ছিল না। কেন কে জানে!
দুদিন হাত পুড়িয়ে নিজেই রান্নাবান্না করলাম। কিন্তু দিনের পর দিন তা আর সম্ভব হচ্ছিলো না। পিওন ছেলেটা জানালো, রান্নার কাজ করানোর মতো একজন আছে। সে কাজ করতে রাজিও হয়েছে। তাকে আগামিকাল পাঠিয়ে দিবে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এই হাত পুড়িয়ে রান্নাবান্না আর পোষাচ্ছিল না।

পরদিন ছিল ছুটির দিন। সারাদিন অপেক্ষা করে বসে রইলাম। কেউ এলো না। দুপুরবেলা ডিমভাজি করে ভাত খেয়ে নিলাম। মনটা খুব খারাপ হলো। এভাবে চলতে থাকলে তো মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকতে হবে!
সন্ধ্যাবেলা ঐ অঞ্চলে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। পল্লীবিদ্যুৎ তখন সবে চালু হয়েছে। পারফরমেন্স বেশি সুবিধার না। আমি মন খারাপ করে বিছানায় শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছি। ঢাকা থেকে আসার সময় কিছু বইপুস্তক সাথে করে এনেছিলাম। সেগুলো পড়ার জন্য সারাদিনে কোনো সময় পাই না। রাতে যাও বা সময় পাই, বিদ্যুৎই থাকে না। মোমবাতির আলোতে গল্পের বই পড়ার মতো জোশ পাই না। এছাড়া রান্নাবান্নার চিন্তা তো মাথায় সারাক্ষণ টিকটিক করছেই!

আমি এসব ভাবতে ভাবতে একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো দরজাতে কেউ যেন টোকা মারছে। চমকে উঠলাম। এমন নির্বান্ধব জায়গায় এই ভর সন্ধ্যাবেলায় কে এলো! দরজা খুলতেই দেখি হ্যারিকেন হাতে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চারপাশে নিকষ অন্ধকার। এর মাঝে হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোতে আমি মেয়েটার মুখ দেখার চেষ্টা করলাম। শাড়ির আঁচলে মুখটা আধোঢাকা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। তার পরনে শাড়ি। মাথায় ঘোমটা টেনে দেওয়া। যেটুকু আলো মুখে এসে পড়েছে তাতে বেশ বুঝতে পারছি মেয়েটা সুশ্রী গৌরবর্ণা আর একেবারে অল্প বয়সী। হয়ত উনিশ কুড়ি এরকম বয়স হবে। আমি ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেলাম। এমন নির্জন জায়গায় এই অন্ধকার রাতে একাকী আমার দরজায় দাঁড়িয়ে কে এই মেয়ে? ভুল দেখছি না তো? চোখ কচলে নিয়ে ভালোভাবে আবার তাকালাম। নাহ! ভুল হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। দিব্যি ফুটফুটে চেহারার একটি মেয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
মুখ থেকে আঁচলটা একটুখানি সরে যাওয়ায় হ্যারিকেনের আলোয় পূর্ণরূপে প্রকাশিত হলো মেয়েটির মুখ। স্বীকার না করে পারছি না, আটাশ বছরের যৌবনকে টলিয়ে দেওয়ার জন্য সেই মুখশ্রী সামান্য নয়। আমি কোনোমতে শুধু জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে তুমি? কাউকে খুঁজছো?’
মেয়েটি নিঃসঙ্কোচে বললো, ‘আপনার কাছেই তো এসেছি! রান্নার লোক খুঁজছিলেন না আপনি?’
আমি হাতে আকাশের চাঁদ পেলাম। যাক আমার পিওন ছেলেটি তাহলে সত্যি সত্যিই একজনকে পাঠিয়েছে! কিন্তু পরমুহূর্তেই দমে গিয়ে ভাবলাম, এরকম একটা রূপসী তরুণী আমার এখানে কাজ করলে লোকে কী বলবে?

যদিও পেটের ক্ষুধা আমার বোধবুদ্ধিকে একটু স্তিমিত করে দিলো। আগে তো পেটের ক্ষুধা নিবারণ করি, লোকের বলা না বলা নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে!
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি রান্না করতে পারো?
মেয়েটি একপাশে ঘাড় কাত করলো। আমি বেশিকিছু বলে সময় নষ্ট করলাম না। বললাম, ‘পাশেই ছোট একটা রান্নাঘর আছে। রান্নার আয়োজন সব সেখানেই পাবে। আপাতত একটু ভাত আর ডাল রান্না করে দাও। কাল আরেকটু তাড়াতাড়ি এসো। আমি বাজার করে নিয়ে আসবো। কী কী লাগবে আমাকে আজকে একটু...’

মেয়েটি আমার কথা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা না করেই পাশের ঘরে চলে গেল। যেতে যেতেই বললো, ‘আমি জানিয়ে দিব। অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। রান্না বসায়ে দিই!’ বলেই দ্রুত নিজের কাজে নেমে পড়লো সে। হ্যারিকেনটাকে একপাশে নামিয়ে রেখে এমন অভ্যস্ত হাতে এটা ওটা টেনে কাজ করছিল যেন এই রান্নাঘরের খুঁটিনাটি সে চেনে। আগেও কাজ করেছে এখানে।
মেয়েটা কাজে নেমে পড়তেই আমি একটু ভাবনার অবকাশ পেলাম। হ্যারিকেনের আলো প্রতিচ্ছরিত হয়ে রান্নাঘরটা এখন বেশ আলোকিত হয়ে উঠেছে। আমি আমার ঘরে আরেকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছি। ঘরের পাশেই রান্নাঘর। মেয়েটিকে খুব ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছি আমি।
সুশ্রী নমনীয় চেহারার একটি মেয়ে। কথাবার্তা যেটুকু বললো, তাতে অশুদ্ধ ভাষার লেশমাত্রও নেই। পরনের শাড়িটি এক প্যাঁচে পরেছে, কিন্তু পরার ভঙ্গিটি খুব সুন্দর। মোটেও পাড়াগাঁ অঞ্চলের নিম্নশ্রেণীর কোনো ঘরের মেয়ে বলে মনে হয় না।
আমি একটু একটু করে আলাপ চালিয়ে গেলাম। মেয়েটার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা দরকার। বলা যায় না, কী মতলবে ঢুকে পড়েছে কে বলতে পারে! এই অঞ্চলে শুনেছি চুরি ডাকাতি আকছার হয়। আমার কেমন যেন মনে হতে লাগলো, এই মেয়েটিকে এখানে পাঠানো হয়েছে আমাকে ফুসলানোর জন্য। আমি ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লেই বাসা ফাঁক করে সটকে পড়বে।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বাড়ি কি আশেপাশেই?’
মেয়েটি মৃদুস্বরে বললো, ‘হ্যাঁ আশেপাশেই থাকি।’
‘এখানে আগে কাজ করতে? তোমাকে দেখে তো মনে হয় না যে...মানে...বলতে চাইছি তুমি কি রান্নার কাজ আগে কখনো করেছো?’
‘আগেও করেছি!’
অল্প কথায় উত্তর। খুব বেশি আলাপচারিতা চালাতে চাইছে না মনে হলো। আমার সন্দেহ আরেকটু গাঢ় হলো। দেখে মনে হচ্ছে না, অভাবী ঘরের মেয়ে। অথচ কাজ করছে নিপুণ দক্ষতায়। এর মানে কী?
তার অভ্যস্ত নিটোল হাতে অল্প সময়ের মধ্যেই ডাল ফোঁড়নের সুবাস নাকে ভেসে এলো। আসার পর থেকেই নিজের হাতের পোড়া আধাসিদ্ধ রান্না খেতে খেতে মুখে অরুচি এসে গিয়েছিল। সেই রুচির খরায় ডাল ফোঁড়নের গন্ধকে বেহেশতী আতরের সুবাস বলে মনে হলো। ভাতের টগবগিয়ে ফুটে ওঠার শব্দে আমার পেটের ভেতরেও ক্ষুধার ঘোড়া টগবগিয়ে উঠলো।

আর দশ পনেরো মিনিট পরেই মেয়েটি আমাকে খেতে ডাকলো। আমি মনে করেছিলাম সে হয়ত রান্নাবান্না সেরেই চলে যাবে। সেটাই ভালো হতো। অপরিচিত মেয়েটার সামনে বসে খেতে আমি নিশ্চয়ই স্বস্তিবোধ করবো না!
গিয়ে দেখলাম, রান্নার আয়োজন অল্প হলেও খুব পরিপাটি। ভাত ডাল আর এরই মধ্যে সে এক ফাঁকে আলুভর্তাও করে ফেলেছে। আমি গোগ্রাসে ভাত খেলাম। এত সুস্বাদু রান্না আগে কখনো খেয়েছি কী না মনে করতে পারলাম না।
মেয়েটি আমার সামনে বসেই এটা সেটা এগিয়ে দিলো। মৃদু গলায় বললো, ‘রান্না ভালো লেগেছে সাহেব?’
‘হ্যাঁ খুব ভালো।’ মুখভর্তি খাবার নিয়ে কোনোমতে বললাম।
‘ঘি নাই বাসায়। থাকলে ভর্তাটা আরো মজা লাগত খেতে।’
এই অল্প মজাতেই আমি প্রায় দু’প্লেট ভাত বিনা বাক্যব্যয়ে সাবাড় করে দিলাম।

আমার খাওয়াদাওয়ার পরে সে রান্নাঘর গুছিয়ে থালাবাসান মেজে হ্যারিকেন হাতে নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় বললো, আগামিকালও একই সময়ে আসবে, সন্ধ্যা নামার পরপরই। আমি যেন বাজার করে রাখি। আমি এতক্ষণে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার নামটাই তো শোনা হলো না!’
মেয়েটি অদ্ভুত রহস্যমাখা হাসি হেসে বললো, ‘ঝিনুকেতে বাঁধি বাসা, কন্ঠে করি বাস
কুড়িয়ে এনে সাগর থেকে... দেয় পরবাস!
একটা ধাঁধা দিলাম। বলুন তো আমার নাম কী?’
আমি এই হেঁয়ালির অর্থ বুঝলাম না। তবু কিছু একটা বলতে মুখ খুলছিলাম। মেয়েটা বলে উঠলো, আজকেই বলতে হবে না। পরে বলেন!’
বিদ্যুতের মতো হাসি ছড়িয়ে সে চলে গেল। অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতা আমাকে ঘিরে ধরলো। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মেয়েটি চলে যাওয়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্যুৎ চলে এলো। সারাঘর ঝকঝকে আলোতে উদ্ভাষিত হলো। আমি রান্নাঘরে গিয়ে দেখি সবকিছু ঝকঝকে তকতকে করে গুছিয়ে রাখা। কোথাও কোনোকিছু আলুথালু হয়ে পড়ে নেই। মিষ্টি এক স্নিগ্ধ সুবাসে সারা বাসা মৌ মৌ করছে।

পরদিন অফিসে গিয়ে পিওন ছেলেটিকে ডেকে বললাম, ‘চমৎকার রান্নার লোক পাঠিয়েছো। খুব ভালো রান্না জানে মেয়েটি।’
‘ওহ তাহলে গিয়েছে! যাক আমি মনে করেছিলাম কিছুদিন দেরি হতে পারে।’
আমার মনের মধ্যে অনেকগুলো জিজ্ঞাসা উঁকিঝুঁকি মারছিল। মেয়েটি কে, কোথায় থাকে, ভালো ঘরের মেয়ে কী না...পড়ালেখা জানে মনে হলো...ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু পাছে ছেলেটি কিছু ভেবে বসে, এই লজ্জায় কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। আর তাছাড়া আমার আসল কাজ হলেই হলো। এত খবরে আমার কাজ কী!

মেয়েটি প্রতিদিন প্রায় একই সময়ে এসে আমার রান্নাবান্নার কাজ করে যেতে লাগলো। একেবারে রুটিন মাফিক তার আসা যাওয়া। সময়ের এতটুকুও এদিক ওদিক নেই কোনোদিন। আর প্রতিদিনই একই নিয়ম। তার আসার কিছু আগেই বিদ্যুৎ চলে যায়। মেয়েটি হ্যারিকেন হাতে ঘরে ঢোকে। টুকটাক গল্প করে। বেশিরভাগ সময় আমিই কথা বলি। মেয়েটি অল্প কথায় উত্তর দেয়। আমাকে সামনে বসিয়ে খাওয়ায়। প্রতিদিন জিজ্ঞেস করে, ‘রান্না ভালো হয়েছে সাহেব?’
ফেরার সময় একই প্রশ্ন করে প্রতিদিন... ‘আমার নামটা কি বের করতে পেরেছেন?’
আমি ভুলে গিয়েছিলাম। মাথা চুলকে বলি... ‘এহ হে! আজকে তো বের করা হয়নি!’
এভাবে প্রতিদিনই ভুলে যাই আমি। কোনোদিনই মেয়েটার নামের ধাঁধাটা আর বের করা হয় না আমার। সে চলে যেতেই এক অদ্ভুত আচ্ছন্ন করা সুবাস পাই। অবাক হয়ে ভাবি, পাড়াগাঁয়ের মেয়ে কী সুবাস গায়ে মাখে কে জানে! কোথায়ই বা পায়?

এভাবে দিন গড়াতে থাকে। আমি প্রতিদিন বিকেল হওয়ার আগেই ঘরে ফেরার তীব্র টান অনুভব করতে থাকি। কাজেকর্মেও আর আগের মতো মন বসে না। কেমন যেন অস্থির অস্থির একটা ভাব বোধ করি। অফিস থেকে ফেরার পথে বাজার করে নিয়ে যাই। আর বাসায় ফেরার পর থেকে সন্ধ্যা হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকি।
মেয়েটি এত সহজ স্বাভাবিক ভাবে কাজ করে যে, আমি মাঝে মাঝে স্থান কাল পাত্র ভুলে যাই। কী বলবো ভাই...তুমি আমার ছোটভাইয়ের মতো। বলতে একটু একটু লজ্জাও লাগছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হতো সে বুঝি আমার ঘরেরই মানুষ। শুধু তফাত এটুকুই যে, সে আমার অপেক্ষায় বসে থাকে না...আমি ঘরে ফিরে তার আসার প্রহর গুনি।
হ্যারিকেনের আবছা আলোয় আমার মনে বিভ্রম জাগে। তুমি তো জানো, আমি মেয়েদের ব্যাপারে আগাগোড়াই লাজুক ছিলাম। একটি মেয়ে নিঃসঙ্কোচে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটা ওটা করছে...অথচ আমার মধ্যেও তেমন কোনো সঙ্কোচ জাগছে না এই ব্যাপারটাই মনে কেমন যেন মায়াজাল তৈরি করতো। মনে হতো এ বুঝি বাস্তব না, আমার কল্পনা। খুব সুন্দর কোনো স্বপ্ন। ঘুম থেকে জাগলেই ভেঙে যাবে।

টুক টুক করে এটা সেটা গল্প করতাম। আস্তে আস্তে মেয়েটিরও সঙ্কোচ কমে এসেছিল। আমার বাড়ি কোথায়, কে কে থাকে সেখানে...সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতো। প্রশ্ন শুনে মনে হতো, আমার ব্যাপারে তার মনে বুঝি অনেক জিজ্ঞাসা। ব্যাপারটা খারাপ লাগতো না আমার। মনের মধ্যে কেমন একটা অজানা শিহরণ জাগতো।
মেয়েটি আমার বাসায় রান্নার কাজ করছে, হয়ত খুব গরীব ঘরের মেয়ে। অভাবে পড়ে মানুষের বাসায় কাজ করছে। আমি তার মনিব। কাজেই মনের এমন লাগামছাড়া অনুভূতি জন্মানো অশোভন। কারণ এর কোনো পরিণতি নেই। কিন্তু এতকিছু মাথায় খেলতো না আমার। দিনশেষে সন্ধ্যা নামলেই আমি কেমন জানি অন্যরকম এক মানুষে পরিণত হতাম। সারাদিনের যুক্তি বুদ্ধি সব কোথায় যেন হারিয়ে যেত।
মেয়েটি কিন্তু নিজের সম্পর্কে খুব বেশিকিছু বলতো না। নিজের নামটাকেই এক মস্ত ধাঁধা বানিয়ে রেখে দিয়েছে আমার কাছে। সেই ধাঁধার উত্তরটাও খোঁজা হয়ে ওঠেনি এতদিনে।

এদিকে আমার এই বিহ্বলতা অফিসে অনেক ঝামেলার জন্ম দিলো। মনিটরিং এর কাজে অনেক নয়ছয় হলো। কাজে গাফিলতির কারণ দর্শিয়ে হেডঅফিস থেকে শোকজ লেটার পেলাম। আমি দিকভ্রান্ত পথিকের মতো শুধু হাবুডুবু খেতে লাগলাম। একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে পিওন ছেলেটাকে বলেই ফেললাম, ‘আচ্ছা তুমি যাকে পাঠিয়েছো সে কোথাকার মেয়ে? বাপ কী করে? মেয়েটা কি ভালো কোনো ঘরের?’
পিওন অবাক হয়ে বললো, ‘মেয়ে না তো স্যার! তিনবাচ্চার মা। মাঝবয়সী মহিলা। স্বামীটা কিছু করে না। গাঁজা ভান খেয়ে পড়ে থাকে। খুব অভাব। সেইজন্যই কাজে গেছে। কেন রান্নাবান্না ভালো না?’
আমি এই কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলাম। আমার কাছে অল্প বয়সী একটা তরুণী মেয়ে কাজ করে। আর আমার এই পিওন এসব কী বলছে? তাহলে কি এই মেয়েটিই তিনবাচ্চার মেয়ে? কিন্তু সে মাঝবয়সী হলো কীভাবে? তার আবার একটা গাঁজাখোর স্বামীও আছে! অথচ মেয়েটার চালচলন কথাবার্তা দেখেশুনে তো এমন কিছু মনে হয় না!

বাসায় ফেরার প্রতি ভীষণ টান এখনো আগের মতোই কাজ করে। তৃপ্তি নিয়ে খাই। অথচ আধো আলো আধো অন্ধকারে কখনোই পুরোপুরি দেখতে পাই না মেয়েটাকে। মেয়েটা যাওয়ার পরেই বিদ্যুৎ চলে আসে। সে থাকা অবস্থায় কখনো বিদ্যুতের দেখা নেই। মেয়েটার ফেলে রেখে যাওয়া মিষ্টি সুবাসে আমার কেমন যেন মাতাল মাতাল লাগে বাকিটা সময়। মাঝে মাঝে মনে হয়, কী এক অদ্ভুত মোহের জালে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি! এই জাল কেটে বের হয়ে আসার কোনোই উপায় জানা নেই আমার!
কাজে মন নেই। শরীরটাও কেমন যেন খারাপ লাগে আজকাল। বুকের মধ্যে কেমন জানি এক শূন্যতা বিরাজ করে। যতক্ষণ মেয়েটা বাসায় থাকে ততক্ষণই ভালো থাকি। মেয়েটা চলে গেলে বিদ্যুৎ আসে ঠিকই। কিন্তু আমার ভেতরটা অন্ধকার হয়ে যায়।

আমার এই অবস্থা দেখে একদিন অফিসের একাউন্টট্যান্ট জলিল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা শোভন সাহেব, কী হয়েছে আপনার বলুন দেখি? শরীরটা খারাপ নাকি?’
আমি শরীরের কথা না বলে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই তার কাছে ধাঁধার উত্তরটা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি কেমন যেন বিস্ময়মাখা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সেদিনই আমার অফিসের পিওন ছেলেটা এসে বললো, ‘স্যার, আমার ঠিক কইরা রাখা সেই মহিলা তো আপনার বাসায় কামে যায়নি! তার নাকি বাড়িতে কী একটা ঝামেলা হইছিল। কাল আইছিল আমার কাছে। বলছে আজ থেইকা যাইবো। আপনার কাছে তাইলে কেডা কাম কইরা দিয়া যায়?’

আমার সারা শরীর রোমাঞ্চিত হলো। আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, পিওন অন্য কারো কথা বলছে। এ কিছুতেই সেই মেয়ে নয়! তাহলে এ কে? কোথা থেকে এসেছে? উদ্দেশ্যই বা কী?
অফিস থেকে বেরুবার সময় জলিল সাহেব আমার সাথে বের হলেন। কিছদূর আসার পরে আমার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, ‘ইয়ে শোভন সাহেব, একটা কথা বলতাম। আপনার এই বাসায় আগে যে স্কুলমাস্টার থাকতো তাকে আমি চিনতাম। সে দিব্যি সুস্থ সবল একজন মানুষ ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তার মধ্যে কিছু অসুস্থতা দেখা দেয়। শুনেছিলাম তার কাছে নাকি কে একজন আসতো। বাসার রান্নাবান্না করে চলে যেত। কিন্তু কোথা থেকে আসতো... সেটা বলতো না। ভদ্রলোক দিনে দিনে কেমন অসুস্থ হয়ে গেলেন। কাজকর্মে মন বসাতে পারতেন না। ধীরে ধীরে তো মাথাতেই গণ্ডগোল দেখা দিলো! আপনি এক কাজ করেন ভাই, এই বাসাটা ছেড়ে দেন! বাসাটাতেই বুঝি কোনো দোষ আছে।’
আমি সবিস্ময়ে বললাম, ‘এই সময়ে বাস করে এটা আপনি কী বললেন? বাসাতে দোষ থাকে কীভাবে?’
জলিল সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, ‘এই বাসায় অনেকদিন আগে এক স্বামী স্ত্রী বাস করতো। স্বামী কাজে চলে গেলে স্ত্রী সারাদিন বাসায় একা থাকতো। মেয়েটার স্বামীর বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হতো। সেই সময় এই অঞ্চলে কারেন্ট আসেনি। মেয়েটা অন্ধকারে খুব ভয় পেত। একটা হারিকেন জ্বালিয়ে বাসার বাইরে উঠানে রেখে দিত। একদিন রাতে মেয়েটার স্বামী দরজায় কড়া নাড়লে মেয়েটা জানালা দিয়ে অন্ধকারে কিছু দেখতে পেলো না। কারণ হারিকেনটা নেভানো ছিল। মেয়েটা তবু ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেয়। কারণ এত রাতে তার স্বামী ছাড়া আর কেই বা আসবে!
কিন্তু সেদিন সেই সময় মেয়েটার স্বামী ফিরেছিল না। কিছু খারাপ টাইপের লোক সেদিন ঢুকে পড়েছিল ঘরে। তারা মেয়েটাকে বাসা থেকে বাইরে বের করে...। স্বামী সেই রাতে বাসায় ফিরে স্ত্রীকে আর দেখতে পায়নি। কিন্তু রান্নাঘরে পরিপাটি করে খাবারদাবার গুছিয়ে রাখা ছিল। প্রতিদিন রান্নাবান্না করে সবকিছু যেভাবে গুছিয়ে রেখে দিত, সেদিনও সেরকমই গুছিয়ে রাখা ছিল। পরদিন সকালে বাড়ির বাইরের এক জঙ্গলে গাছের ডালের সাথে মেয়েটার ঝুলন্ত লাশ পাওয়া গিয়েছিল।
এই ঘটনার পর বাসাটায় ম্যালাদিন কেউ ছিল না। ঐ স্কুলমাস্টার এসব কুসংস্কারকে পাত্তা না দিয়ে জোর করেই এখানে থাকতে শুরু করে। পরে সেও তো চলে যেতে বাধ্য হলো!’

জলিল সাহেব থামলেন। আমার ভেতরটা একেবারে বিদ্রোহ করে উঠলো। আমি এসব বুজরুকিতে বিশ্বাস করি না। আর তাছাড়া মেয়েটা আমার বাসায় আর আসবে না, এটা আমি আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। জলিল সাহেবের কথার উত্তরে কিছু না বলেই বাসায় চলে এলাম।
সেদিন মেয়েটা কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার সময় আচমকাই তাকে অবাক করে দিয়ে তার ধাঁধার সঠিক উত্তরটা বলে দিলাম। মেয়েটা কিছু বললো না। মৌনতা দেখে বুঝতে পারলাম আমার উত্তরটা ভুল হয়নি।

পরদিন ঢাকার অফিস থেকে বদলির চিঠি পেলাম। কাজের পারফরম্যান্স খারাপ হওয়াতে আমাকে এখান থেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। যত শিগগির সম্ভব নতুন কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
মন খারাপ করে প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। দেরি করার কোনো উপায়ই নেই। তবু অবচেতন মনে অপেক্ষা করছিলাম হয়ত সে একবার আসবে। অস্থিরতাটা আগের মতই অনুভব করছিলাম। সন্ধ্যা পার হয়ে রাত্রি নেমে এলো। মেয়েটি আর এলো না। আমি পরদিন নতুন কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে ঠাকুরগাঁ ছেড়ে গেলাম।’

শোভন ভাই থামলো। আমি গভীর বিস্ময়ে গল্প শুনছিলাম। শেষ হওয়ার সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু মেয়েটা কে?’
‘উত্তর জানা নেই! সেই মৃতা নারীর জায়গাতে তাকে কিছুতেই কেন যেন বসাতে পারিনি আমি। মনে মনে ভাবতাম, হয়ত এই মেয়েটা অন্যকেউ! তার ফেলে রেখে যাওয়া সুবাসটা অনেকদিন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। পরে আস্তে আস্তে সয়ে এসেছে। একসময় ভুলে গেছি।’
‘উহুঁ ভুলে যাননি!’ আমি বললাম।
‘মানে?’
‘মেয়েটার ধাঁধার উত্তরটা কী ছিল শোভন ভাই? মুক্তা? মুক্তার আরেক নাম তো গওহর, তাই না? আপনি এখনো গওহরকে মনে রেখে দিয়েছেন। তাইতো আমার মেয়ের নাম রেখেছেন গওহর! অন্য কোনো মেয়েকেও হয়ত আর ভালো লাগেনি আপনার। রহস্যময়ীর সেই টানে এখনো একা থেকে গেলেন!’
শোভন ভাই কিছু বললো না। প্রসঙ্গটাকেও ধামাচাপা দিতে উদগ্রীবও হয়ে উঠলো না।

আমি মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম, না জানি সেই সুবাস কতটা তীব্র ছিল...যার মায়াজাল কেটে এক জীবনে আর বেরই হতে পারলো না শোভন ভাই!’

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২১ রাত ১:২১
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×